১.
রাত বাজে দুটো। আজিবরের চোখে ঘুম নেই। এপাশ ওপাশ করছে কিছুক্ষণ পর পর। এবছর ইনক্রিমেন্টবাবদ স্যালারি বেড়েছে সাকল্যে দেড় হাজার টাকা। প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট দেয় মূল বেতনের ওপর। সংসার কি শুধু মূল বেতনে চলে?
বাড়িওয়ালা ফোন করেছিল। সামনের মাস থেকে বাড়ি ভাড়া বাড়ছে। বাজারে সব জিনিসের আগুনে দাম। মাস বেতনের টাকায় চলছে না, সেভিংসে হাত দিতে হয়েছে।
অবস্থা এতটা খারাপ হয়ত হতো না। ঝামেলা শুরু হয়েছে হাউজ লোন নেয়ার পর থেকে। ব্যাংক কর্মকর্তা কী মধুর ভাষায় বুঝিয়ে বলল, স্যার! মাসে মাসে বাড়িভাড়াবাবদ যে টাকাটা দেন জাস্ট ওইটুকু কিস্তি আর ইন্টারেস্ট বাবদ দেবেন। আপনার গায়েই লাগবে না। দশ বছর পর বাড়ি আপনার!
বাড়ি নির্মাণ শুরু হওয়ার পর বোঝা গেল খরচ কত প্রকার ও কী কী!
বাড়ি নির্মাণের পারমিশন, সিটি কর্পোরেশন ট্যাক্স, প্ল্যান পাস, ইউটিলিটি লাইন- লিগ্যাল কাজের জন্যে সরকারী কর্মকর্তাদের ইলিগ্যাল মানি দেয়া লাগল। সরকারী দলের গুণ্ডাপাণ্ডা তো আছেই! কিছু পর পর এসে হাত পাতে। “আংকেল! বোঝেনই তো ছেলেপুলেদের খাইয়ে দাইয়ে শান্ত রাখতে হয়। ওদের এখন কিছু দেন, বাড়ি হইয়া গেলে দেখবেন কেউ আপনেরে ঘাটাইতে আসলে ওরাই আপনারে প্রোটেকশন দিবে!”
দুইদিনের বাচ্চা পোলাপানের দাপট কত! সাত চড়েও রা করত না এরা। এখন মেঝ নেতা, সেজ নেতা, বড় নেতা হয়ে গেছে একেকজন। ইচ্ছা হয় চড়ায়ে দাঁত খুলে দেই! কিন্তু কী আর করা, দেশটা এখন এমুন হইছে…
২.
-সোহেলের বাবা, কই ওঠ!
-কী হইছে, এই সাত সকালে…
-সাত সকাল? বেলা কয়টা বাজে হুঁশ আছে! বাজারে যাইতে হবে না? ফ্রিজে কাঁচা বাজার কিচ্ছু নাই
-সোহেলরে যাইতে কও
-ও তো…
আজিবর চোখ ডলতে ডলতে বিছানায় উঠে বসে। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল টেনে বের করে সময় দেখে। ৯টা বাজে! অফিস থাকলে উঠতে হয় ৭টার আগে। সরকার সাধারণ ছুটি দিয়েছে। এই ৩ দিন সাধ মিটিয়ে ঘুমিয়ে নিচ্ছে।
-‘ও তো’ কী? সকাল সকাল কই গেছে?
-ও রাতে আসে নাই। রাজিবের বাসায় ছিল।
-আন্দোলনে গেছে, না? এত করে কইছি না যাইতে। আমার কথার কোনো গুরুত্ব নাই তোমাদের কাছে?
-আমি আবার কী করলাম!
-তুমিই তো নষ্টের গোড়া! তোমার প্রশ্রয় পায় বইলাই তো…
নাসিরা বেগম মুখ কালো করে ভেতর ঘরে চলে যায়। আজিবর অযথা রাগে গজগজ করতে থাকে। এত আন্দোলন ফান্দোলন না করে বাসায় মন দিয়ে লেখাপড়া করলেই তো পারে। মেধা থাকলে কোটা লাগে?
আজিবর জানে তার এই ভাবনাটা শুধুই মনকে বুঝ দেয়ার জন্যে। সরকারী চাকুরির জন্যে চেষ্টা সেও কম করে নি। ব্রিলিয়ান্ট না হলেও মোটামুটি ভালো স্টুডেন্ট, কোটার এত আধিপত্য না থাকলে বিসিএস লেগে যেত কিনা জানে না। তবে আজীবন তার চেয়ে খারাপ রেজাল্ট করা সহপাঠীদের যখন কোটার জোরে বিসিএস ক্যাডার হতে দেখে তখন তো একটু খারাপ লাগে বৈকি!
কিন্তু আন্দোলন করে লাভ কী? সিস্টেম তো আর বদলাবে না। ছয় বছর আগে দেখা হয়ে গেছে। অযথা এসব করে মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়ে কী লাভ?
৩.
আজ রাস্তায় যানবাহন নেই। আজিবর শূন্য রাস্তায় অবশপ্রায় শরীরটাকে টেনে টেনে চলে। আজ সারাদিন স্যালারিটাকে বহুভাবে ভেঙেচুরে দেখেছে। এতদিনের মাসকাবারি বেতনটাকে টেনেটুনে বাড়ানোর মন্ত্র তার জানা নেই। খরচটাকে নাগালের মধ্যে রাখা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে।
ছাত্র আন্দোলনের একটা মিছিল যাচ্ছিল আজিবরের পাশ দিয়ে। পঞ্চাশোর্ধ মামুলি বেসরকারি কর্মকর্তা যে, কোটা দিয়ে তার কোনো কাজ নেই। আন্দোলনটাকে তার অপাংক্তেয়ই মনে হয়। মনে হয় ছোকরাদের এই বাড়াবাড়ির জন্যেই তার এই দুই সপ্তার ভোগান্তি। আছে কোটা নিয়ে! আর দেশের আঠারো কোটি মানুষ যে গজবের মধ্যে আছে গেল ষোলটা বছর!
আজিবর সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে পড়েছিল। হঠাত সামনের দিকে এগিয়ে চলা মিছিলের মানুষগুলো কিছুটা পিছিয়ে এসে ছোটাছুটি শুরু করল। আজিবর কিছু বুঝে ওটার আগেই পাশে এসে পড়ল একটা সাউন্ড গ্রেনেড। ছুটতে ছুটতে গিয়ে আশ্রয় নিলো একটা নির্মাণাধীন বাড়ির ভেতর। কিছুক্ষণের মধ্যে তার দিকে অস্ত্র তাক করে এগিয়ে আসে কয়েক পুলিশ। তা দেখেও তার ভয় হয় না। সে তো ছাত্র না, আন্দোলনের আগেপিছে নেই। পুলিশ তাকে কী করবে!
জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা আজিবর করে ফেলেছে। আতংকিত চোখে সে দেখে তার দিকে তাক করে থাকা শটগান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি তার দিকে ছুটে আসছে… বুকে বিঁধছে… ফিনকী দিয়ে রক্ত ছুটে বেরুচ্ছে… সে দাঁড়ানো থেকে লুটিয়ে পরছে ধুলায়। তাকে উদ্ধার করতে দৌঁড়ে আসছে অনেকগুলো তরুণ। আশ্চর্য, সবার গলার ওপরটায় তার ছেলের মুখ!
রক্ত ঘাম ক্লান্তিতে চোখজোড়া বুঁজে আসতে আসতে আজিবরের চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা দৃশ্য। তার নিজের তরুণ বয়সের। নব্বইতে সেও জনতার কাতারে নেমে এসেছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ স্লোগানে। পুলিশের ছোঁড়া একটা গুলি এসে বিঁধেছিল তার গায়ে। আজকের এই ময়দানের সাথে সেদিনের ময়দানের কত মিল! শুধু আন্দোলনটা স্বৈরাচার বিরোধী হতে পারল না, সীমিত থাকল কোটার কোটরে…
হায়রে বোকা মানুষ! সাদা চোখে তুমি ওই দাবির মধ্যে শুধু চাকুরির কোটাই দেখলে! এর মধ্যে যে অনিয়ম, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, শোষণ, জুলুম, বৈষম্য আছে তা খুঁজে পেলে না। এই বঙ্গে সবকিছুর দাম বাড়ার ভেতর তোমার যে দাম কমে গেছে তা বুঝলে না।
উন্নয়নের মহাসড়কে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তোমার সস্তা জীবন। ক্ষমতার উচ্চাসনে আসীন যারা, তোমার সস্তা লাশ তাদের বিকার ঘটায় না। মেট্রোরেল দাম দিয়ে পাওয়া, ভাঙা মেট্রোরেল জড়িয়ে ধরে কাঁদার লোক আছে। তোমাকে পেতে কাউকে মূল্য দিতে হয় নি, তাই তোমার জন্যে দু ফোটা জল তাদের চোখে আসে না। তুমি সস্তা, বড়ই সস্তা!
আকাশে বাতাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে সস্তা… সস্তা… সস্তা…! তারই মধ্যে কুকুর শকুন টেনে-ছিঁড়ে-খুবলে খায় আজিবরের সস্তা লাশ। মানুষ দূর থেকে ভাবলেশহীন চেয়ে চেয়ে দেখে সে দৃশ্য। যেন টিভিতে এনিমেল প্ল্যানেট দেখছে। ডিজিটাল মানবতার কাছে এ নিছক ছায়াজগতের নিঠুর বাস্তবতা। শুধু কিছু সংবেদনশীল ‘সচেতন’ মানুষ অবলা জীবের ক্ষুন্নিবৃত্তিদৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করে। ছায়াজগতে ওগুলো পোস্ট হবে, লাখো মানুষ দেখবে, লাইক কমেন্ট শেয়ার করবে।
হায়রে ডিজিটাল দেশ, মানুষের বিবেকটাকেও ডিজিটাল করে ফেলেছ! যেখানে মানুষের সস্তা জীবন শুধুই মূল্যবান লাইক কমেন্ট শেয়ার এনে দেয়, মমতা জাগায় না।
এটাই ডিজিটাল বাংলাদেশ। ‘আসল’ বাংলাদেশ তো ওই যে, ওখানে পরে আছে, রাজপথে মুখ থুবড়ে। সবচেয়ে অবহেলার, সবচেয়ে মূল্যহীন, সবচেয়ে সস্তা...
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
রাত বাজে দুটো। আজিবরের চোখে ঘুম নেই।
২৫ নভেম্বর - ২০২৩
গল্প/কবিতা:
৭ টি
সমন্বিত স্কোর
৪.২৩
বিচারক স্কোরঃ ২.৪৩ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ১.৮ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪