চৈতন্যোদয়

পদত্যাগ (জুলাই ২০২৫)

মাহাবুব হাসান
  • 0
  • 0
১.
তানজিম চৌধুরী গাড়ি চালাচ্ছেন না, যেন গাড়ি নিয়ে উড়ছেন। এখন মধ্যরাত, ভোরের আলো ফোটার আগেই বর্ডার ক্রস করতে হবে। নইলে তার জীবনেই নেমে আসবে অন্ধকার।
গত দেড় যুগ ধরে তানজিম চৌধুরী এতটাই উপরে উঠেছেন যে কল্পনাও করেন নি কোনোদিন প্রাণ বাঁচাতে নিজের গাড়ি নিজেকেই ড্রাইভ করতে হবে। সবকিছুর জন্যে দায়ী মেজর সুলাইমান। শালারে যদি একবার বাগে পাই… তানজিম আক্রোশে ফুসছিলেন বলে সামনে যে একটা অন্যরকম পরিবেশ দেখা যাচ্ছে তা খেয়ালই করেন নি।
আজ ঘোর অমাবস্যা, ঘুটঘুটে আধারে ঢাকা চারিপাশ। তাতে অসুবিধা হচ্ছে না, হেডলাইটের আলোয় সামনের জায়গাগুলো পরিষ্কার ফুটছে। কিন্তু দূরে ওই জায়গাটায় অন্ধকার যেন বরফের মতো জমাট বেঁধে আছে। নিরেট দেয়াল ভেদ করে আলো যেমন ওপাশে যেতে পারে না, এ জায়গাটাও তেমনই। তানজিম হতবিহ্বল হয়ে ব্রেক কষল।
না, সামনে কালো দেয়াল বা অন্য কোনো প্রতিবন্ধকতার অস্তিত্ব নেই। তবু আলো এই অংশটা ভেদ করে যেতে পারছে না। যেন একটা ব্ল্যাকহোল হেডলাইটের সবটুকু আলো শুষে নিচ্ছে। তানজিম খুব অস্থির বোধ করছেন। আলো ফোটার বেশি বাকি নেই। ইতিমধ্যে পেছনে ফেউ লেগেছে কিনা কে জানে! আবার সামনে জায়গাটা গাড়ি হাকিয়ে যাওয়ার সাহসও পাচ্ছে না।
তানজিম গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করল। এ যেন এক অন্ধকারের টানেল, যার কোনো শেষ নেই। তানজিম একটা ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে সামনের দিকে ছুঁড়ে দিলো। ঢিলটা কিছুতে লেগে ফিরে এলো না, আবার সামনে রাস্তার ওপর আছড়ে পড়ার আওয়াজও নেই। কোথায় গেল জ্বলজ্যান্ত ঢিলটা?
ভূতুড়ে ব্যাপার!তানজিমের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। আচমকা সে আবছা শুনতে পেল পেছন থেকে আসা বেশ কিছু গাড়ির সাই সাই শব্দ। নিশ্চয়ই ওরা পিছু নিয়েছে! একবার ওকে ধরতে পারলে স্ট্রেইট বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে তুলে দেবে। জনতার রোষ এখন যে পর্যায়ে, তাতে তানজিম যতগুলো লাশ পেছনে ফেলে এসেছে তারচেয়ে বেশি টুকরো করবে তাকে। আর ভাবার সময় নেই, তানজিম গাড়িতে উঠেই ড্রাইভ শুরু করল।
কোনো কিছুতে গাড়ি ঠোকে নি, তানজিম আশ্বস্ত হয়ে আরেকটু এগোতেই অপার্থিব একটা অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। কেমন একটা অতিপ্রাকৃত আওয়াজ! একশ কিলোমিটার না, গাড়ির গতিবেগ এখন যেন ঘণ্টায় লক্ষ, কোটি মাইল! তানজিমের মনে হলো সে সামনে যাচ্ছে না, গাড়িসমেত নিচের দিকে পড়ছে। ওর চোখের আলো আপনাতেই নিভে এলো।

২.
কতক্ষণ কাটল- কয়েক মিনিট, কয়েক ঘণ্টা, নাকি কয়েক দিন? তানজিম জানে না। আস্তে আস্তে তার মাথার ঝিম ঝিম ভাবটা কেটে গেল। ফুটে উঠল সামনের দৃশ্যপট। তানজিম আঁতকে উঠল। বাইরে ঝলমল করছে দিনের আলো। তার মানে সে কয়েক ঘণ্টা অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল! তাহলে পেছনে যারা আসছিল ওরা কারা? কুচক্রীদের কেউ না নিশ্চিত। না হোক, চটজলদি বর্ডারের দিকে যেতে হবে।
গাড়ি স্টার্ট দিতে যেতেই তানজিমের সামনের দৃশ্যপটের দিকে খেয়াল হলো। কোন জায়গা এটা? তার তো এখন খুলনা ক্রস করার কথা। গন্তব্য বেনাপোল। কিন্তু রাস্তাটা তো খুলনার মনে হচ্ছে না!
রাস্তার সাইনবোর্ডগুলোয় চোখ পড়তেই তানজিম হাজার ওয়াটের বৈদ্যুতিক শক খেলো- পাশের দোকান, তার পাশের দোকান, তারও পাশের দোকান… প্রতিটা দোকানের সাইনবোর্ড বলছে জায়গাটা ঢাকার শুক্রাবাদ! এসবের মানে কী?
তানজিম গাড়িটা পার্ক করে বোঝার চেষ্টা করল কী হচ্ছে তার সাথে। কিন্তু যতই ভাবছে ততই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ টিন্টেড গ্লাসের ভেতর থেকে তার চোখ পড়ল, গাড়িটা যেখানে পার্ক করেছে তার ঠিক পাশেই ফুটপাত ঘেঁষে একটা ইলেক্ট্রনিক সামগ্রির দোকানে। ওয়াশিং মেশিন, ফ্রিজ, টিভি… টিভিতে সকালের সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে।
“… বিক্ষোভরত জনতা ৭ দফা দাবি পালটে এক দফায় নেমে এসেছে; এখন তারা শুধু চায় সরকারের পদত্যাগ…”
তানজিম আবারো ঝটকা খেলো- এই নিউজ তো তিন সপ্তাহ পুরনো!
ধলেশ্বরী নদীতে অবৈধ দখলের প্রতিবাদে একদল পরিবেশবাদী সচেতন মানুষ আন্দোলন শুরু করেছিল। দখলদাররা সরকারের মদদপুষ্ট। তাই সরকার কোনো রা করছিল না। আন্দোলনের সাথে সাধারণ জনতার একাত্মতা বাড়তে থাকলে দখলদারদের টনক নড়ে। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা চারজনকে খুন করে ভেবেছিল আন্দোলনকে দমিয়ে দেবে। ফল হয়েছে উলটো; সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী নারী শিশু বয়োবৃদ্ধ দলে দলে মানুষ আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে।
আন্দোলনে নির্বিচারে লাঠিচার্জের আদেশ দিয়ে তানজিম দ্বিতীয় ভুলটা করে; সাধারণ মানুষ বুঝে যায় সরকার আসলে দখলদারদের পক্ষে কাজ করছে। দখলদারদের উচ্ছেদ, অবিলম্বে খুনীদের গ্রেপ্তার, হতাহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান… পাঁচ দিন ধরে চলা ৭ দফা আন্দোলন রূপ নেয় একদফায়- সরকারের পদত্যাগ!
কিন্তু এসব তো তিন সপ্তাহ আগেই ঘটে গেছে! তানজিম গাড়ি ভিড়িয়ে ভিড়িয়ে অনেকগুলো শো-রুমের টিভি নিউজ দেখল, সবখানেই একই কথা। শেষতক ফোন ক্যালেন্ডারের তারিখ দেখে নিশ্চিত হলো সে এখন তিন সপ্তাহ আগের দিনটায় আছে। কিন্তু কীভাবে?
অনেককাল আগে সায়েন্স জার্নালে পড়া একটা আর্টিকেলের কথা মনে পড়ল তানজিমের- ওয়ার্মহোল, যেখানে কেউ প্রবেশ করলে ভিন্ন টাইমলাইনে চলে যায়। হতে পারে সেই অন্ধকার জায়গাটা একটা ওয়ার্মহোলই ছিল! যা তাকে টাইম মেশিনের মতো ফিরিয়ে এনেছে অতীতে।
ওটা ওয়ার্মহোল হোক বা না হোক, অতীতের ভুল সংশোধনের চমৎকার সুযোগটা পেয়ে তানজিম উৎফুল্ল হয়ে উঠল। এই সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না। ভাবতে না ভাবতেই স্মার্টফোনের ক্যালেন্ডারে একটা নোটিফিকেশন ভেসে উঠল- আন্দোলনের উদ্ভুত পরিস্থিতি বিবেচনায় করণীয় ঠিক করতে সকাল ১১টায় জরুরি বৈঠকের আহ্বান করেছেন তিনি। তানজিম গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা পিএম অফিসের দিকে ধেয়ে চলল। মিটিং শুরু হতে মোটে পনের মিনিট বাকি!

৩.
তানজিম চৌধুরীর কথা শুনে ক্যাবিনেটের সবাই হাঁ হয়ে গেল- প্রধানমন্ত্রী এটা কী বলছেন? আন্দোলনরত জনতার দাবি মেনে সরকার পদত্যাগ করবে! দেড় যুগের অবাধ শাসনে যিনি আছে, গত দুই সপ্তাহ যাবত চলা আন্দোলনের মুখে যিনি অনমনীয়, তিনি হুট করে বলছেন পদত্যাগের কথা!
তানজিম নিজের সিদ্ধান্তে অটল। তাকে বোঝাতে ক্যাবিনেটের সবাই ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিলো। সরকার এক দফা দাবি না মানলে আগামীকাল থেকে আন্দোলনকারীরা কঠোর অবস্থানে যাওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছিল। তার আগের রাতেই নিউজ চ্যানেলগুলো সরব হয়ে উঠল একমাত্র নিউজে- আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করেছে প্রধানমন্ত্রী তানজিম চৌধুরীর সরকার!
তানজিমের এই ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্তের কোনো কারণই তার দলের মানুষজন খুঁজে পাচ্ছে না। পাঁচ দিন আগেও তো তিনি ক্যাবিনেট মিটিংয়ে আন্দোলনকে পাত্তা না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন! আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠার ইঙ্গিত পাওয়ার পর সামরিক-বেসমারিক বাহিনীর প্রধানদের সাথে মিটিংয়ে তাদের তরফ থেকে সর্বাত্মক মোকাবেলার আশ্বাসও পাওয়া গেছিল। তারপরও সতের বছরের শাসনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত অনমনীয় গদির সুপার গ্লু থেকে তানজিমের পেছন ছোটার কারণ কী?
আত্ম-অহমিকায় ভুগে ছাড় না দেয়ার মানসিকতা, দমন-পীড়ন আর তারপর মানুষের সমর্থন হারানো, হাজার হাজার লাশ ফেলা, আর্মি চিফের ‘প্রতারণামূলক’ ক্যু, প্রাণনাশের সম্ভাবনা, বাধ্যতামূলক দেশত্যাগ… তিন সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ তো তানজিমের জানাই আছে! এই পদত্যাগটা তার প্রাণই শুধু বাঁচাবে না, তার ক্ষীয়মাণ ইমেজকেও সমুন্নত করবে। এদেশে তো ‘ছোটখাট’ ব্যাপারে সরকারের পদত্যাগের কোনো দৃষ্টান্ত নেই। তাই দেড়যুগের একচেটিয়া শাসন আর ন্যায্য আন্দোলনে বলপ্রয়োগের ফলে হারানো জনসমর্থন আবার ফিরিয়ে আনবে পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত।
কে জানে, হয়ত ‘গোল্ড ফিশ মেমরি’ওয়ালা জনতা দেড় যুগের অপশাসন ভুলে সামনের ইলেকশনে তাকেই আবার ক্ষমতার আসনে বসাবে!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

তানজিম চৌধুরী গাড়ি চালাচ্ছেন না, যেন গাড়ি নিয়ে উড়ছেন।

৩০ সেপ্টেম্বর - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ৩৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“ ” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ , থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী