লয়

ঘূর্ণিঝড় (জুলাই ২০২৪)

মাহাবুব হাসান
মোট ভোট ২৩ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.৩৫
  • ১২
  • ১৬১
(১)
তীব্রবেগে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় রেহান। উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোকে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানো হয়েছে। রহমত জেলের মনে বয়ে চলেছে আরেক ঝড়। কোনো নম্বর দিয়ে এর তীব্রতা বোঝানো যাবে না।
ঝড়ের সতর্কবার্তা পেয়ে ফিশিং বোটগুলো উপকূলে ফিরতে শুরু করেছে। রহমতের ফিরতে ইচ্ছে করছে না। ডাঙায় ফিরে করবে কী? পায়ের নিচের জমিনই তো নড়বড়ে হয়ে গেছে! সেখানে এখন শুধুই চোরাবালি। যতবার উঠবার কসরৎ করে ততবারই তলিয়ে যায় আরো গভীরে। মন চায় সাগরের জলে মিশে যেতে। ওতেই যেন নির্বাণ।
রহমতের পনের বছরের কিশোর ছেলেটা নৌকায়। ওর মায়াভরা চেহারার দিকে তাকিয়ে ফিরতে হচ্ছে।
অনেক ইচ্ছা ছিল ছেলেটাকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার। রহমতের যদি লেখাপড়া জানা থাকত তাহলে তিরিশ হাজার টাকার নামে তিন লাখ টাকার ঋণের দলিলে সই করত না, ঋণের জালেও জর্জরিত হতো না। পড়ালেখা বাদ দিয়ে ছেলেকে নামতে হতো না সাগরে।
বাপের মতো ছেলেটাকেও কি গণ্ডমূর্খ হতে হবে? এটাই কি নিয়তি?

(২)
বাহির দুয়ারে পায়ের আওয়াজ পেয়ে আমেনা বেগম ছুটে এলো। এতক্ষণ অধীর আগ্রহে স্বামীর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় ছিল বোঝা যায়। কাল রাতে জামাইবাড়ি থেকে ফোন এসেছে। রহমতের পোয়াতি মেয়েটার কি জানি সমস্যা হয়েছে। দ্রুত অপারেশন করতে হবে। নইলে মা, সন্তান কিংবা দুজনারই প্রাণনাশের আশঙ্কা আছে। ডাক্তার বলে দিয়েছে। জামাইয়ের আয়-উপার্জন বন্ধ এক মাস ধরে, অত টাকা পাবে কোথায়?
স্বামী বাড়ি নেই, আমেনার পানিতে পড়ার জোগাড়। জামাইকে বলেছে যে করেই হোক মেয়েকে যেন হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরেরটা পরে দেখা যাবে। কিন্তু পরে আমেনা আসলে করবেটা কী?
মেয়েজামাই শাশুড়ির কথামত স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। প্রসূতিকে লেবার রুমে ফেলে রাখা হয়েছে। টাকা জমা না করা পর্যন্ত ওটিতে নেবে না।
স্ত্রীর কথা শুনে রহমতের মুখটা শুকিয়ে গেল। এবার মাছ একেবারেই ধরা পড়ে নি। ঝড়ের কারণে ফিরতে হয়েছেও তাড়াতাড়ি। হাতের পাঁচ বলতে নেই তেমন কিছুই। অত টাকা এখন পাবে কোথায়?
আমেনা বেগম ট্রাঙ্ক থেকে টাকার পুঁটলিটা বের করে দিলো। বাড়ি বন্ধকের টাকা। রহমত টাকাটা খরচ করতে নারাজ। আজ বাদে কাল ওর অপারেশন। কিডনিতে পাথর জমেছে, অপারেশন না করলে জীবন সঙ্কট।
“আফনের দুহাই লাগে টাহাডা নেন। অফারিশন না কইরলে মাইয়াড্যা মইরা যাইব!”
“টাহাডা লইলে তুমার অপরেশন ক্যামনে হইব? অপরেশন না কইরলে তুমিও বাঁইচবা না আলমের মা!”
“কসম আল্লার! আমার মাইয়ার কিছু হইলে আমি মইরা যামু”
আমেনা ডুকরে কেঁদে ওঠে। রহমত পড়েছে গভীর জলে। একদিকে কলিজার টুকরা মেয়ে, আরেক দিকে প্রাণপ্রিয় স্ত্রী- কাকে বাঁচাবে? দেরি করার সময় নেই। স্ত্রীর জোরের কাছে হেরে গেল জীবনযুদ্ধে হারতে বসা মানুষটা। টাকা নিয়ে দ্রুত পা বাড়ালো গঞ্জের দিকে। মেয়ে জামাইকে টাকা হুন্ডি করে উঠে বসল বাসে।
রহমত যখন মাঝ রাস্তায় তখন জামাইয়ের ফোন- ওটিতে নেয়ার আগেই মেয়েটা মারা গেছে।

(৩)
“বাজান, আমারে একখান চিঠি লিইখ্যা দিবা?”
রহমত আলী বাড়ির পথ ধরেছে। মেয়ের মরা মুখ দেখার মতো কলিজার জোর তার নেই। হাতের সব টাকা শেষ, দুদিন পর বিনা চিকিৎসায় স্ত্রীও মারা যাবে। এটাই বা সে চোখ পেতে দেখবে কীভাবে? স্ত্রীকে কীভাবে দেবে মেয়ের মৃত্যুসংবাদ?
মেয়েজামাইয়ের সাথে কথা শেষ হয়েছে তাও অনেকক্ষণ। হতবিহ্বল রহমত বাসের সিট ধরে ঠায় বসে আছে। পাথর যেন। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ল। আঁধারে আলোর দিশা! সব সমস্যার একক সমাধান! রহমত বাস থামিয়ে নেমে পড়ল মাঝপথে।
বাড়ির কাছেই স্কুল। আলম এই স্কুলেই পড়ত। ঝড়ো আবহাওয়ার কারণে আজ সকাল সকাল স্কুল ছুটি হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা দলবেঁধে ক্লাস থেকে বেরুচ্ছে। স্কুল ইউনিফর্মে ওদের কী সুন্দর লাগছে! রহমতের চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। ওর ছেলেটাও কি এভাবে হেসেখেলে স্কুল থেকে ফিরতে পারত না?
সোহেলের ডাকে রহমত সংবিৎ ফিরে পেল। আলমের সহপাঠি। আলম কেন এখন আর স্কুলে আসে না? রহমত বুঝে ওঠে না ছেলেটাকে কী জবাব দেবে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকের গভীর থেকে। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে; সোহেলকে বাড়ি ফিরতে হবে। রহমত ওকে দিয়ে একটা চিঠি লিখিয়ে নিল।

(৪)
স্বামী কখন ঘরে এসে আবার বেরিয়েও গেছে রহমতের অসুস্থ স্ত্রী তা টেরও পায় নি। আলম গঞ্জে গেছিল সদাই কিনতে। ফিরে এসে দেখে ওর পড়ার টেবিলে একটা চিঠি। মুক্তার মতো সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। আলম হাতের লেখাটা চিনতে পারল। সোহেলের। ক্লাসে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড।
আব্বা ওর স্কুলে গেছিল কেন? ওনার না চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা!
আলম,
বাজান, ফাইলটা নিয়া তোমার গফুর চাচার কাছে যাইও। উনি সব ব্যবস্থা কইরা দিবো। টাহাডা দিয়া তুমার আম্মার চিকিসসা করাইও। তুমি আবার লিখাপড়া শুরু কইরো। মন দিয়া পড়বা। অনেক বড় হইবা। তুমার আম্মারে দেইখা রাইবা। আমার জন্যি চিন্তা কইরবা না।
ইতি
তুমার আব্বা
চিঠির নিচে একটা প্লাস্টিকের ফাইল। আলম চিঠি পড়া শেষে ফাইলের ভেতরকার কাগজপত্র বের করল। জীবন বিমার কাগজ। প্রতিবেশী গফুর চাচা বিমা কোম্পানিতে কাজ করে। রহমত সাগরে মাছ ধরে বেড়ায়; কত রকম বিপদাপদ হতে পারে! ওর কিছু হলে যেন পরিবারটা সাগরে না পড়ে- গফুর এক প্রকার জোর করেই রহমতকে জীবন বিমা করে দিয়েছিল।
নানাবিধ সমস্যার সাগরে হাবুডুব খেতে খেতে রহমত শেষমেশ জীবন বিমা পলিসিটাকেই খড়কুটার মতো আঁকড়ে ধরল।
আলম জানে বিমা কোম্পানি কখন একজনের জীবন বিমার অর্থ পরিশোধ করে। তড়িৎ টেবিলের ড্রয়ার খুলে বুঝল তার অনুমানই সঠিক। বোটের চাবিটা নেই!
চিঠি ফেলে দৌঁড়ে গেল রঞ্জুদের বাড়ি। রঞ্জুর বাইকের পেছনে চেপে ছুটল সৈকতের দিকে। কিন্তু বাতাসের তাণ্ডবে বেশিদূর যেতে পারল না। ঘূর্ণিঝড় তার স্বভাবসুলভ ধ্বংসলীলা চালিয়ে ক্রমশ এগিয়ে আসছে জনপদের দিকে।

(৫)
রহমত আলী ফিশিং বোটে দাঁতে দাঁত চেপে অনড় বসে আছে। বোটের স্টিয়ারিং হুইল শক্ত হাতে চেপে ধরা। ঘূর্ণিঝড় রেহান সৈকতের দিকে ধেয়ে আসছে। দেড় বছর আগে ওর নিজের বোটটা কেড়ে নিয়েছে যে ঘূর্ণিঝড়, তাকে করেছে ঋণজর্জরিত, তার ভেতরটা সে একবার দেখে আসতে চায়।
উথালপাথাল ঢেউয়ে টালমাটাল ফিশিং বোটটা তুমুল গতিতে ছুটে চলেছে ঝড়ের উৎসমূলের দিকে…
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Jamal Uddin Ahmed অভিনন্দন।
Jamal Uddin Ahmed হৃদয়ছোয়া গল্প। অল্পকথায় অনেক কান্না। অনেক শুভেচ্ছা।
ভালো লাগেনি ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
অনুপ্রাণিত হলাম। ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ফয়জুল মহী চমৎকার উপস্থাপন করেছেন প্রিয়
মোঃ মাইদুল সরকার সুন্দর গল্প লিখেছেন।
ধন্যবাদ মাইদুল ভাই
Sunil Akash মন খারাপ করা গল্প! ট্যুইস্টগুলো জোশ ছিল।
মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

তীব্রবেগে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় রেহান

৩০ সেপ্টেম্বর - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ২৩ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.৩৫

বিচারক স্কোরঃ ২.৫৯ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৭৬ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪