মার্চ ২৫, ১৯৭১
গাইবান্ধার একটি নিভৃত গ্রাম কাশদহ…
গভীর রাত। জয়নবের প্রসববেদনা উঠেছে। আওয়াজ পেয়ে বড় জা সখিনা বিবি একটু আগেই ঘুম থেকে উঠে এসেছেন। লক্ষণ ভালো! তাগাদা পেয়ে রজব আলী তড়িঘড়ি করে ময়নার মার বাড়ির দিকে গেল। ধাই হিসেবে ওনার সুনাম আছে। মহিলার হাত পাকা।
নতুন অতিথি আসতে বড্ড দেরি করে ফেলেছে! এই বয়সে জয়নব মা হবে, সমস্যা হবে না তো? চিন্তা সবার চোখেমুখে। কিন্তু সবার দুশ্চিন্তা দূর করে সুবহে সাদিকের আগেই সন্তান আলোর মুখ দেখল। রজবের বুকে জমা হওয়া দুশ্চিন্তার পাথরটা নেমে গেল যেন। ফুটফুটে মেয়েকে কোলে তুলে নিতে নিতে নাম ঠিক করে ফেলল- মুক্তা!
প্রত্যন্ত গ্রামের এই পরিবারটা জানে না নবজাতকের ধরায় আগমনের আনন্দে তারা যখন উদ্বেল, পূর্ব পাকিস্তানের বুকে ততক্ষণে উপ্ত হয়ে গেছে নতুন এক স্বাধীন দেশের জন্মবীজ।
একই দিন ঢাকার উত্তরা…
-বাবা! ও বাবা! তুমি কই যাও?
-রেডিওতে যাই মা, গান আছে
-আমিও যাব…
-তুমি গিয়ে কী করবা, মা?
-আমি গান গাব…
-তুমি তো এখনো ছোট, মা। এখন গেলে ওরা তোমার গান বাজাবে না। আরেকটু বড় হও, তারপর…
-না আমি যাব…
বলেই পিচ্চিটা ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। সিদ্দিকুর রহমান পড়লেন মহাপেরেশানিতে। মেয়ের যা জেদ! যাবে বলেছে, না নিলে কেঁদেকেটে পাড়া মাথায় তুলবে। ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজ রেডিও পাকিস্তানে তার গানের রেকর্ডিং। প্রতি সপ্তাহে দেশাত্মবোধক গানের জন্যে তার ডাক পড়ে।
-মুক্তির মা, দেখো তো তোমার মেয়ে আমায় ছাড়ছে না!
-কী হয়েছে?
-আমার সাথে যাবে, জেদ ধরেছে...
-আহা, নিয়েই যাও না! এত করে বলছে…
-কিন্তু ওকে একা বসিয়ে রেখে টেক দেব কীভাবে? কান্নাকাটি করে যদি
-কাঁদবে না! দেখো না তুমি যখন রেওয়াজ করো ও কেমন চুপ করে শোনে
-আহা! পথঘাটের অবস্থাও তো বুঝতে হবে। যা দিনকাল পড়েছে...
-কিচ্ছু হবে না! যাও তো, ওকে নিয়ে যাও। আয় তো মা চুলে ঝুঁটি করে দেই
-যেমন মেয়ে তেমন মা! যাও, ওকে তাড়াতাড়ি রেডি করে আনো, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে
গান রেকর্ড করে স্টুডিও থেকে বেরোতে বেরোতে বেশ রাত হলো। ওরা যখন মাঝ রাস্তায় তখন হঠাতই গোলাগুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠল চারপাশ। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে দূর দূরান্তে পৌঁছে গেল বার্তা- পালাতে হবে! সিদ্দিকুর রহমান ঘুমন্ত মেয়েকে বুকে চেপে ছুটতে ছুটতে বাড়ি পৌঁছলেন। ততক্ষণে এদিকেও পৌঁছে গেছে হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের খবর।
কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দিল আমিনা বেগম। এতক্ষণ দুজনকে নিয়ে উদ্বেগে পায়চারী করছিলেন ঘরময়। এক উদ্বেগ কাটতেই শুরু হলো আরেক উদ্বেগ। কী হবে এখন?
সিদ্দিকুর রহমান ঘরে ঢুকেই স্ত্রীকে বললেন দ্রুত দরকারি জিনিসগুলো গুছিয়ে নিতে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ঘর ছাড়ল ওরা। মোটরকার ওদের নিয়ে যেন উড়াল দিল রাজধানী ছেড়ে বহু বহুদূরে গ্রামের বাড়ির পথে…
ডিসেম্বর, ২০২১
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ঢাকার এক সকাল…
-মা যাই...
-খাবি না?
-না মা, আজ একটু সকাল সকাল যেতে হবে
-আজ কী করবি তোরা?
-আজ আমরা লাল কার্ড প্রদর্শন করব মা। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লাল কার্ড…
-বাহ, তাই নাকি! বেশ তো…
-আচ্ছা, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে মা। আমি গেলাম
-ঠিক আছে, যা। বাইরে কিছু খেয়ে নিস
বিজয় প্রায় ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেল। ড্রয়িংরুমে মুক্তি বেগমের সাথে পাশের বাসার গৃহকর্ত্রীও ছিল। বিলকিস সুলতানা।
-কী ব্যাপার ভাবী, বিজয় ইউনিফর্ম পড়ে কই যায়? স্কুল কলেজ না বন্ধ…?
-(একটু হেসে) যে কারণে স্কুল কলেজ বন্ধ সে কারণেই তো যাচ্ছে!
-মানে? বুঝলাম না
-স্টুডেন্টরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছে, জানেন না?
-হ্যাঁ জানি তো! টিভিতে দেখেছি…
-বিজয় ওই আন্দোলনেই গেল
-বলেন কি ভাবী! ওকে আন্দোলনে যেতে দিলেন? কতরকম বিপদআপদ হতে পারে
-যেতে দেবো কী? বিজয়ই তো ওই আন্দোলনে লিড দিচ্ছে!
বিলকিসের মুখে কথা সরে না। কী বলে এই মহিলা!
-যেখানে আমরা বাচ্চাদের ঘরের বাইরে বেরোতে দিচ্ছি না সেখানে ওইটুকু ছেলেকে আন্দোলনে যেতে দিলেন? আপনার তো অনেক সাহস!
মুক্তি বেগম মুচকি হাসে। বিলকিস ভুল কিছু বলে নি। আসলেই ওর অনেক সাহস। এই সাহসের উৎস তিনি জেনেছেন দুই যুগ আগে।
…………
সাল ১৯৯১
দেশে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলমান। সাংবাদিকতা এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ পেশা, দেশের ক্রান্তিকালে সেটা হয়ে পড়েছে আরো ঝুঁকিপূর্ণ। এমন একটা সময়ে নির্ভীক সাংবাদিকতায় অগ্রগামী হবে একজন নারী- এ তো অভাবনীয়! সেই অভাবনীয় কাজটিই নিয়মিত করে চলেছে মুক্তি। তার জয়গান সাংবাদিক অঙ্গনে। এ বছর সবচেয়ে সাহসী সাংবাদিকের এওয়ার্ড পাচ্ছে সে।
দেশজুড়ে যখন মুক্তির জয়গান, ঘরে তখন ভিন্ন চিত্র। মেয়েকে নিয়ে সারাক্ষণ ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে বাবা সিদ্দিকুর রহমান। মেয়ে বাবাকে অভয় দেয়। কখনো কখনো বিরক্তও হয়।
-বাবা, তুমি এত ভয় পাও কেন বল তো? তুমি না মুক্তিযোদ্ধা…!
-এই জন্যেই তো ভয়! যুদ্ধে অনেক কিছু হারিয়েছি রে মা, তোকে হারাতে চাই না
-এই কথা যদি সেদিন মাও বলত- তোমাকে হারাতে চাই না! যদি তোমাকে যুদ্ধে যেতে বাধা দিত… তাহলে কি তুমি নিষেধ শুনে ঘরে বসে থাকতে, বলো?
-মা রে, কিসের সাথে কী মেলাস! ওটা তো দেশরক্ষার দায়িত্ব ছিল
-দেশরক্ষার দায়িত্ব কি শেষ হয়েছে? হয় নি! এই দায়িত্বের আমিও একটা অংশ। তোমাদের অস্ত্র ছিল মেশিনগান, আর আমার কলম।
-তোর অনেক সাহস মা… কোত্থেকে পাস এত সাহস?
-বা রে, আমি মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে না! জানো, আমার কলিগরাও এই কথা বলে… তোমার এত সাহস, কিন্তু তোমাকে নিয়ে তোমার বাবা এত ভীতসন্ত্রস্ত কেন থাকে? তোমাকে নিয়ে তো তার গর্ব হওয়ার কথা…
সিদ্দিকুর রহমান চুপ মেরে গেলেন। তার চেহারায় দেখা দিল এক অদ্ভুত আঁধার। মুক্তির চোখ এড়ায় না তা।
বহুবার এভাবে বাবাকে চুপ করে যেতে দেখেছে সে। বাবার এই নিস্তব্ধতা এক জোরালো আওয়াজে জানান দেয়- রহস্য আছে! দিনের পর দিন কোনো এক রহস্যকে তিনি আগলে রেখেছেন সযত্নে। কী সেই রহস্য? মুক্তি কি কখনো তা জানতে পারবে?
বছর ছয়েক পর…
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছেন সিদ্দিকুর রহমান। লাং ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ। ডাক্তারের বেঁধে দেয়া সময় বাধ্যগত ছাত্রের মতো মেনে মৃত্যুশয্যায় স্থান নিয়েছেন বরাবরই অবহেলিত এই মুক্তিযোদ্ধা। রাষ্ট্র তার খোঁজ রাখে নি, তিনিও কখনো অধিকারবলে কিছু চাইতে যান নি কারো কাছে। একাকী সময়টুকুতে সার্বক্ষণিক সঙ্গী একমাত্র মেয়ে মুক্তি। পেশা থেকে দীর্ঘ ছুটি নিয়ে বাবার পাশে থাকে পুরোটা সময়।
অনেক দায়িত্ব মেয়েটার। নিজের একটা আস্ত সংসার আছে। ব্যস্ত একটা পেশা আছে। তার ওপর বর্তেছে মৃত্যুপথযাত্রী বাবাকে দেখভালের দায়িত্ব। মেয়েকে এই গুরুদায়িত্ব থেকে মুক্তি দেবার আনন্দ সিদ্দিকের রোগযন্ত্রণায় একটু হলেও উপশম দিয়েছে।
বাবার একটা স্টিলের ট্রাঙ্ক আছে। ওটা নিয়ে মেয়ে কখনো অযাচিত কৌতূহল দেখায় নি। চাবিটা বাবার কাছেই থাকে সবসময়। সেটা তিনি আজ মেয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন। মুখ ফুটে অনেক কিছুই বলতে চেয়েছেন, কিন্তু সবটা বোঝা যায় নি। আবছা বোঝা গেছে কোনো একটা ডায়েরির কথা বলছেন।
মেয়েকে দায়মুক্ত করে বাবা চলে গেলেন অস্তমিত সূর্যের মতো। তাকে ভারমুক্ত করতেই বুঝি জীবনের শেষটায় সুন্দর করে গুছিয়ে ডায়েরির পাতাগুলো গোটা গোটা অক্ষরে ভরিয়ে তুলেছিলেন তিনি। সেই অক্ষরগুলো মুক্তিকে নিয়ে গেল একাত্তরের এক রাত্তিরে।
এপ্রিল ২৯, ১৯৭১
গাইবান্ধার নিভৃত গ্রাম কাশদহ
বঙ্গবন্ধুর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বানে দলে দলে ঘরছাড়াদের কাতারে শামিল হলো রজব আলীও। ছোট্ট মেয়েটার কপালে চুমু দিয়ে স্ত্রী পরিজনকে বিদায় জানিয়ে রাতের আঁধারে ঘর ছাড়ল সে। দরজায় শিকল তুলে দিয়ে বাধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল এতক্ষণ শক্ত থাকার অভিনয় করা স্ত্রী জয়নব।
ডায়েরির লেখাগুলো পড়তে পড়তে মুক্তি বিস্মিত বিমুগ্ধ হলো। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠক আর কেউ না, তার বাবা!
রজব আর সিদ্দিক পাশাপাশি বাড়ির প্রতিবেশী, ছোটবেলার খেলার সাথী। মুক্তিযুদ্ধেও সাথী হলো দুজন। কিন্তু এর অল্প কিছুকাল পরই ভিন্ন এক বন্ধন যে ওদের একসাথে করে দেবে সারাজীবনের জন্যে তা কি ওরা তখন জানত?
যুদ্ধজয়ের পর নতুন যুদ্ধ…
যুদ্ধ শেষ। গ্রামের পর গ্রাম জনমানবশূন্য। কেউ শত্রুর হাতে নিহত হয়েছে, কেউ উদ্বাস্তু হয়ে স্থান নিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। যুদ্ধাহত হাতটা নিয়ে সিদ্দিক পাগলের মতো স্ত্রী-সন্তানদের খুঁজে বেড়ায়। দেশে সন্ধান না পেয়ে পাড়ি জমায় বর্ডারের ওপার।
এক কোটি শরণার্থীর মধ্যে দুজনকে খোঁজার চেয়ে খড়গাঁদায় সুঁই খোঁজা অনেক সহজ। শিবিরের পর শিবির ঘেঁটে অবশেষে সন্ধান মেলে প্রতিবেশী ক’জনার- জয়নাল, সুনীল মাস্টার, রাজিব ভাই, ভাতিজা সৌরভ, জয়নব ভাবী….
কিছু দুঃসংবাদ দেয়ার ছিল, কিছু দুঃসংবাদ পাওয়ার ছিল সিদ্দিকের।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় পাওয়া যায় কেবল সম্মুখ সমরের বীর যোদ্ধাদের নাম। কখনো জানা যাবে না আমিনা বেগমের মতো ত্যাগী মহীয়সী নারীদের, যারা জীবন বাঁচানোর পর্যাপ্ত সুযোগ পাওয়ার পরও শুধুমাত্র দেশের প্রতি দায়িত্ববোধের তাগিদে জীবনকে বিপন্ন করতে পিছপা হয় নি।
স্বামী সিদ্দিককে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছিল যুদ্ধে যাবার বেলায়, অথচ নিজের বিদায়বেলায় দেখা হলো না প্রিয় স্বামীর মুখখানা!
সুন্দরগঞ্জের দিকে শত্রুর গানবোট আসছে; খবর পেয়ে সবাই পালাচ্ছিল বর্ডারের ওপারে। সন্ধ্যা তখন নামে নামে। সবাই গেল, থেকে গেল শুধু আমিনা বেগম কোলের বাচ্চাটাকে নিয়ে। বাড়ির পেছনে খড়ের গাঁদার ভেতর মুক্তিবাহিনীর গোলাবারুদের একটা মজুদ লুকিয়ে রাখা আছে, আজ রাতেই নিতে আসবে। ওরা যদি এসে খুঁজে না পায়! আমিনা বেগম সকলের নিষেধ সত্ত্বেও থেকে যায়।
ভাগ্যের পরিহাস, মুক্তিবাহিনী আসার আগেই এসে পড়ল হানাদারবাহিনী! আমিনা বেগম খাটের নিচে লুকিয়ে প্রায় বেঁচেই গেছিল। ধরা পড়ে গেল মুক্তির কান্নার আওয়াজে। তারপর… সব শেষ! মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা এসে পেল ওদের নিথর দেহ…
ডায়েরির এই অংশে এসে মুক্তি প্রায় লাফ দিয়ে উঠল। হাত থেকে পড়ে গেল ডায়েরিটা। সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে।
মায়ের সাথে মুক্তিও মারা গেছে! মানে কী? কী লিখেছে এটা বাবা! বাবা এটা লিখেছে কী? মুক্তির অস্তিত্ব ধরে যেন টান দিল ডায়েরির অক্ষরগুলো।
দীর্ঘসময় পর একটু ধাতস্থ হয়ে মেঝে থেকে ডায়েরিটা যখন তুলতে গেল, ভেতর থেকে টুপ করে পড়ল একটা সাদাকালো ছবি। রাইফেল কাঁধে এক মুক্তিযোদ্ধা। বিবর্ণ কাগজের পটে শক্তসমর্থ এক যুবার ছবি। সময়ের সাথে সাথে রঙ হারানো ছবিটার পেছনে গোটা গোটা হরফে লেখা নাম…
সেদিন গোলাবারুদ আনতে যেতে মুক্তিসেনাদের একটু দেরি হয়ে গেছিল। খড়গাঁদায় সবকিছু ঠিকঠাক পেয়েছিলও। কিন্তু ঠিকঠাক পাওয়া যায় নি এর জিম্মাদারকে। গোলাবারুদের চেয়েও ভারী দুঃসংবাদটা ওরা বয়ে তো এনেছিল, কিন্তু তা দিতে পারে নি তাদের কমান্ডার সিদ্দিককে। মিথ্যে করে বলেছিল ওর স্ত্রী-সন্তান ভালো আছে। এত বড় একটা দুঃসংবাদ দিয়ে তাকে দুমড়ে দিতে চায় নি ওরা।
সবার অলখে কেমন একটা সন্ধি হয়ে গেল দুই দুঃসংবাদের মাঝে! সিদ্দিকও যে রজবের মৃত্যুসংবাদ জয়নবকে জানাতে নিষেধ করেছিল গোলাবারুদ আনতে যাওয়া সেনাদের…
দুদিন আগের একটা মিশনে শত্রুপক্ষের যোদ্ধাদের কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল সিদ্দিকের বাহিনী। নিজে আক্রমণ চালু রেখে বাকিদের কমান্ড দিয়েছিল পিছু হটার। সবাই যখন পিছু হটছে, হঠাৎ একটা গুলি এসে লাগে সিদ্দিকের ডান হাতে। মুহূর্তে হাত থেকে ছিটকে পড়ে মেশিনগান। ঝাপসা চোখে মৃত্যুকে খুব কাছে দেখে সে।
এই তো আরেকটু ক্ষণ... পাকসেনারা ওকে ঘিরে ধরবে। ভাগ্য ভালো হলে এক গুলিতে খুলি উড়িয়ে দেবে, না হলে শেষ করার আগে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নেবে শত্রুহননের অনির্বচনীয় আনন্দের স্বাদ...
কিন্তু এর কিছুই হলো না! চকিতে রজব ঝাঁপিয়ে পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছে গেল সিদ্দিকের কাছে। শক্ত হাতে তাকে পিছে ঠেলে দিয়ে নিজেই নিল যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ। ও যখন গুলি চালিয়ে শত্রুসেনাদের ব্যস্ত রেখেছে ততক্ষণে সিদ্দিককে কাঁধে তুলে নিয়েছে কেউ।
লিডারকে নিয়ে সবাই নির্বিঘ্নে পিছু হটে গেল। ক্লান্তি আর ব্যথায় চোখ বোঁজার আগে সিদ্দিক শেষবারের মতো দেখল বন্ধু তার কী অপরিসীম নির্ভীকতায় মেশিনগান চালিয়ে যাচ্ছে...
রজবের সাহসিকতায় সেদিন সিদ্দিক আর ওর বাহিনী প্রাণে বাঁচলেও রজব ধরা পড়ে যায়। জঙ্গলের ধারে ফেলে যাওয়া ওর নিথর দেহটা সহযোদ্ধারা চিনতে পারছিল না। শক্ত শরীরটা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মোরব্বার মতো ফালাফালা করে ফেলেছিল...
সিদ্দিকের মুখ থেকে স্বামীর মৃত্যুসংবাদ নিতে পারে নি জয়নব। এতগুলো দিন শরণার্থী শিবিরে খেয়ে না খেয়ে দিন গুনেছে কবে স্বামী এসে তাদের নিয়ে যাবে। আফসোস! স্বামীর বদলে এলো তার মৃত্যুসংবাদ! সেই যে মুর্ছা গেল, জ্ঞান আর ফেরে নি। দশ মাসের কোলের বাচ্চাটা সব হারিয়ে ঠাঁই পায় সিদ্দিকের কাছে। ফুটফুটে শিশুটাকে সে বুকে চেপে নেয় পরম মমতায়। এ যে তার বন্ধুর আমানত!
যুদ্ধশিবিরে কোনো এক নিশুতি রাতে স্বাধীন বাংলা বেতারে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ শুনতে শুনতে রজব প্রিয়বন্ধুকে বলেছিল, যদি ও আর না ফেরে তাহলে মুক্তাকে যেন মুক্তির সাথে আগলে রাখে। সেদিন কি তবে সে নিজের মৃত্যুকে আঁচ করেছিল?
পরম প্রভু মুক্তিকে তুলে নিয়ে আবার মুক্তারূপে ফিরিয়ে দিলেন সিদ্দিকের বুকে। সেই থেকে মুক্তাই তার কাছে মুক্তি। বুকের সবটুকু ভালবাসা দিয়ে বন্ধুর মেয়েকে সে সারাটা জীবন আগলে রেখেছে মৃত্যুর আগপর্যন্ত নিজের মেয়ের মতো। বন্ধুকে দেয়া ওয়াদা সে সহীভাবে পালন করেছে, মরণে আর নেই কোনো আফসোস। এ যে তার বোনাস লাইফ!
ডায়েরি পড়া শেষে মুক্তি ভেতরের ছবিটা আবার হাতে নিল। পেছনে গোটা গোটা হরফে লেখা নাম- রজব আলী শেখ... মানুষটা তার জন্মদাতা বাবা! ছবিটায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার ডায়েরির ভেতর সযত্নে তুলে রাখল।
ডায়েরি তার দায়িত্ব সেরেছে; এতগুলো দিন বুকে যে বার্তা জমিয়ে রেখেছিল তা উজাড় করে দিয়েছে। আজ থেকে তার অবসর!
মুক্তি এখন জানে তাকে নিয়ে সিদ্দিকের তটস্থতার কারণ। বাবাকে সে এতদিন ভীতু ভীরু জেনে এসেছিল, এখন জানে ওটা তার বাবার সাহসের উল্টো পিঠ- সাবধানতা!
মুক্তি এখন জানে তার সাহসিকতার উৎস- তার জন্মদাতা বাবা, যে অকুতভয়ে পুরো দলকে বাঁচিয়ে নিজেকে করেছে উৎসর্গ।
মৃত্যুভয়ও যাকে পিছু হটাতে পারে নি সেই বাবার সন্তান সাহসী হবে না তো কে!
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
গভীর রাত। জয়নবের প্রসববেদনা উঠেছে।
৩০ সেপ্টেম্বর - ২০২৩
গল্প/কবিতা:
২১ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.১৭
বিচারক স্কোরঃ ২.৫৭ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৬ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪