ছলনা

বন্ধুত্ব নাকি ছলনা (নভেম্বর ২০২৩)

মাহাবুব হাসান
  • ৬৪
-তুই কি আমার বন্ধু হবি?
হৃদয়ের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। বুড়ো লোকটা বলে কী! পুরো বাড়িতে আর কোনো মানুষের সাড়াশব্দ নেই। ওর কেমন ভয় ভয় করতে লাগল।
ভর দুপুরে বাড়ির কাউকে না বলে বন্ধুদের সাথে খেলতে বের হয়েছিল হৃদয়। বিশাল বাগানটায় বড় বড় গাছ। বেশিরভাগই ফল গাছ, না হয় ছায়াদার বৃক্ষ। মোটা একটা আমড়া গাছের গোঁড়ায় চক দিয়ে স্ট্যাম্প একে ছয় বালক মেতে উঠেছিল ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে। মানে ক্রিকেটে! ক্লাস টিচার একদিন বলছিলেন ক্রিকেট মানে নাকি ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। খুব মজা পেয়েছিল শুনে। এরপর থেকে বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানায়- চল, ‘ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক’ খেলি!
তো আজও নির্জন বাগানে ওরা মহানন্দে খেলছিল। এর মধ্যে একটা ফুলটস পেয়ে উঁচিয়ে মেরেছিল হৃদয়। বলটা অদ্দুর যাবে সে বোঝে নি। ছক্কার আনন্দ তিতা হয়ে যেতে সময় নিল না। পড়বি তো পর, বলটা পড়েছে বাগান লাগোয়া দোতলা বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলার জানালায়। গ্লাস ভেঙে সোজা ভেতরে।
আজ কপালে যে কী আছে! ছক্কা যেহেতু হৃদয় পিটিয়েছে, বলটাও তাকেই আনতে হবে। না আনলে জিন্দেগীতে খেলার নাম মুখে আনতে পারবে না। বলটা ওর বাপের কিনে দেয়া তো না!
নিতান্ত অনিচ্ছায় পা ঘষে ঘষে বাড়িটার দিকে এগোলো। দরজা দেখি আধখোলা! আস্তে করে দরজাটা আরেকটু খুলে ভেতরে ঢুকল। সামনে এগোতেই বুড়ো লোকটার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। উনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিলেন চোখ ডলতে ডলতে আর হাই তুলতে তুলতে। হাতে ক্রিকেট বল!
নির্ঘাৎ দুপুরের আরামের ঘুম ভাঙিয়েছে! হৃদয় কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ঝেড়ে দৌঁড় লাগাবে? তাহলে সবাই তাকে বলবে ‘চিকেন হার্ট’! থেকে গেলে লোকটার কিছু গালাগাল, বড় জোর দু’চার ঘা। কিন্তু পালালে আজীবন বন্ধুরা লজ্জা দেবে।
হৃদয় থেকে যাওয়াটাই ঠিক মনে করল। যা হয় হবে! অমন কত গালাগাল আর ‘চটকানা’ বাপের কাছে খেয়েছে। এতদিনেও যদি চামড়াটা মোটা না হয় তো কেমন বাপের ব্যাটা সে!
কী আশ্চর্য! লোকটা হৃদয়কে কোনো গালাগাল দিল না, মারধর তো ‘দূর কি বাত’! অভয়ের হাসি হেঁসে কাছে ডেকে বলটা ওর হাতে দিল।
বুড়ো লোক বলতে সে এদ্দিন জেনে এসেছে বুক-পেটের চামড়া ঝোলা বলীরেখায় পূর্ণ সদাবিরক্ত কাশফুলের মতো কিঞ্চিত চুলওয়ালা মানুষ। কিন্তু এই লোকের মাথার চুল সাদা হলেও শরীর ঝরঝরে। মুখটা প্রশান্তিমাখা হাসিতে উজ্জ্বল। আর গলার স্বর মোটেই শ্লেষ্মাজড়ানো না; পরিষ্কার আর মিঠা!
-কী নাম রে তোর?
-হৃদয়!
-থাকিস কই?
-মল্লাপাড়া!
নামটা ঠিক বললেও ঠিকানা ভুল বলেছে। ইচ্ছে করেই। মানুষকে দিয়ে বিশ্বাস আছে! রিস্ক নিয়ে লাভ নেই। যদি বাড়ি খুঁজে নালিশ জানিয়ে আসে! বাপের কানে গেলে পিঠের চামড়া তুলে নেবে!
-পেয়ারা খাবি?
হৃদয় হ্যাঁ না কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। এমনও লোক হয়? জানালার গ্লাস ভাঙার জন্য কোথায় গালাগাল দেবে; উল্টো পেয়ারা সাধছে! ব্যাটার মতলব কী?
হৃদয়ের জবাবের অপেক্ষা না করে লোকটা কিচেনের দিকে গেল। পেয়ারা পাড়াই ছিল। তার বাগানের পেয়ারা। বড় দেখে একটা পেয়ারা নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে দেখল ছেলেটা নেই। পালিয়েছে! লোকটা আপনমনে হাসলেন। ভয় পেয়েছে ছেলেটা!
বলটা হাতে পেয়ে হৃদয় হাফ ছেড়ে বেঁচেছে যেন। লোকটা একটু দূরে যেতেই বল নিয়ে মেরেছে ভোঁ দৌড়! পেয়ারা নাম করে লাঠিসোটা আনতে গেছে কিনা কে জানে! আজ যদি জানে মেরে ফেলে তো আশেপাশে দেখার কেউ নেই। কী দরকার যেচে বিপদে পড়ার! আর কোনদিন এই বাগানে খেলতে আসবে না। জায়গার অভাব পড়েছে নাকি!
সপ্তাখানেক পর ঠিকই বাগানটায় খেলতে এলো ওরা। আসার কারণও আছে। এতগুলো দিন গেল, কেউ তো কমপ্লেইন নিয়ে আসে নি! তার মানে যত খারাপ ভেবেছিল লোকটা আসলে অত খারাপ না। আচার-আচরণও ভালো। নাহ্ সেদিন লাঠি না, সত্যি সত্যি পেয়ারা আনতে গেছিল! নিজেকে বুঝ দেয় হৃদয়। আর তাছাড়া ভর দুপুরে তো লোকটা ঘুমায়। বাড়িটার দিকে জোরে না মারলেই হলো!
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কথাটা সে শুনেছিল; এবার হাড়ে হাড়ে টের পেল কথাটার মানে।
বাড়িটার দিকে যাতে ছক্কা না মারতে পারে সেজন্য স্টাম্প উল্টো দিকের একটা গাছে এঁকেছিল। কিন্তু ন্যাড়া তো একবার বেলতলায় যাবে না! যাবে বারবার। সেরকম সেও ফুলটস পেয়ে জোরে হাকালো। অফসাইডে সে এত জোরে পেটাতে পারে তা জানত না। কিন্তু আনন্দ করবে কী, বল আবারো সেই বিল্ডিংয়ে! এবার অবশ্য ঘরের ভেতরে না, বলটা ঢুকে পড়েছে বাড়িটার সাথে লাগোয়া ফুল বাগানে। বাগানের চারধার ফুট তিনেক উঁচু বাঁশের চটার বেড়ায় ঘেরা।
আল্লাহ্ বাঁচাইছে ঘরে ঢোকে নাই! টুপ করে বল কুঁড়িয়ে নেবে, কাকপক্ষীটিও টের পাবে না!
হৃদয় চুপিচুপি বেড়ার ধারে গেল। আধভেজানো দরজার সাথে লোকটা দাঁড়িয়েছিল। হৃদয়ের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। মুচকি হেঁসে এগিয়ে এলেন।
-কী রে, বল এবার কোথায় পাঠিয়েছিস? ঘরে, না ছাদে?
-বাগানে!
-হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? নিয়ে আয়! বেড়া টপকাতে পারবি না?
হ্যাঁ পারব- বলেই হৃদয় এক লাগে বেড়ার ওপাশে চলে গেল। বল নিয়ে আরেক লাগে এপার।
-পেয়েছিস?
-জ্বি!
-আচ্ছা, সেদিন তোকে দাঁড়াতে বললাম, চলে গেলি কেন? আমি পেয়ারা নিয়ে বাগানের সবখানে খুঁজে এলাম, দেখি কেউ নেই!
হৃদয় কী বলবে বুঝে উঠল না। ওকে চুপচাপ ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটা হেঁসে ফেলল।
-কী রে, তুই কি আমাকে ভয় পাস? ভয় পাস নে! আমি কি মারব নাকি! দাঁড়া, তোর জন্যে পেয়ারা নিয়ে আসি। লাল পেয়ারা খেয়েছিস কখনো?
-লাল পেয়ারা! পেয়ারা আবার লাল হয় নাকি? পেয়ারা তো সবুজ হয়।
-লাল পেয়ার মানে পেয়ারা লাল না, পেয়ারার ভেতরটা লাল। খুব মজা! খেলেই বুঝবি। দাঁড়া এখানে, পালাস নে।
বৃদ্ধ কয়েকটা পেয়ারা হাতে বাইরে এলেন। হৃদয় আজ যায় নি। লোকটাকে আজ তার মতলববাজ মনে হচ্ছে না। ওর দাদার বয়সী। ইস, ওর যদি এরকম একটা দাদা থাকত!
লোকটা খুব মিশুক; অল্প সময়ের মধ্যেই হৃদয়ের হৃদয় জয় করে নিল। ভদ্রলোক চাকুরি করতেন, বছর দুই হলো অবসর নিয়েছেন। বছর তিনেক আগে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে পুরো বাড়িতে একা। ছেলে-মেয়ে দুজনই প্রবাসী। স্বামী স্ত্রী সন্তান নিয়ে বিদেশে থাকে। বাবাকে আরো আগেই নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু জমি জমার কিছু ঝামেলা থাকায় যান নি। ছেলের ঘরের ছোট্ট নাতিটার সাথে নাকি তার খুব ভাব। একে অন্যকে দোস্ত বলে ডাকে! তুই তোকারি সম্পর্ক।
হৃদয় নাকি ওনার নাতির মতো দেখতে! বয়সও কাছাকাছি। এজন্যেই হৃদয়কে এত স্নেহ করেন। ওকে দেখলে নাতির কথা মনে পড়ে। আর তাইতো হৃদয়ের সাথে দোস্তি করতে চান।
ওনার দোস্তি পাতানোর প্রস্তাব পেয়ে হৃদয়ের শুরুতে কেমন কেমন লাগলেও কিছুদিনের মধ্যে সত্যি দুজন দোস্ত হয়ে গেল!
কে বলে বন্ধু কেবল সমবয়সী বা একই ক্লাসের ছেলেমেয়েদের মধ্যে হয়! অসম বয়সীদের মধ্যেও গভীর বন্ধুত্ব হতে পারে যদি মনের মিল থাকে। হতে যে পারে তার উদাহরণ এই দুজন। বন্ধুর মতোই রাজ্যের আলাপ দুই বন্ধুর মধ্যে। নিজেদের হেন কথা নেই যা তারা দুজন বলে না।
লোকটার মনে বেজায় কষ্ট। ছেলে মেয়ে যার যার জীবনে ব্যস্ত, ভীষণ ব্যস্ত। সপ্তাহে দুসপ্তাহে একদিন ফোনে হ্যালো করেই দায়িত্ব শেষ! স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে শূন্যতা আরো বেড়েছে। ছেলেমেয়ে আর নাতি-নাতনীদের কাছে পেতে মন হাহাকার করে। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না। ওদেরও তো চাকুরি আছে, সন্তানদের স্কুল আছে। মাকে শেষবারের মতো দেখতে ওরা এসেছিল। তারপর কেটে গেছে তিন বছর। দোস্তটারে কত দিন ছুঁয়ে দেখে না!
ছেলেটা এসে নাতির দুঃখ যেন ভুলিয়ে দিয়েছে। আর লোকটা সঙ্গ পেয়ে হৃদয়ও খুব খুশি। ছোটবেলা থেকে অবহেলা অনাদরে দিন কাটে তার, এতটা মমতা সে কোনদিনও পায় নি। সৎবাবার সংসারে দুবেলা খাওয়া আর স্কুলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে সে, আর কী চাই! কারণে অকারণে যখন সৎ বাবা তাকে ধরে পেটায় তখন আড়াল থেকে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না দুখিনী মায়ের।
দিনের পর দিন ডালভাতে পেট ভরাতে হয়, কোনদিনও মুখফুটে কিছু বলতে পারে না হৃদয়। হয়ত নিজের বাবা হলে বলতে পারত, আর ডালভাত খেতে ভালো লাগে না বাবা! আজ বাজার থেকে মাছ আইনো।
সৎ বাবার ঘরে মায়ের কোলজুড়ে একটা ফুটফুটে মেয়ে এসেছে। মায়ের যত আদর-সোহাগ মেয়েটার প্রতি, এতদিন যাওবা হৃদয়ের খেয়াল রেখেছে, সেটাও এখন বন্ধ! হৃদয় কয়েকদিন ইচ্ছে করেই না খেয়ে স্কুলে গেছে দেখার জন্যে যে মা খোঁজ করে কিনা। সে খেয়ে স্কুলে গেল নাকি না খেয়ে তা দেখারও সময় মায়ের এখন হয় না!
হৃদয়ের বুকভরা কষ্ট, অভিমান; স্কুলে আর পাড়ায় হৃদয়ের এত বন্ধু, তবু সে কখনো নিজের কষ্টের কথা কারো কাছে বলে না। ভালো লাগে না বলতে। কে তার আপন যে মনের কথাগুলো বলবে!
হৃদয় এখন সবকথা বলে তার দোস্তকে। দোস্তও পেয়েছে বটে! সেদিন দুজন বাগানে ঘুরতে বেরিয়েছে। পুকুরপাড়ে অনেকগুলো নারকেল গাছ। লোকটা হঠাৎ বলল, ডাব খাব! পেড়ে দে!
হৃদয় মহা উৎসাহে দাঁতে দাঁ কামড়ে ধরে নারকেল গাছে উঠল। হাজার হলেও দোস্ত ডাব খেতে চেয়েছে! গোটা পাঁচেক ডাব নিচে ফেলে নেমে আসল। মজা করে ডাব খেল দুজন।
দোস্তর বাগানে যে কত ধরণের ফল! ফল পাকলে লোক ডেকে পাড়ায়। হৃদয়ের জন্যেও রেখে দেয় কিছু। আর ওরও এ বাড়ি প্রতিদিন একবার ঢুঁ না মারলে পেটের ভাত হজম হয় না! সাথে করে এটা ওটা নিয়ে আসে দোস্তর জন্য- কোনদিন মায়ের হাতের আচার, কোনদিন বিলের টাটকা শাপলা।
সেদিন ঝুম বৃষ্টি! বৃষ্টির মধ্যেই কদম গাছে উঠল। হাতভর্তি একগুচ্ছ কদম ফুল পেড়ে নিচে নামতে গিয়ে বেমক্কা পা গেল উলটে। অল্পের জন্যে ভাঙে নি। তবে ব্যথা পেয়েছে খুব। ব্যথা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গেল দোস্তর বাড়িতে। আজ দোস্তর জন্মদিন!
জন্মদিনে এক তোড়া কদম ফুল উপহার পেয়ে লোকটা শিশুর মতো খুশি হয়ে উঠল। কদম ফুল তার ভীষণ প্রিয়। আজ তার বাড়িতে দুপুরের খাবারের নেমন্তন্য; টিফিনের বিরতিতে কাউকে কিছু না বলে এসেছে দোস্তর বাড়িতে। পাঁজি জামালটা বাড়িতে গিয়ে কিছু না বললেই হয়!
দুপুরে পেট পুরে খেল হৃদয়। এমন মজার খাবার সে জীবনেও খায় নি। পোলাউ, মুরগীর রোস্ট, গরুর মাংস, ফিরনী- সব দোস্ত নিজে রান্না করেছে। খেতে খেতে জানাল কাল মায়ের সাথে মামা বাড়ি যাবে। স্কুল ছুটি দিয়েছে। এক সপ্তাহর ছুটি। ছুটিটা মামার বাড়ি কাটাবে। ওর নানা নানী বহু আগে মারা গেছে। ওবাড়িতে এখন আছেন মামা মামী আর মামাত ভাই বোন। মামা মামী হৃদয়কে খুব আদর করেন।
বহুদিন বাদে মামা বাড়ি যাচ্ছে, হৃদয় একদিক থেকে খুব খুশি। আবার দোস্তকে ছেড়ে এতগুলো দিন থাকতে হবে ভেবে কষ্টও লাগছে।
সকালের ট্রেনে উঠলে দুপুরের মধ্যে মামাবাড়ি পৌঁছান যায়। মায়ের সাথে হৃদয় আর ওর বোন সকাল সকাল স্টেশনে এলো। ট্রেন আসতে আধঘন্টা লাগবে। হৃদয় মায়ের গা ঘেঁষে আনমনে বসে আছে। হঠাৎ তার বুকটা ছলাৎ করে উঠল। ওই তো তার দোস্ত! গালভরা হাসি নিয়ে এগিয়ে আসছে। দূর থেকেই জোরে ডাক ছাড়ল- দোস্ত!
দোস্ত তাহলে হৃদয়কে বিদায় জানাতে স্টেশন পর্যন্ত ছুটে এসেছে!
হৃদয়ের মনটা খুশিতে ভরে উঠলেও তা ম্লান হতে সময় লাগল না। লোকটি হৃদয়কে বিদায় জানাতে না, এসেছে ছেলে ছেলে-বৌ আর আদরের নাতিকে রিসিভ করতে। ‘বেবি এলিফেন্ট’টাকে মুহূর্তের মধ্যে কোলে তুলে নিলেন। বহুদিন বাদে আদরের নাতিকে পেয়ে তার আনন্দ আর ধরে না!
হৃদয় মিলাতে পারছে না। লোকটা তো গতকালও বলে নি ওরা আজ আসবে! হৃদয়ের সাথে চোখাচোখি হয়েছে, কিন্তু উনি কেন তার সাথে কথা বলল না? এড়িয়ে কেন গেল?
হৃদয় নিজেকে প্রবোধ দেয়- এটা ওর মনের ভুল। হয়ত দোস্ত তাকে খেয়াল করে নি। এতদিন বাদে আদরের মানুষগুলোকে কাছে পাওয়ার আনন্দে একটু বেখেয়াল তো কেউ হতেই পারে!
সপ্তাহখানেক পর মামাবাড়ি থেকে হৃদয় বাড়ি ফিরেছে। দিনগুলো কাজিনদের সাথে হেঁসেখেলে অস্বস্তিকর ভাবনা থেকে মনকে সরিয়ে রাখতে পারলেও এখন আর নিজেকে মানাতে পারল না, বিকেল হতেই ওবাড়ির দিকে ছুটল।
ওই তো, ছাদেই দোস্ত! ফুটফুটে নাতিটার সাথে হেসেখেলে বেড়াচ্ছে। বাবুটা কী সুন্দর! বাহারি পোষাক আর সানগ্লাসে রাজপুত্রের মতো লাগছে। নিজের গায়ের ছেঁড়া ফুটো জামা নিয়ে কোনদিনই হৃদয়ের মন ছোট হয় নি। কিন্তু এখন হচ্ছে। এই পোষাকে ও বাড়ির ভেতরে যেতে তার সাহসে কুলালো না।
প্রতিদিনই বাগানে আসে হৃদয়। খেলার জন্যে অবশ্য না। খেলার সাথীরা এখন আর এখানে খেলতে আসে না। হৃদয়ও ওদের সাথে আর আগের মত মেলামেশা করে না। নতুন বন্ধুকে পেয়ে ওদের সে ভুলে গেছিল। কিন্তু এখন খুব খালি খালি লাগে তার।
বাগানে ঘুরে ঘুরে মনমরা হয়ে ঘরে ফেরে প্রতিদিন। প্রতিবারই তার মনে হয় দোস্ত বোধ হয় দূর থেকে দেখে তাকে কাছে টেনে নেবে। কিন্তু তার আর হয় না। বন্ধু কি তবে তাকে ভুলে গেছে?

আজ খুব তুচ্ছ কারণে বাবার হাতে বেদম মার খেয়েছে হৃদয়। ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরেছে। তাতেও পাষাণটা থামে নি! মাঝে মা এসে না ঠেকালে আজ হয়ত মেরেই ফেলত। বাবার হাত থেকে ছাড়িয়ে ছেলেকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল মা। নিজের কান্না ধরে রাখতে পারল না। আদর করে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ঠোঁট কতটা কাটল দেখতে গেছিল; হৃদয় অভিমানে মায়ের হাত সরিয়ে এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
যখন আর কেউ থাকে না তখন সব রাগ ক্ষোভ বিরক্তি অভিমান গিয়ে পড়ে অবলা মায়ের ওপর! বুঝি মায়ের কারণেই তার সব দুর্ভোগ। কী ক্ষতি হতো যদি মা তাকে এই দুনিয়ায় না আনত! এত কষ্ট তাহলে পেতে হতো না।
বুকভরা অভিমান নিয়ে রাস্তায় রাস্তায়, নদীর ধারে, বনেবাদারে দিনভর ঘুরল ছেলেটা। এতদিন যাকে বলে মনের ভার হালকা করেছে- সেই দোস্তর কাছে ছুটে যেতে প্রাণ ব্যাকুল, কিন্তু আরেক মনে যে অভিমান বাসা বেঁধে আছে!
দিনভর বৃষ্টিতে ভিজে হৃদয় যখন ঘরে ফিরল তখন তার প্রচণ্ড জ্বর। জ্বরে প্রায় অচেতন হয়ে চার পাঁচটা দিন কাটল। পুরোপুরি সেরে উঠতে লেগে গেল দু’ সপ্তাহ। এতগুলো দিন স্কুলে যেতে না পারাটা তাকে ততটা পোড়ায় নি, যতটা পুড়িয়েছে দোস্তর সাথে বিচ্ছেদ। সুস্থ হতেই তাই সব অভিমান পেছনে ফেলে সে দোস্তর বাড়ি গেল।

বাড়ির বাইরে একটা লোহার গেট বসানো হয়েছে। একতলা দোতলার সব জানালা বন্ধ। বাইরের দরজায় বিশাল একটা তালা! ঘরময় শুনশান নীরবতা। হৃদয় হতবাক; মানুষটা গেল কই!
বাড়ির ভেতরদিকে এক রুমের একটা ঘর। ঘরের ভেতর নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে মাঝবয়সী অচেনা এক লোক। হৃদয় তাকে ডেকে তুলল।
ইনি বৃদ্ধের পরিবারের কেউ নন। ইনি হলেন কেয়ারটেকার, ছেলের সাথে আমেরিকা যাওয়ার আগে বৃদ্ধ তাকে বাড়ি দেখভালের জন্যে রেখে গেছেন।
এতগুলো দিন দোস্তর সাথে এত কিছু নিয়ে এত কথা হলো, অথচ বৃদ্ধ ঘুণাক্ষরেও কোনদিন জানান দেয় নি নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা- চিরতরে দেশ ছেড়ে সন্তানের কাছে চলে যাবেন। যাবার আগে একবারের জন্যেও খোঁজ করেন নি ছোট্ট বন্ধুর। হৃদয় কেয়ারটেকারের কাছে জেনেছে।
হৃদয়ের ভীষণ কান্না পাচ্ছে, প্রাণপণে চেষ্টা করছে কান্না থামাতে। অভিমানে বুকটা ভেঙে যাচ্ছে তার।
নিঃসঙ্গতার সময়টাতে মানুষটা ওকে আপন করে নিয়েছিল। হৃদয়ও তার হৃদয় উজাড় করে দিয়েছিল বন্ধুর প্রতি। অথচ নাতিটাকে কাছে পেয়ে সব ভুলে গেল! যাবার আগে একবার খোঁজ পর্যন্ত নিল না।
এতদিন কি তবে লোকটা তার বন্ধু ছিল না? বন্ধুত্বের নামে সবই কি ছিল ছলনা?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

পুরো বাড়িতে আর কোনো মানুষের সাড়াশব্দ নেই

৩০ সেপ্টেম্বর - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ২৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪