চোখটা একটু বুজে এসেছিল। নিত্যসঙ্গী ফোনখানা নিশ্চিত গালটাকে পাশ কাটিয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে আমার সাথেই, মুখের উপর ধপাস করে পড়লে একটু ব্যথাট্যথা পেতাম। চোখের দরজা-জানালা বন্ধ হতেই কেমন যেন সাঁই করে মামদোবাজির মতো পৌঁছে গেলাম পরীক্ষার হলে। কোয়ারেন্টিনের বদৌলতে সব পরীক্ষা-ক্লাস অনলাইনে হবে জানতাম, অফলাইনে এত বড় হলে এমন সামাজিক দূরত্ব মেনে পরীক্ষার কথা শুধু মিমেই দেখেছি। আমার ভাগ্য এত পুড়লো কবে যে ক্ষণিক বিশ্রামের মধ্যে এখানে আসতে হলো? এমনিতেও এ বছর আমি তো যাকে বলে ‘রেগুলার স্টুডেন্ট’ও নই। অনার্সের রেজাল্টের অপেক্ষা করছি (নাকি করছিলাম!?)।
আমার সিটে বরাবরের মতোই চক দিয়ে লেখা ৫৯৬৩, দু-তিন বছরে এ রোলখানা বেশ ঠোঁটস্থ হয়েছে রেজিস্টার বিল্ডিং/ডিপার্টমেন্ট অফিসের বদৌলতে। কিন্তু আজ কোনো অ্যাডমিট কার্ড দেখছি না সাথে! নাহ, পকেটেও নেই। সামনে দুটো ক্যাপ ছাড়া কলম, এ আমারই পরীক্ষা বটে!
সামনে দেখছি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক গোছের একজন দাঁড়িয়ে সানন্দে পান চিবুচ্ছেন। তার কাছে গিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, (ইনাকে স্যার বলাটাই সমীচীন হবে মনে হচ্ছে)- স্যার, আমার পরীক্ষা হবার তো কথা ছিল না।
তিনি টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচানো শুরু করলেন। নাহ, ভার্সিটিতে এমন কাউকে দেখিনি বাবা! ভার্সিটির মানুষজন একটু ‘ক্লাসি’ হয়, না তো হবার একটা প্রবণতা থাকে। ইনি সেসবের ঊর্ধ্বে মনে হচ্ছে। সে যাকগে, বিষয়টা বোধহয় বোঝেননি, একটু বুঝিয়েই বলি।
-আমি তো ছাত্র নই, মানে আমি ছাত্র কিন্তু আমি তো এ বছর ক্লাস করছি না। পরীক্ষাটা কীসের তাই বুঝলাম না।
--তাই নাকি? প্রশ্নপত্র দেয়া হয়েছে কী করতে? একবার দেখে নিলেই তো হয়!
[এই যাহ! একটা কাগজ তো ছিল বটে, ওটাই কি প্রশ্নপত্র? বিশাল ভুল হয়েছে!]
--তুমি কোন বিভাগের? আজকাল তো গণ্ডায় গণ্ডায় বিভাগ খুলছে। তবে ফেসবুকটাই আমার কাছে জাতের মনে হয় বাবা। মামা-চাচা থেকে হালের সেলেব্রিটি সব্বাই এঁটে যায়। একদম ইনক্লুসিভ!
-ফেসবুক!?
--তুমি ফেসবুক চালাও না?
-তা আর বলতে। সারাদিনই… (একটু লজ্জা লজ্জা স্বরে বললাম, যেন বিশাল ভুল করে ফেলেছি)
--হ্যাঁ, তাইতো! বেশ মনোযোগী তো তুমি। তবে আবার ‘ছাত্র না, ছাত্র না’ করছিলে যে?
মহোদয়ের মেজাজ চড়ে গেলে আবার পেছনে রাখা বেতটা প্রয়োগ না করে বসেন, সে ভয়ে একটু পিছিয়ে গেলাম।
যাই, পরীক্ষা দিই।
তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে কার্ণিশের দুটো টিকটিকির সঙ্গমদৃশ্য উপভোগ করতে লাগলেন। ওটা আমারো প্রিয় দৃশ্য, কিন্তু এখন আবার ঘাড়ের উপর পরীক্ষা জেঁকে আছে।
সিটে এসে আরেকটু অবাক হলাম। যাবার আগে এতগুলো কাগজ দেখিনি তো! মনে হচ্ছে, কেউ সুন্দর করে উত্তরপত্র, প্রশ্নপত্র সাজিয়ে দিয়ে গেছে।
প্রশ্নপত্র খুলে দেখলাম তিনটি বিভাগ দেয়া। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার।
ইনস্টাগ্রামে সদ্য প্রবেশ করেছি, ছবির ফিল্টার বদলানো ছাড়া আর কিছুই জানি না। আর টুইটার তো সব সেলেব গোছের লোকেদের আস্তানা। সারাদিন যার হোমপেজে নির্দ্বিধায় স্ক্রল করি, সে-ই তবে পরীক্ষার খাতা হয়ে হানা দিল আমার একান্ত নিশিযাপনে? খুশি হবো, নাকি দুঃখী- সেসব দ্বিধা সরিয়ে পরীক্ষাটা দিয়ে নিই আগে!
সব পরীক্ষার মতো এখানেও দেখি সেই একই সমস্যা। সবই পারি, পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছে না। দাঁতে কলম চেপে প্রশ্নগুলো পড়ছি…ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ঝুলিয়ে রাখার যুক্তিযুক্ত কারণ আবার কী? ‘ইচ্ছে করে না’- এই উত্তর দিলে একটু বেশি আলসে-কুঁড়ে ভাববে না? মাইনাস মার্কিং করে যদি!
সৃজনশীল সব প্রশ্নের উত্তর ভাবতে মশগুল হয়ে আছি, এমনটাতে ওদিকে আবার কীসের গোলমাল!? একজন দেখছি স্যারের সঙ্গে বেশ বাকবিতণ্ডায় জড়িয়েছে। আমারই সমবয়সী হবে মনে হচ্ছে।
-ডিজিটাল পরীক্ষায় ডিজিটাল উত্তরপত্র থাকা খুবই জরুরি। আমি বিষয়টা মানছি না। আমি কাগজে-কলমে কিছুই লিখব না, আমার ল্যাপটপ লাগবে।
–“দেখ বাবা, সবকিছুর একটা প্রক্রিয়া আছে। প্রক্রিয়া ছাড়া কিছুই হয় না।”
যাহ বাবা! এসব কথা কেমন শোনা শোনা লাগছে না? স্বপ্ন, নাকি দেজা ভু? স্যারটির চেহারাও কেমন ধীরে ধীরে তালগোল পাকিয়ে ভার্সিটির এক ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তার মতো হয়ে যাচ্ছে।
এই স্বপ্নের সবটাই অদ্ভুত। আমি বরং উত্তরগুলো লিখে নিই।
হুমম…দুটো প্রশ্ন বেশ মনে ধরেছে। এগুলো লিখে বেশ কয়েক পাতা ভরিয়ে ফেলতে পারব মনে হচ্ছে।
৮। মানসিক চাপ বৃদ্ধির জন্য ফেসবুকের অবিস্মরণীয় ভূমিকা ব্যাখ্যা কর।
১১। জীবনে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আনতে ফেসবুক কীভাবে সাহায্য করে?
দুটো আমার ভীষণ প্রিয় বিষয়। পরস্পরবিরোধী হলেও কী যে সত্যি আমার জন্য এগুলো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই মনের সুখে মনের ভাবনায় কলম ঘষতে লাগলাম।
ভোঁ ভোঁ করে ভাইব্রেশন হলো কোথায় যেন (আমার ফোন চিরন্তনভাবেই ভাইব্রেশন মুড, নো রিংটোন)। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পান চিবোনো স্যারটি আর নেই। কেমন স্যুটেড ব্যুটেড ক’জন দৌড়ে দৌড়ে খাতা সংগ্রহ করছেন। ধুপধাপ এসে আমার খাতাও নিয়ে গেলেন একজন, কী যে ক’টা লিখলাম, রিভিশনই দিতে পারলাম না! যাকগে, শেষ হলো তো। ও মা, ওদিকে দিকে আরেকজন চেঁচাচ্ছে…
-ব্যাটারি লো অ্যালার্ট দেয়া হয়নি কেন? আমি খাতা জমা দেব না…
এমন চিৎকার করছে যে ঘুমটাই ভেঙে যাবার জো। রেজাল্ট জানব কী করে, কে জানে, নাকি আগেরটার মতো এটাও 'উড়ো খৈ গোবিন্দায় নমোঃ' হবে নাকি!? আরেকটা লম্বা ভাইব্রেশনে চোখ মেললাম আমি।
কী অদ্ভুত স্বপ্নই না ছিল! দারুণ অ্যাডভেঞ্চারাস পরীক্ষা দিলাম অনেকদিন পর। চোখ ডলতে ডলতে ফোনটা হাতে নিলাম। একটা ইন্যাক্টিভ আইডি থেকে ম্যাসেজ-
“অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ”!
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
স্বপ্নলোকের তথা স্বপ্নের যদি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা খুঁজতে যাই, তবে দেখা যাবে যে আমাদের অবচেতন মনই এর পেছনের মূল কারিগর। আমরা যা বাস্তবে করি বা করি না, ভাবি কিংবা ভাবনা থেকে সরিয়ে রাখি, মূলত সবকিছুই স্বপ্নে একটা না একটা রূপে চলে আসার সামর্থ্য রাখে। এই গল্পটিও তেমনই ভাবনা থেকে লেখা। বলতে গেলে, গল্পটি মোটমাট আমার স্বপ্নেই পাওয়া। সারাদিন ফোন চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, স্বপ্নেও যেদিন সামাজিক মাধ্যমকেই মূল ভূমিকায় দেখতে পেয়েছি- সেদিনই গল্পটি লিখে ফেলেছিলাম।
২২ সেপ্টেম্বর - ২০২৩
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“নভেম্বর ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ নভেম্বর, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী