পুকুরপাড়ের আতঙ্ক

আতঙ্ক (নভেম্বর ২০২৫)

মোহাম্মদ শাহজামান
  • 0
শৈশব আর কৈশোরের রাতগুলো যেন আজকের দিনের মতো আলোকোজ্জ্বল ছিল না। তখন বিদ্যুৎ ছিল না, মোবাইল ফোনের আলো ছিল না, টেলিভিশনের ঝলকানিও গ্রামে পৌঁছায়নি। বিনোদনের একমাত্র উৎস ছিল জোসনা ভরা রাত, আর সেই রাতগুলোতে গ্রামের মুরুব্বিদের মুখে শোনা কিচ্ছা-কাহিনি। কিচ্ছায় ভরে থাকত দৈত্য-দানব, ভূত-পেত্নী, জিন-পরী আর অচেনা সব আতঙ্কের গল্প। শোনা যত আনন্দের ছিল, বাস্তবে তত ভয়াবহ হয়ে উঠত। রাত গভীর হলে মনে হতো—বাশঝাড়ের কাছে গেলে হয়তো হঠাৎ পেত্নী এসে দাঁড়াবে, তালগাছের গোড়ায় যেন কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে, কিংবা তেতুল গাছের নিচে অদৃশ্য কোনো ছায়া নড়ছে।
আমার গ্রাম শাহাবৃদ্ধি থেকে একটু দূরে বিস্তৃত ছিল বিশাল এক পুকুর। আমাদেরই চাষের পুকুর। সেখানে নানা রঙের মাছ ভেসে বেড়াত—রূপালী রুই, লালচে কার্প, সোনালি কই। বিকেলে সূর্যাস্তের আলো পড়লে মাছগুলোর গায়ে চিকচিক করত, যেন ছোট ছোট প্রদীপ জ্বলে উঠছে জলে। গ্রামের ছেলেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখত, আর আমরা যারা মাছের মালিক, তাদের চোখে ভেসে উঠত ভবিষ্যতের স্বপ্ন। সেই মাছ একদিন বড় হবে, বাজারে বিক্রি হবে, আর সংসারে সুখ এনে দেবে।
রাত হলেই দায়িত্ব বাড়ত। কেউ যাতে চুরি করে মাছ না নেয়, তার জন্য পাহারা দিতে হতো। সাধারণত আমি আর রফিক ভাই মিলে পুকুরপাড়ের ডেড়ায় বসতাম। গল্পগুজব করতে করতে কখনো হাসি, কখনো ভয়ের গল্পে শিহরণ—তারপর অজান্তেই ঘুম।
কিন্তু এক রাতে অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আমি যথাসময়ে ডেড়ায় এলাম, অথচ রফিক ভাই এলো না। প্রথমে ভেবেছিলাম, দেরি করছে। অপেক্ষা করতে করতে সময় গড়াল। রাত ক্রমেই ঘন হয়ে উঠল। চারদিক নীরব, কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। সেই নীরবতার ভিতর হঠাৎ মনে হলো, পুকুরের পানি যেন কারো পায়ের শব্দে কেঁপে উঠছে। বুক ধড়ফড় করতে লাগল।
মনে পড়তে লাগল মুরুব্বিদের গল্প। খাল পাড়ে নাকি পেত্নীরা থাকে। তালগাছের গোড়ায় নাকি ভূতের আসর। আমি তো বাড়ি ফিরতে পারব না। খাল পার হতে গেলে যদি সত্যিই কেউ আঁকড়ে ধরে! মনে হতে লাগল—যদি এখন কোনো ভয়ংকর ছায়া এসে দাঁড়ায় সামনে? গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল। আমি ডেড়ার ভেতর বসে আছি, কিন্তু যদি প্রসাবের দরকার হয়, আর বাইরে যেতেই হয়? ভূত কি তখন আমাকে টেনে নিয়ে যাবে? চিন্তায় গা শিউরে উঠল।
এক সময় মনে হলো রফিক ভাই হয়তো আর আসবেই না। আমি একা। ভয় আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। রাত যেন থেমে গেছে। এত অন্ধকার, এত নিস্তব্ধতা আগে কখনো অনুভব করিনি। দূরে বাঁশঝাড়ের দিকে তাকালে মনে হয়, পাতার ফাঁক দিয়ে কারো চোখ জ্বলজ্বল করছে। আমি চুপ করে বসে থাকলাম, গায়ে গা লুকিয়ে। ভয়ে চোখ বন্ধ করতে পারছি না, আবার খুলেও থাকতে পারছি না।
কোনো এক মুহূর্তে হয়তো আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ভোরের প্রথম আলো না, বরং ফজরের আজানেই ঘুম ভাঙল। মসজিদের মাইকে ভেসে এলো—
“আস-স্বালাতু খাইরুম মিনান্ নাওম, আস-স্বালাতু খাইরুম মিনান্ নাওম।”
কণ্ঠের গভীরতা আর পরিচিত আহ্বান আমাকে যেন আবার জীবিত করে তুলল। মুহূর্তেই মনে সাহস ফিরে এলো। মুরুব্বিদের কথাই মনে পড়ল—আজানের সময় কোনো ভূত-পেত্নীর ক্ষমতা থাকে না। আমি ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেললাম, যেন বুকের ভেতরের ভার হালকা হয়ে গেল।
কিন্তু আবার মনে হলো—আজানের পর তো কালো আঁধার নামে। ফজরের পর থেকে সূর্য ওঠা পর্যন্ত সময়টাকে আমরা বলি ‘কালা আন্ধার’। সেই সময়টাতেই নাকি ভূতেরা সবচেয়ে সক্রিয় থাকে। ভেতরের সাহস আবার কেঁপে উঠল। কিন্তু এবার আমি ভিন্ন কিছু করলাম। মায়ের কাছ থেকে শেখা দোয়া মনে পড়ল। আমি আস্তে আস্তে কুরআনের আয়াত পড়তে লাগলাম—আয়াতুল কুরসি, তিন কুল। মনে হলো দোয়াগুলো আমাকে ঘিরে রেখেছে অদৃশ্য এক বর্মের মতো। ভয় ধীরে ধীরে কমতে লাগল।
কালো আঁধারের আঁধার ভাঙতেই দূরে দেখলাম, মাঠ থেকে আসছে আরব আলী। তার কাঁধে লাঙ্গল, হাতে জোয়াল, আর সামনে দুটি গরু। গরুগুলো হেঁটে আসছে নীরবে, মাথা দোলাতে দোলাতে। সেই দৃশ্য দেখে মনে হলো, পৃথিবীতে আলো ফিরে এসেছে। আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনতাম—গরুর আশেপাশে কোনো ভূত-পেত্নী থাকে না। আরব আলীর উপস্থিতিতে মনে হলো—আমার ভয় চিরতরে দূরে সরে গেছে।
সেদিন থেকে আমি শিখলাম, ভয় যত বড়ই হোক না কেন, সাহসের আলো থাকলে তা দূর হয়। আমাদের ভেতরেই আছে সেই আলো, শুধু জাগিয়ে তুলতে হয়। দোয়া-দরুদ, প্রার্থনা আর মানুষের উপস্থিতি ভয়কে মুছে দেয়। পুকুরপাড়ের সেই রাত আমাকে নতুন এক শিক্ষা দিয়েছিল—অন্ধকার যত গভীরই হোক, আলো আসবেই।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী চমৎকার লেখা। মুগ্ধ হলাম
মেহেদী মারুফ বাহ!! আপনার এই গল্পের মাধ্যমে আমার স্মৃতিতে আরেকটু নাড়া লাগলো। আমরাও মাধ্যমিক পড়াকালীন এমন একটা সময় কাটিয়েছি। রাতে দোকানে যেতে হলে দৌড়ে যেতাম। কোথাও থামলেই হয়তো ভুতে হামলা করবে এই ভয়ে। যত দোয়া আছে সব পড়তাম মনে মনে। সেই ভয় বা আতঙ্ক এখন আর নেই, শুধু স্মৃতিগুলো আছে। ধন্যবাদ শাজাহান ভাই, এই সুন্দর স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। শুভ কামনা রইলো।
আপনার কমেন্টস পড়ে আমি নিজেও নস্টালজিক হলাম। আপনার উৎসাহে আমার লিখা এগিয়ে যাবে। আপনাকে ধন্যবাদ

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

শাহাবৃদ্ধি গ্রামের এক নির্জন পুকুরপাড়ে রাত্রিবেলা পাহারা দিতে গিয়ে এক তরুণ পড়ে যায় ভয় আর কল্পনার ঘূর্ণিতে। চারপাশে তালগাছ, বাঁশঝাড় আর খাল—যা শৈশবের কিচ্ছায় ভূত-পেত্নীর আসর হিসেবে গেঁথে আছে মনে। সঙ্গী রফিক ভাই না আসায় একা রাত কাটাতে হয় তাকে। নিস্তব্ধতার মাঝে মনে হয়, অন্ধকারের ভেতরেই যেন কিছু ওঁত পেতে আছে। ভয় গ্রাস করে ফেলে পুরো শরীর, কিন্তু ফজরের আজান আর দোয়া-দরুদ তাকে ধীরে ধীরে সাহস জোগায়। কালো আঁধার ভাঙতে ভাঙতে আরব আলীর গরুর আগমন সেই আতঙ্ককে মুছে দেয় একেবারে।

১১ আগষ্ট - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ২৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "মুক্তিযুদ্ধ”
কবিতার বিষয় "মুক্তিযুদ্ধ”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৫