শীতল ভোরের আলো যখন ধীরে ধীরে শহরের জানালাগুলোয় প্রবেশ করে, তখনও রীমার চোখে ঘুম আসে না। বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় সে ঘড়ির কাঁটার শব্দ শোনে—টিকটিক টিকটিক। প্রতিটি টিক তার মাথার ভেতর প্রতিধ্বনির মতো বাজে, যেন সময় তাকে তাড়া করছে। অথচ করার মতো কোনো কাজ নেই, কোনো দায়িত্ব নেই, কোনো অগ্রীম পরিকল্পনাও নেই। তবু তার মন ছুটে বেড়ায় এক অদৃশ্য গোলকধাঁধায়, যেখানে চিন্তারা একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে শুধু শব্দ তোলে—ঝনঝন আর গুঞ্জন।
রীমা ভাবছিল—গতকাল প্রতিবেশী আন্টি যে কথাটা বলেছিলেন, তাতে কি সত্যিই কোনো গোপন ইঙ্গিত লুকানো ছিল? কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ সেমিস্টারে ওর প্রেজেন্টেশনে যে ছোটখাটো ভুল হয়েছিল, তার কারণে কি ওর শিক্ষকদের মনে কোনো খারাপ ধারণা রয়ে গেছে? আবার অফিসের কাজ নিয়েও তার ভাবনা থামছে না—একটা ই-মেইলের উত্তর দেওয়ার সময় কি খুব তাড়াহুড়া করে ফেলে এসেছে?
চোখ বন্ধ করলেই চিন্তাগুলো এসে ভিড় করে। শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু মাথা থামে না। যেন মাথার ভেতরে একটা যন্ত্র বসানো আছে, যার সুইচ বন্ধ করার কোনো উপায় তার জানা নেই।
করোনা মহামারির সময় থেকেই এই বাড়তি চিন্তার সঙ্গে রীমার পরিচয়। দীর্ঘদিনের একাকিত্ব, বন্ধ ঘরের চার দেয়ালের ভেতরে কাটানো নিঃশব্দ দিনগুলো তার ভেতরে একটা অদৃশ্য গর্ত তৈরি করেছে। সেই গর্তে জমা হচ্ছে অকারণ আশঙ্কা, অহেতুক দুশ্চিন্তা আর ভয়। সে বুঝতে পারে, সমস্যার জায়গাটা ছোট হলেও চিন্তার ভারে তার আকার হয়ে যায় আকাশসমান।
একদিন বিকেলে রীমার বন্ধু মায়া তাকে ফোন করল।
—“শোন, তুই এতদিন কেনো দেখা দিচ্ছিস না? সব ঠিক আছে তো?”
রীমা একটু দ্বিধা নিয়ে উত্তর দিল,
—“হ্যাঁ… সব ঠিক আছে। শুধু মনটা খুব অস্থির লাগে।”
—“অস্থির কেন? কিছু হয়েছে?”
—“না, কিছু না। মানে… হয়তো আমি বেশি চিন্তা করি। ছোটখাটো বিষয় নিয়েই মাথায় ভিড় জমে যায়। রাতে ঘুম হয় না। মনে হয় কোনো কিছু ঠিকঠাক হচ্ছে না আমার।”
ফোনের ওপাশে মায়া একটু থেমে গিয়ে বলল,
—“শোন, তোকে তো সবসময় সাহসী মনে হতো। এখন এভাবে ভেঙে পড়ছিস কেন? তুই কি কখনো চেষ্টা করেছিস চিন্তা থেকে বের হওয়ার?”
রীমা একটু হেসে বলল,
—“চেষ্টা করি বটে, কিন্তু পারি না। মাথার ভেতরে একই জিনিস বারবার ঘোরে। কখনো মনে হয় আমি কোনো বড় ভুল করেছি, কখনো মনে হয় ভবিষ্যতে কিছু ভয়াবহ ঘটতে চলেছে।”
মায়া নরম গলায় বলল,
—“চিন্তা তো স্বাভাবিক। কিন্তু যখন সেটা বারবার ফিরে আসে আর তোর কাজের ক্ষমতা কেড়ে নেয়, তখনই সেটা অহেতুক হয়ে ওঠে। তুই কি কখনো নিজের পছন্দের কোনো কাজে ডুবে দেখেছিস? যেমন—তুই আগে তো ছবি আঁকতে ভালোবাসতি। আবার শুরু কর না?”
রীমা সেদিন রাতে অনেক ভেবেছিল। সত্যিই তো, শৈশবে রঙের তুলি হাতে নিলেই সে যেন অন্য এক জগতে চলে যেত। কাগজে ফুটে ওঠা নীল আকাশ, সবুজ মাঠ বা লাল শাপলা তাকে প্রশান্ত করত। অথচ বহু বছর হয়ে গেছে, একটিও ছবি আঁকা হয়নি।
পরদিন সকালে সে একটা সাদা কাগজ আর পুরোনো রঙের বাক্স খুঁজে বের করল। প্রথমে হাত কাঁপছিল, কিন্তু তুলি ডুবিয়ে কাগজে ছোঁয়া মাত্র যেন ভেতরের চাপা থাকা দম আটকে থাকা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। রঙের সঙ্গে তার মনও একটু হালকা হলো।
দিনগুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। তবু দুশ্চিন্তা পুরোপুরি ছাড়ল না। মাঝে মাঝে আবারও ফিরে আসত। রাতে ঘুম ভেঙে যেত। তখন সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াত, তারাভরা আকাশের দিকে তাকাত। মনে মনে বলত, “অতীত তো আর বদলানো যাবে না, তবে ভবিষ্যতও তো পুরোপুরি আমার হাতে নয়। তাহলে আজকের দিনটাকে কেন এভাবে নষ্ট করছি?”
একদিন সন্ধ্যায় রীমা তার মায়ের সঙ্গে বসেছিল। মা চুপচাপ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—“বাবা, জানিস তো? মানুষের মনের ভেতরে যত শূন্যতা থাকে, সেখানে তত অযথা দুশ্চিন্তা জমে। মনটাকে কাজে ভরিয়ে রাখতে হয়।”
রীমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—“কিন্তু মা, সবকিছু কি এত সহজ?”
—“সহজ না হলেও চেষ্টা করতে হয়। জীবন তো দুশ্চিন্তার জন্য নয়, জীবন বাঁচার জন্য।”
মায়ের কথাগুলো যেন তার ভেতরে ধীরে ধীরে শেকড় গেড়ে বসতে শুরু করল। সে বুঝল, চিন্তাকে পুরোপুরি মুছে ফেলা যাবে না, তবে তার নিয়ন্ত্রণে বাঁচা সম্ভব। একদিন ঠিক করল, মনের ভেতরের ঝড়গুলো বন্ধুর কাছে খুলে বলবে। মায়াকে ডেকে নিয়ে পার্কে বসে সব বলে দিল। মায়া মন দিয়ে শুনল, আর শেষে বলল,
—“দেখ, তোকে আমি একটা কথা মনে করিয়ে দিই—চিন্তা তোকে নিয়ন্ত্রণ করবে না, তুই চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করবি। এই কথা ভুলবি না।”
সেদিনের পর থেকে রীমা ছোট ছোট নিয়ম বানিয়ে নিল নিজের জন্য। কাজের মাঝে সময়মতো বিরতি নিত, রাতে ঘুমানোর আগে ডায়েরি লিখত, প্রতিদিন অন্তত আধাঘণ্টা আঁকাআঁকি করত। কোনো সমস্যা মনে এলেই ভেবে বসে না থেকে লিখে ফেলত কাগজে। তারপর ভাবত, সমাধান কী হতে পারে। আর যদি সমাধান এখনই সম্ভব না হয়, কাগজ ভাঁজ করে ড্রয়ারে রেখে দিত। যেন সে চিন্তাকে আটকে রাখছে এক টুকরো কাগজের ভেতরে।
ধীরে ধীরে রীমা অনুভব করল, তার মাথার ভেতরের ভার হালকা হয়ে আসছে। আগে যেখানে ঘুমের শত্রু ছিল দুশ্চিন্তা, সেখানে এখন ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকার তাকে আলিঙ্গন করে নেয়। সকালবেলায় উঠে জানালার বাইরের আলো তাকে আর তাড়া করে না, বরং নতুন দিনের জন্য আশীর্বাদের মতো মনে হয়।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
শীতল ভোরের আলো যখন ধীরে ধীরে শহরের জানালাগুলোয় প্রবেশ করে, তখনও রীমার চোখে ঘুম আসে না।
১১ আগষ্ট - ২০২৩
গল্প/কবিতা:
২৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ অক্টোবর,২০২৫