নীলনকশা পরগাছার

পরগাছা (আগষ্ট ২০২৫)

মোহাম্মদ শাহজামান
  • 0
  • 0
  • ৩৪
গভীর বর্ষার রাত। অফিসপাড়া ফাঁকা হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু জেলা ভূমি অফিসের তৃতীয় তলার ছোট কক্ষে এখনো আলো জ্বলছে।
সেই আলোয় বসে আছে জয়নাল মাস্টার।
তার চোখে অস্থিরতা। ফাইলের উপর রাখা হাতদুটো ঘেমে গেছে।
দুই মাস ধরে দৌড়াচ্ছেন। পৈতৃক ভিটায় ঘর তুলবেন, তাই খতিয়ান ঠিক করাতে এসেছেন। সারাদিন লাইনে দাঁড়ানো, নোটিশ শোনা, জমি মাপজোক – সবই শেষ। শুধু শেষ অনুমোদনের সিলটাই বাকি।
তিন সপ্তাহ ধরে কর্মকর্তা হারুন সাহেব ফাইলটা নিজের টেবিলে আটকে রেখেছেন।
প্রতিদিন বলেন,
– আপনার কাগজে এক জায়গায় সমস্যা আছে। কাল আসেন।
– ও মাপজোকের কাগজে ভুল আছে। পরশু আসেন।
– আরও কিছু লাগে, পিয়নকে জিজ্ঞেস করেন।
আজ রাতেও অফিসে গিয়ে দেখলেন হারুন সাহেব বসে আছেন। ফাইল খুলে দেখে বললেন,
– মাস্টার সাহেব, কাজ হয়ে যাবে। তবে কিছু তো খরচাপাতি লাগে।
– কত লাগবে স্যার?
হারুন সাহেব মুচকি হাসলেন।
– এইটুকু কাজ… ২০ হাজার লাগবে। নইলে ফাইল যাবে না। এখানে সবাইকে দিতে হয়।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল জয়নাল মাস্টারের। স্কুলে ৩০ বছরের চাকরি, এখনও এক লাখ টাকার ঋণ আছে। তবু নতজানু কণ্ঠে বললেন,
– স্যার, কমানো যাবে না?
– উঁহু। এটাই নিয়ম। নাহলে ফাইল ফ্রিজ থাকবে মাসের পর মাস।
জয়নাল মাস্টার বোঝেন, কোনো ভুল নেই। কাগজপত্র ঠিক। তবু ইচ্ছাকৃতভাবে ফাইল আটকে রাখা হয়েছে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তার উপার্জনের অংশ লুটে নেওয়ার জন্য। তিনি জানেন, অফিসের কর্পূরের মত সাদা পাঞ্জাবি পরা এই কর্মকর্তা পরগাছা। Mistetoe-এর মত সে অন্য গাছের ডালে জন্মায় না; জন্মায় মানুষের জীবনের উপরে। যেমন Mistletoe গাছের রস শুষে নেয়, তেমনি এরা মানুষের ঘাম, শ্রম আর স্বপ্ন শুষে নেয়।
শুধু হারুন সাহেব নয়।
গ্রামে ওয়ারিশ সনদ নিতে গেলে চেয়ারম্যানের দালাল এসে বলে,
– কিছু খরচাপাতি দিলে সই হবে।
বাজারে সুদখোর মকবুল মিয়া রোগীর চিকিৎসার জন্য পাঁচ হাজার ধার দিয়ে মাসে হাজার টাকা সুদ নেন। কোনোদিন শোধ না হলে আসল টাকাই পাঁচ বছরে পাঁচ গুণ হয়ে যায়।
জমি রেজিস্ট্রি অফিসে গেলেই শোনে,
– দাদা, কাগজে খুঁত আছে। একটু চা-পান খরচ লাগবে।
এরা সবাই পরগাছা। কোনো পণ্য উৎপাদন করে না, কোনো সেবা তৈরি করে না, শুধু কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মানুষের রক্ত শুষে খায়।
পরগাছা কখনো পোষককে খায় না, কিন্তু একসময় তাকে শুকিয়ে ফেলে। হারুন সাহেব জানেন, এই মাসে ১০ জন থেকে ২০ হাজার টাকা করে নিলে তার দুই লাখ আয় হয়ে যাবে। অথচ কোনো কাজই নতুন করে করছেন না, কেবল ফাইল আটকে রাখার খেলা খেলছেন।
মকবুল মিয়াও জানে, সুদের চাপে কৃষকের গরু যাবে, জমি যাবে, শেষমেশ কৃষকও চলে যাবে – শুধু সুদখোরই বেঁচে থাকবে, অন্যের রক্তে সজীব পরগাছার মত।
মহাপুরুষরা বলেন, সমাজে উৎপাদক, ভোক্তা এবং পরগাছা থাকে। উৎপাদকরা শ্রম দিয়ে খাদ্য তৈরি করে, ভোক্তারা সেই খাদ্য গ্রহণ করে, আর পরগাছারা শুধু শোষণ করে। Mistetoe গাছ যেমন কখনো ফুল ফোটায়, কখনো ফল ফলায়, তবু তার মূল কাজ অন্য গাছকে নিঃশেষ করা।
মানুষের সমাজের পরগাছারাও তাই। মিষ্টি কথার ফুল ফোটায়, চায়ের টেবিলে সস্তা জ্ঞানের ফল ফলায়, কিন্তু হৃদয়, পকেট, স্বপ্ন – সব শুষে নেয়।
রাত সাড়ে দশটা। ফাইল হাতে মাস্টার সাহেব বের হলেন। ফাইল হয়ে গেছে। তবে হারুন সাহেবের টেবিলের ড্রয়ারও ভরে গেছে।
ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাস্টার সাহেব আকাশের দিকে তাকালেন। বিদ্যুতের তারে তারে Mistetoe লতার মত ঝুলে আছে অসংখ্য মানুষ। তারা কারো ডালে জন্মায়নি, জন্মেছে অন্যের শ্রম আর কষ্টের উপরে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

গভীর বর্ষার রাত। অফিসপাড়া ফাঁকা হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু জেলা ভূমি অফিসের তৃতীয় তলার ছোট কক্ষে এখনো আলো জ্বলছে।

১১ আগষ্ট - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ২৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "প্লেন ক্র্যাশ”
কবিতার বিষয় "প্লেন ক্র্যাশ”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ আগষ্ট,২০২৫