ভয় আর আতঙ্কের একটি দেশ

আতঙ্ক (নভেম্বর ২০২৫)

এম. আব্দুল কাইয়ুম
  • 0
  • ১৪
ছোট দিনের সময় রাতটা ছিল ভারি, যেন শহরের ওপর কেউ একটা কালো চাদর বিছিয়ে দিয়েছে।
টিনের ছাউনি বেয়ে বৃষ্টি পড়ছিল, কিন্তু শব্দটা অস্বাভাবিকভাবে চাপা। কেমন জানি একটি ভয়ে বুকের ভিতরে ক্ষেপে ওঠে। কিছু না বলে এগিয়ে যায় রফিক। দরজা বন্ধ করছিল দোকানের। ছোট্ট মুদি দোকান, কিন্তু এলাকার মানুষ তাকে ভালোবাসত। হাসিখুশি মানুষ।
আজ হঠাৎই মনে হলো এমন করে—কেউ যেন তাকে দেখছে।
পেছনে তাকাতেই সাদা পোশাকের দু’জন মানুষ দেখা গেল।
একজন এগিয়ে এসে বলল,
“আপনি কি রফিক?”
রফিক উত্তর দেয়ার আগেই মুখে কাপড় চেপে ধরা হলো।
গাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ, তারপর সব অন্ধকার।

রাতে অপেক্ষার পরে হঠাৎ ঘুমিয়ে যায় সেলিনা। রফিকের বোন সেলিনা ভোরে জেগে দেখল, রফিক ঘরে ফেরেনি। রাতের খাবার যেমন ছিল তেমনই পড়ে আছে। ফোন বন্ধ, কোথাও কোনো খবর নেই। এলাকায় আশে পাশে খবর করে কোথায় পাওয়া গেল না।

থানায় গেলে অফিসার বলল,
“মিসিং পারসন রিপোর্ট করতে পারেন, তবে বেশি হৈচৈ করবেন না।”
তার কণ্ঠে একধরনের শীতল হুমকি।

বাড়ি ফেরার পর সেলিনা বুঝল, পাড়া নিঃশব্দ হয়ে গেছে।
পাশের বাড়ির রুবিনা চোখ নামিয়ে নিল, দেলোয়ার ভাই দরজা বন্ধ করে দিলেন।
ভয় যেন ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে—অদৃশ্য অথচ স্পষ্ট।

একটি অন্ধকার ভবনের বেসমেন্টে তিনজন অফিসার বসে আছে।
সামনে বড় স্ক্রিনে কিছু নাম ও ছবি—
একজন বলে,
“এই নামগুলো অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি। রফিক নামের লোকটা বেশ কিছুদিন ধরে শ্রমিক ইউনিয়নে সক্রিয় ছিল।”

আরেকজন ঠাণ্ডা গলায় বলে,
“অর্ডার এসেছে—‘নিষ্ক্রিয়’ করতে।”

রেকর্ডে একটি লাল দাগ টানা হয়।
রফিকের নাম মুছে যায়,
শুধু ফাইল নম্বরটা থেকে যায় : ০৭-১৩-র।

দশ দিন পর রাতে ফোনটা বেজে উঠল। সেলিনা ধরতেই অপর প্রান্তে রফিকের ক্ষীণ কণ্ঠ—
“আমি বেঁচে আছি... কিন্তু বেশি কিছু বলো না... ওরা সব শুনছে।” তবে শুনো আমি একা নয়, আরো কত শত মানুষ গোপনে বন্দি আছে।

লাইন কেটে গেল। তারপরই বাইরে গাড়ির শব্দ।
সেলিনা জানালার পর্দা নামিয়ে দিল, বুকের ভেতর কাঁপুনি।

পরদিন ভোরে খবর এল—
নদীর ঘাটে এক মরদেহ পাওয়া গেছে। চোখ বাঁধা, শরীর ক্ষতবিক্ষত।
“অজ্ঞাত ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সন্দেহ।”

সেলিনা চিনে ফেলল আঙুলের আংটি দেখে। চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।
সেই দিন থেকে শহরটা বদলে গেল। কেউ আর প্রশ্ন করে না।
মানুষ নিজের দরজা বন্ধ করে, খবরের কাগজ পড়েও কিছু বলে না।

টেলিভিশনে বলা হয়—
“রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে জড়িত এক জঙ্গি অপরাধীর মৃত্যু।”

কিন্তু সেলিনা জানে, রফিক কখনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ছিল না—
সে কেবল ন্যায়ের পক্ষে ছিল। তার কোনো দুষ নেই।

একদিন রাতে সেলিনা গোপনে কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করল—
যাদের প্রিয়জনও “নিখোঁজ”। তারা ঠিক করল, ভয় পাবে না আর।

ভয় যখন রাষ্ট্র হয়ে যায়, তখন নীরবতাই অপরাধ।

তাদের লক্ষ্য একটাই—
সত্যকে ফিরিয়ে আনা, যদিও সেই পথে মৃত্যুই শেষ গন্তব্য।

“ভয় কোনো অস্ত্র নয়, ভয় হলো রাষ্ট্রের ছদ্মবেশ।
যখন মানুষ তা চিনে নেয়, তখনই শুরু হয় বিপ্লব।”

এক অন্ধকার সন্ধ্যায় শহরের উপকণ্ঠে একটা পুরনো গোডাউনে জড়ো হয়েছিল কয়েকজন মানুষ। সবার মুখে ক্লান্তি, চোখে আগুনের মতো শোক।

সেলিনা বলল,
“আমরা ভয় পেয়েছিলাম, তাই ওরা পার পেয়ে গেছে।
এখন ভয়কেও ভয় দেখাতে হবে।”

আরেকজন বলল,
“কিন্তু তারা সর্বশক্তিমান। ওরা সেনাবাহিনী, সরকার, আইন—সব।”
সেলিনা শান্ত গলায় উত্তর দিল,
“না, তারা শুধু ভয়। ভয় যদি আমরা না মানি, ওরা অস্তিত্ব হারাবে।”

তারা ছোট্ট একটি সংগঠন গঠন করল —
“নীরব পাখির কণ্ঠ”।
লক্ষ্য: নিখোঁজদের তালিকা প্রকাশ করা, সত্য লিপিবদ্ধ করা, এবং ন্যায়ের দাবি জানানো।

রাজধানীর একটি অফিসে বসে এক কর্মকর্তা মনিটরে সিসিটিভি ফুটেজ দেখছিল।
সেলিনার মুখ দেখা গেল, গোডাউনের বাইরে বের হচ্ছে।

“ওই মহিলা সক্রিয় হয়েছে,” অফিসার বলল।
পাশেরজন জবাব দিল,
“তাহলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ওর কণ্ঠ থামিয়ে দিতে হবে।”

কিন্তু এবার সব সহজ ছিল না। সেলিনারা সাবধান ছিল।
তারা মোবাইল বন্ধ রাখত, ছদ্মনামে চলত, বার্তা পাঠাত হাতের লেখা চিরকুটে।

ভয়ের রাজ্যে এখন ভয় জন্ম নিচ্ছিল উল্টো দিকেও—
সরকারি বাহিনীর অফিসারদের মনেও, কারণ তারাও জানত, সত্য কখনও মরে না।

এক রাতে বিদেশি এক সাংবাদিকের কাছে পৌঁছে গেল একটি গোপন ফাইল।
ভেতরে ছিল ডজনখানেক ছবি —
অন্ধকার ঘর, বাঁধা মানুষ, এবং এক অফিসার মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ছবিগুলো প্রকাশ হলো আন্তর্জাতিক সংবাদে।
সারা দেশ কেঁপে উঠল।
সরকার অস্বীকার করল, বলল “ভুয়া প্রচারণা।”
কিন্তু মানুষ বুঝে গেল — ভয়ের দেয়ালে প্রথম ফাটল ধরেছে।

এক ভোরে বাড়ি ঘিরে ফেলল গাড়ি। সেলিনাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হলো।
তদন্ত কক্ষে একজন অফিসার বলল, “তুমি জানো না, আমরা কারা?”

সেলিনা হাসল—
“জানি। তোমরা মানুষ নও, ভয়।
আর ভয়কে আমি চিনে ফেলেছি।”
সেলিনা হাসল—
“জানি। তোমরা মানুষ নও, ভয়।
আর ভয়কে আমি চিনে ফেলেছি।”

সেই হাসিটা তাদের অসহ্য লেগেছিল। কিন্তু বাইরে তখন মানুষ রাস্তায়।
“নিখোঁজ রফিকের বোনকে মুক্তি দাও”—
স্লোগান উঠছে, প্রথমে দশজন, পরে শত শত মানুষ একসঙ্গে। আর নয় ভয়, সত্যকে করো জয়।

তিন দিন পর সেলিনাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো তারা। কারণ শহরে বিদ্রোহের গন্ধ ছড়িয়ে গেছে।

মানুষ আবার কথা বলা শুরু করেছে। ভয় আর আগের মতো কাজ করছে না।
কেউ কেউ বলছে, “ভয়ই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে।” সরকারী বাহিনীর গুলিতে হাজারও ছাত্র জনতার লাশ। তবেও উত্তাল রাজধানীসহ সারা দেশ।

রাতে সেলিনা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল।
তার মনে হলো, রফিক দূর কোথাও থেকে দেখছে।
সে চুপচাপ বলল—
“তুমি ঠিকই বলেছিলে, ভয় কখনো বাইরে আসে না।
কিন্তু যখন আমরা কথা বলি, ভয় মরে যায়।”

“একদিন এই দেশ আবার জেগে উঠবে,
যেখানে ভয় থাকবে না, শুধু মানুষের কণ্ঠ থাকবে—
সত্যের মতো উজ্জ্বল, রক্তের মতো জীবন্ত।”

তরুণ ছাত্র জনতার আহবানে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায়। দাবি একটাই। সৈরাচারের পতন, সত্যের বিজয়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী ঋদ্ধ অনুভূতির চমৎকার উপস্থাপন। মুগ্ধতা রইলো।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

মানুষ আবার কথা বলা শুরু করেছে। ভয় আর আগের মতো কাজ করছে না। কেউ কেউ বলছে, “ভয়ই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে।” সরকারী বাহিনীর গুলিতে হাজারও ছাত্র জনতার লাশ। তবেও উত্তাল রাজধানীসহ সারা দেশ।

২২ জুলাই - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ৩৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "মুক্তিযুদ্ধ”
কবিতার বিষয় "মুক্তিযুদ্ধ”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৫