চাপা দীর্ঘশ্বাস

শীতের সকাল (জানুয়ারী ২০২৪)

রুমানা নাসরীন
  • 0
  • ৪৪
--বাবা, আমি কি মরে যাচ্ছি?
গভীর ঘুমের মধ্যে বিরবির করে বললো অনু। সুমন রায় কোন জবাব না দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। আজ সকালেই তার একমাত্র পুত্র প্রীতমকে দাহ করে আবার ছুটে এসেছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেখানে তার একমাত্র কন্যা অনু চিকিৎসাধীন রয়েছে। সুমন রায়ের শূন্য দৃষ্টি দেখে বোঝার উপায় নেই তার মনের ভিতর কী গভীর তোলপাড় চলছে। তার স্ত্রী শুক্লা পুত্র হারানোর শোকে এখনো অচেতন রয়েছেন। সুমন রায়ের মন বলছে এই 'বাবা' ডাকটা তার জীবনে আর কখনও শোনা হবে না, জীবন থেকে চিরতরে হারিয়েই যাবে। তার প্রিয় ঋতু শীত যে এভাবে তার জীবনে হাহাকার এনে দিবে ভাবতে পারেনি। প্রকৃতিপ্রেমী সুমন রায়ের চোখে কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া মেঠোপথগুলোকে খুব বেশি রহস্যময় মনে হতো। মনে হতো দূর গ্রহ থেকে আসা ঠিক যেন কোন ভীনদেশী প্রাণি। প্রতিটা শীতের সকাল বাবা ছেলের শুরু হতো অদ্ভুত এক রহস্যময়তা দিয়ে। আট বছরের ছোট্ট প্রীতমও বাবার মতো প্রকৃতিপ্রেমী। মায়ের হাজার বারণ সত্বেও রোজ সকালে বাবার হাত ধরে কুয়াশার গাঢ় চাদর ভেদ করে ঘুরে বেড়ানো তার ভীষণ প্রিয়। শীতের সকালের টাটকা খেজুর রসের ভুবন ভোলানো স্বাদে পৃথিবীটা আরও বেশি মায়াবী মনে হয় বাবা ছেলের কাছে। কিন্তু এই মায়াবী পৃথিবী তার মায়ায় বেশিদিন জড়িয়ে রাখতে পারলো না প্রীতমকে। মাত্র তিনদিনের জ্বরে পৃথিবীর মায়ার চাদর ছিঁড়ে প্রীতম চলে গেছে ওই ওপারে, অন্য আরেক রহস্যের জগতে। শুধু প্রীতমই নয়, গত পাঁচদিনে প্রায় পনেরোজন মৃত্যুবরণ করেছে এই অজানা জ্বরে, অজ্ঞাত অসুখে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে আরও অনেকেই। তবে এখন পর্যন্ত কারও সুস্থ হয়ে ফিরে আসার কথা শোনা যায়নি। উত্তরের জেলা লালমনিরহাটের এক শান্তিপূর্ণ উপজেলা হাতীবান্ধা যেনো হঠাৎ পরিনত হয়েছে মৃত্যুপূরীতে। এলাকার প্রতিটি মানুষ আজ আতঙ্কিত, কেউ কেউ তো বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যাচ্ছে। সবার মধ্যে জীবন বাঁচানোর এক অন্যরকম প্রচেষ্টা। ঢাকা থেকে আজ দশ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ টিম এসেছিল। সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে তারা বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে গেছেন। হয়তো দু একদিনের মধ্যে জানতে পারা যাবে এই অজ্ঞাত মৃত্যুর কারণ। কিন্তু বাইরের জগতের কোন কিছুতেই যেন সুমন রায়ের কিছু আর যায় আসে না। তার বুকের খুব গভীরে একটা অজানা আশংকা, একটা অজানা ভয় বারবার নড়েচড়ে বসছে। এই আশংকা তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে সবকিছু কেমন অবশ করে দিচ্ছে। অবশ করে দিচ্ছে তার চিন্তাশক্তি। জাগতিক কোন আকর্ষণ, কোন বিষয় আর তাকে টানছে না। সন্তান হারানোর শোক বুঝি এমনই হয়!

সকালে একমাত্র পুত্রের শেষকৃত্য সম্পন্ন করার পর সুমন রায় জানতে পারেন তার একমাত্র কন্যা অনুরও জ্বর এসেছে। আর কোন ভাবনা চিন্তা না করেই ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে ছুটে এসেছেন উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুরে। চিকিৎসকেরা সাধারণ জ্বরের চিকিৎসাই দিয়ে যাচ্ছেন। তাদেরই বা কি করার আছে? অজ্ঞাত অসুখ সম্পর্কে গবেষণালব্ধ কোন চিকিৎসা আবিষ্কার করা তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আসলে সৃষ্টিকর্তার রহস্য বোঝার ক্ষমতা তো মানুষের নেই। তিনি না চাইলে কোনকিছুই সহজ হবে না।

তৃতীয় দিনে অনুর অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাওয়ায় তাকে তড়িঘড়ি করে আইসিইউতে নেয়া হলো। হাসপাতালের করিডোরে অনুর মায়ের বিলাপে আকাশ বাতাস সব যেনো ভারি হয়ে এলো। সুমন রায়ের শূন্য দৃষ্টি বোধহয় আরও শূন্য হয়ে গেলো। একই রকম উপসর্গ নিয়ে আরও অনেকেই ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। অজানা জ্বরের আতংক ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। সাধারণ সর্দি জ্বরেও অনেকেই আতংকিত হয়ে পড়ছে। চর্তুথ দিনে সকালে অনুর নিথর দেহ নিয়ে তার পরিবার বাড়ি ফিরল। এলাকায় শোকের মাতম। প্রাণনাশি ছোঁয়াচে রোগ ভেবে অনেকে ঘরের ভিতর লুকিয়ে থাকছে। কেউ বা জীবনের মায়া ত্যাগ করে ছোট্ট নিষ্পাপ পুতুলের মতো মেয়েটাকে একবার শেষ দেখা দেখার জন্য ছুটে আসছে। মাত্র চারদিনের ব্যবধানে যে বাড়িতে দুটো শিশুর মৃত্যু হয় সেই বাড়ির পাখিরাও বুঝি হাসতে ভুলে যায়। বিকেলের দিকে স্থানীয় প্রশাসনের তত্বাবধানে এলাকায় মাইকিং করে জানিয়ে দেয়া হলো বিশেষজ্ঞ টিমের পাঠানো সতর্কবার্তা। এক বিশেষ ধরনের ভাইরাসের কারণে এই মৃত্যুর মিছিল। ভাইরাসটির নাম নিপাহ ভাইরাস। যা সাধারণত পাখির লালার মাধ্যমে বিশেষ করে বাঁদুরের লালার মাধ্যমে ছড়ায় এবং শীতকালে এর প্রকোপ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। খেজুরের রস, পাখি বা বাঁদুর কামড়ানো ফল মূল খেলে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। তাই খেজুরের রস না খেতে এবং টাটকা ফলমূল পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে খেতে পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞ দল। এটি কোন ছোঁয়াচে রোগ নয় জানার পর জনমনে কিছুটা স্বস্তি এলো। তবে শোকের বাতাস যেনো আজীবনের জন্য বন্দী করে দিলো সেই পরিবারগুলোকে যারা হারিয়েছে তাদের প্রাণের স্পন্দন।

৪ জানুয়ারি,২০২৩ খ্রীস্টাব্দ; সুমন রায় আজ এক যুগ পর ঝাপসা চোখে শীতের সকাল দেখছেন। শিশিরের ফোঁটাগুলো তার কাছে বড্ড অপরিচিত লাগছে। এই একযুগে এলাকার অনেক চিত্র পালটে গেলেও শীত ঠিক আগের মতোই তার কুয়াশার জাল বিছিয়ে রেখেছে। কিন্তু সুমন রায়ের বুকের চাপা দীর্ঘশ্বাসটি তেমনই রয়ে গেছে। এই দীর্ঘশ্বাস শীত কিংবা গ্রীষ্মের মতো কখনও রূপ পালটায় না। সুমন রায়ের ঝাপসা চোখ ধীরে ধীরে প্রকৃতিকে আরও ঝাপসা করে দিচ্ছে, আরও বেশি ঝাপসা.......
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী অতুলনীয় সুন্দর অনুভূতির উপলব্ধি অসাধারণ প্রকাশ মুগ্ধতা অপরিসীম শুভকামনা অবিরত।
ভালো লাগেনি ১১ জানুয়ারী, ২০২৪
আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
ভালো লাগেনি ১৩ জানুয়ারী, ২০২৪
Faisal Bipu আরও বেশি ঝাপসা........
ভালো লাগেনি ২ জানুয়ারী, ২০২৪
আন্তরিক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ৩ জানুয়ারী, ২০২৪

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

শীতের সকালে এক সন্তানহারা পিতার ব্যাথাতুর স্মৃতিচারণ বিষয়ের সাথে যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে আমি মনে করি।

০৮ জুলাই - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪