আমাদের আব্বা

বাবা (জুন ২০২৩)

শাওন আহমাদ
  • ১০
  • 0
  • ১৬
আমি আমার আশেপাশে বাবা-ছেলেদের যে মধুর সম্পর্ক দেখে বড় হয়েছি,আমাদের সাথে আমাদের আব্বার এমন সম্পর্ক কল্পনা করাও ছিলো কল্পনাতীত। যে মানুষটার গলার শব্দ শুনে আমাদের প্রাণবায়ু বের হয়ে যাবার উপক্রম হতো, যার চোখের চাহনীতে আমাদের শিড়দাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যেতো, তাঁর সাথে আমাদের মধুর সম্পর্ক হওয়াটা সত্যি কল্পনাতীত'ই ছিলো বটে। আমরা আমাদের আব্বাকে এতোটাই ভয় পেতাম যে আমাদের সম্পর্ক ছিলো চিল আর মুরগির ছানার মতো। মুরগির ছানারা যেমন চিলের আনাগোনা পেলে দৌড়ে গিয়ে মায়ের ডানার নিচে লুকায়, আমরাও তেমন বাবার সাড়াশব্দ পেলে দৌড়ে গিয়ে মায়ের আঁচলের নিচে মুখ লুকাতাম বা বাড়ির এমন কোনো জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতাম; যেখানে আব্বা খুব একটা যেতেন না।

এই ভয়ের কারণেই আব্বার সাথে আমাদের দূরত্ব ছিলো ঢের।আমাদের কাছে আমাদের আব্বার উপস্থিতি আনন্দের চেয়ে ভয়েরই ছিলো বেশি। আব্বা তাঁর ব্যবসার কাজ ছাড়া যতোটা সময় বাসায় থাকতেন এই পুরোটা সময় আমাদের শ্বাস বন্ধ হবার জোগাড় হয়ে থাকতো। ভয়ে আমরা পড়ার টেবিলে বা অন্য কোনো জায়গায় জড়সড় হয়ে বসে থাকতাম। সারা বাড়ি জুড়ে তখন মৃত্যু শোকের মতো নীরাবতা বিরাজ করতো। আমরা সাধারণ বিষয় নিয়েও আব্বার সাথে নিজে থেকে কথা বলতাম না। আমাদের কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে মায়ের কাছে জানাতাম, মা আব্বার কাছে বলে সেগুলো আদায় করে দিতেন।

আমাদের লেখাপড়ার প্রথম টিচার আব্বাই ছিলেন, অক্ষর চিনানো হাতে ধরে লেখা শিখানো সব আব্বার কাছ থেকেই হয়েছে। অবশ্য আব্বার কাছে পড়তে বসলে যতোটা না আমরা পড়তাম তার চেয়ে বেশি ভয়ে কাঁপতাম; একটু এদিক রেখে ওদিক হলেই ঠাস ঠাস পড়তো গালে। পড়ালেখার বাইরে কোনো অপরাধ করলে তার শাস্তি আরও ভয়ংকর ছিলো। আমরা তখন মায়ের ডানার নিচে গিয়ে লুকাতাম। মা আমাদের বুক দিয়ে আগলে রাখতেন আর সমস্ত ঝড় তার উপর দিয়ে যেতো। ঝড়ঝাপটা শেষে প্রকৃতি শান্ত হয়ে গেলে আমারা ডানার নিচ থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক চলে যেতাম।

আব্বার কথা ছিলো একটাই, খাওয়া ঘুম আর পড়া। এর বাইরে কিছুই করা যাবেনা। সপ্তাহে একদিন মানে শুক্রবারেও কখনো আমরা আব্বার কাছ থেকে টেলিভিশন দেখার অনুমতি পেতাম না। সন্ধ্যায় আলিফ-লায়লা দেখতে না পারার আফসোস নিয়ে আমরা পড়ার টেবিলে বসে থাকতাম; কিন্তু পড়াশোনা কিছুই হতোনা কারণ তখন মন বিচরণ করতো আলিফ-লায়লা জুড়ে। শুক্রবারও যথারীতি আমাদের দিন শুরু হতো শাসন আর পড়াশোনা দিয়ে, সপ্তাহে একদিন যে বেলাকরে ঘুমাব তার যো ছিলো না। আমার আব্বার ভয়ে পাড়ার ছেলে-পেলেরাও আমাদের সাথে মিশত না খুব একটা। যদিওবা কেউ ভয়ে ভয়ে আমাদের কাছে আসতো; কিন্তু আব্বার কন্ঠ শুনলেই ভোঁ দৌড় দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচত, সে বেলায় আর তার ছায়াকেও আমাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখা যেতো না। আব্বা যখন তার ব্যবসার কাজে কিছুদিনের জন্য দূরে কোথাও যেতেন আমরা তখন আমাদের নিজস্ব রাজ্যের রাজা বাদশা হয়ে যেতাম, আমাদের আকাশে তখন ঈদের চাঁদ দেখা দিতো; দিনমান খেলাধুলা আর লাফালাফিতে ব্যতিব্যস্ত থাকতাম আমরা। তিনি বাসায় ফিরে এলেই সব আবার আগের মতো রঙহীন আর মৃত্যুশোকে ছেয়ে যেতো।

আব্বার নীল রঙের একটা সুজুকি মটরসাইকেল ছিলো, এর শব্দ ছিলো অন্য সব মটরসাইকেলের চেয়ে আলাদা। আব্বা যখন মটরসাইকেল নিয়ে বাসায় আসতেন আমরা মটরসাইকেলের শব্দ শুনে সুবোধ ছেলের মতো শান্ত হয়ে পড়ার টেবিলে বসে থাকতাম; কিন্তু আমরা ডালে ডালে চললে আব্বা চলতেন পাতায় পাতায়। মাঝেমাঝে আমাদের পরীক্ষা করার জন্য আব্বা অফিসে মটরসাইকেল রেখে বাসায় আসতেন; আর এসেই যদি আমাদের এলোমেলো দেখতেন শুরু হয়ে যেতো ধুমধাম। অবশ্য অন্য ভাইয়েদের চেয়ে আমি ভাগে সবসময়ই কম পেতাম; কারণ আব্বা বলতেন আমার চোখের দিকে তাকালে নাকি তার মায়া হয় খুব এ জন্যই আমি বরাবর বেঁচে যেতাম। যদিও আমি আমার কোটেরে ঢোকা ডার্ক-সার্কেল পরা চোখে মায়ার ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাইনা কখনো।

আব্বা আসলে এসব করতেন কারণ তার বাচ্চারা যেনো অন্য বাচ্চাদের চেয়ে আলাদা হয়, তার বাচ্চারা যেনো সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ পায়। আমাদের জন্যই তিনি দিনরাত খাটতেন; কিন্তু ছোটবেলায় বাবা কে ভয় পাবার কারণে আমাদের মাথায় তাকে অন্যভাবে দেখা ছাড়া আর কিছু কাজ করত না। যেদিন সকালবেলা আব্বা মারা গেলেন, মা আমাদের জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। আমরাও মায়ের সাথে গলা মিলিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলাম। যাকে আমরা সবমসময় চাইতাম দূরে থাক সেই মানুষটাই যখন চিরতরে দূরে চলে গেলো তখন তাকে ছাড়া কিভাবে বেঁচে থাকবো এই ভেবেই হাউমাউ করে কাঁদছিলাম,এতোগুলো বছর পরেও কাঁদি।

বাবারা আসলে এমনই হয় তারা খুব একটা ভালোবাসা প্রকাশ করেন না। তারা বুকে ভালোবাসা জমিয়ে রেখে সন্তানের জন্য ভবিষ্যৎ গড়ায় ব্যস্ত থাকেন। আমার আব্বাও তাই করতেন। আমাদের এমনও দিন গিয়েছে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ আমাদের আব্বার সাথে দেখা হতো না। তিনি তার ব্যবসার কাজ নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকতেন যে, আমরা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পর তিনি বাসায় আসতেন; আবার ভোরবেলা আমাদের ঘুম থেকে উঠার আগেই বাইরে চলে যেতেন। এই সকল পরিশ্রম, আরাম-আয়েশ বিসর্জন সব আমাদের ভালো রাখার জন্যই করতেন। তখন আব্বার অনুপস্থিতি আমাদের মনে ভালো লাগার সঞ্চার করলেও এখন তার সেইসব দিনের ত্যাগের কথা হৃদয় পটে উঁকি দিলেই বিষাদে বুক ভারী হয়ে যায়, আঁখি যুগলে ঘোর বর্ষা নামে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী খুব সুন্দর হয়েছে। তবে বেশি বেশি পড়তে হবে। এখানে ভালোভালো লেখকদের প্রচুর গল্প আছে। খুঁজে পড়ে দেখতে পারেন। শুভ কামনা রইল সবসময়।।
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
ফয়জুল মহী নিটোল ভাবনায নিপুণ কলমের লিখনশৈলি। ভালো লাগা এবং ভালোবাসা নিবেদন করলাম।
অসংখ্য ধন্যবাদ! আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
মোঃ মাইদুল সরকার আপনার বাবার জন্য জান্নাত কামনা করছি। ভাল থাকুক সকল বাবা। ভোট রইল।
আমীন, ধন্যবাদ ভাইয়া আপনার মন্তব্যের জন্য। ভাইয়া একটা প্রশ্ন, আপনি কি সামহোয়্যার ইন এর মাইদুল সরকার?
বিষণ্ন সুমন ঠিক যেন আমার বাবারই গল্প। আসলে বাবারা সব একই হয়। তাই বাবা হারানোর কষ্টটা একই হয়। দোওয়া করি বাবারা ওপারে ভালো থাকুন।
ধন্যবাদ ভাইয়া আপনার মন্তব্যের জন্য। আমাদের গল্পগুলো ঘুরেফিরে প্রায় এক জায়গায় এসেই মিলে যায়। আপনার বাবার জন্যে দুআ রইলো।
mdmasum mia বাবা নেই , কিছু নেই।
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ! সত্যিই বাবা ছাড়া জীবন প্রতিকূলতায় ঘেরা।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

একজন বাবার গল্প

১৮ মে - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪