বাবার স্বপ্ন

বাবা (জুন ২০২৩)

Mohammed Monjur Alam
  • 0
  • ৩৪
বাবা কে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি
প্রতি সপ্তাহেই আসতে হয়, কখনো কখনো সপ্তাহে দুই বার আসি, হাসপাতালের সাথে নিবিড় একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে নিত্য আসা যাওয়া! হুইল চেয়ারে বসা বাবা, ভাবলেশহীন দেহটা, কথাও বলতে পারেননা। শুধু ইশারা ইঙ্গিতে বুঝায়, কখনো কখনো নিজে নিজে কান্না করে। আজ বাবার মাথায় সিটি স্ক্যান করাবেন ডাক্তার। সেই জন্য একটু সকাল সকাল চলে আসছি।
সিটি স্ক্যানের জন্য অপেক্ষা, একটু পরে ডাক আসলো, মাহাবুবুর রহমান, বাবা কে হুইল চেয়ার সহ সিটি স্ক্যান রুমে নিয়ে যাই,তারপর ধরধরি করে সিটি স্ক্যান মেশিনের প্লেটে শুয়াই দিয়ে আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।

বাবা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো, মধ্যবৃত্ত পরিবার আমাদের, মা বাবা আর তাদের একমাত্র সন্তান শুধু আমিই।
বাবার আয়ের উপর নির্ভরশীল পুরো পরিবার। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে বাবার চাকরি টা আমাকেই করতে হচ্ছে, তাতে সংসারের কিছুটা হাল ধরতে পেরেছি। সকাল সাত টায় বের হয় সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরি। এরপর বাবার দেখাশোনা, বাজার করা মেডিসিন নিয়ে আসা সব নিজেই করি। আমার মা ও খুব অসুস্থ বাবার জন্য চিন্তা করতে করতে আগের মতো কথা বলেনা সব সময় একটা চিন্তার মধ্যে ডুবে থাকে।

আজ থেকে ছয় মাস আগে বাবা ডিউটি থেকে রিক্সায় করে ফেরার পথে, একটা ট্রাক এসে রিক্সার পিছনে ধাক্কা দিলে বাবা দূরে ছিটকে পড়ে, মাথায় প্রচন্ড আঘাত পায়।
সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে আসি। বাবার মাথায় একটা অপারেশন হয়। ডাক্তার বলেছে মাথার আঘাত টি খুব গুরুতর, ব্রেইনের নার্ভ গুলো ইনজুরি হওয়ায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম,তবুও আমরা চেষ্টা করবো।
সেই থেকে বাবা কে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত আছি।
সহায় সম্পত্তি যা ছিল সব কিছু বিক্রি করে দিয়েছি,একমাত্র থাকার জায়গা টা রাখছি,কারণ বাবার কঠোর বারণ করে বলেছেন -আমার পৈত্রিক বসতবাড়ি তোমার দাদার স্মৃতি কখনো ছেড়ে যাবে না। তাই মা বলেছেন বসতবাড়িটি বিক্রি না করার জন্য।

আমার বাবার কোন তুলনা হয়না, পৃথিবীতে দেখা সকল সেরা বাবার কাতারেই থাকবে আমার বাবার স্থান।
বাবা কে কখনো দেখিনি মনখারাপ করতে,সব সময় হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করতো, সংসারে যতই অভাব অনটন আসুক না কেন বাবা কখনো ভেঙে পড়তো না। বাবার প্রতিটি কাজ শৃঙ্খলাবদ্ধ, সেই ভোর সকাল মুয়াজ্জিনের আজানের সাথে ঘুম থেকে উঠা, সঠিক সময়ে নামাজ পড়া, সামর্থ্য অনুযায়ী দান সদকা করা। বাবার দুয়ার থেকে কখনো কেউ ফেরত যায়নি যখন যা পারে গরীব দুঃখী মানুষ কে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বাবা আমার যত আবদার ইচ্ছা পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বাবা নিজের জন্য কখনো চিন্তা করেনি। নিজের জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনলে সেটা দিয়ে চালিয়ে দিতো দুই তিন বছর। কিন্তু পরিবারের জন্য আমার জন্য কখনো কৃপণতা করেনি। যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। বাবা প্রত্যেক রমজান ঈদে একসাথে আমার মা ও আমাকে নিয়ে নিয়ে যায় শপিংএ, আমাদের জন্য আত্নীয় স্বজনের জন্য সাধ্যমত শপিং করে নিয়ে আসতো। একবার রমজান ঈদে বাবা একটি পাঞ্জাবি দেখেছিল নিজের জন্য, কিন্তু দোকানদার দাম বেশি বলাতে না নিয়ে চলে আসেন। আমি জিজ্ঞেস করলে বাবা বলেছিলেন পছন্দ হয়নি। আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম, বাবা দাম বেশি বলাতে ইচ্ছে করে নিয়ে আসেনি। আমি বাবার অগোচরে পাঞ্জাবিটা কিনে নিয়ে আসি, এবং রাতে বাবার হাতে তুলে দিতেই বাবা আমাকে এক গাদা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, কোথা থেকে এনেছিস কেন এনেছিস টাকা কোথায় পেলি! আমি বাবা কে বলি, বাবা আমার সামান্য কিছু হাতখরচের টাকা ছিল সেখান থেকে এনেছি বাবা। বাবা তুমি শুধু দিয়েই যাবে তোমার কোন সাধ আহ্লাদ নেই?
বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
আমি বাবার চোখে আনন্দ অশ্রু দেখেছি সেদিন। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, খোকা আমি তোর জন্য দোয়া করি, তুই অনেক বড় হও মানুষের মতো মানুষ হও। বাবা সেদিন আমার মাথায় হাত রেখে তার মনের ভিতরে পুষিয়ে রাখা স্বপ্নের কথা বলেছিলেন, খোকা আমার একটা স্বপ্ন আছে,তুই আমাকে কথা দেয় আমি মরে গেলেও তুই আমার স্বপ্ন পূরণ করবি। আমি বাবার হাতের উপর হাত রেখে বলেছিলাম, বাবা তুমি আমাকে হুকুম করো ! কি করতে হবে। বাবা আমাকে বললো খোকা আমার একটা স্বপ্ন এই গ্রামে একটা পাঠাগার হবে, সেখানে সকল শ্রেণির মানুষের জন্য বই থাকবে, ছোট ছেলে মেয়েরা এসে বই পড়বে, বড়রাও আসবে, সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। আর যে সমস্ত পরিবারের ছেলে মেয়েরা
লেখা পড়া করতে পারেনা বইয়ের অভাবে তাদের কে বিনামূল্যে বইয়ের ব্যবস্থা করে দিবে। বাবার স্বপ্ন টি সেদিন থেকে অন্তরে পুষিয়ে রেখেছিলাম, বাবাকে কথা দিয়েছিলাম, বাবা আমাকে দোয়া কর, ইনশাআল্লাহ, আমি একদিন এই গ্রামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করবো যেখানে সব বয়সী ছেলে মেয়েরা বই পড়তে পারবে।

হঠাৎ মায়ের কল, খোকা, কোথায় তোরা? তুর বাবা কোথায়? এইতো মা আমরা হাসপাতালে, বাবা কে সিটি স্ক্যান রুমে নিয়ে গেছে এখনো শেষ হয়নি, বের হলেই তোমাকে কল দিব।
কিছুক্ষণ পর সিটি স্ক্যান রুম থেকে ডাক আসলে, ভিতরে গিয়ে বাবাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলাম।


দু দিন পর ডাক্তারের কাছে সিটি স্ক্যান রিপোর্ট দেখালাম, ডাক্তার আমাকে আশানুরূপ কিছু বলতে পারেনি। শুধু এইটুকু বলেছে, আপনার আব্বুর ব্রেইনের নার্ভ গুলোতে ইনফেকশন হয়ে আরও জটিল অবস্থা হয়ে গেছে, এই মূহুর্তে আমরা আর অপারেশনে যেতে পারছি না। হয়তো কয়েক দিন পর উনার খিচুনি চলে আসবে, উনার ব্রেইন ঠিক মতো কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন! মেডিসিন গুলো ঠিক মতো খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন। আমি ডাক্তারের কথা গুলো শুনছিলাম, নিজের অজান্তেই চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। আমি ডাক্তার কে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, স্যার আর কোন আশা ভরসা নেই কি আমার বাবা কে ফিরিয়ে আনার। ডাক্তার আমার প্রশ্নের কোন উত্তর
দেয়নি! ডাক্তারের নীরবতা আমি বুঝতে পেরেছি! কিন্তু মা,কে কিছুই জানায়নি শুধু নিজের মধ্যে রেখেছি।মা শুনলে সয়তে পারবে না!
এরই মধ্যে আরো দুই টা নিউরো সার্জন ডাক্তার দেখানো হয়েছে। সবার কথা একিই! হোমিওপ্যাথি কবিরাজি যে যেটা বলেছে বাদ দিইনি একটাও! এভাবে কেটে গেলো আরও একমাস। বাবা ধীরে ধীরে আর-ও দূর্বল হয়ে পড়ে। মেডিসিন গুলো এখন ঠিক মতো খাওয়াতে পারিনা, খিচুনির সাথে বমি করে দেয়! তবুও চেষ্টা করি মেডিসিন গুলো খাইয়ে দেওয়া জন্য।

প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, বাবা ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকে, আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নাকাটি করে। আজ সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বাবার পাশে বসি। বাবার হাতটি ধরে বাবা কে বলি, বাবা আমি অফিসে যাচ্ছি। কিন্তু প্রতি দিনের মতো বাবা আজ আমার হাতটি ছাড়েনি! আমার হাতটি শক্ত করে ধরে রাখে, আর বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে! আমি মা,কে ডাকি, মা! এদিকে আসো তো বাবা কেমন জানি করছে! মা দৌড়ে আসে অবস্থা দেখে কেঁদে কেঁদে আমাকে বলে, খোকা গাড়ির ব্যবস্থা কর, তোমার বাবার অবস্থা ভালো না এখনি হাসপাতাল নিতে হবে! আমি আর দেরি না করে এম্বুলেন্স নিয়ে আসি। বাবা কে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, ডাক্তার বলেছে কন্ডিশন খুব খারাপ! আমি মা,কে সব বলে দিই, বাবার পরিস্থিতি আমাকে ডাক্তার বলেছিলেন একমাস আগে! মা আমাকে কেঁদে কেঁদে বলে, খোকা আমি সব জানি! সব বুঝি আমার ভিতর টা ফেটে যাচ্ছে রে খোকা! মায়ের কান্না থামেনা,আমাকে জড়িয়ে ধরে মা!

নিউরো সার্জন ডাক্তার এসে আমার মা,কে বলল,
আপনি মাহামুদুর রহমানের স্ত্রী?
মা-হে ডাক্তার,
ডাক্তার -দেখুন আমরা আগেই বলেছিলাম উনার কন্ডিশন ভালো না, যেকোনো মূহুর্তে অঘটন ঘটতে পারে! তো আমি এখন আপনাদের যেটা বলবো সেটা শোনার জন্য আপনাদের মন কে শক্ত করতে হবে! উনি আর বেঁচে নেই, আমরা অত্যন্ত দুঃখিত!
আমাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো, মা সাথে সাথে বেহুশ হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়লো। আমি মা কে জড়িয়ে ধরি, মা! কথা বলো, মা! মা!
আমি বাবা নিথর দেহটি নিয়ে আসি বাড়িতে, অবশেষে বাবা আমাদের ছেড়ে ঠিকই চলে গেলো না ফেরার দেশে!

আজ বাবার চতুর্থ তম মৃত্যুবার্ষিকী।
বাড়ির পাশেই একটা জায়গার উপর নির্মাণ করলাম বাবার সেই স্বপ্নের পাঠাগার , পাড়ার মুরব্বিদের নিয়ে বাবার কবর জিয়ারত শেষে, আমার মা,কে দিয়ে উদ্বোধন করলাম বাবার স্বপ্নের পাঠাগার, যার নাম দিয়েছি "বাবার স্বপ্ন পাঠাগার " আমার মা,কে নিয়ে মোনাজাত করি আল্লাহর দরবারে,
বাবা আমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছি বাবা! বাবা তুমি আমাকে দোয়া করেছিলে, সেই দোয়াতে আজ আমি তোমার স্বপ্ন - পূরণ করেছি বাবা, হে আল্লাহ তুমি আমার বাবাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান বানিয়ে রাখুন। আমিন।।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিষণ্ন সুমন চোখে পানি চলে এলো ভাই। অসাধারণ লিখেছেন।
mdmasum mia বেদনাময় বাবার স্মৃতি।
শাওন আহমাদ বাবা থাকুক পৃথিবীর কাছের মানুষ গুলো।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

একজন বাবা তার সন্তানের প্রতি কতটুকু যত্নবান, কতটুকু নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

১৮ ফেব্রুয়ারী - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ১৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪