মাহতাব ভক্তের আচরণ বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে। সপ্তাহখানেক ধরে তার কথা এবং আচরণে এক উচ্ছলতা ও উত্তেজনা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
গত ১ তারিখ তিনি ডাক্তারের কাছে গেলেন। জানতে পারলেন তার ভেতরের এই ভয়টা তিনি যদি না কাটান তাহলে কখনো নিজ থেকে যাবে না। এটা তার মনের অবস্থা। তিনি তার চিন্তাকে বিশ্বাসে পরিণত করেছেন বলেই এরকম হচ্ছে।
ডাক্তার বললেন, ভক্ত সাহেব এটা অমূলক চিন্তা। আপনি এরকম ভাবলে কখনোই দেশের মাটিতে ফেরা হবে না।
ভক্ত: কিন্তু আমার উচ্চতাভীতি দিন দিন তো বেড়েই চলেছে। আপনি কি বুঝতে পারছেন না- আমি এই উচ্চতাভীতির জন্যই আপনার চেম্বরে না গিয়ে আপনাকে এখানে আনাই!
ডাক্তার: এক্সাক্টলি, আমি এটাই বলতে চাচ্ছি। এটা আপনার 'হাইট ফোবিয়া'। একবার কাটাতে পারলে তখন দেখবেন সব দুধভাত। তাছাড়া, আপনার এই সমস্যা তো আর জন্মগত না। এটা হয়েছে আপনার লন্ডনে আসার পর। আগে হলে তো আপনি আর লন্ডনে আসতে পারতেন না।
ভক্ত: আগে থাকলেও সমস্যা হতো না। আপনি হয়ত জানেন না, আমি কিন্তু জলপথে লন্ডনে এসেছি। বিমানে নয়।
কিন্তু, এখন মনে হচ্ছে- না আসলেই ভাল করতাম। কুত্তার পেটে ঘী সয়না। আমরা মধ্যনিম্নবিত্ত বাংগালী। আমাদেরও এতো লাক্সারি জীবন সয় না।
প্রথমবার লিফটে আটকে আমার মনে হয়েছিলো -আমি আর বেঁচে ফিরবো না। বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। দোয়া কালাম পড়ে পরপারের জন্য প্রিপারেশন নিয়েছিলাম। স্বচ্ছ কাচের ওপারে এতো ওপর থেকে মানুষগুলোকে পিঁপড়ার মতো দেখাচ্ছিল । মনে হচ্ছিল, আমি যেকোনো সময় নীচে পড়ে একদম চ্যাপ্টা হয়ে যাব।
বিমান দেখলেই ভয়ে কাঁত হয়ে যাই। মনে হয় যদি প্লেন ক্র্যাশ করে? তখন তো বাঁচার সম্ভাবনা শূন্য শতাংশ।
এরপর থেকে ওপরে উঠলেই মনে হয়- আমি মারা যাব। আমার শ্বাসকষ্ট বাড়ে। দম বন্ধ হয়ে আসে।
ডাক্তার: শুনুন ভক্ত সাহেব। এই কথাটাই তো আপনাকে বুঝাচ্ছি। এটা একটা ভয়। এবং ভয়টাও অমূলক তা বলছি না। তাই বলে ভয়ের কাছে হার মেনে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে জীবনের লীলা সাঙ্গ করবেন? এর কোনো মানে হয় না।
আপনি চলুন, আজ গিয়ে টিকিট করে আসি। এবং ভয় কাটানোর প্রথম ধাপ হিসেবে এজেন্সি থেকে ঘুরে আসি। চলুনতো।
ভক্ত: না ভাই, বাড়ি গেলেও অন্য উপায়ে যাব। প্লেনে করে যেতে পারব না। কোনোভাবেই সম্ভব না।
ডাক্তার: আপনি এখন ২০২৫ সালে আছেন। বিমান ছাড়া অন্য উপায়ে যাবেন কী করে? আজ ৩০ বছর পার হয়ে গেল এই প্লেন ক্র্যাশের ভয়ে বাড়ি যাচ্ছেন না।
আর জাহাজে গেলে যে জাহাজ পানিতে ডুববে না এমনটা বললে কে? সুতরাং অমূলক ভয় না করে আগামীকাল রেডি থাকবেন। দুপুরের পর বের হব আমরা।
...
অফিস বয় হাতে পানির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার শফিকুল গ্লাসে থেকে হাতের আঁজলে পানি নিয়ে হাত ঝেড়ে ভক্ত সাহেবের কপাল-মুখ মুছে দিচ্ছেন।
ভক্ত সাহেবের হার্টবিট বেড়ে গেছে। তিনি লিফটে উঠলেন। ওঠার সাথে সাথে একটা ঝাঁকুনি হলো। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হলো- তিনি বুঝি মারা যাবেন। তাল সামলাতে না পেরে লিফটের দেয়াল ধরার চেষ্টা করলেন। ডাক্তার শুরু থেকে নজরে রাখছিলেন। ভক্ত সাহেবকে তিনি হাত বেড়ি দিয়ে রাখলেন।
ধরাধরি করে অফিসে বসানোর পর থেকে এই দৃশ্য চলছে।
ডাক্তার: ভক্ত সাহেব, খুব বেশি খারাপ লাগছে?
ভক্ত: না, আমি ঠিক আছি।
ডাক্তার: খুব ভয় পেয়েছিলেন বুঝি?
ভক্ত: হু, ঝাঁকুনি দেখে মনে হচ্ছিল লিফটটা এখনি ছিড়ে যাবে। আর আমরা সকলে মারা যাব।
ডাক্তার: আপনার ভয় যে অমূলক বুঝতে পারছেন?
ভক্ত: হু, পারছি।
ডাক্তার: আপনি কিন্তু দিব্যি সুস্থ আছেন। তাহলে এখন টিকিট কাটা যাক! কী বলেন?
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন ভক্ত সাহেব। এরপর আস্তে করে বললেন, চলুন। তার হাইট ফোবিয়া পুরো যায়নি তখনো।
ডাক্তার: সমস্যা নাই। যে কয়দিন আছেন সে কয়দিন আমাদের লাঞ্চ ডিনার আর ব্রেকফাস্ট রুফটপে সারব। তাহলে অভ্যস্ততা এসে যাবে।
...
টিকিট কাটা হয়েছে আজ এক সপ্তাহ। ১২ তারিখ আসতে আরও তিনদিন বাকি। কেনাকাটা, ব্যাগ গোছানো সব শেষ।
ছেলে মেয়ে বাবার এমন উচ্ছ্বাস দেখে আনন্দিত।
ছোট নাতিটা দাদার যাওয়ার কথা শোনার পর থেকে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। সে তার দাদা ভাইয়ের সাথে যাবেই। যতই বোঝানো হচ্ছে, দাদা ভাই কিছুদিনের জন্য যাচ্ছেন। শিগগিরই ফিরে আসবেন। কিন্তু এসব সে শুনতে নারাজ। জেদ ধরে আছে।
বড়ছেলে বৌকে বাচ্চা সামলাতে বলে বাবার কাছে গেলো।
ভক্ত সাহেব তাকে জরুরী তলব করেছেন।
ছেলে বারান্দায় এসে বাবা, ডেকেছেন আমাকে?
ভক্ত: হু, কই থাকো খুঁজে পাইনা। এদিকটা দেখেছ?
ছেলে: কোনদিকটা বাবা?
ভক্ত: ঐ যে, একদিন আগে মানে আগামী পরশু তোমার বোন, বোনাই আর ভাগ্নে, ভাগ্নি আসবে। তাদের থাকা খাওয়া সব কেমনে কী করবে ভেবে রেখেছ?
ছেলে: হ্যা, দিদি আর লীনার সাথে কথা হয়েছে। তারা পরশু আসবে। পরদিন এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আপনাকে ছাড়তে যাবে আমাদের সাথে।
ভক্ত: হ্যা, লীনা জামাইকে নিয়ে আসবে। থাকা খাওয়ার বিষয়টা নিয়ে কী ভাবলে সেটাই জানতে চাচ্ছি।
ছেলে: খাবার তো সমস্যা না, বাদবাকি এক রাতেরই তো বিষয়। গাদাগাদি করেই থাকা যাবে।
...
ভক্ত কটেজে আজ সুনসান নীরবতা। চারিদিকের বাতাস ভারী হয়ে আছে। ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।
ছেলে আসীম ভক্ত পাথরের মূর্তির মতো বারান্দায় বসে আছে।
ডাক্তার শফিকুল বুঝতে পারছেন না। দেশে যাবে, এখানে এরকম গুমট পরিবেশ তৈরি করার কোনো মানে হয়!
বাড়ির কর্তা যাবেন, তারা হাসিখুশী থাকবে, তা না, সকলে মিলে বুড়োর মন দূর্বল করে দিচ্ছে উল্টো।
এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির মূল ফটকে প্রবেশ করে বুঝতে পারলেন, এই নীরবতা সাধারণ কোনো নীরবতা না।
মেয়েরা মাকে নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছে। ভদ্রমহিলা জ্ঞান হারিয়েছেন। ছেলের বৌরা মাথায় ঘোমটা দিয়ে কেঁদে চলছে। এক কোণায় ৫-৭ জন বসে কোরআন তেলাওয়াত করছেন।
ভক্ত সাহেব গতকাল ডিনার সেরে সবার সঙ্গে কথা বলে ঘুমানোর তাগিদ দিয়ে নিজেও ঘুমাতে গেছেন।
দুপুর ১২টায় ফ্লাইট। সকালে উঠতে হবে। মিসেস ভক্ত ফজরের নামাজ পড়েন। ভক্ত সাহেবকে ডাকতে যান। গিয়ে দেখেন শরীর হিমশীতল। হাত ধরে টান দিয়ে দেখেন হাত লোহার মতো শক্ত হয়ে আছে। মিসেস ভক্তের বুক ধরফর করে ওঠে। তিনি সবাইকে চিৎকার করে ডাকতে থাকেন। ভক্ত সাহেব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
ভক্ত সাহেবের আর প্লেনে ওঠা হলো না। এক অজানা ভয়কে সংগী করেই তিনি চলে গেলেন...
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
ভক্ত সাহেব একবার আকাশচুম্বী এক বিল্ডিংয়ের লিফটে চড়লেন। যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে লিফট বন্ধ হয়ে গেলো। এতো ওপরে আটকে তার মনের মধ্যে নানা দুশ্চিন্তা ভর করল। তিনি ভাবলেন মারা যাবেন। এতো উচ্চতা থেকে পুরো শহরকে হাতুর তালুর মতো লাগছিলো, মানুষকে পিঁপড়ার মত দেখাচ্ছিল।
এই যে তার মাথায় ঝেকে বসল "উচ্চতা ভীতি " আর কখনও কমেনি।
বহু বছর কেটে গেলো। তিনি দেশে ফিরেন না। তার মনে হয় যদি প্লেন ক্র্যাশ করে? এই ভয় থেকে বাড়ি যাওয়ার চিন্তা বাদ। এখন বুড়ো হয়ে গেছেন। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন, ছেলেরাও সংসারী। শেষ বয়সে দেশের জন্য মন টানে।
২৯ অক্টোবর - ২০২২
গল্প/কবিতা:
৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর,২০২৫