অবশেষে তিন বছর রিলেশনের পর পারিবারিকভাবে আকাশের সাথে আজ আমার বিয়েটা সম্পন্ন হল। আজ আমি অনেক খুশি,শেষ পর্যন্ত আমার ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পেলাম। আমার শাশুড়ি মায়ের বেশ মন খারাপ। মা (শাশুড়ি) হয়তো এখনো আমাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। একমাত্র ছেলের বিয়ে এভাবে মানতে হয়তো মায়ের( শাশুড়ি) অনেক কষ্ট হচ্ছে।
জোনাকি
হুম আকাশ বলো
মা তোমায় রেগে কিছু বললে তুমি কিছু মনে করো না, বুঝতেই তো পারছো মায়ের মনের অবস্থা। তবে দেখো জোনাকি পরিস্থিতি ঠিক হলে ঠিক তোমায় মেয়ের মত ভালবাসবে। আর এখন থেকে আমি যা যা বলবো, সব কথা শুনে চলবে কেমন।
হুম আকাশ
আকাশ মৃদু হেসে আমার কপালে একটা চুঁমো এঁকে বললো লক্ষি বউটা আমার।
শ্বশুর বাড়িতে আসার পর থেকে মা (শাশুড়ি) আমার সাথে তেমন কোনো কথা বলেননি খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া। আকাশ আমাকে মায়ের( শাশুড়ির)পছন্দ অপছন্দের বিষয় গুলো বলেছে। উনার অপছন্দের কাজগুলো করতে নিষেধ করেছে। আমি ওর প্রত্যেকটা কথা শুনে চলি।
সবসময় মাথায় লম্বা করে একটা ঘোমটা দিয়ে রাখি।শুধু এতেই শেষ নয়,মাথায় চুপচুপে করে গন্ধরাজ তেল দিয়ে ও রাখি। গন্ধরাজ তেল ছাড়া নাকি মনে হয় না বাড়িতে নতুন বউ আছে। সবসময়ের জন্য সবকাজ কর্মের মাঝে আমার শাশুড়ি মাকে বুঝিয়েই চলছি আমি নতুন বউ।
ঘর ঝাড়ু থেকে শুরু করে সব কাজ করে চলেছি। এক বিছানা দুই তিনবার গোছাচ্ছি। বোঝাতেই হবে আমি বাড়ির বউ।
সেদিন সন্ধেবেলায় আমার শাশুড়ি মা হঠাৎই আকাশকে ডেকে বললেন কত মাইনে নিবে,কত দিবো? মাস তো শেষ হয়ে এলো।
আকাশ কিছুটা অবাক হয়েই আমার শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করলেন কিসের মাইনে দিবে মা,কাকে মাইনে দিবে।
আমার শাশুড়ি মা আমার দিকে একপলক তাকিয়ে বললো কাকে আবার যে সারাদিন এত কাজ করে বেড়াচ্ছে তাকে।
আকাশ বেশ রেগেই গেলো এবার,মা জোনাকি আমার স্ত্রী। কাজের মেয়ে নয় যে তুমি ওকে মাস শেষে মাইনে দিবে।
মেনে নিতে পারোনি বলে তুমি জোনাকিকে কাজের মেয়ে বলবে মা।
আমার শাশুড়ি মা কিছুটা অভিমান নিয়ে বললো,আমি মেয়ে চেয়েছিলাম, তুই যদি তোর বউকে বাড়ির সমস্ত কাজ করিয়ে কাজের মেয়ে প্রমাণ করার জন্য উঠে পরে লাগিস তবে তো আমাকে তাকে কাজের মেয়েই বলতে হয়। যা তোর বউকে গিয়ে বল কত টাকা মাইনে দিতে হবে।
আকাশ খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার শাশুড়ির দিকে।
আমি কাছে এসে মার পাশে বসে মাকে বললাম,এই কাজের মেয়েটাকে তোমার মেয়ে করে নাও না মা।
এবার আমার শাশুড়ি আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন আমি কারও মা নয়, কই এসে পর্যন্ত তো কেউ একবারও মা বলে ডাকেনি আমায়।
কথাটা বলেই কেঁদে দিলেন মা।
আশ্চর্য তিনি কাঁদছেন অথচ আমি ভেবে এসেছি উনার মনে কোনো মায়াই নেই। মা অনেকটাই নারিকেলর মত, বাহিরটা শক্ত আর ভেতরটা নরম।
এবার বেশ করে জড়িয়ে ধরে বললাম আমায় ক্ষমা করে দাও মা আর এমন ভুল হবে না মা।
মা এক চিলতে হেঁসে পাশে বসিয়ে হাত থেকে বালাগুলো খুলে আমার হাতে পড়িয়ে দিয়ে বললেন স্বামী সংসারী হও। আর মাথা ভর্তি ওমন চুপচুপে করে তেল দিতে হবে না, বাড়ির মেয়ে বাড়ির মেয়ের মত থাকবে,এই গরমে মাথায় এত বড় ঘোমটা টানতে কে বলেছে?
বলেই আমার শাশুড়ি মা আকাশের দিকে তাকালেন, একি আকাশ কোথায় গেলো,এইখানেই তো ছিলো।
হাঁদারামটা নিশ্চয় লেজ গুটিয়েছে(পালিয়েছে)
মা ছাঁদে যাবে?
আজ মা মেয়েতে একসাথে চাঁদ দেখাবো।
অনেক গল্প করবো। কতদিন প্রাণ খুলে হাসি না। আজ প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে আমরা আনন্দবিলাস করবো।
মায়ের (শাশুড়ীর) হাতটা ধরে ছাঁদে এনে পাটি পেতে বসলাম মা মেয়েতে।
দেখো মা আজকের চাঁদটা কতো বড়,চাঁদটা ও বুঝে গিয়েছিলো যে,আজ আমি তোমার সাথে জোৎস্না বিলাসে আসবো। তুমি আর আমার উপর রাগ করে নেইতো মা।
পাগলী মেয়ে কি যে বলে,মা কখনো মেয়ের উপর রাগ করে থাকতে পারে। মাথাটা নিয়ে এসো দেখি,চুলে বিলি কেটে দেই। আমি মায়ের(শাশুড়ী) কোলে শুয়ে আকাশের চাঁদটাকে দেখছি আর মা আমায় গল্প শোনাচ্ছেন, পাশেই আকাশ এয়াল ঘেষে দাড়িয়ে আছে, কিছুটা পেছনের দিকে।
আমায় খুব ভয় পেয়েছিলি নারে মা?
মায়ের(শাশুড়ীর) কথাটা শুনে শোয়া থেকে উঠে বসে বললাম নাতো মা, ভয় পাবো কেন।
খুব কষ্ট দিয়েছি নারে মা,সব কাজ তোমায় দিয়ে করিয়েছি,কথা বলিনি।
কই এসে থেকে একবারটি তো মা বলে ডাকোনি আমায়।বেশ অভিমানী সুরেই কথাগুলো বললেন মা(শাশুড়ী)। আমার তো বাড়ির বৌমা চাই না,আমার একটা মেয়ে চাই।
ঠিক তোমার মতো।
আকাশের কথা একদম শোনার দরকার নেই,যা করবো আমরা মা মেয়েতে মিলে করবো। কতকাল অপেক্ষা করে মেয়ে পেয়েছি দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেবো মা মেয়েতে মিলে। বলেই মুচকি হেঁসে মা(শাশুড়ী) আমার মুখে হাত বুলিয়ে কপালে চুঁমো খেয়ে মিস্টি হেঁসে বললেন,জানো তো জোনাকি আজকের সমাজে আমরা ছেলের মায়েরা দিনশেষে শাশুড়ীই থেকে যায়। মা আর হতে পারি কই? অনেক ভালবাসার পরে আমরা ছেলের মায়েরা শাশুড়ীই থেকে যায় আর দিনশেষে আমাদের জায়গাটা ওই তো বৃদ্ধাশ্রমেই হয়।
পান থেকে চুন খসার মত দোষ খোজা হয় এখনকার সমাজে শাশুড়ি বউয়ের মধ্যে। আমাদের সময় কথা হতো না তা নয়,তবে আমরা শাশুড়ি,ননদ,জা( দেবর বা ভাসুরের বউকে বলা হয়)সবাইকে নিয়েই সংসার করেছি।
আমার শাশুড়ি তার ছেলে মানে তোমার শশুড় মশাইয়ের কাছেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এখন এমন কজনের কপালে আর জোটে সবই তো বৃদ্ধাশ্রমের দিকে ছুটে। বলেই তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
মা
হুম,কিছু বলবে?
তোমাদের এত কষ্টে গড়ে তোলা চার কামরার ঘরেই দেখবে আমাদেন ছোট্ট সংসারটা আজীবন টিকে থাকবে মা(শাশুড়ী)।
আমি না হয় এই ছোট্ট জীবনে তোমার মেয়ে হওয়ার প্রচেষ্টায় রইলাম।
চোখের কোণের পানিটা মুছে মা(শাশুড়ি)বললেন রাত অনেক হয়েছে, ঘুমোও গিয়ে।
বিছানায় শুয়ে ভাবছি একটা মানুষের মনে ঠিক কতটা কষ্ট থাকলে এত অনায়াসে মনের কথাগুলো বলে দিতে পারে। সত্যিই তো আমরা বৌমা, শাশুড়ীরা কারণে অকারণে কতই না দোষ খুঁজেতে থাকি নিজেদের মধ্যে। বয়স হলে কিন্ত সবার মধ্যেই একটা চেন্জ্ঞ আসে। শাশুড়ি শব্দটা পেতেও কিন্তু যথেষ্ট বয়স এবং শ্রম সাধনার ব্যাপার আছে। একটা মানুষ একদিনেই শাশুড়ি হয়ে যায় না। অথচ আমরা এই বয়সের করা ভুলগুলোকে দোষ ভেবে নেই কত সহজে। খুব কম সংখ্যক-ই আপন ভাবতে পারি এই শাশুড়ি বৌমার সম্পর্কটাকে। এই সত্যটা আমরা তখনি উপলব্ধি করতে পারবো যখন একসময় আমরাও শাশুড়ি হবো,এই বয়সটাই পৌছাবো।
সত্যিই আমার রাজকপাল বটে,রাজকপাল না হলে কি আর আকাশের মত বর কপালে জোটে।
এখন আমার আর মায়ের(শাশুড়ী)মধ্যে বেশ একটা বন্ধু বন্ধু ব্যাপার হয়ে গেছে ।
সবাই তো এখন অবাক হয়ে যায়,আমি বাড়ির বউ না ওনার মেয়ে। মা শব্দটা যতটা মধুর ততটাই কোমল উনার ব্যবহার। ভাগ্য করে এমন পরিবারে বউ হয়ে আসা যায়।
সেদিন বিকেলে মা মেয়েতে একসাথে একটু ঘুরতে বের হয়েছিলাম। একই রঙ্গের শাড়ি পড়ে একই সাজে বেড়িয়েছিলাম আমরা। পাড়াকে পাড়ার লোক ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলো আমাদের দিকে।
কি জানি হিংসে হচ্ছিলো নাকি তাদের।
বাপু এমন মেয়ে তো কখনো দেখিনি, কোনা যাদুটোনা করেছে নাকি শাশুড়ীটাকে,দেখবে দুদিন পড়েই এ ভালবাসা হারিয়ে যাবে। বউটা মনে হয় বড়লোক বাড়ির মেয়ে গো,তাই এতো আদর,শুনেছি বাপটা অনেক বড় ব্যবসায়ী।
আমরা মা মেয়েতে বের হলেই, এমন সব কথা বলেন পাড়ার চাচিরা।
তবে আমার বেশ ভালোই লাগে, সব কথা কেন খারাপ ভাবে নিতে হবে। বলুক না যার যতটুকো বলার আছে।
তবে সত্যি বলতে আমি বাবার বাড়ি থেকে এক পয়সাও আনিনি। বলতে গেলে অনেকটা এক পোশাকে বের হয়ে এসেছি আকাশের হাত ধরে। বাবা অন্যত্র আমার বিয়ের কথা বলছিলেন।
বাবাকে বার বার বোঝানোর পরও বাবা বুঝতে চাননি যে আমি আকাশকে ভালবাসি,কোনোভাবেই বোঝাতে পারিনি যে আমি ওর সাথেই সুখে থাকবো।
কোনো উপায় না দেখে আকাশকে ফোন করে জানাতেই, ও আমাদের বাসায় এসে বাবার সাথে কথা বলে। জানি না বাবা আর আকাশের মাঝে সেদিন কি কথা হয়েছিল তবে ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই আমাদের বিয়েটা হয়ে গিয়েছিলো।
বিয়ের পরপরই আমার অহংকারী,দাম্ভিক বাবা আমার সাথে সম্পূর্ণরুপে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।
উনার নাকি কোনো সন্তান নেই।
আজ এক মাস আমি আমার মায়ের সাথে ও কথা বলতে পারিনি, কষ্টটা দ্বিগুন হতে পারতো,কিন্তু হয়নি।এইজন্যই হয়তো আমি এখানে এসে মায়ের ভালবাসা পেয়েছি।
সেদিন দুপুরে বাবা-মা( শশুর -শাশুড়ী) বাড়িতে ছিলেন না।
তাই রান্নাটা নিজেই করে ফেললাম। সেই দুপুর থেকে খাবার নিয়ে বসে আছি,আকাশের কোনো চিহ্নই নেই।প্রায় বিকেলের আগে কোথা থেকে আসলো আকাশ। ক্ষিদেয় পেটে ছুচো ডন দিচ্ছে আর উনার এতক্ষণে আসার সময় হলো।
খেতে বসেও ফোন টেপা লাগবে উনার।
আকাশ ফোনটা রাখো, খাওয়া করে শেষে হাতে নিও।
কথাটা বলতেই রাগে আকাশ কি অদ্ভুত ভাবে তাকালো আমার দিকে।
আকাশের রক্তরাঙ্গা চোখ দেখে আর কিছু বলার সাহস হলো না আমার। প্রচন্ড রেগে আছে, এই মূহুর্তে কিছু বলা ঠিক হবে না ভেবে চুপ করে গেলাম।
খাওয়া শেষে রুমে এসে দেখি সেই ফোন নিয়েই ব্যস্ত। আকাশ তোমায় কিছু বলার ছিলো। কথাটা বলতেই কেন জানি না, আবারও খুব অদ্ভুত ভাবে খানিকটা বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালো আকাশ।
কেন জানিনা এই প্রথম আকাশকে খুব ভয় লাগছে আমার।
তোমার কি কোনো কারণে মন খা-রা-প আকাশ,কোনো সমস্যা হয়েছে কি তোমার?
কথাটা বলতেই আমার কাছাকাছি এসে পাশ কাটিয়ে আলমারির উপর থেকে নীল শার্ট টা হাতে নিয়ে কোথায় যেন বেড়িয়ে গেলো আকাশ।
কিচ্ছু ঠিক লাগছে না রাত এগারো টা বাজে এখনও বাসায় ফিরলো না,কখনো তো এত দেরি হয় না ওর। রাত্রি প্রায় বারোটার দিকে বাসায় ফিরলো আকাশ।
এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানার একপাশে বালিশে হেলান দিয়ে বসে আবার ও টাইপিং এ ব্যস্ত হয়ে পড়লো আকাশ।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পরও আকাশ ফোন থেকে চোখ সরাইনি।
এই মূহুর্তে নিজেকে কেমন মৃত বলে মনে হচ্ছে। মৃত বললেও ভুল হবে মৃতদেহ তো দেখা যায় কিন্তু আকাশ তো আমাকে দেখতেই পাচ্ছে না। তাহলে কি অশরীরী হয়ে গেলাম আমি। আমার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। আকাশের অবহেলা টা ঠিক মেনে নিতে পারছি না।
টানা একান্ন মিনিট পর ফোনটা রাখলো আকাশ,পানির বোতলটা এগিয়ে দিতেই আমার হাত থেকে বোতলটা ঝটকা দিয়ে নিয়ে বললো সামনে থেকে সর।
খুব অবাক হলাম আমি আকাশের এমন ব্যবহারে। এসে থেকেই দেখছি ফোনে কি সব করছো, আমি জলজ্যান্ত একটা মানুষ যে তোমার সামনে দাড়িয়ে আছি,তোমার সেদিকে কোনো খেয়াল আছে। তুমি তো আমায় দেখতেই পাচ্ছো না আকাশ।
আমার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে আকাশ আবার ফোনটা হাতে তুলে নিলো।
দেখি ফোনের মধ্যে কি আছে তোমার,যে সবসময় এই ফোনটাকে নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত থাকতে হবে তোমাকে। দেখি দাও তো ফোনটা।
জোড় করে ওর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিতেই যত্ত রাগ হলো ওর। আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিতে না পেরে আকাশ আমার গালে সপাটে দুটো চড় মারলো। আমি নিজের গালে হাত দিয়ে রোবোটের মত দাড়িয়ে রইলাম। ফোনটা কেড়ে নিয়েই থেমে থাকেনি আকাশ।আমার গালে হাত চেপে দাতে দাত পিষে দেয়ালের দিকে ধাক্কা মেরে বললো নিজের লিমিটের মধ্যে থাকবি।
তবে এটা দেখলাম যে ও সাদিয়া নামের কোনো একটা মেয়ের সাথে কথা বলছিল।
সাদিয়া কে আকাশ?
প্রশ্নটা করাতেই আকাশ বললো সব কিছু তোকে কেন বলতে হবে, কে তুই?
এমন ব্যবহার করছো কেন তুমি,কি হয়েছে তোমার?
জবাবে কোনো কিছু না বলেই রুম থেকে হনহন করে করে চলে যাচ্ছিলো আকাশ।
আকাশ আমি পেগন্যান্ট।
আকাশ আমার দিকে একপলক তাকিয়ে বেশ শান্ত গলায় এবরোশন করে ফেল বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো..
তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে আকাশ,শোনো কোথায় যাচ্ছে তুমি?
এই মানুষটাই তো একটা সময়ে আমাকে এতটা ভালোবেসেছিল। তাহলে আজ হঠাৎ কি এমন হলো আকাশের যে ও আমাদের বাচ্চাটাকেই পৃথিবীতে আনতে চাইছে না। রাতে আকাশ আর বাড়ি ফিরলোনা। সারারাত জেগে ফরজের নামাজ পড়ে কখন যে জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি।
হঠাৎ আমার গায়ে এলোপাথাড়িভাবে কিছু একটা পড়ছে মনে হলো।
আচমকা উঠে বসতেই দেখি আকাশ আমার জামাকাপড় গুলো একটা ব্যাগে ঢোকাচ্ছে আর এদিক ওদিক ছুড়ে ফেলছে। মা(শাশুড়ী) নিষেধ করার পরেও ও এগুলো করে চলেছে। তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে আকাশ,কি করছো এসব?
আমার ডিভোর্স লাগবে জোনাকি!
মানে?
মানে আমার ডিভোর্স লাগবে , ডিভোর্স, শুনেছো তুমি। আমি আর থাকতে চাই না তোমার সাথে।
কথাটা শোনা মাত্র মা(শাশুড়ী) কষে আকাশের গালে একটা থাপ্পড় মারলো।তোর কত বড় সাহস তুই আমার সামনে এসব কথা বলিস। বাবা(শশুর) আকাশকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করছে।
বেশ শান্ত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললো আমি সাদিয়াকেই বিয়ে করছি, তোমার ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছি, এবার তুমি আসতে পারো জোনাকি।
আকাশ আমি কি কোন ভুল করেছি, কি হয়েছে তোমার। আচ্ছা সব দোষ আমার। প্লিজ এসব বলো না। আমাদের বাচ্চার কথা ভাবো একবার।
ওর ছোট ছোট আঙুলে আমরা হাত রাখবো। আচ্ছা আমরা কি নামে ডাকবো আমাদের বেবি কে...ওর নাম...
আকাশ আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাতে পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললো এ্যাবরোশন করে নিও।
টাকাটা ফেলে দিয়ে আমি আকাশের পায়ে পড়ে গেলেও আমার আর শেষ রক্ষা হলো না। জোড় করে টানতে টানতে আমাকে নিয়ে এসে গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়া হলো। বাবা-মা(শশুর -শাশুড়ী) যেন বাধা দিতে না পারে এজন্য দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়েছে আকাশ।
দেখতে দেখতে নয় মাস মাস কেটে গেলো সেই যে আমাকে জোড় করে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো আর একবারও আমার কোনো খোজ নেয়নি আকাশ। ও বাড়ি থেকে বাবা-মা(শশুর -শাশুড়ী) দু একবার এসেছিলেন। তবে আমার বাবা কথার তোপের(অগ্নি বর্ষক বা বন্দুকের গুলি বোঝানো হয়।) মুখে পড়ে তারাও আর এ বাড়ির পথ মাড়াইনি পরবর্তীতে।
বিকেল থেকেই প্রচন্ড ব্যথা করছে পেটের চারপাশে। মাকে ডাকতে গিয়ে হঠাৎই মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরতেই মনে হলো আমি হাসপাতালে আছি।
শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে।
বাবার কথাগুলো বেশ মনে পড়ছে, কি বাবা তোমাকে হারিয়ে দিলাম তো।
তোমার মেয়ে বলে কথা,ধৈর্য তো থাকবেই, কি বলো বাবা। মনে মনে কথাগুলো বলে নিজের অজান্তে একাই হেসে ফেললাম আমি।
সেদিন নিতান্তই নিরুপায় হয়েই এসে উঠেছিলাম বাবার কাছে। মাঝে মাঝেই মাকে বলতে শুনতাম চুপ করো, আস্তে কথা বলো মেয়েটা শুনতে পাবে।
জবাবে বাবা বলেছেন মরে যাক ওমন মেয়ে। কে আসতে বলেছে মুখ পুড়িয়ে আমার কাছে আসতে। দেশে তো আর রশি,গাছের অভাব ছিল না। আর নদীও তো সব শুকিয়ে যায়নি,যে আমার কাছেই আসতে হলো।
দরজার এপাশ থেকে দেখতাম মা মুখে আঁচল চেঁপে কাঁদতেন আর বাবার সামনে হাতজোর করে বলতেন চুপ করো মেয়েটা অসুস্থ।মেয়েটার মনের অবস্থা একটু বোঝার চেষ্টা করো। প্রায় সময়ই দেখতাম মা এমন আকুতি -মিনতি করেই বাবাকে চুপ রাখতেন। আমি আর কি করতাম আমারও কোনো উপায় ছিলো না। কবে লাত্থি দিবে, কবে পেটের এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরলো এসবের মায়াই পড়ে গিয়েছিলাম। তাই আর নিজের মায়াটা ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারেনি পৃথিবী নামক যন্ত্রণা থেকে। এক কথায় মা হওয়ার নেশা আমাকে দিব্যি(কসম বা অঙ্গীকার)পেয়ে বসেছিল। তাই আর বাবার কথাগুলো গায়ে লাগতো না আমার। অনেকটাই কান কাটার(বেহায়া-নিলজ্জ) মতোই বলতে পারো আমাকে। যা কিছু হয়ে যাক আমি মা হবোই হবো।
আমি যখন ছোটবেলায় খুব রাগ করতাম, বিভিন্ন বায়না ধরে না পেয়ে যখন মাকে বলতাম তুমি আমাকে এতটুকুও ভালোবাসোনা। মা বার বার বলার পরও যখন মানতাম না মা আমাকে ভালোবাসে। তখন আমার মা আমাকে বলতেন মা হওয়া এত নয় মা।
মা হতে গেলে অনেককখানি ত্যাগ করা লাগে। নিজের শখ আহ্লাদ সব বিসর্জন দিতে হয়। নিজের ভালোলাগা বলে তখন আর কোনকিছুই থাকে না। সব ভালোলাগা তখন সন্তানকে ঘিরেই হয়।
তুমি এখন বুঝবে না মা,মায়েদের কতটা কষ্ট করে মা ডাকটা শুনতে হয়। তুমি সেদিন বুঝবে যেদিন তুমি নিজে মা হবে। তখন আর আমায় প্রশ্ন করবে না আমি তোমায় কতটা ভালবাসি। মায়ের কথাগুলো সত্যিই সেদিন আমি বুঝনি,তবে আজ বুঝতে পারছি। তাইতো বাবার এত্তো এত্তো কথা ভুলেও গায়ে মাখিনি,ভুলেও একবার ও ভাবিনি আকাশের সেদিনের বলা কথাগুলো। পাগলের মত ছটফট করেছি যেন তার কাছে একটু আশ্রয় মিলে যায় আমার। মানুষটার পা পর্যন্ত ধরেছি কিন্তু মন আর গললো কই?
সব মনে রাখলে কি আর মা হওয়া যায়। মা হতে হলে ত্যাগ করা লাগে তুমিই তো বলেছো মা। আজ আমি বুঝছি মা কি, মা হওয়া কতটা প্রশান্তির।
শুনেছি ক'দিন আগে নাকি সাদিয়াও ওকে ছেড়ে চলে গেছে। অনেকবার ফোন করলাম,কিন্তু রিসিভ করলোনা।
আমার তো ওর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। ভুল হয়তো আমারই ছিলো। আমিই হয়তো ওর প্রতি কেয়ারলেস ছিলাম। আজও কি আকাশ আমাকে একটিবার দেখতে আসবে না।
সন্ধে নেমে গেছে চোখগুলো খুলতে পারছি না। মনে হলো কেউ আমার হাতটা ধরে আছে। স্পর্শটা আমার বহুকালের চেনা মনে হলো। চোখ খুলতেই দেখি আকাশ আমার হাতটা ধরে বসে আছে। কোলের পাশেই আমার ছোট্ট বাবুটা।
আকাশের দিকে তাকাতেই বললো আমাদের অবনী। আমি এক রাজকন্যার মা হয়েছি।
এই মুহূর্তে চোখ বেয়ে দু'ফোঁটা জ্বল গড়িয়ে পড়লো আমার।
জোনাকি!
বেলা শেষে মায়া বাড়াতে এসেছো আকাশ।
ওর মুখটা বড্ড শুকনো হয়ে আছে,তাকানো যায় না মুখটার দিকে।
বাহিরে এক পুরুষ কন্ঠের কান্নার আর্তনাদ শুনতে পেলাম। কন্ঠটা চিনতে খুব একটা বিলম্ব (দেরী) হলো না আমার। এ কন্ঠ আমার জন্মদাতা পিতার।
তবে আমি যতদুর জানি তিনি বড্ড অহংকারী, দাম্ভিক, পাষাণ প্রকৃতির মানুষ। তিনি হঠাৎ এতটা গলে গেলেন কেন?
তবে কি.....
যাক কোনো একটা অযুহাতে হলেও আমার পাষাণ বাবার অভিমান গলেছে।
বাবা তো বাবাই হয়...
কোনো বাবাই কি পারে সন্তানের লাশ কাঁধে তুলতে।
আমার মায়ের আহাজারিতে আমার বুকের ভেতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমার নিঃশ্বাস নেওয়া প্রত্যেকবারের বাতাস ভারি হয়ে উঠছে।
মাগো আজ আমি সেদিনের উত্তর পেয়ে গেছি,আজ আমি বুঝেছি মায়ের ভালবাসা কি।
অথচ যখন মায়ের ভালবাসা কি বুঝতে পারলাম,তখন আমার মেয়েটাকেই একটু ভালবাসতে পারলাম না আমি।
মা(শাশুড়ি)এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর বলছেন, তোমার মেয়েটা দেখতে ঠিক তোমার মত হয়েছে।
তোমার মাকে একবার ডাকি নাতনির মুখ দেখবেন তো।
বলেই মা(শাশুড়ি) আঁচলে মুখ ঢেকে ভেজা চোখ নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন রুম থেকে।
মৃদু হেসে নিজেই নিজেকে বললাম,যাকে হাজার বার দেখলেও দেখার শেষ হবে না,যাকে বার-বার দেখতে ইচ্ছে করছে সে মানুষটা আমার সামনেই আছে।
খুব ইচ্ছে করছে আমার অবনীটার কপালে একটা চুঁমো এঁকে দিতে, কিন্তু শক্তিতে কুলাচ্ছে না। শরীর অবশ হয়ে আসছে।
কেন জানি না আকাশ খুব কাঁদছে, অঝরে কাঁদছে। ওকে আর থামালাম না৷ আজকের দিনটা না হয় কাঁদুক। আজ যে ওর শেষ কান্না।
শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আকাশের হাতে ভর করে সামান্যই উঠে বসলাম। পিছনের দিকে বালিশের সাথে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে হালকা হাত বাড়িয়ে ওকে ঈশারায় বললাম অবনীটাকে একবার আমার কোলে তুলে দিতে।
নিঃশ্বাসের সাথে অনেকটা পাল্লা দিয়েই অবনীকে কোলে নিয়ে ওর কপালে চুঁমো এঁকে শেষ বারের মতো আকাশের হাতে হাত রেখে বললাম
আমার অবনীটাকে কখনও অবেলায় হারিয়ে যেতে দিও না আকাশ।
যেমনটি আমার বাবা দিলেন।
শেষ পর্ব
বি:দ্র:যেকোনো সম্পর্কেই তৃতীয় ব্যক্তি আসলেই যে সম্পর্ক নষ্ট হবে এমন কিন্তু নয়। সম্পর্ক তখন নষ্ট হয় যখন দুইজনের মধ্যে কেউ একজন ওই তৃতীয় ব্যক্তিটাকে প্রশ্রয় দেয়। হারানোর ভয় একজনের মধ্যে থাকলে সেটা হারিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক, হারানোর ভয় দু'জনের মধ্যেই থাকা উচিত।