১
১৯৭১ সাল। বাংলার প্রকৃতিতে তখন গ্রীষ্মের দাপট, কিন্তু তার চেয়েও উত্তপ্ত ছিল এ দেশের মানুষের মন। ২৫শে মার্চের কালরাত সবকিছু বদলে দিয়েছিল। নদীমাতৃক বাংলার এক ছোট্ট গ্রাম, যার বুক চিরে বয়ে গেছে তিস্তা, সেই গ্রামেরই চঞ্চল কিশোর আকাশ। বয়স সবে সতেরো পেরিয়েছে, চোখে তার স্বাধীনতার স্বপ্ন আর বুকে ক্রোধের আগুন।
বাবা ছিলেন স্কুলের হেডমাস্টার, দেশপ্রেমের গল্প তিনি ছোটবেলা থেকেই শিখিয়েছেন। কিন্তু এখন সেই বাবা নিজেই পাকবাহিনীর হাতে নিঁখোজ। আকাশ আর চুপ করে থাকতে পারল না। গ্রামের কয়েকজন সমবয়সী তরুণকে নিয়ে সে রাতের আঁধারে সীমান্ত পাড়ি দিল। তাদের লক্ষ্য—ভারতের মেলাঘর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পৌঁছানো।
সীমান্তের কাঁটাতারের ওপারে অপেক্ষারত ছোট একদল গেরিলার সাথে তাদের দেখা হলো। দলের নেতা, বছর পঁচিশের রফিক ভাই, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। রফিক ভাই তার কাঁধ চাপড়ে বললেন, "সাবাস! এতটুকু বয়সে এমন সাহস! মনে রাখবে, এই পথ শুধু যুদ্ধের নয়, এটা আত্মত্যাগের পথ।"
আকাশের কানে তখন কেবল বাবার শেষ কথাগুলো বাজছে: "স্বাধীনতার চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নেই, বাবা।"
২
মেলাঘরের ক্যাম্প ছিল যেন এক নতুন জগৎ। রাইফেল চালানো, গ্রেনেড ছোড়া, মাইন বসানো—প্রতিটি প্রশিক্ষণই ছিল কঠোর। আকাশ তার তীব্র শেখার আগ্রহ আর ক্ষিপ্রতার জন্য রফিক ভাইয়ের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলো। বিশেষ করে রাতে চুপিসারে শত্রুপক্ষের ঘাঁটিতে ঢুকে তথ্য আনার কাজে তার জুড়ি মেলা ভার।
একদিন রফিক ভাই পুরো দলকে ডাকলেন। "শত্রুপক্ষের একটা কনভয় আগামী পরশু গঞ্জের ব্রিজ পেরোবে। ওতে নাকি তাদের একটি গোপন নথিপত্র আছে, যা আমাদের জন্য খুব জরুরি। আমাদের কাজ হবে কনভয় ধ্বংস করা এবং সেই নথি উদ্ধার করা।"
অপারেশনটির নাম দেওয়া হলো 'অগ্নিবাণ'। এই অপারেশনের মূল দায়িত্ব পড়ল আকাশ ও তার দুই বন্ধু—শান্ত ও বিজয়ের ওপর। তাদের কাজ ছিল ব্রিজের নিচে বিস্ফোরক বসানো এবং বিস্ফোরণের পর মূল দল পৌঁছানোর আগেই নথিটি খুঁজে বের করা।
গভীর রাতে, বৃষ্টিস্নাত অন্ধকারে তারা হামাগুড়ি দিয়ে ব্রিজের দিকে এগোতে থাকল। তিস্তার জল তখন ফুলে উঠেছে, ব্রিজের নিচে স্রোতের একটানা শব্দ। শান্ত ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল, কিন্তু আকাশ তাকে সাহস জোগাল। হাতে তার একটি ডেটোনেটর আর বুকে অদম্য স্পৃহা।
৩
বিস্ফোরক বসানো হলো। অপেক্ষা শুরু। ভোরের আবছা আলো ফুটতেই দেখা গেল কনভয় এগিয়ে আসছে। আকাশ ডেটোনেটরে চাপ দিতেই এক ভয়ংকর শব্দে ব্রিজটি কেঁপে উঠলো! ধোঁয়া আর ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে তারা দৌড়ে গেল কনভয়ের দিকে। তাদের কাজ সফল—নথিটি তাদের হাতে এল।
কিন্তু ঠিক তখনই পাশের ঝোপ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে এলো! তারা ফাঁদে পড়েছে! একদল রাজাকার তাদের গতিবিধি অনুসরণ করেছিল।
"ফাঁকা গুলি করো না! ওদের জীবন্ত চাই," হাঁক দিল রাজাকারদের সর্দার, মোতালিব। মোতালিব ছিল আকাশের গ্রামেরই এক কুখ্যাত মানুষ, যে এখন পাকবাহিনীর দোসর।
শান্ত বুকে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল। বিজয় মরিয়া হয়ে পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করল, কিন্তু সংখ্যার দিক থেকে তারা ছিল দুর্বল। আকাশ নথিটি প্যান্টের কোমরে লুকিয়ে নিয়ে বিজয়ের হাত ধরে এক দৌড়ে নদীতে ঝাঁপ দিল।
পাকসেনাদের গুলি তাদের তাড়া করছিল, কিন্তু তিস্তার খরস্রোত তাদের টেনে নিয়ে গেল দূরে। জলের নিচে দম বন্ধ করে আকাশ শুধু ভাবছিল, "শান্ত, তোর রক্ত বৃথা যেতে দেব না।"
৪
নদীর স্রোতে ভেসে আকাশ আর বিজয় এক জঙ্গলের প্রান্তে এসে ভিড়ল। বিজয় আহত, তার পায়ে গুলি লেগেছে। আকাশ তাকে নিয়ে গ্রামের দিকে না গিয়ে গহীন বনের ভেতরে আশ্রয় নিল, যেখানে সাধারণ মানুষজন ঢুকতে সাহস পায় না।
এদিকে, ক্যাম্পে ফিরে রফিক ভাই শান্তর মৃত্যুর খবর শুনে মুষড়ে পড়লেন। তিনি বুঝলেন, মোতালিবের এই বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত জবাব দিতে হবে।
পরদিন সকালে একজন ছদ্মবেশী গুপ্তচর ক্যাম্পে খবর নিয়ে এল: "মোতালিব তার দলবল নিয়ে গ্রামের পুরোনো জমিদার বাড়িতে ঘাঁটি গেড়েছে। সে আহত বিজয়কে খুঁজে বের করার জন্য পুরো এলাকায় তল্লাশি চালাচ্ছে।"
আকাশ সিদ্ধান্ত নিল, লুকিয়ে থাকা যাবে না। বিজয়কে একটি নিরাপদ গুহায় রেখে সে একাই জমিদার বাড়ির দিকে রওনা হলো। তার অ্যাডভেঞ্চার এখন ব্যক্তিগত প্রতিশোধ এবং গুরুত্ত্বপূর্ণ নথি রক্ষার মিশনে পরিণত হয়েছে।
রাতে কালো পোশাকে আকাশ জমিদার বাড়ির ছাদে উঠে গেল। নিচে মোতালিবের নেতৃত্বে রাজাকাররা বসে আছে। আকাশ তার বাবার শেখানো কৌশল কাজে লাগিয়ে একটি পুরোনো কূয়োর ভেতর থেকে গোপন সুড়ঙ্গপথ আবিষ্কার করল। সুড়ঙ্গপথটি গিয়ে পৌঁছেছে জমিদার বাড়ির ভাঁড়ার ঘরে।
ভাঁড়ার ঘরে ঢুকে আকাশ দেখতে পেল—তার বাবা! মাস্টার মশাইকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে। বাবার পাশে বসে আছে মোতালিব।
মোতালিব অট্টহাসি হেসে বলল, "দেশের জন্য এত ভালোবাসা? চলুক এবার তোমার স্বাধীনতার গল্প!" সে তার হাতের বেয়নেট উঁচিয়ে ধরতেই, আকাশ আর স্থির থাকতে পারল না।
৫
আকাশ বিদ্যুতের বেগে ভাঁড়ার ঘরের দরজা ভেঙে সামনে এসে দাঁড়াল। "মোতালিব! তোর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সময় এসেছে!"
মোতালিব তাকে দেখে হতভম্ব। "কে? এই সেই ছেলেটা!"
মুহূর্তেই শুরু হলো তুমুল লড়াই। আকাশ তার সীমিত প্রশিক্ষণের সবটুকু দিয়ে লড়তে শুরু করল। মোতালিবের হাতে ধারালো বেয়নেট, আর আকাশের হাতে একটি পুরোনো গাছের ডাল। একসময় মোতালিব সুযোগ পেয়ে আকাশকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল।
"আজ তোদের বাবার সাথে ছেলেকেও শেষ করব," বলে সে যখন আকাশের দিকে বেয়নেট তাক করল, ঠিক সেই মুহূর্তে ভাঁড়ার ঘরের অন্য দরজা ভেঙে প্রবেশ করলেন রফিক ভাই আর তার পুরো দল!
আসলে আকাশ যখন জমিদার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল, সে চতুরতার সাথে পথের মাঝে একটি সাংকেতিক চিহ্ন রেখে গিয়েছিল। রফিক ভাই সেই চিহ্ন দেখে বুঝতে পারেন, আকাশ জমিদার বাড়ির দিকে গেছে।
তুমুল গোলাগুলি শুরু হলো। মুক্তিযোদ্ধার দল মুহূর্তেই মোতালিবের বাহিনীকে ঘিরে ফেলল। মোতালিব পালানোর চেষ্টা করতেই আকাশ দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে তাকে জাপটে ধরল। মোতালিবের বেয়নেট আকাশের কাঁধ ছুঁয়ে গেল, রক্ত ঝরতে শুরু করল। কিন্তু আকাশ তার বাঁধন আলগা করল না।
রফিক ভাই এগিয়ে এসে মোতালিবকে নিরস্ত্র করলেন।
আকাশ বাবার বাঁধন খুলে দিল। বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। চোখের জলে ভিজে গেল দুজনেরই মুখ।
মুক্তিযোদ্ধারা মোতালিবকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে গেল। আকাশ সেই গোপন নথি রফিক ভাইয়ের হাতে তুলে দিল। নথিটি ছিল পাকবাহিনীর একটি বড় সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা। এই তথ্য হাতে আসায় বহু মুক্তিকামী মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হলো।
কিছুদিনের মধ্যেই সেই নথির ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর মূল ঘাঁটিগুলোতে পাল্টা আক্রমণ শুরু করল। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ—১৬ই ডিসেম্বর।
স্বাধীনতার পর, বিজয় সুস্থ হলো। গ্রামের সবাই আকাশকে নিয়ে গর্ব করে। কিন্তু আকাশ তার বাবার পাশে বসে শুধু শান্তর কথা ভাবে। সে জানে, এই স্বাধীনতা শত শত শান্ত, হাজারো বীরের আত্মত্যাগের ফসল।
তিস্তার স্রোত তখন শান্ত, আকাশের চোখে ভবিষ্যতের আলো। সেই আলোর নাম—বাংলাদেশ।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
১৯৭১ সাল। বাংলার প্রকৃতিতে তখন গ্রীষ্মের দাপট, কিন্তু তার চেয়েও উত্তপ্ত ছিল এ দেশের মানুষের মন।
২৬ জানুয়ারী - ২০২২
গল্প/কবিতা:
৩৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৬” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৬ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী