দর্জি আমজাদের এখন পোয়া বারো, তা কেনোই বা হবে না, সে তো আর কারো বাড়া ভাতে ছাঁই ঢেলে দেয়নি। বরং সে বরাবরই ধোঁপদুরস্ত গোবেচারা স্বভাবের মানুষ। কারো সাতে-পাঁচে থাকে না কখনো, কেউ ডাকলে সাড়া দেয়, না ডাকলে কারো দিকে ফিরেও তাকায় না। তবে পোয়াবারো হওয়ার বড় কারণ, গাঙ্গোপাড়া হাটের ঠিক তার আশেপাশে যে ক’জন ভালো দর্জি পা ছড়িয়ে বসে পুরোদস্তুর কাজ চালিয়ে, চুটিয়ে দুটো পয়সা কামাই করে যাচ্ছে, সে ছাড়াও আরেকজন নছির মন্ডল।
গত মাসে নছির মন্ডল দুবাই চলে গেছে টাইলস্ মিস্ত্রীর কাজ নিয়ে বছর তিনেকে চুক্তির ভিত্তিতে, যাওয়ার সময় মেশিনসহ দোকানখানা একেবারে পানির দরেই বিক্রি করেছে আমজাদের কাছে। টাকা অবশ্যই সবটাই নগদ দিতে হয়নি, হাজার পাঁচেক প্রথম লেগেছে, বাকি সারে তিন হাজার দশবারে শোধ করতে হবে, ষ্টেম্পের ওপর সইস্বাক্ষর-টিপসই স্বাক্ষীসবুর সবই খুব সর্তকতার সঙ্গে হয়েছে, নছির মন্ডলের বউ আনজুয়ারা প্রতিমাসে টাকা বুঝে নেবে, মালিকিন যেহেতু সেই এখন।
দোকানটার যেদিন দখল পায়,সেদিনই ভালোভাবে সাফ-সুতরো করে স্যাভলন ঢেলে পানির সাথে,পাকিস্তানি ঝড় ফ্যানে হাওয়া দিয়ে শুঁকোয়, গোলাপপানিও একবোতল ঢালে, পৌনে তিন মাস আগের কুরবানী ঈদের বেঁচে যাওয়া আতরও ছড়িয়ে দেয় খানিক। মিলাদ না দিলে অনেক কথা যখন উঠবে, মিলাদও দিলো গাঙ্গোপাড়া হাটের প্রায় সবাইকে জানান দিয়ে, মনির মিষ্টান্ন ভান্ডারের গরমাগরম টুইটম্বুর জিলাপির অর্ডার দিলো কেজি ছয়েক।
মাধবতলীর ওপাশে হাঁসবেড়িয়া নাকি কাঞ্চনপুর ঠিক তার লাগোয়া গ্রামেই তো মৌখালি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, হুজুর মোতালেব জায়গীরদারকে সসস্মানে ডেকে এনে মিলাদ পড়ানো হলো কোনো এক সন্ধ্যের ঠিক পরপরই। মোতালেব হুজুর বেশ কামেল বটে, বাংলা-আরবী আর উর্দু ভাষায় বয়ান দেশ-গ্রামে মানুষের মনপ্রাণ কেড়েছে, সেই সুবাদে একটা সুখ্যাতি ছড়িয়েও পড়েছে চারদিকে, লোকে কতোটুকু বোঝে কি বোঝে না সেটা তো কোনো বড় কথা নয়, বড় কথা হলো মোতালেব হুজুর আলেম মানুষ, তার পবিত্র মুখের কথা তো আর দশটা লোকের মতো নয়,তার আরবী-উর্দু বয়ান শুনে মজলিসের সবাই হু-হু করে কেঁদে বুক ভাসায়। যারা বাংলা ছাড়া অন্যভাষা বোঝে না তারাও কাঁদতে-কাঁদতে হুস-জ্ঞান হারায়।
আমজাদ দর্জির চোখেও টলটলে পানি, যেন শ্রাবণ মাসের ভরা বিল। একসময় মোতালেব হুজুর বলে, তামাম দুনিয়া ভি আন্ধারপুরি, লক্ষ কোটি বছরের একটা ছিনাল মাগী এই দুনিয়া, লেকিন এর জন্য মায়া-মমতা না করে আখিরাতের চিন্তা করতে হবে, নেকদার-ঈমানদার হতে হবে, বেশি-বেশি দান খয়রাত করতে হবে, কবি আল্লামা রুমী (রঃ) বলেছেন...!
ফার্সী একটা বয়ান দিয়ে কি বোঝালেন কেউই কিছুই তার সারমর্ম বুঝলো না। একসময় মোতালেব হুজুর হু-হু করে কেঁদে ফেলে, তারপর বলে ওঠে একটু হুংকার দিয়ে, ভাইরে ভাই বাংলা ভাষা বোঝো শুধু, বাংলার জন্য জীবন দিলে হবে না, আরবী-ফার্সী-উর্দু বোঝো না তোমরা, কি হবে পরকালে গিয়ে সে চিন্তা করো না, বাংলা হলো হিন্দুদের ভাষা, রামায়ণ-মহাভারত-গীতা তো আল্লাহ পাকের কাছে যাবে না, কি উত্তর দেবে বলো, চোখে শুধু আন্ধার দেখো, আল্লাহ পাকের ভাষা আরবী-ফার্সী-উর্দু, কি হবে পুলফেরাতে, বাংলা ভাষা তো আমার আল্লাহ বোঝে না, কবরের ওই ছোট্ট আন্ধার ঘরে যে দু’ফেরেস্থা প্রশ্ন করবে, তারাও তো আরবী ভাষায় বলবে, বাংলা তারা জানে না, তোমাদের কি হবে,একবার ভেবে দেখো ভাইরে ভাই--
উপস্থিত সবাই হাউ-মাউ রবে উ”ঁচস্বরে কাঁদতে থাকে, কি একখান মস্ত কথা শুনলো আজ। বুকের ভেতরটা কেমন ভেজা-ভেজা হয়ে গেলো, এমন একটা পাপ করছে তারা, আরবী ভাষা রপ্ত না করে কেউই মরতে চায় না। ওদিকে অর্ডারের জিলিপি মনির মিষ্টান্ন ভান্ডারের টেবিল মোছা ছোড়া নেকবর দিতে আসে বড় ঠোঙায় ভরে।
আমজাদ দর্জির নোতুন কেনা দোকানটার কথা কেউ একজন মোতালেব হুজুরকে কানে-কানে বলে দিলে স্মরণ হয় তখন। একটা লম্বা সুরা টেনে বলে, কানে ডান হাত দিয়ে, হালাল আয়-রোজগার আল্লাহ রাব্বুলামিন আদেশ দিয়েছেন, আলেম ওলামা মাওলানা মোদাচ্ছের হাফেজদের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে, কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, হুজুর-মাওলানারা মাছ-মাংস খাবে না, দেশী মুরগীর সোরার স্বাদ পাবে না, তাও তো হয় না, কি বলেন ? তাই বলি নোতুন দোকান দিয়েছে বলেই, আমজাদকেও গাঙ্গোপাড়া হাটের তাবৎ ইনসানকে নেকনজরে রাখতে হবে, বিশেষ করে হুজুর মমিনদের দিকে, হুজুর একপলক আমজাদের দিকে তাকিয়ে দেখে নেয়, তারপর বলে, কি তবে রাজি তো ! তারপর আরেকটা লম্বা সুরা এবং কবি ইকবালের একটা শ্লোক দিয়ে মোনাজাত শেষ করে।
গরমাগরম জিলিপি সবাইকে দেওয়ার আগে মোতালেব হুজুরের সঙ্গে আনা মস্ত রুমালটাতে আধা কেজি বেঁধে দেওয়া হয়। তারপরও চশমার ফাঁক দিয়ে একবার দেখে মৃদু ধমক দিয়ে বলে, খবরদার ইনসাফ ঠিক রাখবে, আমাকে বেশি দিলে আখিরাতে বাধা থাকবে, বোঝো কিছু...
বাদবাকি দু’এক পিচ করে উপস্থিত সবাইকে দিয়ে শেষ করলো একসময়। হুজুরকে বিদায় জানানোর সময় আরো পঞ্চাশ টাকা হাতে গুঁজে দিতেই খেঁকশিয়ালের মতো খেকিয়ে ওঠে মুহূর্তে, কি ফকির মিসকিন পেলে তোমরা বলো তো ! এতো টাকা পয়সা দু হাত খুলে খরচখরচা করলে তার বেলা কিছু না, আলেম ওলামাদের দেওয়ার সময় হাত ছোট হয়ে যায় ! এসব খেসলত তো ভালো না ?আরো পঞ্চাশ টাকা তুলে দেয় আমজাদ, ঈষাৎ হাসি ছড়িয়ে মোতালেব হুজুর বলে, আত্মাকে প্রসারিত করো মিয়া দেখবে ব্যবসায়ও উন্নতি হবে।
আমজাদ দর্জির কপাল স্বর্ণ দিয়ে গড়া বলে গাঙ্গোপাড়া হাটের লোকেরা কানাঘুষা করে। দোকান এখন দু’দুটো, কারিগর খান তিনেক, কাজও বেশ বেড়েছে, রাতারাতি সাইনবোর্ড একটা ঝুলিয়ে দিয়েছে দোকান নেওয়ার পরপরই, নামটা দেখে অনেকের চোখ চড়কগাছে ওঠার জোগার,“শৈলী ফ্যাশান এন্ড টেইলরস্” গাঁও-গ্রামে এমন আধুনিক রগরগে নাম তো কেউই শুনেনি, তারপর আবার ফ্যাশান শব্দটা জুড়ে দেওয়ায় উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে পড়ার দশায় এসে দাঁড়ালো।
সেদিন মহিষঘাটির রথীন হালদার তেড়ে এসে বললো, কি গো দর্জির ব্যাটা দর্জি, কলি কালে কি এও দেখতে হবে বলতিছো, গাঁ-গেরামের মাইয়া ছেলেমেয়েগোরে ফ্যাশান-ফুশান কইরা শেষে কি যাত্রা অপেরায় লাচতে লিবেক।
আমজাদ কথা বলতে পারেনি, ওমনি সুতোপুরের কওমী মাদ্রাসার হুজুর এবাতুল্লাহ হেঁড়ে গলায় জানায়, আল্লার দুনিয়ায় লজ্জা-সরম থাকা ভালো, তোমরা তো ঘরের মেয়েদের এখন উলঙ্গ হয়ে বাইরে বার হতে মদদ জোগাচ্ছো, এ’কেমন ভরা রোজকেয়ামতের পূর্বভাস বলো তো!
আমজাদ দর্জি বুঝে পায় না, এই একটা শব্দ নিয়ে লোকের মনে এতো ক্ষোভ কেনো। শৈলী ফ্যাশান এন্ড টেইলরস্ নামকরনটা বদল করতেই চেয়েছিলো শেষাবধি কিন্তু শত লোকের এই একই ঘ্যাঁনঘ্যাঁনানি শুনতে-শুনতে একসময় কেমন সহ্য হয়ে যায়।“লোকের মুখ ওমনই,বলছে বলুক,আছে বলেই তো বলছে” হরিশংকরপুরের সীতা মাসির উঠতি বয়সি মেয়ে রাধারাণীর কথা শুনে মনে জোর পায় সে।
আরেকদিন রতনডাঙার সাগরিকা জানালো,“নামটা বেশ গো, নাম শুনেই মজে গেছি,বদলানোর দরকার নেই, ভালো ডিজাইন করলে কাজের অভাব...”
সত্যসত্যি একসময় ঠান্ডা বরফ হয়ে যায় ব্যাপারটা, নোতুন জিনিস পুরানো হলে খাপেখাপে মিলে যাবে, তখন কে আর কাকে চেনে, সোনায় সোহাগা যাকে বলে। গাঁ-গেরামের মেয়ে-বউ-ঝি’রা এখন বেশি ভীড় করে আমজাদ দর্জির দোকানে। কারণ গাঙ্গোপাড়ার আর সব দর্জির চেয়েও আমজাদ দর্জির হাতের ডিজাইন ভালো, ফ্যাশান-ট্যাশান বোঝে বেশ। কারণ অবশ্য আরো একটা আছে তা হলো, সে আজ গাঙ্গোপাড়ার মতো প্রায় গাঁ-গেরামের দর্জি হলেও হাতেখড়ি তো হয়েছে রাজশাহী শহরে। টানা পৌনে চার বছর কাজ শিখেছে রাজশাহীর এক নামকরা টেইলারে, সে গল্প অনেক মেয়ে বউ ঝি’রা জানে,আমজাদ দর্জি একটু ফুরসত পেলেই সময় সুযোগ মত তার ফিরিস্তি জাহির করতে ভারী পছন্দ করে। ইনিয়ে বিনিয়ে কতো কথা বলে রসিয়ে-রসিয়ে।
এভাবেই কেটে যায় আমজাদ দর্জির জীবন। নদীর স্রোতের মতো কখনো সামন্তরালে আবার কখনো এঁকেবেঁকে, জীবনের মানে তো আসলে নদীর জোয়ারভাটা।
সেদিন আনজুয়ারার কাছে কিস্তির টাকা দিতে গিয়ে শোনে, দুবাইতে নছির মন্ডল নাকি খুব কষ্টে আছে, তিন মাসের টাকা বাকি, ভালো করে খেতেও দেয় না, অথচ চৌদ্দ ঘন্টার কাজ করিয়ে নেয়। আনজুয়ারার কথা শুনে আমজাদের মন ভেঙে যায়,কারণ তারও অনেক সাধ সামনে ছোট ভাইটাকে পাঠাবে দুবাইয়ে। একটা ভাই বিদেশে গেলে মন্দ কি, টাকা পয়সা ঘরেই তো আসবে, বাপের জমি-জিরাত সবই ঠিকঠিক থাকবে, মাঝখানে টাকায় টাকা হবে তাদের পরিবার। চিন্তা ভালো ছিলো কিন্তু নছির মন্ডলের বউয়ের কথা শুনে মনটা মুষড়ে যায়।তাহলে কি আর করা,বাড়ির পথে আসতে-আসতে ভাবতে থাকে আমজাদ দর্জি, দুবাই থেকে নছির মন্ডল দেশে ফিরে এলেও বা তার কি,দোকান তো তাকে ফিরে সে আর দিচ্ছে না, তাছাড়া প্রথমবার এবং মাস কিস্তির অংক মিলিয়ে যা এ’পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে, তা প্রায় শেষের পথে, এখন আর কিছু দেওয়া বাকি। কিন্তু ভাইটাকে একটা দেশে পাঠাতে হবেই হবে, তো অনেক দেশ আছে, সেখানে সে অবশ্য পাঠাবে ভাইকে।
মতিলালের চায়ের ষ্টলে এসে একটা পাওরুটি এবং কলা নিয়ে খেতে বসে। মতিলালের দিকে তাকিয়ে বলে,“একটা চা দিও দাদা”।
মতিলাল ঠাঁট্টাবাজ মানুষ,এক চোখ মেরে বলে,“কি ব্যাপার রাতদুপুরে দেখছি আনজুয়ারার বাড়ি থেকে আসা হচ্ছে, খাওয়া কি কিছু পাওয়া যায়নি”।
একটা হোঁচট খায় আমজাদ দর্জি। সত্যিই রাত্রি অনেক এখন। নছির মন্ডল দুবাই চলে যাওয়ার পর থেকে আনজুয়ারা প্রায় একাই থাকে, বাড়িতে কে কে আর থাকে তা কখনো সেভাবে ভেবেও দেখেনি। একটা মানুষকে কার ওপর রেখে গেছে, এমন চিন্তা কেনো এতোদিন এলো না, তার জন্য অনুতপ্ত হলো মুহূর্তে। মনের মধ্যে একটা গোপন আকাঙ্খা ভর করে ওর, বুকটা কেঁপে ওঠে।
আনজুয়ারার চেহারা বেশ আকর্ষণীয়,চোখ জোড়া বড় শান্ত হলেও চঞ্চল করতে পারে অন্যকে, কার বুকে যে সাপের মতো ছোবল দেবে সে রকম এক সম্ভাবনা থাকে। কয়েকবার দেখেছে কি যেন বলতে চাই ওই কাজল টানা হরিণী চোখ। নছির মন্ডলের সঙ্গে আনজুয়ারার বিয়ে তো বেশিদিনের নয়, বছর তিনেক হবে হয়তো,এর মধ্যে একটা বাচ্চাও হয়ে গেছে, শরীর-স্বাস্থ্য এখনো বেশ আটসাট, শক্ত বাহু আর সরু কোমর সে দেখেছে আড়চোখে, প্রস্থর-চওড়া নিতম্ব দেখতেও মন্দ লাগেনি। বুক জোড়া বেশ ডাসা মনে হয়েছে, উচ্ছল পায়ে চলার ছন্দ দেখে ভালো লেগে যায়।
নছির মন্ডলের সংসারে আসার আগে আনজুয়ারার একবার বিয়ে হয়েছিলো কিন্তু চরিত্রের অপরাধ দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে আগের স্বামী। নছির আগেও দু’দুটো বিয়ে করেছে অথচ বউরা কেউই বেশিদিন তার কাছে থাকেনি। অত্যাধিক কামুক প্রকৃতির বলে নাকি বদনাম আছে, ছিঁড়ে-ছঁড়ে নাস্তানাবুদ করে ফেঁড়ে ফেলে, বউরা কেউই ওর ওমন পশুর মতো ধকল মেনে না নিয়ে মুখ বুঁজে বাপের বাড়ি পাড়ি দেয়, তারপর আর ফেরে না।
ঘটনা কতোখানি সত্য কে জানে, নছির মন্ডল নিজের পৌরুষের কথা বেশি-বেশি জাহির করে এ’বলে, আসল ইতিহাস কেউ জানে না। আনজুয়ারার যৌনতৃষ্ণাত্ব চোখ দেখে তো তার কোনো আলামতই পাওয়া যায় না।
মতিলালের ষ্টল থেকে বের হয়ে বাড়ি এসে শুয়ে পরে রাত্রের খাওয়া খেয়ে। মাথার মধ্যে আনজুয়ারার শরীরের নাচুনে ছন্দ বড় বেশি তোলপার করতে থাকে এখন। নছির মন্ডল দু’দুখানা বিয়ে করলেও তার এখনো একটিও জুটেনি। মা চলে যাওয়ার পর থেকে সংসারটা কেমন মরুভূমি হয়ে গেছে, কে আর কার খবর রাখে, বিবাহিতা বোন দুটো স্বামী-সন্তান নিয়ে দু’চার মাস পরপর আসলেও দু’ পাঁচদিন থেকে আবার চলে যায়। তখন অনুরোধ আবদার করে ভাইয়ের একটা বউয়ের জন্য,কয়েকদিন চলতে থাকে এদিক ওদিক মেয়ে দেখা, তখন হয়তো নেগেটিভ দু’একটা উচ্চবাচ্চ করে আমজাদ, এখন না, আর কয়েকদিন অপেক্ষা,ছোটভাইটা একটু উঠে দাঁড়াক, বিয়ের বয়স তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না, এমন কথা বলতে হয় বলেই হয়তো বলা, তারপর সব ফর্সা, কে কার,যার যার কাজে চলে যায়,পরে থাকে সেই সংসার, একজন আমজাদ শুধু সেই একজন আমজাদই আর কি । বিধবা একমাত্র ফুপুই সংসারটাকে কোনোমতে আগলে রেখেছে যজ্ঞির ধনের মতো, আমজাদরাও ওই ফুপুর ওপর ভরসা রেখে বসে আছে। ভাগ্যিস বিধবা ফুপুর ছেলে-মেয়ে নেই, তাছাড়াও দু’কুলে কেউই নেই পৃথিবীতে তার। একমাত্র বড় ভাই অর্থাৎ আমজাদের বাপের কাছে সেই যে বিধবা হয়ে চলে এলো, তার ঠিক বছর কয়েকের মাথায় ভাইটাও একদিন চলে গেলো, কি নিষ্ঠুর নিয়তি! সেই থেকেই আছে মায়ের মতো একজন ফুপু।
অনেক রাত্রি এখন, আস্তে-আস্তে পৃথিবীটা কেমন শান্ত হয়ে গেছে, কি নরোম স্নিগ্ধ রাত্রি যেন। আজ পূর্ণিমা বলে কি এতোটা রমণীয় করে সেঁজেছে,বাইরের পৃথিবীটা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে, যা হয়তো ঘরের ভেতরে থেকে কেউই অনুভব করতে পারবে না। কোনোভাবে মনকে স্থির রাখতে পারে না সে, কেনো যে এমন হলো বুঝে পায় না। ছোট ভাইটা ওর ঘরে ঘুমোচ্ছে, ওর খবরও অনেকদিন নেওয়া হয়নি। ফাজিল ছেলে-ছোকরাদের সঙ্গে মিশে গোল্লায় গেছে, লেখাপড়া হলো না শেষপর্যন্ত। বাপের কাছে কথা দিয়েছিলো মানুষ করবে যেভাবেই হোক, কিন্তু হলো না, কে কার কথা রাখে। মাথায় একটু লম্বা হলেই ভাবে আমিই বা কম কিসের।
ভাতমাড়ি গ্রামের ছোট মসজিদের মুয়াজিন আব্বাসউল্লাহর সেজো মেয়ে নাদিরার সঙ্গে কি একটা বাজে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়,দু’চার গাঁয়ে নাদিরার কুকৃত্তির কাহিনী সবারই জানা। মাদ্রাসায় পড়ার সময় কোনো এক অল্প বয়সী হুজুরের প্রেমে মজেছিলো একবার। বাচ্চাও নাকি এসেছিলো লোকমুখে প্রচার পায়। তারপর জানাজানি একটু-আধটু শুরু হলে মেয়েকে দূর গাঁয়ে অর্থাৎ নাদিরার নানীর বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। ওর মামারা ভাগ্নিকে কোনো এক উকিলের মুহুরীর সঙ্গে বিয়েও দিয়ে দেয় মাস চারেকের মাথায়, বছর না ঘুরতেই মুহুরী তাড়িয়ে দেয় নাদিরাকে কি এক অজুহাতে। নানি বাড়ির কেউই আর তারপর দায়িত্ব নেয়নি, আর রাখতে চায়নি বলেই একদিন প্রত্তুষে বাপের বাড়ি চলে আসে অনেকটা বাধ্য হয়েই। ওসব ঘটনা কে বা খোঁজ রাখে, কার উনুনে আগুন জ্বলছে কি জ্বলছে না সে সংবাদ নেওয়ার সময় কোথায়। মানুষের জীবনের ঝাঁক্কি ঝামেলা পোহাতেই একশেষ, কার জন্য কার বা অতো মাথাব্যথা।
কচ্চিৎ একদিন আমজাদের জন্য প্রস্তাব আসে নাদিরাকে বিয়ে করার, সংবাদটা বেশ সৌরভ ছড়ায়, চারদিকে ছড়িয়ে যায় আব্বাসউল্লাহর মেয়ে নাদিরার সঙ্গে আমজাদ দর্জির বিয়ে, গন্ধ ছড়ানোর আগে দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসে তারপর।
কাকতালীয়ভাবে একদিন পঞ্চনন্দপুর গ্রামের মনসা ঠাকুরের পুজারী কৃষ্ণচন্দ্র প্রামাণিক কবিরাজ আমজাদকে জানায়,“মেয়ে তো ভারী সুবিধের নয় গো... তাছাড়া তুমি তো অবিবাহিত মিয়া, মেয়ে বিবাহিত ছাড়াও নষ্টা!”
আমজাদ শুধু শুনে যায় সেদিন। সত্যসত্যি দিনদুনিয়ায় কতো কিছু ঘটে যাচ্ছে,কে তার সংবাদ নেয় কতোটুকু। ঘরের পাশেও কতো খবর লুটোপুটি খায়, সে জানে না, জানতে ইচ্ছেও করে না। কি হবে মানুষের এতো খবর রেখে। নিজের চিন্তা নিজের কাছেই অনেক, সব কষ্ট মুখ ফুটে মানুষ বলতে পারে না, এই বলতে না পারার যন্ত্রণা আরো কষ্টের।
অনেক কথা বলে কবিরাজ। ফড়ফড় করে বলে যাচ্ছে, কে শুনলো কি শুনলো না সেদিকে ওর কোনো খেয়াল নেই। সে যেন ভেবেই রেখেছে কেউ শুনুক আর না শুনুক বলে যাবেতার মতো করে। শেষে কবিরাজ জানায়,“ও মেয়ের দু’বারের বাচ্চায় আমাকে দিয়ে খালাস করিয়েছে !”
আর শুনতে ইচ্ছে করেনি আমজাদের অথচ সেই মেয়ে বড়ঁশী গাঁথে কিনা তারই ছোট ভাইকে, আর ভাবতে পারে না। ভাবনাও যেন খেই হারিয়ে ফেলে, তাছাড়া ভাবনাগুলো খেই হারিয়ে কোথায় বা যাবে।
কুন্ডলী পাঁকিয়ে-পাঁকিয়ে একেবারে জট পাঁকিয়ে থাকে তারই মধ্যে, আমজাদ দর্জি আলোকিত জ্যোৎস্নার নীচে একজন মানুষ বৈ তো কিছু না। অকস্মাৎ আনজুয়ারার বাঁকা চোখের নাচুনে ছবিটা স্মরণে আসে, ততক্ষণে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না। কোথায় একটা তার কেটে যায়। তার কাঁটা তানপুরার সুর বড় বেশি বেসুরা লাগে।