আমি তখন মাধ্যমিকের ছাত্র। সবে নির্বাচনি পরীক্ষায় কোনমতে টেনেটুনে পাশ করেছি। ফলে যা হওয়ার তাই হলো; অনেক বকাঝকা শুনতে হলো। এমন যদি হয় পড়ালেখার ধরন তবে এস এস সি পরীক্ষায় নিশ্চিত ফেল। আর তাই যদি হয় তবে বাড়িতে আর জায়গা হবে না, এ আমার মায়ের শেষ কথা। বাবা এ ব্যাপারে কিছুই বললেন না, তিনি বরাবরই এসব বিষয়ে উদাসীন। অন্ততপক্ষে বাইরে থেকে দেখে তাই মনে হয়। ভিতরে ভিতরে হয়ত কিছু আশা-আকাঙ্খা লালন করেন তবে তা আমার কাছে কখনো উন্মোচিত হয়নি। মায়ের ওপর সংসারের সমস্ত ভার ন্যাস্ত করে তিনি জনকল্যাণেই মগ্ন থেকেছেন সব সময়।
যাহোক ভূমিকা রেখে এবার মূল কথায় আসি। বাড়ি ছাড়া হওয়ার ভয়ে আমি রাতদিন এক করে পড়ালেখা আরম্ভ করলাম।
একদিন রাতে পড়তে ভীষণ একঘেয়েমি লাগছিল। তখন ঠিক কতখানি রাত তা বলতে পারছি না। তবে রাত্রি যে গভীর তাতে কোন সন্দেহ নেই। পল্লী জীবনের সব চঞ্চলতাই তখন শান্ত। চারদিক থেকে শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হলো, যাই বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসি।
বাইরে এসেই মনটা হালকা হয়ে গেল। এতক্ষন ঘরের মধ্যে দম বন্ধ লাগছিল। চাঁদের আব্ছা আলোতে প্রকৃতি যে এমন সুন্দর হয়ে ওঠে তা আগে উপলব্ধি করিনি। মাঘের শেষ সময় চলছে এখন। শীত যাই যাই করছে, শুধু ফাগুনের অপেক্ষা। ফাগুনের আগমনে সে বিদায়ের সুর বাজিয়ে দেবে। পথে খানিক দূর এগিয়ে যেতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেল, এত রাতে একা একটা মেয়ে রাস্তার উপর গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
ভাবলাম, মেয়েটি কে তা দেখতে হচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি তা খেয়াল না করে রাস্তা ধরে উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করল। কাল বৈশাখী মেঘের মত ঘন কালো চুল হাঁটু পর্যন্ত ঝুলছে। মাঝে মাঝে ঠান্ডা হাওয়া চুলের উপর কেমন একটা ঢেউ খেলে যাচ্ছে। জোছনার আলো ক্রমশ যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। চোখের সামনে এখন সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। মেয়েটির পিছন পিছন যাওয়াতে তার চেহারাটা দেখতে পাচ্ছি না। একটা সাদা ওড়না দ্বারা ঘোমটা দিয়ে মুখটা ঢেকে রেখেছে। আমি হাতা কাঁটা একটা সোয়েটার পরে আছি। একটু পর পর শীতল বাতাস এসে আমাকে জানান দিচ্ছে, সে এখনো যায়নি বরং প্রকৃতিতে তার অবাধ বিচরণ আরো কিছুদিন থাকবে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো এতে মেয়েটির কিছু আসে যায় বলে মনে হলো না। এমন শীতের রাতে তার গাঁয়ে কোন প্রকার শীতবস্ত্র নেই!
এমন সময় শুনতে পেলাম মেয়েটি গুনগুন করে গান করছে। গানের কথা গুলো ঠিক বুঝতে পারলাম না; কিন্তু গানের সুরটি চমৎকার, ভীষণ রকম মায়াবী। কোথা থেকে যেন রজনীগন্ধার সুবাস ভেসে এলো। এই ফুলের সুবাস আর মায়াবী মনোহারী সুর আমাকে সম্পূর্ণ মোহাবিষ্ট করে ফেলেছে। আমি ভাবলাম, এত ভালো যার গানের গলা সে নিশ্চয় খুব সুন্দর হবে। আমি হঠাৎ হাঁটা বন্ধ করে তার সুন্দর মুখের একটি ছবি কল্পনা করলাম। তখনই মেয়েটি আমার দিকে এগিয়ে এলো। তার রুপ দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। আমি যা ভাবছিলাম এ তো তার থেকে অনেক বেশি রুপসী! এই নারীর মুখশ্রী এমন অপূর্ব হৃদয়গ্রাহী লাবন্যময় যে তার তুল্য কিছুই আমি খুঁজে পাইনি।
সহসা একটা ঘেউ ঘেউ শব্দে আমার ভ্রম কেটে গেল। দেখলাম সে সামনে হেঁটে চলেছে। ঠিক করলাম, এতক্ষন যেমন দেখলাম মেয়েটি যদি সত্যিই এমন সুন্দরী হয় তবে কিছুতেই একে হাতছাড়া করা চলবে না। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন সে সময় আমার বা ঐ মেয়েটির বয়স কত তা নিয়ে কোন ভাবনা আমার মাথায় আসেনি। আমি তাকে লক্ষ্য করে বললাম, এই যে শুনছেন?
সে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। কিন্তু একি! সাদা ওড়নার মাঝে তো কোন মুখ দেখতে পাচ্ছি না! শুধু অন্ধকার! বিদঘুটে অন্ধকার! সেই সাথে একটা বিস্মৃত হাসির আওয়াজ! সে মুহূর্তে কোথা থেকে একটা বিড়াল ম্যাও শব্দ করে লাফিয়ে পড়ল আমার কপালের ওপর। আ! বলে চিৎকার করে উঠলাম আমি। ভেতরের ঘর থেকে মা বললেন, চিন্ময় কি হয়েছে?
আমার ঘোর কেটে গেল, দেখলাম আমি চেয়ারে বসে আছি। সামনে টেবিলের ওপর রসায়ন বইটা খোলা। হেরিকেনের তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় আলো নিভু নিভু করছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম ঘুটঘুটে অন্ধকার। পুনরায় মায়ের গলা ভেসে এলো, চিন্ময় কি হলো? আমি আধো আধো স্বরে বললাম, নাÑ কিছু হয়নি মা।
কপালের ওপর একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলাম। কপালে হাত দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে তিন ব্যাটারির টর্চটা নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দেখলামÑ কপালের ঠিক মাঝে তিনটি নখের আঁচরের দাগ। কেটে যাওয়া ঘোর আবার ফিরে এলো। সে রাতে আর ঘুম হলো না। বুঝলাম আমার প্রথম প্রেম কেবল ঘুমের ঘোরে দেখা এক স্বপ্ন, একটুখানি মুখ লুকানো স্মিত হাসিমাখা লজ্জা আর অনেকখানি সুখেরÑ না সুখের নয় বিস্ময়ের অনুভব।
সমাপ্ত
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।