মা যে আমার এই পৃথিবীর সবচেয়ে আপনজন
মায়ের মত হয়না উদার অন্য কারো মন
মা ওগো মা, মা ওগো মা......................................
বিকেল বেলা সামিনা জামান মেয়ে রুমে গিয়ে দেখতে পেলেন মেয়ে তার গানের রেওজান করছে। মাকে নিয়ে সে নতুন গান বেধেছে, নিজেই সুর করেছে গাইছেও নিজে। রিতার কন্ঠ বেশ সুরেলা। মেয়ের মুখে মায়ের গান শুনতে বেশ লাগছে। তিনি দরজায় দারিয়ে তন্ময় হয়ে শুনছেন। হঠাৎ তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
সামিনা জামান এর বুকের আয়নায় নিজের মায়ের পান পাতার মত মুখ ভেসে উঠল। তার মা হামিদা বানু ছিলেন সন্তান অন্ত প্রান মহিলা। মায়ের ভালোবাসা যে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ সেটা তিনি বুঝেছেন তার মায়ের আত্মত্যাগ দেখে।
সামিনা জামান আর আমিনা দুই বোন। দুই বোনকে বলতে গেলে হামিদা বানু একাই মানুষ করেছেন। তাদের বাবা আলি হায়দার ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে প্রবাসে গিয়ে সেই যে নিরুদ্দেশ হলেন আর ফিরে আসেননি।
আমিনাকে বিয়ে দেয়ার পর সামিনা যখন ডিগ্রিতে পড়া শোনা করছে তখন হঠাৎ করেই সে এক অদ্ভুত অসুখে পড়ল। তার তল পেট ব্যথা করে উঠে সময়ে অসময়ে। ডাক্তার দেখানো হলো, বৈদ্য , কবিরাজ বাদ গেলনা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলনা। কেন ব্যথা করছে সেটা ধরতে পারছেনা, কোন ঔষধে কাজ করছেনা।
মেয়ের অবস্থা বেগতিক দেখে হামিদা বানু নফল রোজা রাখলেন আর আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন- আল্লাহ যেন মেয়েকে সুস্থ্যতা দান করেন এবং মেয়ের পরিবর্তে তাকে সেই অসুখ দেন।
মাহিদা বানুর মনে প্রানে এই চাওয়া কবুল হলো। সামিনা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন আর হামিদা বানু মেয়ের অসুখে নিজে ভুগতে লাগলেন।
তারপর একদিন হামিদা বানু পাড়ি জমালেন অনন্তের ওপারে। মায়ের এই ত্যাগ পৃতিবীতে বিরল।
সামনিা জামান স্মৃতি থেকে ফিরেন। মায়ের মৃত্যুর জন্য সে নিজেকে অপরাধী মনে করে। তাই নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারেনা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেয়ের রুমে ঢুকে পড়েন।
রিতা মাকে দেখে মুচকি হাসে। গান থামায়। মা মেয়ে কথা হয় অনেক বিষয় নিয়ে।
- তোর কলেজে কবে হচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সা
-
- মা তুমি যে কি ? সব ভুলে যাও। আর মাত্র দুদিন বাকি।
-
- তা এই গানটা গাইবি বুঝি।
-
- অবশ্যই।
-
- নে এবার কিছু নাস্তা করে নে।
-
- ঠিক আছে তুমি যাও আমি আসছি।
সামনিা জামান ডাইনিং টেবিলে মেয়ের জন্য নস্তা সাজাচ্ছে। রিতা সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে গেলো। পড়ে যাওয়াতে সে বেশ ব্যথা পেয়েছে।
হঠাৎ পড়ে যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে রিতা মাকে বলে মাথা ঘুড়ে উঠেছে তাই সে পড়ে গেছে।
মায়ের মন কু ডাক ডেকে উঠল। এটা ভাল লক্ষণ নয়।
দুদিন পর রিতা তার মাকে নিয়ে কলেজের সংস্কৃতি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করল । তার গান শুনে সবাই মুগ্ধ। গান শেষে সবাই যখন করতালি দিয়ে তাকে উৎসাহিত করল, সে তখন মনে মনে ঠিক করলো নিয়মিত গান গাইবে। বাসায় ফিরে গান নিয়ে তোর জোর শুরু করল কিন্তু কে জানত বিধির লিখন ছিল অন্য।
এদিকে রিতার বড় বোন রেহেনা বেশ কয়েকদিন যোগাযোগ করছে না তাই সামিনা জামান বেশ চিন্তিত । রেহেনা তার স্বামী সন্তান নিয়ে কানাডায় থাকে প্রতি সপ্তাহে ফোনে ভিডিও কলে কথা হয় কিন্তু ইদানিং তাকে অনলাইনে দেখা যাচ্ছে না। তাই মেয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেনা মনটা সামিনা জামানের ভার হয়ে আছে।
তাহলে কি রেহেনা কোন অসুখে পড়েছে ? নাকি এক্সিডেন্ট করেছে, কে জানে ?
তবুও সামিনা জামান মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠিয়ে রেখেছে- তোদের কি হয়েছে? কোন খোঁজ খবর পাচ্ছি না। আমি খুব টেনশনে আছি।
আরো দুদিন কেটে যাওয়ার পর রাতের বেলা রেহেনা ফোন দেয় তার মাকে। তারা সাপ্তাহিক বন্দের দিনে ঘুরতে বেরিয়েছিল কিন্তু ফেরার পথে গাড়ি এক্সিডেন্ট করাতে তাদের কয়েকদিন হাসপাতাল থাকতে হয়েছে তাই যোগাযোগ করতে পারেনি।
সামিনা জামান বলল- সন্তান বিপদে পড়লে মায়ের মন ঠিকই টের পেয়ে যায়। তোরা এখন থেকে সাবধানে থাকিস। ভালো থাকিস।
রিতা গান নিয়ে পড়ে আছেন এর মধ্যে হঠাৎ একদিন সে আবিষ্কার করল তার মুখের ভিতর একটা ছোট্ট গোটার মত হয়েছে।
গোটা হয়তো নিজেই সেরে যাবে তাই সেটাকে গুরুত্ব দিলো না রিতা। সেই গোটা ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো । এখন খাওয়ার সময় অস্বস্তি হয়। ব্যাপারটা আর চেপে না রেখে রিতা মাকে জানালো।
সামিনা জামান বললেন, সব ব্যাপার অবহেলা করতে নেই। কিছু কিছু ব্যাপারে সিরিয়াস হতে হয় । চল আজই ডাক্তার দেখাই।
ডাক্তার দেখানোর পর ডাক্তার টেস্ট দিলেন। টেস্ট করিয়ে বাসায় ফিরে রিতা বেশ টেনশনে পড়ে গেল। এ বার তার কি হয়ে গেলো। কত স্বপ্ন পড়ে রয়েছে। ডিগ্রী কম্পিলিট করে সে সৈকতকে বিয়ে করবে। তারপর চাকরি করবে, গানের এ্যালবাম প্রকাশ করবে।
পরের দিন রিপোর্ট দেখে ডাক্তার যেটা বললেন সেটা শুনে সামিনা জামান আকাশ থেকে পড়েন।
তার সুস্থ সবল মেয়ে, তার নয়নের মনি রিতার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। একি বিশ্বাস করা যায় !
আল্লাহ এখন কি হবে, এই মরন ব্যাধি কেন আমার মেয়ের বুকে বাসা বাঁধলো। রিতাকে রিপোর্টের কথা জানানো হয়নি।
কিন্তু দিন যতই যেতে লাগল রিতা ততই অসুস্থ হতে লাগলো । তার খাওয়া-দাওয়া করতে আরও বেশি সমস্যা হতে লাগলো । সে বারবার বলতে লাগলো, মা আমার কি হয়েছে ? আমি কেন খেতে পারছি না।
সামিনা জামান চোখের কান্না চেপে রেখে মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, তেমন কিছু হয়নি রে মা চিকিৎসা করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সুস্থ্য হলে তুমি সব খেতে পারবে।
বেশ কয়েক মাস পর ডাক্তার যখন বললেন যে ক্যামোথেরাপি নেওয়া ছাড়া আর উপায় নাই। তখন বাধ্য হয়ে রিতার মা রিতাকে জানাল। তখন রিতা প্রথম জানতে পারলো তার ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
সে প্রথম দুদিন বেশ মনমরা হয়ে রইল। তারপর নিজের নিয়তিকে মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো।
সৈকত জোহার সাথে রিতার প্রেম ছিল। রিতা সৈকতকে জানিয়ে দেয় তুমি আর আমার সাথে যোগাযোগ রেখো না। এ জীবনে তুমি আর আমায় পাবে না। আমি চাইলেই তোমার সাথে ঘর বাধতে পারবনা।
সৈকত মরিয়া হয়ে জানতে চায় কেন ? তোমার কি হয়েছে ?
রিতা শুধু কাদে। কোন কথা বলতে পারেনা। শেষে বলে তুমি একদিন বাসায় আসো।
সৈকত রিতার সাথে দেখা করে বলে, তোমার যাই হোক না কেন আমি তোমার হাত ছাড়বো না।
রিতা হেসে বলে কিছু কিছু ভালোবাসা কখনোই পূর্ণতা পায় না। হয়তো এ জীবনে তোমাকে পাবো না। কিন্তু আমি পরকালে তোমার জন্যই অপেক্ষা করবো । তুমি আমাকে ভুলে গিয়ে অন্য কারো সাথে জীবন শুরু কর।
আমার জন্য তুমি নিজেকে কষ্ট দিওনা তাহলে আমি সে আঘাত সইতে পারবো না। চোখের জলে ভাসিয়ে সৈকতকে বিদায় দেয় রিতা। তার পর সময়ের স্রোতে ভেসে চলে সে, ভেসে চলে পৃথিবীর আর সবকিছু।
প্রথম ক্যামোথেরাপি দেওয়ার পর রিতার মনে হল তার মুখটা বুঝি পুড়ে গেছে। দ্বিতীয় ক্যামোথেরাপি দেওয়ার পর তার চুল ঝরে যেতে লাগলো। মুখে মলিনতার ছাপ, চোখের নিচে কালি। ভগ্ন স্বাস্থ্য আর উদাসী দৃষ্টি।
সামিনা জামান তাঁর প্রাণবন্ত মেয়ে রিতার এই হাল দেখে আৎকে উঠেন। আর বলেন আমার মেয়ের না হয়ে যদি আমার ক্যান্সার হতো তাহলে আমি খুশি হতাম। আল্লাহ তুমি আমাকে নিয়ে যাও কিন্তু আমার মেয়েকে বেঁচে থাকার শক্তি দাও। তিনি কাঁদেন, আহাজারি করেন।
একদিন রিতা হাসপাতালের বেটে শুয়ে মাকে বলল, মা আমার মন চায় সাদা ঝরঝরা ভাত আর গরুর মাংস খেতে ।
তোমার যা মন চায় আমাকে বলবে মা। তোমার আর কি খেতে মন চায় ? আমি তোমার সব চাওয়া পূর্ণ করবো। সামিনা জামান বাসমতি চালের ভাত আর গরুর মাংসের কালা ভুনা করে নিয়ে আসেন। মায়ের হাতে রান্না দেখে খুশি হয় রিতা কিন্তু মুখে দিতেই সে বুঝতে পারে ভাত মাংস খাওয়ার শক্তি বা সাধ্য কোনটাই তার নেই।
মেয়ে যখন মুখ থেকে খাবার ফেলে দিল সামিনা জামান পর্দার আড়াল থেকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মায়ের সামনে সন্তানের অভুক্ত থাকা তারপর করুন মৃত্যু দিকে এগিয়ে যাওয়া সেটা কি কখনো মেনে নেওয়া যায়।
এদিকে রেহেনা বার বার বলছে সে তার বোনকে কানাডায় নিয়ে চিকিৎসা করাবে কিন্তু রিতা যেতে চায় না। সে বলে কোন লাভ নেই । যদি আমি ভাল হই তবে দেশের চিকিৎসা ভালো হবো আর আমার মৃত্যু যদি লেখা থাকে আমি দেশের মাটিতেই মরবো।
রিতা এক দিন তার মাকে তার শেষ ইচ্ছার কথা জানালো, মা আমার বধূ সাজার খুব ইচ্ছে। সাদা গাউনে নিজেকে দেখতে ইচ্ছে করে।
রিতার মা মেয়ের কথা শুনে বুঝে গেলেন মেয়ে আর বেশি দিন বাঁচবেনা। তার মুখে পচন ধরেছে। আগে যারা আত্মীয় স্বজন দেখতে আসতো তারাও আর আসেনা। মা সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেছেন, জন্ম দিয়েছেন মা সব সয্য করতে পারেন কিন্তু অন্যরাতো আর সয্য করবেনা।
মেয়েকে বিয়ের সাজে সাজিয়ে তাকিয়ে তাকেন সামিনা জামান। সাদা গাউনে পরীর মত লাগছে রিতাকে। বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। বিয়ের আগেই মেয়ে কবরের ঘরের বাসিন্দা হতে যাচ্ছে।
অবশেষে একদিন রিতা না ফেরার দেশে পারি জমায়। একলা জননী সামনিা জামান মেয়ের সেই গানটা গুন গুন করে গান আর অশ্রু বিসর্জন দেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আশা
মায়ের ভালোবাসার কাছে পৃথিবীর সবকিছুই তুচ্ছ। মোটামুটি ভালো লেগেছে।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
একজন মা তার সন্তানের জন্য জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দেন এবং মায়ের মন সন্তানের বিপদ আগাম টের পেয়ে যায় সেটাই গল্পে তুলে ধরা হয়েছে।
২৪ আগষ্ট - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৯৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।