কিলো সোহেলী আজ তোর কি হইছে ? কামে মন নাই ক্যান। কথা বলেই দলের শামীমা দোকানদার থেকে দশ টাকা আদায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আজকাল কেউ আর টাকা দিতে চায়না। তখন অশোভন আচরণ করে টাকা দিতে বাধ্য করে শামীমার মত হিজড়ারা। আর যদি দলবল নিয়ে বের হয় ওরা তবেতো কথাই নেই। টাকা না দিয়ে সহজে কেউ পার পায়না। আজকে সোহেলীদের দলে আছে পাঁচজন। হাততালি দিয়ে, রং ঢং করে মানুষের কাজ থেকে টাকা চেয়ে, চাঁদা উঠিয়ে, গালি দিয়ে, গালি শুনে এভাবেই জীবন চলছে তাদের।
রুমির সেদিনের কথাটা খুব মনে পড়ে আজকাল-এটা কি কোন মানুষের জীবন, সং সেজে থাকা, প্রতিদিন নিজের সাথে নিজেই অভিনয় করে যাওয়া। না পুরুষ না নারী কাউকে ভালোবাসা যায়না, কাউকে আপন করে পাওয়া হয়না। কেউ ভালবাসেনা আমাদের। মৃত্যুই একমাত্র মুক্তি।
রুমি ওদের সাথে আজ কয়েক বছর ধরে আছে। রুমী মেয়েদের পোশাক পড়েনা, টাকা উঠানে যায়না। নিজের মত করে স্বপ্ন দেখে । আর স্বপ্ন দেখায় ওদের মত চির অবহেলিত হিজড়াদের সুন্দর করে বেঁচে থাকার।
দুপুরের দিকে আগ্রাবাদ মোড় পাড় হওয়ার জন্য যখন ওরা রাস্তার পশ্চিম পাশে দাড়িয়েছিল। ঠিক তখনই সোহেলীর হৃদপিন্ডে ধুকপুক শুরু হলো। অস্থিরতায় ছটফট করতে লাগলো সে। ঘামে ভিজে গেল সর্বাঙ্গ।
আজরেক দিনটা কেমন যেন অলুক্ষনে। সকালে বের হওয়ার সময় দরজায় ছিটকানিতে লেগে হাত কেটে রক্ত বেরোলো। রুমীর সাথে দেখা হলনা। রুমি কি একটা কাজে বেরিয়ে গেছে আরও আগে। গেটের পাশে আসতে না আসতেই নীম গাছটায় একটা দাড়কাক ডাকতে লাগলো। সেই কাকের চোখে যেন অশুভ ছায়া । তাকালেই কেমন ভয় লাগে। গলিটা পাড় হতে না হতেই পাড়ার ছেলেগুলো এক দফা হেনস্তা করলো। ওদের হাত থেকে কোন রকম পালিয়ে বাচলো সোহেলী। নাস্তা খাওয়ার মুঠটাই নষ্ট করে দিল ছোকড়াগুলো।
সারাটা দিন কেমন যেন পানসে লাগলো। নাচ, গান, ফূর্তি, মানুষের শরীরে হাত দেওয়া সবকিছুই কেমন যেন খেলো মনে হতে লাগলো। পৃথিবীর প্রতি যেন মন বিতৃষ্ণায় ভরে গেলো।
সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরার মূহুর্তে সুরুচি ক্যাফেতে এক কাপ চা খাওয়ার চরম ইচ্ছে জাগলো। চা হাতে যখন ওয়েটা ছেলেটা আসছিল হঠাৎ আরেকজনের সাথে ধাক্কা লেগে চা পড়ে গেলো। সোহেলী আর দেড়ি না করে সেখান থেকে দৌড়ে ওদের আস্তানায় চলে এলো।
সোহেলী বা তাদের দলের জন্য এক বেদনাদায়ক সত্য অপেক্ষা করছিল। ঘরের সামনে সাদা কাপড়ে একটা লাশ পড়ে আছে। সেখানে জড়ো হয়ে কাঁদছে সবাই।
রুমির দুর্ঘটনার কথা শুনে আর স্থির থাকতে পারলনা সোহেলী। রুমি, রুমিরে বলে একটা চিৎকার দিয়ে সে লুটিয়ে পড়ল লাশের উপর। জ্ঞান ফিরার পর থেকে অনেকক্ষণ কাঁদলো সোহেলী। কখনো নিরবে কখনো আর্তনাদ করে। কাঁদতে কাঁদতে সোহেলীর চোখের জলে যেন শ্রাবণ ধারা হয়ে গেছে। রুমির লাশের পাশে ওরা সবাই ছিল কারণ রুমি ওদের সবার পছন্দের মানুষ ছিল। ওদের অভিশপ্ত জীবনে রুমি ছিল একমাত্র আশার আলো। রুবি মারা গেছে সেই দুপুরে অ্যাক্সিডেন্টে আর এখন রাত নেমেছে অন্ধকার রাত ।গভীর রাত ছাড়া তো রুমিকে খবর দেওয়া যাবে না। ওরা যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তাইতো তাদের জন্মতে যেমন অভিবাদন নেই , নেই উষ্ণতার পরশ তেমনি মৃত্যুতেও থাকেনা আপনজনের বিদায়ী হাতের স্পর্শ আর পায়না প্রিয়জনের শেষ স্পর্শের উষ্ণতা ।
সবাই ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে একটু বিশ্রামের জন্য যার যার রুমে চলে গেছে। কিন্তু সোহেলী রুমিকে ছেড়ে যেতে চায় না তাই সে একটা চাদরে নিয়ে উঠানে রুমির লাশের পাশে বিছিয়ে শুয়ে রইলো। নিরব নিস্তব্ধ রুমির নিস্পন্দন দেহের দিকে তাকিয়ে সোহেলীর কত শত স্মৃতি পাখা বুকের ভিতর প্রজাপতির মতো ডানা মেলেছে।
সোহেলী যেমন একদিন সমাজ, পরিবার, পরিজন এর কাছে চরমভাবে নিগৃহীত হয়ে চলে এসেছিলো এক কাপড়ে রাস্তায় তারপর তো এই হিজড়াদের আখড়াই হয়ে উঠে তার ঠিকানা। বাড়ি থেকে যেদিন চলে এসেছিল সেদিন সে অনেক কেঁদেছিল কিন্তু তার কান্নার কোন মূল্যই দেয়নি কেউ। বরং সেই মানুষগুলো তার কান্না দেখে যেন খুশিই হয়েছে, যেন আপদ বিদায় হচ্ছে ভেবে তারা শান্তনা পাচ্ছে। জন্তু জানোয়ারের মত আঘাত করেছে কি শরীরে, কি হৃদয়ে। তাদের কথার আঘাত, হাতের আঘাত, পায়ের আঘাত আজও দগদগে ঘা হয়ে আছে মনের ভিতর। শরীরে পাওয়া আঘাত একদিন শুকিয়ে যায়, কিন্তু মনে যে আঘাত দেয় কাছের মানুষেরা তা শুকায়না কখনো।
রুমিকে যখন ওরা রাস্তায় পেয়েছিল তখন ওরা অবাক হয়েছিল যে সমাজের উচ্চবিত্তের ঘরে জন্ম নিয়েও রুমির কপালে জুটেছে তাদের মতোই ভাগ্য। সারা শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন। জায়গায় জায়গায় কেটে ফেটে রক্ত বেরিয়েছে বার বছরের একটি শিশুকে এভাবে তার বাবা ও সৎ মা অত্যাচার করতে পারে সেদিকনও সেটা যেন অনেকটা কল্পনার বাইরে ছিল। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর সেই রুমিকে দেখে, ওর চোখে সেই বাঁচার আকুতি দেখে সোহেলী ওকে নিয়ে গিয়েছিল ওদের আস্তানায়।
তারপর সুস্থ হওয়ার রুমি মুখ খুলে ছিল বলেছিল তার উপর নির্মম নির্যাতন করার কথা। মা মরে গেলে বাবা বনের পশু হয়ে যায় রুমি যেন সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আরেকবার এই সমাজকে। সম্পদ ও সম্পত্তির লোভে বাবার প্রাক্তন গার্লফ্রেন্ড বিয়ের জন্য যখন জোরাজুরি করতে লাগলো তখন বাবা বাধ্য হয়ে সেই গার্লফ্রেন্ডের সাথে লিভ টুগেদার করতে লাগলো। খুব শিঘ্রই তারা বিয়ে করবে। তাদের অবাধ যৌনতার জীবনে রুমি যেন পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ালো তাই তাকে অহেতুক অযথা খাবারের কষ্ট দেওয়া, শীতের রাতে বাথরুমে ভিজিয়ে বন্ধ করে রাখা, বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করাসহ হরেক রকমের নিত্যনতুন অত্যাচার চলতে লাগলো তার উপর।
কংক্রিটের দেয়াল ভেদ করে তার কান্না পৌছায়না প্রতিবেশীদের কাছে। তবুও মাঝে মাঝে তার চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা জানতে চাইলে সেই মহিলা বলতো-বাচ্চা পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে কিংবা হাত কেটে গেছে তাই কাদছে।
সেইসব দিনগুলোতে রুমির নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে গেলে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে মাকে ডাকতো তাকে একটু জড়িয়ে ধরার জন্য একটু ভালোবাসার জন্য একটু স্নেহের জন্য একটু বুকের ওম দেওয়ার জন্য।
মা কেন তুমি একা চলে গেলে ? আমাকেও কেন নিলেনা সাথে। আমার যে এখানে বড় কষ্ট। রুমির এমন হাহাকার বাতাসে মিলিয়ে যায় আর পৌছে যায় খোদার আরশে।
সোহেলীকে রুমি জানিয়েছিল-আমার আঠার বছর বয়স হলে আমি ঐ বাসা দখল নেবে। আমার নামে ইউল করা ঐ বাসার মালিক হবো আমি। কি নিয়তি আমার নিজ বাসায় অন্য এক মহিলার রাজত্ব।
সোহেলী বলেছিল-আমরা নিজ পরিবারেই বরাধীন বাসিন্দা। যেন প্রাচীনকালের দাস। না আমাদের কোন মূল্য আছে। না আছে চাওয়া-পাওয়ার দাম।
রুমি যেহেতু স্কুলে পড়ত তাই সে আখড়ায় এসেও লেখাপড়া করতে চাইতো তাই তাকে লেখাপড়ায় বাধা দেওয়া হয়নি। অন্যান্যদের মত সে টাকা তুলতে যেত না, যেত না কোন খারাপ কাজে, যেত না দেহ ব্যবসার কাজে। সর্দারনী তাকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখত। রুমি বলতো আমার আঠারো বছর পার হয়ে গেলে আমি তোমাদের সবাইকে এক সুন্দর জগতে নিয়ে যাব, যেখানে আমার জীবন হবে মশৃন।
উত্তরার ছয় তলার ফ্ল্যাট যেহেতু রুমির নামে । তাই সে ভেবে রেখেছে বয়স আঠারো পূর্ণ হলেই সে তার অধিকার ছিনিয়ে নিবে তার বাবার কাছ থেকে আর সেই নিষ্ঠুর মহিলার কাছ থেকে। তারপর সেই ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে যা টাকা পাওয়া যায় সেটা দিয়ে এই অবহেলিত অনাদরে পরে থাকা হিজড়াদের আর্থিক ভাবে সফল করার জন্য সহযোগিতা করবে।
কিন্তু সেই নিদারুণ স্বপ্ন মাঝপথেই এভাবে দুঃস্বপ্নের মতো ভেঙে যাবে কে জানতো। কে জানতো এক্সিডেন্টের নামে তাকে তার আপন বাবা মা-ই খুন করবে। কে জানতো নিয়তি যে এমন নির্মম খেলায় মেতে উঠবে। কে জানতো জীবন নামের যন্ত্রণা এভাবেই সমাপ্তি হবে।
সোহেলী ভাবে প্রতিশোধ নেবে কঠিন প্রতিশোধ। পুলিশকে জানিয়ে দেবে কিন্তু জানিয়ে বা কি লাভ হবে এই সমাজর আইন শুধু যাদের টাকা আছে তাদের জন্য। সে তো প্রমাণ করতে পারবেনা। রুশির বাবা মা ই প্রকৃত আসমী। সোহেলী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে খুনের বদলে খুন। জীবন থাকতে সে এর শেষ দেখে ছাড়বে।
খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বড় অভিমান নিয়ে সৃষ্টিকর্তাকেই বলে চলছে রুমি- কোন অপরাধে এমন জীবন দিলা বিধি ? জন্মের পর থাইকা শুধু জ্বালা আর যন্ত্রনা। নেই আদর, নেই কোন কদর। বেঁচে থাকার অপর নাম শুধু লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। শুধু মৃত্যুতে মুক্তি মেলে তবু সেখানেও নাটক- জানাযার নামজ পড়ানোর মত কাউকে পাওয়া যায়না, দোয়া হয়না, প্রিয় জনা পাশে থাকেনা। একমুঠো কবরের মাটি পাওয়ার জন্য রাতের অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা।
দুচোখে অশ্রুর ফোয়ারা নিয়ে সে জিজ্ঞেস করে চলে-কেন ? কেন ? কেন এমন জীবন দিলা বিধি। না পুরুষেরে ভালোবাসা যায়, না নারীকে ভালোবাসা যায়। সংসার করা যায়না, সন্তান নেওয়া যায়না। অস্পর্শের দেয়ালে বন্দি থেকে কলিজা পোড়ানো কষ্ট নিয়া জীবন বয়ে বেড়ানোর জন্য কেন দুনিয়াতে পাঠাইলা।
রুমিকে গভীর রাতে যখন গোরস্থানে নিয়ে কবর দেওয়া হচ্ছিল তখন সবার চোখের অশ্রু বাদ না মেনে গড়িয়ে পড়ছিল ঘাসের গায়ে। সোহেলী শুধু কবরের মাটি কি বলছিল- হে কবরের মাটি রুমিকে তোর কাছে রেখে গেলাম। জীবনে যখন ভালোবাসা পায়নি মরনে যখন তোর বুকে ঠাঁই হয়েছে তুই একটু মায়ের কোলের ওমের মতো উষ্ণতা দিস, একটু ভালোবাসা দিস।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনে চরম সত্য তুলে ধরা হয়েছে। যারা সারা জীবন ধেরে খুঁজে বেড়ায় একটু উষ্ণতা।
২৪ আগষ্ট - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৯৮ টি
সমন্বিত স্কোর
৩.৬৪
বিচারক স্কোরঃ ২.১ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ১.৫৪ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪