প্রত্যাশা

প্রত্যাশা (আগষ্ট ২০২০)

deep
  • ৪২৬
আজ অনেক দিন বাদে আবারও ওই একই জায়গায় গিয়ে বসে আছি। দেশবন্ধু পার্কে এলেই অনেক পুরোনো কথা ,পুরোনো স্মৃতি মনের মধ্যে ফুটে ওঠে। ঠিক ভালো লাগে না খারাপ লাগে সেটা বুঝতে না পারলেও প্রতিবারই একটা অন্যরকম অনুভূতি হয় মনের ভেতর। এবারেও সেরকমই অনুভূতি হচ্ছে। বিকেলে পড়ন্ত রোদটা মাঠের একপাশে পড়েছে , একটা মৃদু মিঠেল হাওয়া বইছে , মাঠে কয়েকটা ছেলে ক্রিকেট খেলছে। বয়ে যাওয়া ঠান্ডা হাওয়াটা গায়ে মেখে নিয়ে বেশ স্বস্তি অনুভব করলাম আমি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাতেই পেঁজা তুলোর মতো মেঘগুলো চোখে পড়লো। মেঘগুলো কি সুন্দর আকাশের গায়ে একটা নকশা এঁকেছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো আর্টিস্ট তার ক্যানভাসে নিজের খেয়ালে তার সৃষ্টি ফুটিয়ে তুলেছে।

পার্কটায় আজ অন্যদিনের তুলনায় ভীড় বেশ কম । এদিক ওদিকে কয়েকটা বেঞ্চে কিছু প্রেমিক প্রেমিকা একে ওপরের হাত ধরে বসে আছে। চা , বাদামওয়ালারা ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছে। কিছু বয়স্ক লোক মাঠে একপ্রান্তে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ছেলে,মেয়েগুলোকে দেখে আবার মনের মধ্যে পুরোনো স্মৃতিগুলো ভেসে উঠলো ....

“আমার পক্ষে তোর সাথে আর সম্পর্ক রাখাটা সম্ভব হবে না , সামনের মাসেই আমার বিয়ে “ আঁখির এই একটা কথা চার বছর ধরে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা ভালোবাসার নির্মম সত্যটাকে এক নিমেষে গুড়িয়ে দিয়েছে। তারপর প্রায় তিন বছর কেটে গেছে , এর মধ্যে অনেকবার ভেবেছিলাম আর ভাববো না , আর ভেবে কি হবে ,ভেবে কি সবটা আগের মতো হবে ,সবটা কি আগের মতো ভাবলেই বদলে যাবে নাকি। কিন্ত না ভাবতে চাইলেও কি ভাবে জানি পাল্টা হওয়ার মতোই মনের মধ্যে পুরোনো স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে। যে সময়টা চলে যায় তা আর কখনোই ফিরে আসে না। যে সুযোগ একবার চলে যায় তা আর দ্বিতীয়বার কখনো ফিরে আসে না। কিন্তু এখনও কেন জানি না কিসের টানে বারবার এখানে আসতে মন চায়। এখানে এলেই একরাশ মন খারাপ ভিড় করে আসে। তবু এখানে আসার টান এখনও আমার কাছে অজানা।

"বাদাম নেবেন বাবু, বাদাম" ঘোর টা কাটলো বাদামওয়ালার আওয়াজে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে চলেছে টেরই পাইনি। বাদাওয়ালা দিকে তাকিয়ে বললাম "উম, না খাবো না" । "আচ্ছা" জবাব দিয়ে চলে গেল। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম ভিড় খানিকটা বেড়েছে আগের থেকে। উঠে পরলাম আমি, হেঁটে কিছুটা মাঠটা পেরোতেই পিছনে একটা গলার আওয়াজ শুনে থমকে দাড়ালাম। হঠাৎ একটা হালকা শিহরণ খেলে গেল শরীরের মধ্যে। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো ভুল শুনেছি , এই ভেবে আরেকটু এগোতেই আবারো সেই চেনা ডাক। "সৌম্য,তুই না?"। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখি যার কথা ভেবে আজও আমার ভালো সময়গুলো কাটতে চায় সেই আঁখি। হ্যা আঁখি। চার বছর ধরে যে ছিল আমার ভালো থাকার প্যান্দরা বক্স তাকে দেখলে চিনতে পারব না এ কখনোই হতে পারে না। সেই চোখ, সেই এক মুখ, সেই কোমর অবধি নেমে যাওয়া লম্বা চুল, আর হ্যা আমার সবথেকে প্রিয় ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা একটা হালকা মিষ্টি হাসি। তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এসব কিছুই পাল্টায়নি। ওকে এখানে দেখে মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কি করবো বুঝতে পারছি না। এগিয়ে যাবো নাকি ফিরে যাবো নিজের মনকেই প্রশ্ন করলাম আমি। হৃদস্পন্দন কয়েকগুন বেড়ে গেছে অনুভব করলাম। মনের মধ্যে একটাই কথা আসছে সামনে আঁখি দাড়িয়ে। যাকে একটু দেখার জন্য ছট্ফট্ করেছি, আজ সে আবার আমার সামনে দাড়িয়ে , চলে যাওয়া কি ঠিক হবে। আমাকে হয়ত আরেকটা সুযোগ দেবে নতুন করে সবকিছু শুরু করার। "দূর এসব কি ভাবছি, এটা কখনোই সম্ভব না, ওর বিয়ে হয়ে গেছে" নিজের মনকে বোঝালাম আমি। ওর ওপর আর আমার কোনো অধিকার নেই, ওর জীবনে সৌম্যর কোনো জায়গা নেই। ওর আর আমার মধ্যে ব্যবধান এখন অনেক বেড়ে গেছে। সেটাকে মিথ্যা করার অধিকার আমার নেই। এই ভেবে কিছুটা বিব্রত হয়ে পিছনে ফিরতেই দেখলাম ওই এগিয়ে আসছে।

"কিরে চলে যাচ্ছিস। এতদিন পর দেখা হল। আর কিছু কথা না বলেই চলে যাচ্ছিস"
"না মানে আমার কিছু কি আর সত্যি বলার আছে।" আমতা আমতা করে বললাম আমি।
"তোর কিছু বলার নেই?"
"আমাদের কথা তো অনেক দিন আগেই শেষ হলে গেছে আঁখি, আর কি কিছু বাকি আছে" মুখটা নামিয়ে বললাম আমি।
আঁখির হাসিটা মিলিয়ে গেল কথাটা শুনে।হালকা ভাবে শুধু বলল "ও, ঠিক আছে" । একটু থেমে আঁখি বলল "তবু তিন বছর পর দেখা হল, কিছু তো বল। এখানে এলেই তো তোর কথাই শেষ হতো না। কি করে সময় কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না।"
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে যেন বুকের মধ্যে মৃদু যন্ত্রণা অনুভব করছি। হয়তো যে যন্ত্রণাটা এতদিন মেঘ হয়ে জমে ছিল আজ যেন বৃষ্টি হয় নেমে আসতে চাইছে।ওর কথা না রেখে পারলাম না বললাম, "চ ওদিকটায় "। "কোথায় যাবি?" বলল আঁখি।
"কেনো এখানে এলে যেখানে গিয়ে বসতাম…”

চেনা জায়গায় গিয়ে দেখলাম ওখানে দুজনে বসে আছে। তাই বাধ্য হয়ে একটু দূরে আরেকটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। ওর দিকে সরাসরি তাকাতে পারছি না মুখ টা নামিয়ে আছি। একটু সময় দুজনে চুপ থেকে আঁখি বলল "কেমন আছিস?" প্রশ্নটা করতেই ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম “কেমন আছি ? তা শেষ যেমন দেখে গেছিলি।তা মুখ দেখে তো আগে বুঝতে পারতিস কেমন আছি । “ আঁখি ঘাবড়ে গেল হয়তো ও এমন উত্তরের প্রত্যাশা করেনি। আমিও আঁখিকে দেখে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেও যেন পারছি না। আঁখি হালকা হেসে বলল “তিন বছর কেটে গেছে। আর তোর মুখ দেখেও আমার বোঝা সম্ভব না। সেই সম্পর্কের স্বাভাবিকতা আজ আর আছে কি ?” আমি আঁখির হাতটা নিজের অজান্তেই কাছে টেনে নিয়ে বললাম “আমি জানিস তো , প্রেমিকার থেকেও অনেক বেশি তোকে বন্ধু হিসাবে চেয়েছিলাম। আর তোর প্রতি ভালোবাসাটা কেন জানি না আজও একই রকম আছে। সেই জন্যই একটু কথা বলার আবদারটা ফেলতে পারলাম না।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম কথাটা বলে। আঁখি ওর হাতটা আমার হাতের থেকে সরিয়ে নিয়ে বলল “ আমার সব মনে আছে , কোনোকিছু ভুলতে পারিনি “
“যাক ভালোবাসার কথাটা ভুলিসনি এখনো, শুনেও ভালো লাগলো। তা আমার কথা বাদ দে। তোর কথা বল আমার কাছ থেকে যা যা পাসনি সব পেয়েছিস এখন। কত বড় পরিবারে তোর বিয়ে হয়েছে। অত বড় নামি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির টেকনিকাল হেড তোকে নিশ্চই খুব সুখে রেখেছে। ব্যাংকক ,দুবাই ঘুরে বেড়াচ্ছিস। “ আঁখি একটা ব্যঙ্গ মিশ্রিত হাসি হেসে বলল “হুম ভালোই আছি .“

“তুই এখানে আজ কি করতে এসেছিলি। কোনো বিশেষ কারণ নাকি ?” আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো আঁখি।
“না, ওই একটু ঘুরতে, একসময় তো এই জায়গাটা আমার বড্ড প্রিয় ছিল, শহরের ব্যস্ত কোলাহল পেরিয়ে বেশ একটা নিরিবিলি সবুজের হাতছানি। তাই আর কি মনটা শান্ত করতে। “
“আচ্ছা কলেজ জীবনের মতো এখনো গল্প-কবিতা লিখিস আর?. খুব সুন্দর লিখতিস তুই”
“হ্যা, ওটাই তো আমার এখন একমাত্র অক্সিজেন। জানিস তো অনেক প্রেমের গল্প লিখেছি, কিন্তু আমার জীবনের প্রেমের কাহিনী এভাবে লেখা হবে বুঝতে পারিনি। গল্প আর বাস্তবের মধ্যে অনেক তফাৎ, গল্পে চরিত্রের ভাগ্য আমি নিজেই ঠিক করি, কিন্তু বাস্তবে সেটা চেয়েও হয়না। সেজন্যই বাস্তবের খাতাটা ছিড়ে ফেলে দিয়েছি” একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম “ভুলে যেতে চাইলেও কিছু ভুলতে পারিনা। আজও আমি শেষদিনের মুহূর্তগুলতে পরে আছি, এগিয়ে যেতে পারছি না। সেই মুহূর্তগুলো বারবার যেন চোখের সামনে ফুটে ওঠে.”

আমি দেখলাম আঁখির চোখে জল। আমার চোখও নিজের অজান্তে ভিজে গেছে। আঁখি আমার হাত ধরে বলল “সৌম্য তুই এখনো কেন এতো ভাবিস ? যা হবার তা তো হয়ে গেছে। কেন এসব ভেবে এখনো নিজেকে কষ্ট দিস “
চোখ মুছে নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম “ওই যে বললাম কেন করি ,কি করি ,তা আমার নিজের কাছেও অজানা। শুধু আজও প্রতি রাতে ফেসবুক খুললে তোর প্রোফাইলটা একবার হলেও চেক করি। ওয়াটসএপ এ আজও তোর লাস্ট সিন্ আর প্রোফাইল পিকচার দেখি। আজও গভীর রাতে যখন শহর নিস্তব্ধ হয়ে যায় , তখন সিগারেট হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে জলছবির মতো সেই দৃশ্যগুলো দেখতে পাই। আর ভাবি যদি সেই দিনগুলো ফিরে আসতো। না সেটা ফেরা সম্ভব না আর কোনোভাবে। তবুও …. যাক বাদ দে সেসব কথা, তা হ্যারে এখনো তুই এটা কিনবো, সেটা কিনবো বলে বরের কাছে বায়না করিস বাচ্চাদের মতো। সেই আমার সাথে বেরোলেই ফুচকা আইসক্রিম খাবি বলে বায়না করতিস।সেই মনে আছে একবার ধর্মতলায় গিয়ে একটা গোলাপি রঙের পার্শ দেখে কেনার বায়না করেছিলি। সেই কিনে দিছিলাম না বলে কত রাগ করছিলি। তারপর সেই ভিড়ের মধ্যে কত কষ্ট করে সেই পার্শটা কিনলাম। তারপর আবার দাম বেশি নিচ্ছিলো বলে দোকানদারের সাথে ঝগড়া জুড়ে দিলি। উফ বাবা পারিসও বটে। চারদিকে সবাই তোর দিকে তাকিয়ে। তারপর আমি বললাম নে কিনে না , তারপর মেয়ে শান্ত হলো। তারপরও রাগে গজগজ করছিলি। ” আঁখি একটু গম্ভীর হয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল “তো কি করবো। ওরম সেম ব্যাগ মধুরিমাও কিনেছিল। ওর তুলনায় দাম বেশি বললে তো রাগ হবেই।
“ দেখছিস এখনো ঠিক একই আছিস , বাচ্ছাদের মতো করছিস।
আঁখি আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো। “সত্যিরে সেই দিনগুলো মনে পড়লে খুব হাসি পায়।”
“এটা তো আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না আঁখি ,আমি বলছি এখনো বরের সাথে বেরোলে এরম ছেলেমানুষি করিস “
“সময়ের সাথে সাথে সব কিছু পাল্টে যায় সৌম্য। সেই আঁখি আর এখনের মধ্যে বিস্তর তফাৎ। সময় সবাইকে ছোট থাকতে দেয় না। এখনো নিজের মধ্যে আগের আখির কোনো প্রতিচ্ছবি নেই। এখন আমি সেই ছোট্ট আঁখি নই। এখন আমি চ্যাটার্জী বাড়ির বড়ো বৌ। পরিবারে সকল দ্বায়িত্ব এখন আমার কাঁধে। পরিবারের সব ব্যাপারে তোমাকে আগে এগিয়ে আসতেই হবে। আর্থিক ভাবে মানসিক ভাবে ও শারীরিক ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেই হবে। তাতে তোমার নিজের ইচ্ছে আছে কি না তাই নিয়ে কারুর কোনো মাথা ব্যথা নাও থাকতে পারে। তবে এসব তোমার কর্তব্য"। এক নিঃশ্বাসে কথাগুল বলল আঁখি।
“তুই তো এমন জীবনই চেয়েছিলি। অনেক বড় পরিবার পাবি। স্বামী ভালো জায়গায় চাকরি করবে। নিজের গাড়ি বাড়ি হবে, এদিক সেদিক ঘুরবি, দামি দামি জামাকাপড় পড়বি, ভালোই করেছিস, সেসব আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। আমি আর কি করতে পেরেছি দেখ। বাবা মা কত আশা করে কলেজে ভর্তি করলো। পাশ করেও বেকার রয়ে গেলাম। যাওবা একটা কাজ পেয়েছিলাম সেটাও এসে চলে গেল। লেখালিখি করতে ভালোবাসি। তাও দু একটা ম্যাগাজিন ছাড়া বড়ো কোথাও সাফল্য পাইনি। বই বের করার চেষ্টা করলাম সেটাও হল না। এর মধ্যে বাবার চাকরিটা চলে গেল। মার ও ক্যান্সার ধরা পড়লো। আপাতত লাস্ট স্টেজ। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। এরম ভালো ভাগ্য আর কারুর দেখছিস।” একটা ব্যঙ্গত্বপূর্ণ হাসি হাসলাম আমি। তারপর বললাম “ তুই চলে যাবার পর, প্রথম প্রথম খুব রাগ হয়েছিল তোর ওপর। তারপর ভাবলাম আমার সাথে থাকলে সব আশা আকাঙ্খা পূরণ হতে পারত না তোর। অন্যদের মতো তোর ও নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে নেবার অধিকার আছে। তার থেকে যা হয়েছে ভালো হয়েছে এই বলেই নিজেকে সান্তনা দি।"
গলা শুকিয়ে গেছে। একটু জল পেলে ভালো হত। বুঝলাম অনেক দিন ধরে জমে থাকা মান অভিমানের আজ বিস্ফোরণ হচ্ছে।

আঁখি আগের থেকে অনেক গম্ভীর হয় গেছে। আমায় বলল "কাকুর চাকরি চলে গেছে। কাকিমার এই অবস্থা। তবে তুই সামলাছিস কি করে?"।
নিজের ভবিত্যবের কথা ভেবে হেসে বললাম "ওই দু একটা জায়গায় গল্প লিখে কিছু টাকা পাই। আর দুটো বাচ্চাকে পরিয়ে ওই যতটুকু পাই তাতে কোনরকমে চলে যায়"।

"বুঝলাম, সত্যি রে সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু চেঞ্জ হয়ে যায়। পরিস্থিতির চাপে পড়ে অনেকেই নিঃশেষ হলে যায়। তোর সব কথাই সত্যি আমি তোর থেকে অনেক বেশি সচ্ছল অনেক বেশি স্বাধীন, কিন্তু ওই যে সব কয়লাই হিরে হয় না। বাবা মা বিয়ে দেবার পর প্রথম কয়েকমাস ভালই চলছিল। তার পর রণিত অফিসার কাজে বাইরে যেতে লাগলো। তার পর আস্তে আস্তে বাইরে যাওয়া বাড়তে লাগলো। তার মধ্যে বাড়তে লাগলো ওর কাজের প্রেশার। মাঝে মাঝে কয়েক মাস বাড়ি ফিরত না। আমাকে ওকে ছাড়াই থাকতে হত। শাশুড়ি মা আমাকে ঠিক মেয়ে বলে মেনে নিতে পারেনি, ফলে নিত্য নতুন অশান্তি হত। মাঝে মাঝে গুমরে গুমরে কাঁদতাম।মাঝে মাঝে ওর থেকে এক দু সপ্তাহ কোনো ফোন আসতো না। বুঝতাম সম্পর্ক টা আর আগের মতো নেই। ওর সাথে ঝামেলা হত। ভাবতাম ডিভোর্স দিয়ে দি। কিন্তু বাবার কথা ভেবে আর মুখে বলতে পারিনি। মেয়ে ভালো থাকবে, সুখী থাকবে এই ভেবেই ওরা বিয়েটা দিয়েছিল। সব বুঝেও এখনও চুপ করে আছি।" রুমালে চোখটা মুছে নিল আঁখি।

এর মধ্যে কখন যে আঁখি আমার কাধে মাথা রেখেছে টেরই পাইনি। আজ যেন সেই হারানো দিন গুলো আবার ফিরে পাচ্ছি। সময় টা এখানেই থেমে গেলে বেশ হত। কিন্তু সময় যে স্থায়ী নয়। হয়তো আর কিছুক্ষন ব্যাস। সময় সবটা পাল্টে দিয়েছে। এখন দুজনের সংগ্রামটা দুরকম। দুজনের বাস্তব সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব ভাবতে ভাবতে মনে হল আর না এবার উঠতে হবে। যতই হোক আমাদের দুজনের পথ ভিন্ন। আর ওর জীবনের প্রতি হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমার নেই। তার কোনো প্রয়োজনও নেই। উঠে পরলাম আমি। আমাকে উঠতে দেখে আঁখি বলল "চলে যাবি ?"।
আমি বললাম "আর কি করবো বল। তুইও একটা সংগ্রামে লড়ছিস। আমিও। যদিও আমাদের দুজনের পথ ভিন্ন। দুজনকেই লড়ে যেতে হবে। নিস্তার কারুর নেই। ভালো থাকিস" এই বলে যাবার পথ বাড়ালে আঁখি বলল "দাঁড়া একটু"

তারপর আমার মুখোমুখি দাড়িয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল "তোকে একটা কথা বলবো"।
আমি বললাম "বল"
আঁখি বলল "তোর মনে আছে, সেই একবার তুই আর আমি যখন হাতিবাগান দিয়ে হাঁটছিলাম আমার একটা কানের দুল পছন্দ হয়েছিল। দামটা অনেক বেশি ছিল। তাই তুই কিনে দিতে পারিসনি। তার জন্য সেই আমার কি রাগ দুদিন কথাই বললাম তোর সাথে। তুই ফোন করছিলি ধরলাম না। তারপর আমার জন্মদিনের দিন আমায় ডেকে ঠিক এখানে এসে বললি চোখ বন্ধ কর। তারপর চোখ বন্ধ করতেই আমার হাতে সেই দুল জোড়া দিয়ে বললি এবার প্লিজ রাগটা কমা। আমাকে বলেছিলি সবসময় এই দুলটা পড়ে থাকতে। আমার বিয়ে হয়ে যাবার পর, তোর থেকে পাওয়া সব স্মৃতি চলে গেলেও এটা আমি হারাতে চাইনি। এদেখ এখনও পড়ে আছি এটা। এটাই আমার কাছে তোর একমাত্র স্মৃতি" । আঁখির কানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেই দুল জোড়া টা যেটা কলেজের ম্যাগাজিনে গল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে যে টাকা পেয়েছিলাম সেই টাকায় কিনে দিয়েছিলাম।

দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম। হঠাৎ পিছন ফিরে আওয়াজ শুনলাম "উফ সত্যি , তোমাকে নিয়ে পারা যায় না। বললাম গেট তার সামনে দাঁড়াতে, আর তুমি এখানে এসে দাড়িয়ে আছো। জ্যাম এর জন্য এমনি আসতে কত দেরি হয়ে হয়ে গেল। তার ওপর তোমাকে খুঁজতে। কলকাতা শহরে কত জায়গা আছে, তোমার যেন এখানে না এলে হত না।বলেছিলাম আমার দেরি হবে, ধর্মতলা দিকে আসো, কিন্তু শুনলে ত"। লোকটি এবার আঁখির কাছে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল "একি আপনি কে? আপনি ওর সাথে …. " । আমি লোকটির দিকে তাকাতেই আঁখি বলল "ওই রনিত, আমার হাসবেন্ড" । আমি বললাম "নমস্কার রনিত বাবু। আমি আঁখির কলেজের বন্ধু ছিলাম। আপনি আমায় চিনতে পারবেন না"। রনিত আমতা আমতা করতে আমি বললাম "চলি রে আঁখি, ভালো থাকিস, " বলে আঁখির দিকে তাকিয়ে হেসে এগিয়ে গেলাম। ওরাও মাঠের ওদিকটায় চলে গেল।

আঁখি এখনও আমার দেওয়া কানের দুল পড়ে। এটা ভেবেই মুখের হাসি আরো চওড়া হয়ে গেল। পার্কের গেট দিয়ে বেরোতে বেরোতে শুনলাম কারুর একটা মোবাইলের লাউডস্পিকারে গান বাজছে

যখন.. নীরবে দূরে, দাঁড়াও এসে
যেখানে পথ বেঁকেছে।
তোমায় ছুঁতে চাওয়ার মুহূর্তরা
কে জানে কি আবেশে দিশাহারা
আমিও ছুটে যাই সে গভীরে
আমিও ধেয়ে যাই কি নিবিড়ে
তুমি কি মরীচিকা না ধ্রুবতারা।

সত্যি ভালোবাসার মানুষের দাবিগুলো অত সহজে উপেক্ষা করা যায় কি?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নুরুন নাহার লিলিয়ান ভাল লাগল । লেখকের জন্য শুভ কামনা
ফয়জুল মহী কোমল পরশে শ্রুতিমধুর  চয়ন।

০৯ জুলাই - ২০২০ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "নগ্নতা”
কবিতার বিষয় "নগ্নতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ মে,২০২৪