হাওয়াই মিঠাইওয়ালা

প্রত্যাশা (আগষ্ট ২০২০)

  • ৩৫
একের পর এক বাস এসে স্ট্যান্ডে দাড়াচ্ছে। একেকটি বাস কতকজন মানুষকে তার পেটে ভরে ক্ষুদার্ত চিতার মতো ছুটে যাচ্ছে পরবর্তী বাস স্ট্যান্ডে, আরও কিছু মানুষ দিয়ে তার উদরপূর্তি করার জন্য। ছুটছে তো ছুটছেই, যেনো দম নেওয়ারও ফুরসত নেই। বাসের এ ভয়ার্ত গতিময়তা আমার মস্তিষ্কে এক প্রকার অনূনাদ সৃষ্টি করে, কিছুক্ষণের জন্য আমার চিন্তাকে স্তব্দ করে দেয়। নিত্য দিনের এই এক চিত্র, এক অসীম যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা। ভাবতে ভাবতে মূর্ছা গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নাই। আমিও দাড়িয়ে আছি, কোন একটা বাসের পেটে আরোহন করার যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার প্রতীক্ষায়। আমার গন্তব্যের একটা বাসও এখন পর্যন্ত আসেনি। অপেক্ষা করছি, কখন সে আসবে।

“স্যার, দুটো টাকা দিবেন?”

হঠাত পেছন হতে কচি কন্ঠে শুদ্ধ উচ্চরণের এমন কোমল আবেদন শুনে পিছন ফিরে তাকালাম। ছেলেটির বয়স সাত-আট বছর হবে হয়তো। ছেলেটির চোখে চোখ পড়তেই আমার মুখে মুচকি হাসির রেখা দেখা দিলো। একে হাসি বলা যায়না, একে বরং ছেলেটির এমন কোমল আবেদনের প্রতি ভদ্রতার বহিঃপ্রকাশ বলা যেতে পারে। আমার হাসিটা আমাকে প্রফুল্ল করতে না পারলেও ছেলেটাকে যে খুশি করতে পেরেছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাইতো তার মুখে ফুটে উঠেছে এক চিলতে শুকনো হাসি। এ হাসির বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যটাই আমার নিকট বেশি প্রতিভাত হলো। আমার চিন্তায় ভিন্ন রকমের এক নাড়া দিয়ে গেলো। কেননা, ছেলেটির মুখশ্রী আর পোশাকের সাথে তার কোমল আবেদনের এমন উচ্চারণ ও ভাষার কোন যোগসূত্রই আমি খুঁজে পাচ্ছিনা। এমন একটি ছেলের মুখে এমন শুদ্ধ বাংলায় এমন শ্রুতিমধূর আবেদন হতে পারে?

ছেলেটির দিকে একটু ঝুকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম-
-কি নাম তোমার?
-ময়নাল।
-তুমিতো খুব সুন্দর করে কথা বলো।
-স্যার, আমার মায় কইছে, ভদ্রলোকদের লগে সোন্দর কইরা কথা কইতে। সোন্দর কইরা কথা কইলে তারা বেশি ট্যাকা দেয়।
-তাই নাকি?
-হ স্যার।

আমার ভাবনার ঘুড়িটা স্থির হয়ে গেলো তার কোমল আবেদনের মৃদু বাতাসে। জীবিকার জন্য তার কত সুন্দর ব্যবহার। হোকনা সেটা ভিক্ষার জন্য। তারপরেও ভালো কে তো ভালোই বলতে হয়, তাইনা?

-তুমি লেখা-পড়া করো?
-জে, বস্তিতে সাপ্তায় দুই দিন ইস্কুল বয়, আমি হেই ইস্কুলে যাই।
-কতদূর পর্যন্ত লেখা-পড়া করেছো সেই স্কুলে?
-এ্যাই মনে করেন, আমি এ্যাহন পেফারের বড় বড় লেখা দ্যাখলে ফড়তে পারি, দোহানের সাইনবোড ফড়তে পারি।

প্রতিটা কথার পরেই ছেলেটার মুখে ভেসে উঠে একটুকরো হাসি। কি নির্মল তার হাসি। অথচ আমি হাসতে পারিনা প্রাণ খুলে। হাসতে গেলেই জাগতিক যন্ত্রনার দৈত্যটা এসে আমার গলা চেপে ধরে, চোখের সামনে মেলে ধরে তার বিভৎস চেহারা। বেঁচে থাকাটাই যাদের সার, তাদের মুখে কি আর হাসি ধরে? তথাপি তার হাসির সাথে তাল মিলিয়ে আমি একটু হাসলেই তার এক টুকরো হাসি হয়ে উঠে আরো উচ্ছল-প্রাণবন্ত। তার এ হাসিতে তার খুশির গভীরতা পরিমাপ করা আমার কাছে মহাসাগরের তলদেশ খোঁজার মতোই মনে হয়।

-ভিক্ষে করা ভালো নয়, এটা কি তুমি জানো?
-জে স্যার, জানি। স্কুলে আমাগোর আফা আমাগোরে কইছে। আমরা যেন কেও ভিক্ষা না করি।
-তারপরও তুমি যে আমার কাছে টাকা চাইলে?
-স্যার, এই ট্যাহা দিয়া আমারা স্কুলের বন্ধুরা মিলে বই-খাতা কিনি।

আমার অফিস যাওয়ার যে তাড়া আছে, তার কথার মায়ায় এটা আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। হঠাতই আমার হাতে পড়া সস্তা প্লাস্টিক বেল্টের ঘড়িটার দিকে তাকাতেই মনে হলো আমার অফিস সময় শুরু হতে আর মাত্র ত্রিশ মিনিট বাকী, অথচ আমি যদি এখনো বাসে উঠি তারপরেও অফিসে পৌছাতে অন্ততঃপক্ষে চল্লিশ মিনিট লাগবে। এরই মধ্যে আমার সামনে দিয়ে আমার গন্তব্য অভিমুখি চারটি বাস আমাকে স্ট্যান্ডে রেখে চলে গেলো।

-তোমার বাবা কি করে?
-আমার বাবা নাই।
-বাবা নাই মানে?
-মায় কইছে আমার বাবা নাই, আমি আর কিছুই জানিনা।

উত্তরটা শুনে ছেলেটার চোখের দিকে তাকালাম। তার চোখের ভাষা বুঝার আগেই মুহুর্তের মধ্যে ছেলেটা তার মুখটা ঘুড়িয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো রাস্তার উপর পার্ক করে রাখা বিলাসবহুল গাড়িটার জানালায়। একটি ফুটফুটে শিশু জানালা দিয়ে মাথা বের করে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গাড়িটার পাশে দাড়িয়ে তালপাতার সেপাই বিক্রি করা বৃদ্ধ লোকটির দিকে। ময়নালের চোখ দুটি স্থির হয়ে আছে সেই শিশুটির মুখপানে, আর বিমর্ষ বদনে কি যেন ভাবছে। তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে তাকে আবার জিজ্ঞেস করলামঃ

-তোমার মা কি করে?
-কাওরানবাজারে হোটেলে বাসন মাজনের কাম করে।

“মায় কইছে আমার বাবা নাই, আমি আর কিছুই জানিনা।” কথা দুঠো আমার হৃদয়ে সূচের মতো বিধে যায়। এই বুঝি হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ শুরু হলো বলে। নিজেকে হালকা করার জন্য এবার আমিও চোখ রাখলাম বিলাসবহুল গাড়িটার জানালা দিয়ে মাথা বের করে রাখা সেই ফুটফুটে শিশুটার দিকে। ময়নালের বিমর্ষ বদনের ছবির পিছনের হাহাকার আমার মনের আয়নায় ভেসে উঠে। আহারে, দায়িত্বশীল বাবা!

প্রতিদিনকার মতো বাসে ঝুলার কোন তাড়া নেই আজ আমার মাঝে। কি এক যাদুময়তায় টেনে ধরেছে আজ আমাকে। এ যাদুময়তার কাছে সময়মতো অফিসে উপস্থিত হওয়ার তাড়া গৌণ হয়ে গেছে আজ আমার। আবারো ছেলেটার সহিত আলাপচাড়িতায় ফিরে এলাম।

-তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও?
প্রশ্নটা শুনে কালবিলম্ব না করে সে ঝটপট উত্তর দিলো, মনে হলো সে যেনো উত্তরটা তৈরি করেই রেখেছিলো।
-হাওয়াই মিঠাইঅলা হইতাম চাই আমি।
-এত কিছু থাকতে তুমি হাওয়াই মিঠাইওয়ালা হতে চাও? কেন?
-স্যার, হাওয়াই মিঠাই আমার খুব পছন্দের। প্রত্যেকদিন যহন বস্তির রাস্তা দিয়া হাওয়াই মিঠাইঅলা যায়, তহন দেখলেই আমার খাইতে মন চায়।
চোখের কোনে তার হাসির রেখা। মনে হচ্ছে সে বুঝি এখনি হাওয়াই মিঠাইওয়ালা হয়েই গেলো।

আমার মতো অল্প বেতনের চাকরীজীবি, যাদের একদিন একশো টাকা অতিরিক্ত খরচ করলেই মাসের শেষে বাজেট ফেইল করে, সেই আমি মানিব্যাগের গোপন পকেটে রাখা একটি একশো টাকার নোট ছেলেটির হাতে গুজে দিলাম, আর বললাম, এ্ই টাকাটা দিয়ে হাওয়াই মিঠাই কিনে খেও। টাকাটা হাতে পেয়ে তার মুখের সেই একচিলতে শুকনো হাসি এবার সদ্য প্রস্ফুটিত চাঁপা ফুলের মতো প্রানবন্ত হয়ে উঠলো এবং কৃতজ্ঞতার সুভাষ ছড়াতে লাগলো।

আমি স্বল্প আয়ের মানুষ, যাকে কিনা প্রতিদিনই নানান প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে নিয়মিত যুদ্ধ করে এগিয়ে যেতে হয়। এসব কিছু একপ্রকার জোর করেই মনকে মানিয়ে নিয়েছি এবং প্রতিনিয়ত সুখে থাকার অভিনয় করে যাচ্ছি। আজ আমি সুখের অভিনয় করছিনা, আজ আমি প্রকৃতই এক সুখী মানুষ। আজ আমার মনটা সদ্য বৃষ্টি ঝড়া স্নিগ্ধ আকাশের মতো উজ্জ্বল। আজ আর বাসে যাবোনা, হেটেই অফিস যাবো। অফিসে দেরী হয় হোক, বেতন কাটা যায় যাক। আমি হাটছি। নতুন এক স্বপ্ন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি এক হাওয়াই মিঠাইওয়ালা। আমার পিছন পিছন হাটছে নির্মল হাসিমুখের সাত-আটজন বালক-বালিকা। আহা !!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী নন্দিত অনুভূতি চলনসই প্রকাশ

১০ জুন - ২০২০ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪