তখন আমার বয়স ৬ কি ৭, স্কুলে ভর্তি হব, প্রায়ই একটা কথা শুনছি মা আর দিদিদের মুখে, স্কুলে যখন যাবি মাসুদ স্যারের হাতে পরলে ঠিক সোজা হয়ে যাবি।
সন্ধ্যায় পড়তে না বসলে মা বলত, আর ক’দিন পরে এমনিতেই পড়বি, না হলে মাসুদ স্যার এমন শাস্তি দেবে-----।
কি বলব, স্কুলে পা রাখবার আগে থেকেই মাসুদ স্যার আমার জন্য দুঃসপ্ন হয়ে উঠল।
স্কুলে যাবার দিন খুব কাঁদছিলাম, অথচ মন খুলে কাউকে কিছু বলতেও পারছিনা, কারন সব শুনলে ছোট ভাইবোনেরা আমায় ভীষণ ক্ষ্যাপাবে, তাই মাসুদ স্যারের ভয় আমার মনে নিভৃতে বেড়ে উঠতে লাগল----।
স্কূলে গিয়ে ভয়ে ভয়ে পা ফেলতে লাগলাম, মাসুদ স্যার না জানি কোথায় আছে, প্রথম দিনেই বেশ কিছু বন্ধু জুটে গেল, জানতে পারলাম মাসুদ স্যারের ভয়ে তারা্ও অস্থির। যাক, আমি একা নই তাহলে, ওরাও ভয় পাচ্ছে।
মাসুদ স্যারকে চোখে দেখলাম আরও কয়দিন পর, সুমন বলে একটা ছেলে ছিল, ওই চিনিয়ে দিয়েছিল, ভয়ে ভয়ে আড়াল থেকে দেখেছিলাম, সত্যিই ভয় পাবার মতোই, ভীষণ লম্বা, মোটাসোটা শরীর, মুখে কাচাঁপাকা গোঁফ, ভয়ঙ্কর চোখদুটো উঁকি দিচ্ছে মোটা ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে। আর হাতে যা দেখলাম তাতে গা শিউরে উঠল, চকচকে বেতটি দারুনভাবে দুলছিল স্যারের হাতে-------।
যা দেখলাম তাতে ভয় বাড়ল ছাড়া কমল না, স্যারের ভয়ে প্রতিরাতেই দুঃসপ্ন দেখে জেগে উঠতাম। স্বস্থির বিষয় ছিলো এটাই যে,স্যারের কোনো ক্লাস আমাদের করতে হতো না। তবুও স্যারের সর্ম্পকে নানারকম কথা শুনতাম যেমন স্যার ফাইভের একটি ছেলেকে নকি এমন মেরেছেন যে তার নাকমুখ দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে এসেছিল, আর একটি ছেলেকে তো ক্লাসে তালা দিয়ে বন্দী করে রেখেছিলেন ছুটি না হওয়া পর্যন্ত ।স্যরের এই হাজারো কাহীনি নানাভাবে ভীতিপ্রদ হয়ে কানে আসত। মনে মনে চাইতাম স্যারের ক্লাস যেন কখনো করতে না হয়, আমাদের ক্লাস নেবার আগেই স্যার যেন স্কুল ছেড়ে চলে যায়।
একদিন ক্লাসে সব ছেলেমেয়েরা মিলে জটলা করছিলাম সে ক্লাসের টিচার আসেনি বলে, হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো, একটা কাশির শব্দে তাকিয়ে দেখি মাসুদ স্যার ক্লাসে ঢুকছেন, হাতে রোলকলের খাতা এবং অবশ্যই সে বিখ্যাত চকচকে বেত।
আমরা যে যেখানে ছিলাম পাথর হয়ে গেলাম। স্যার হাতের খাতাটা সশব্দে টেবিলে রেখে বললেন, বসো, হচ্ছিলোটা কি এতক্ষণ?
সবাই চুপ, ক্লাসে তখন পিন পড়লে তারও আওয়াজ শোনা যাবে, স্যার হুংকার দিয়ে বললেন, কি হলো কথা কানে যায় না?
এই ছেলে তুমি বলো তো------
ভয়ে চোখ বুজে আছি, পাশে রন্টু কনুই দিয়ে ঠেলতে লাগল,
স্যার তোকে ডাকছে-যা না
আমি ভয়ে মুখ তুলতেই স্যার বললেন, হুম, তুমি,তোমাকেই ডাকছি এসো! ততক্ষনে আমার বুক শুকিয়ে গেছে, পা দুটো ভীষণ কাপঁছে---------- আমার বন্ধু পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলল, পিঠটা টানটান করে রাখিস না, তাহলে মারলে ব্যাথা কম লাগবে।
আমি কয়েক পা এগিয়ে স্যারের কাছে পৌঁছে গেলাম, স্যার বলল, অত দূরে কেন! সামনে এগিয়ে এসো।
এই কথাই আমি আর পারলাম না, “আমি কিছু করিনি স্যার-----” বলতে বলতে স্যারের সামনেই কেঁদে ফেললাম--------।
কেঁদে ফেলে ভয়ে তাকিয়ে দেখি স্যারের বিরাট হাতটা উপরে উঠছে---- রন্টুর কথামতো পিঠটা টানটান করতে চাইলাম, কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা কোমল হাত আমার পিঠ ছুঁলো, কি হযেছে বুঝতে না পেরে তাকিয়ে দেখি, স্যারের ভয়ঙ্কর মুখে একচিলতে হাসি, আমার পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে বললেন, এ্যই কাদিঁস কেন? আমি না মারলাম না বকলাম তাতেই এত কান্না! যখন সত্যি মারব তখন যে কি করবি খোদাই জানে।
স্যারের সে সত্যি মারটা বহুবছর কেউ খায়নি, তবুও অজানা কারনে মাসুদ স্যার ভীতি কখনোই আমাদের ভেতর থেকে পুরোপুরি লুপ্ত হয়নি।