সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। প্রিতম এখনো বাড়ী ফিরে আসে নাই।
প্রিতমের বাবা আর মা দু‘জনে বসে প্রিতমের ব্যাপারেই কথা বলছেন।
“খুব চিন্তায় আছি, আজ যে আবার কি ঘটলো,কে জানে?“ বললেন সত্যেণ বাবুর স্ত্রী ।
এমন সময় প্রিতম মুখ শুকনো অবস্থায় বাসার ভিতরে প্রবেশ করল।
“কি হলো বাবা? তুই একা আসলি যে?মৌ এলো না ? “ মা বললেন।
“না মা আসল না। আমি এখন কি করব বল?“ বলল প্রিতম।
“দেখি কি করা যায়। তুমি খেয়ে ঘুমাও। কাল দেখা যাবে।“ বললেন,প্রিতমের মা।
“বিষয়টার একটা সুরাহা হওয়া দরকার।“ বললেন সত্যেণ বাবু।
সত্যেণ বাবু একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে স্ত্রীকে বললেন, এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। আমার ভুলের জন্যই ছেলেটা এতো কষ্ট পাচ্ছে।এর একটা চুড়ান্ত ফয়সালা দরকার। কালই এব্যাপারে মৃণাল বাবুর সংঙ্গে কথা বলব।
“ যা ভাল বুঝ করো। তবে ছেলেটা আমার খুব কষ্টে আছে গো।“ বললেন প্রিতমের মা।
বলে চাপা কান্না কাঁদতে লাগলেন প্রিতমের মা।
“বন্ধু হলে কি হবে? আসলে বড়লোকদের সংঙ্গে আত্মীয়তা করা ঠিক হয় নি।“বললেন সত্যেণ বাবু।
সত্যেণবাবু এবং মৃণালবাবু দু‘জনেই ছোট বেলার বন্ধু। খুবই ঘনিষ্ট সম্পর্ক তাদের মধ্যে।বিয়ের পর দু‘জনে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন যদি একজনের ছেলে এবং আরেক জনের মেয়ে হয় তবে তারা দু‘জনের ছেলেমেয়ে বিয়ে দেবেন।তাহলে সম্পর্কটা চিরদিন টিকে থাকবে।
সত্যেণবাবু একটা ছোটখাট সরকারী চাকুরী করতেন। এখন তিনি চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছেন।সত্যেণ বাবুর ছেলে প্রিতম লেখাপড়া করে ছোটখাট একটা সরকারী চাকুরী পেয়েছে।
অন্যদিকে মৃণালবাবু ধনাড্য ব্যাক্তি। তিনি ব্যবসা করেন।তাঁর একটি মাত্র আদরের মেয়ে। আদর করে নাম রেখেছে মৌ।
মৌ খুবই উচ্চাভিলাসী একজন মেয়ে।
সত্যেণবাবুর ছেলে প্রিতমের আচারণ,কর্মস্পৃহা ও উদ্যমী মনোভাব ,মৃণাল বাবুর মন কেড়ে নেয়।
সত্যেণবাবু ছেলের বিয়ের কথা ভাবছে। তবে এখন আর মৃণালবাবুর মেয়ের সংঙ্গে নয়। কারণ মৃণালবাবু অনেক টাকা পয়সার মানুষ। এখন কি তাঁর অতীতের কথা আর মনে আছে?
এদিকে মৃণালবাবু ভাবছেন, তাঁদের অতি আদরের উৎশৃংখল মেয়ে মৌ কে সামলানোর জন্য প্রিতমের মতই একজন ছেলে দরকার।মৃণালবাবু তাঁর মেয়ের আচারণ ভালভাবেই জানেন।তাই তড়িঘড়ি করে মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন।
একদিন মৃণাল বাবুই তাঁর মেয়ের সাথে প্রিতমের বিয়ের ব্যাপারে প্রস্তাব করলেন সত্যেণ বাবুর কাছে।
সত্যেণ বাবু বন্ধুর প্রস্তাব সানন্দে গ্রহন করলেন।
তারপর হিন্দু রীতিনীতি মেনেই বিয়ে হলো দু‘জনের।তবে বিয়ের আগে কেও কাওকে দেখে নাই ।এমনকি ছবিও না। মৌ দেখতে ফর্সা , স্লীম এবং স্মার্ট ।অন্যদিকে প্রিতম ছিল কালো এবং চেহারাও খুব একটা আর্কষনীয় ছিল না।এক কথায় খুব একটা ষ্মার্ট ছিল না প্রিতম ।খুবই সাদাসিদা একটা ছেলে প্রিতম।
সারাদিন শারীরিক এবং মানসিক ভাবে পরিশ্রম হলেও কোন ক্লান্তিভাবই প্রিতমকে বশ করতে পারছে না আজ।
রাতের খাওয়া শেষ করে প্রিতম যখন বিছানায় শুতে যায় তখন অতীতের স্মৃতিগুলো মনের মধ্যে ভেসে উঠে।
গতবছর প্রিতম আর মৌ-এর বিয়ে হয়েছিল এই দিনে।তাইতো প্রিতমের আজ বেশী বেশী মনে পড়ছে মৌ কে।
ফুলসজ্জার রাতে যখন প্রিতম মৌ কে আংটি পরাতে যায়,তখন মৌ ছিটকে বিছানা থেকে দূরে চলে যায়।আর বলে তুমি আমাকে স্পর্শ করবে না ।কোথাকার এক গেঁয়ো কাল ভূতের সাথে আমাকে বিয়ে দিয়েছে! আমি এ বিয়ে মানি না।
“আমাকে ছুঁবে না বলে দিলাম।কি করে ভাবলে তোমার মত একজন কালো ভূতকে আমি পছন্দ করব?“বলল মৌ।
মৌ আরও বলল, শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করে একটা চাকুরী পাওয়াই সব কিছু নয়। আজকালকার যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে,অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়,যা তোমার মত একজন ব্যাকডেটেড ছেলের পক্ষে সম্ভবপর নয়।তুমি একটা আস্ত গেঁয়ো ভূত।
“তাহলে এ বিয়েতে রাজি হয়েছিলে কেন?“ বলল প্রিতম।
বিয়েতে আমি কোনদিনই রাজি ছিলাম না। সবার জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়েছিলাম বিয়ের পিঁড়িতে বসতে।প্রথম ভুল ভাঙ্গল শুভ দৃষ্টির সময়। তখন আর কি করব।বলে ডুকরে কেঁদে উঠল মৌ।
আর আবেগে মৌ বলতে লাগল,জীবনে স্বপ্ন দেখতাম একটা ভালবাসার মানুষ আসবে যার প্রতি আস্তা, বিশ্বাস আর দাবি থাকবে।জানি,এমন তো তুমি হতে পারবে না!
বাবা আমার মতের বিরুদ্ধেই বিয়েটা ঠিক করেছে। একটিবার আমার মতামতের প্রয়োজনও মনে করেনি।
“আমিও দেখাতে চাই বাবার সিদ্ধান্তটাই ছিল ভুল।বাবার মান সম্মান রক্ষার্থে বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম।“ বলল মৌ।
“তাহলে তুমি কি আমার ছবিও দেখনি বিয়ের আগে?“ বলল প্রিতম।
“না দেখিনি।“বলল মৌ।
“তাহলে এখন তুমি কি করবে ভেবেছো?“প্রিতম বলল।
“মোট কথা, তোমাকে আমি মেনে নিতে পারছি না। আর কোনদিন মেনেও নিতে পারব না। দেখি কিভাবে জীবন চালানো যায় ।তবে তোমার থেকে দূরে চলে যাবোই।“ বলল মৌ।
“তুমি চলে যেতে চাও,যাবে। কোন না কোন ছুতোই তুমি যাবে। তোমাকে আমিও ধরে রাখতে চাই না। তবে যাওয়ার বেলায় অভিমানের কালিতে ভালবাসার দেওয়ালে লিখে দিয়ে যাচ্ছ এক রাশ কষ্ট। যে কষ্ট সয়ে যাওয়াই হবে আমার অভ্যেস। এক সময় হয়ে উঠব অভ্যাসের দাস। দাসত্ব করে করে এক সময় অভ্যাসটাই হতে পরে আমার বদভ্যাস।যা কারো জন্যই কল্যাণকর হবে না।বুঝলে কিছু?“ বলল প্রিতম।
এভাবে সেদিন বাসর রাত্রি কেটেছে তাদের।
সেদিনের পর থেকেই নিজেকে গুঠিয়ে নিয়েছিল প্রিতম।ছোটবেলা থেকেই সে ঝগড়া বিবাদ পছন্দ করত না।তাই সেদিনও জিজ্ঞেস করতে পারে নি যে,“ ঠকলো টা কে? চুপচাপ মুখ বন্ধকরে সরে নি:শব্দে রাত্রিটা পার করেছিল সেদিন দু‘জনেই।
বিয়ের পর মৌ এর মনোভাব খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না।প্রিতমের সাথে সম্পর্কও ভাল ছিল না।মৌ সেই আগের মতই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়,ক্লাবে যায়।সত্যেণবাবু এবং তাঁর স্ত্রী মৌকে খুব ভালবাসতেন। ওনারাও মৌ এর এই অবাদ চলাফেরার জন্য তেমন কিছুই বলতেন না।মৌ-কে ওনারা দু‘জনেই মেয়ের মতই স্নেহ করতেন।
একদিন মৌ তার এক বান্ধবীর জম্মদিনে পূর্বের অভ্যেসমত নেশা করে বাসায় ফিরে। নেশার ঘোরে কাছে টেনে নেয় প্রিতমকে।জীবনের প্রথম ভালবাসাকে আজ আর ফিরিয়ে দিতে পারেনি প্রিতমও।রাতের অন্ধকারে একাত্ম হয়ে যায় দু‘টি শরীর।কিন্তু এর পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে ,তা টের পায় প্রিতম পরদিন সকালে।
পরদিন সকালে যখন মৌ এর নেশা কেটে যায় তখন সরাসরি দায়ী করে প্রিতমকে রাতের ঘটনার জন্য,তখন প্রিতম হতবাগ হয়ে যায়।
সকালে মৌ ঘুম থেকে উঠেই রাগে বাসা থেকে বের হয়ে যায় তার বাবার বাড়ীতে।
প্রায় আটমাস কেটে গেল, মৌ তার বাবার বাড়ীতেই আছে।
সত্যেণবাবু এবং তাঁর স্ত্রী বেশ কয়েকবার গিয়েছিলেন মৌকে ফিরিয়ে আনার জন্য,মৃণালবাবুর বাড়ীতে কিন্তু আসেনি।
মৃণালবাবুও মৌ কে বুঝিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে চুপচাপ আছে।
প্রিতম একবারও যায় নি মৌ-কে আনার জন্য।তাই আজ তার মায়ের অনুরোধে মৌ কে আনতে গিয়াছিল।
অনেক বুঝানোর পরও মৌ কে সংগে নিয়ে আসতে পারেনি নিজ নীরে প্রিতম।
প্রিতমের মাথায় অনেক কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে।প্রিতম ভাবছে,চলে যাওয়া সহজ, যেতে দেওয়া নয়! চলে যাওয়া মানেই যদি প্রস্থান হতো, হতো বন্ধন ছিন্ন করা, তবে হয়তো মানুষ বেঁচে যেত।
কাছের মানুষগুলো চলে যায় অবুঝের মত এক বুক অভিমান নিয়ে, পরিশেষে রেখে যায় কিছু ছড়ানো ছিটানো মায়া। এ মায়া বড় ভয়ংকর! চলে যাওয়া মানেই যদি কষ্টের সমাধী হতো, তবে কেন মৌ চলে গেলে কষ্টের ভাগ এতো বেশী হলো? মন কেন বার বার পিছু ফিরে দেখে? কেন আসেনা মনের দুয়ারে নতুন ফাগুন? চলে গেলেই যদি ভুলে যাওয়া যেত তবে কেন হারানো মুখগুলো স্মৃতির ডানায় ভর করে বার বার বেদনার অশ্রু হয়ে ঝড়ে দু’চোখে? প্রিতমের ভাবনার দুয়ারে সবসময় এই কথাগুলো কড়া নাড়ে।
এদিকে সময়ের সাথে সাথে মৌ-এর শারীরিক পরিবর্তন হতে লাগল। মৌ সহজেই বুঝতে পারল যে তার জীবনে একজন নতুন মুখ আসছে। এই সময় একজন মেয়ে যা চায়,মৌ ও তাই মনে মনে তাই এখন চাচ্ছে। কিন্তু মুখফুটে কাওকে কিছু বলতেও পারছে না।এখন তার নিজের ভুল নিজেকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
একসময় যাকে ব্যাকডেটেড কালো ভূত বলে গালি দিয়েছে,অপমান করেছে .এমনকি যার অকৃত্রিম ভালবাসাকে নিষ্ঠুরভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে, এখন দেখছে কোন্ সময় মনের অজান্তেই তাকে আজ কাছে পাবার আকাঙ্খায় অধীর হয়ে উঠেছে মৌ।কিন্তু মুখে বলতে পারছে না।
মানছি আমি ভুল করেছি। তাই বলে কি ক্ষমার অযোগ্য আমি ? শুধু নিয়ে যাওয়ার জন্য বাবা মা কে পাঠায় । এতোদিন কেন সে নিতে আসল না? স্বামী হিসাবে তার কি কোন দায়িত্ব বা অধিকার নাই স্ত্রীর উপর?সে জন্যই তো আজও কাছে যায়নি মৌ। প্রিতম তো স্ত্রীকে নিতে আসেনি ,এসেছিল তার সন্তানের জন্য। বসে বসে ভাবছে মৌ।
এতো কিছু ভাবনা মৌকে আজ অস্থির করে তুলছে।ভুল কি তার নিজের? না কি প্রিতমের?
রাত্রিতে মৌ এর খাবার খেতে তেমন ইচ্ছে নেই।মাথাটা ঘুরছে।তাই মৌ খাবার না খেয়েই বিছানায় শুতে যায়। কিন্তু ঘুম আসেছে না । এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় ঘুমের ভাব চলে আসে। এদিকে প্রকৃতির ডাকে বাথরুমে যেয়েই হঠাৎ করে মাথাটা ঘুরে পড়ে যায়।এতে মৌ পেটে,বুকে প্রচন্ড আঘাত পায় এবং অজ্ঞান হয়ে পরে।সংগে সংগে মৌ এর বাবা মৌ কে হাসপাতালে নিয়ে যায়।হাসপাতালে মৌ-কে অবচেতন অবস্থায় ভর্তি করেন মৌ এর বাবা।মৌ এর পেটের বাচ্চার অবস্থা সংকটাপন্ন বলে ডাক্তার জানান।
মৌ কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রিতম ঘুমিয়ে পড়েছিল। সারাদিন মানসিক অশান্তিতে কেটেছে তবুও প্রিতমের মন মৌ-এর আচারণে খারাপ হলেও ভুলতে পারছে না মৌ কে। প্রিতমের মন বলে মৌ তার কাছে একদিন আসবেই এবং তার ভুল বুঝতে পারবে ।বড়লোকের মেয়ে বলে কথা। এমন কিছু তো ভুল করেনি সে যে মৌ তাকে ছেড়ে চলে যাবে ? এগুলো মৌ এর রাগ নয় বরং অভিমান।মৌ-র এর অভিমান একদিন ভাংবেই এইটা প্রিতমের বিশ্বাস।
বেশী ভালবাসা থেকেই অভিমানের জম্ম হয়।প্রিতমের ভালবাসার কমতি ছিল না। কিন্তু মৌ তা বুঝতে পেরেছে কি-না,প্রিতম তা বুঝে উঠতে পারে নাই কোনদিনই । বাবা মার অতি আদর পেয়েই মেয়েটা হয়তো এমন বেয়ারা হয়েছে ।চিন্তা করতে করতে প্রিতম একসময় ঘুমিয়ে পরে।
রাত তখন ৩ টা ।ক্রিং ক্রিং করে বারবার টেলিফোন বাজছে।
টেলিফোনের শব্দে প্রিতমের ঘুম ভেংগে গেল।
“হ্যালো“প্রিতম বলছো?“বললেন মৌ এর বাবা।
“হ্যা বলছি।কি হয়েছে বাবা ?“ বলল প্রিতম।
“ আমি দিসান হাসপাতাল থেকে বলছি। মৌ ভীষণ অসুস্থ।জরুরীভাবে হাসপাতালে জরুরী ভর্তি করা হয়েছে। তুমি একটু তাড়াতাড়ি আস।“ বললেন মৌ এর বাবা।
প্রিতম বিছানা থেকে উঠে তাড়াতাড়ি কোন রকমে প্যান্ট শাট পড়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
এতো রাতে রিক্সা বা গাড়ী রাস্তায় না থাকায় হেঁটেই রওনা দেয় প্রিতম। সামনে একটা অটো দেখতে পেয়ে,সেই অটোতেই হাসপাতালে যায় প্রিতম।
হাসপাতালে গিয়ে দেখে অপারেশন থিয়েটারের সামনে প্রিতমের বাবা আর তার হিতৈষি কিছু লোকজন ।বেচারা এদিক ওদিক চিন্তামগ্ন অবস্থায় পায়চারি করছেন।
প্রিতম হাসপাতালে ঢুকেই জানতে পারে মৌ-কে ও-টি তে নেয়া হয়েছে।
ও টি এর সামনে সবাই ছিল। প্রিতম মৌ এর বাবা কে জিজ্ঞাসা করল,মৌ এর কি হয়েছে,বাবা?
“আর বলো না , বাতরুমে পরে গিয়ে আঘাত পেয়েছে। তারপর অজ্ঞান।এখন তো ডাক্তার দেখছে, কি হবে বলতে পারছি না।“বললেন মৌ এর বাবা।
এমন সময় অপারেশন থিয়েটার হতে একজন ডাক্তার বের হয়ে এলো।সবাই ডাক্তারকে ঘিরে ধরে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করতে লাগলেন।
কেমন আছে মৌ! এখন কি অবস্থা? বাচ্চা কেমন আছে ?ইত্যাদি ইত্যাদি।
ডাক্তার একটু বিরক্ত হয়েই ভারী গলায় বললেন, বাচ্চাকে তো বাঁচানো গেল না।তবে বাচ্চার মায়ের এখনও জ্ঞান ফেরেনি। চেষ্টা চলছে।ধৈর্য্য ধরুন আপনারা। আমরা চেষ্টা করছি।
মৌ এর বাবা প্রিতমকে জড়িয়ে ধরে ডুকরিয়ে কেঁদে উঠলেন। বলতে লাগলেন এ কি হলো বাবা প্রিতম?
এখন কি হবে? কি করব আমি এখন? আবোল তাবোল বকতে লাগলেন মৌ এর বাবা।
এমন সময় অপারেশন থিয়েটার হতে অবচেতন অবস্থায় মৌকে কেবিনে নিয়ে আসে।
মৌ এর সাথেই একজন মহিলা ডাক্তারকে ওটি থেকে বেরুয়ে আসতে দেখে অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে প্রিতম প্রশ্ন করে, মৌ এখন কেমন আছে ম্যাডাম।
“ এখন স্ট্যাবল আছে যদিও জ্ঞান ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে,তবে বাচ্চাটা অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না।
মৌ এর হতে স্যালাইন লাগানো অবস্থায় কেবিনে রাখার পর প্রিতম মৌ এর পাশে দোঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।মৌ এর একটু জ্ঞান ফিরেছে। চক্ষু মেলে প্রিতমকে দেখেই মৌ মুখ ফিরিয়ে নিল।
প্রিতম কিছু বলছে না,প্রিতমের চক্ষু দিয়ে ঝড় ঝড় করে জল গড়িয়ে পড়ছে।মাথা থেকে প্রিতমের হাত সরিয়ে দিল মৌ।এমন সময় একজন নার্স ভিতরে ঢুকল মৌ কে ঔষধ খাওয়ানের জন্য।
নার্সকে দেখেই মৌ বলছে,আমার বাচ্চা কোথায়? নার্স হত বিহব্বল হয়ে ভীরু ভীরু কন্ঠে বলল, বাচ্চা তো নেই।
“কেন?নেই মানে? আমার বাচ্চা এনে দাও?“ মৌ উচ্চস্বরে বলল।
বাচ্চাটা যে মারা গেছে সে কথা মৌ জানত না।মৌ আবারও উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে বলল, আমার বাচ্চা কোথায়? এনে দাও আমার বাচ্চা আমার কাছে।
“উত্তেজিত হবেন না, আপনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়বেন।“ নার্স মৌ কে বলল।
মৌ এর চেঁচামেচি শুনে মৌ এর বাবাসহ সবাই মৌ এর কাছে গেলেন।তারা সকলেই মৌ কে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। অবশেষে মৌ এর বাবা সত্যটা বলে দিলেন।মৌ চিৎকার দিয়ে আবারও অজ্ঞান হয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার ,নার্স রা মৌ জ্ঞান ফিরিয়ে আনলেন। মৌ কিছুতেই তার বাচ্চার অভাব মেনে নিতে পারছে না। হাও মাও করে কেঁদে উঠল মৌ।
অবশেষে প্রিতম আবারও মৌ এর পাশে গিয়ে শান্তনা দিতে লাগল এবং মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগল, “যে যাবার, সে তো যাবেই। কোন না কোন ছুতোই যাবেই সে। তাকে ধরে রাখা যায় না। বিশাল এই ধরনীর বুকে কে, কাকে পেরেছে ধরে রাখতে! পৃথিবী কি পারে তার মনুষ্যকুল কে আজীবন বেঁধে রাখতে? পারেনা। তবে মানুষ হয়ে আমাদের কি সাধ্য কাওকে ধরে রাখার !“
মৌ কোন কথা বলছে না। এবার মৌ প্রিতমের হাতটা সরিয়ে দিল না।রাগে, মনোকষ্টে এবং অভিমানে মৌ দিশেহারা হয়ে গেল।মৌ এর চোখ দিয়ে কষ্টের এবং অভিমানের অশ্রুজল গড়িয়ে পড়তে লাগল।
“তুমি এতোদিন চলে গিয়ে শান্ত আহত পাখির মত বিশ্রাম নিয়েছিলে কোন এক অজানায় উদ্দেশ্যে? আমি শুধু নিরলস মায়ার মোহে এতোদিন খুঁজেই ফিরেছি তোমাকে। তোমার রেখে যাওয়া সেই অভিমানের স্মৃতির বালির চিহ্নে হাতিয়ে ফিরি তোমারই হাড়ানো মুখ।কি জানি কি খুঁজে পাই?“ বলল প্রিতম।
“তুমি বড় অবুঝ! তুমি নিষ্ঠুর! তুমি ভালবাসা বুঝ না।অভিমানও বুঝ না।তাইতো মোদের এতো কষ্ট।“বলল মৌ। “ তুমিও অভিমান করে নতুন জীবনে প্রতিনিয়ত কুঠারাঘাত করে ভুলন্ঠিত করেছিলে জীবনের সুন্দর শুভক্ষণগুলো । আজ তারই প্রতিফলন পোহাতে হচ্ছে দু‘জনকেই।“ বলল প্রিতম।
“আর বলো না প্রিতম। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।শাস্তিও পেয়েছি। আর নয়।“ বলল মৌ।
“তোমার চলে আসা মানেই যদি বন্ধন ছিন্ন করা হতো, তবে কেন তিমিররজনী কাঁটেছে আমার অশ্রুবর্ষনে? তবে কেন কষ্ট হতো আমার! এ কি তবে মায়া! এ মায়া কাঁটানোর সাধ্য কে রাখে! মায়ায় মায়ায় কেঁটে গেছে এক বছর। কেঁটেছে শত শত নির্ঘুম রাত। জ্বোৎস্নাকে করেছিলাম মায়ার সাথী, পাহাড়া দিয়েছি একাকীত্ব! কতবার ডুবে গিয়েছে শুক্লাপক্ষের পঞ্চমীর চাঁদ। নক্ষত্রের ভীরে খুঁজেছি শুকতারাটিকে । যদি ভুলক্ষনে দ্বিপ্রহরে কখনো খশে পরে রাতেরতাঁরা, তবে বাসনায় যেন তোমায় ফিরে পাই।“ বলল প্রিতম।
চলো আর অভিমান নয় ,এবার আমরা সবকিছু অতীত বদঅভ্যাস ভুলে গিয়ে নতুন জীবনের প্রত্যাশায় ঘরবাঁধি। বলতে বলতে প্রিতম মৌ এর হাতটি নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে ।
মৌ তখন ফুঁফিয়ে ফিুঁফিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,“ ভুল তো আমরা দু‘জনেই করেছি আর তার জন্য শাস্তিও পেয়েছি। তুমি স্বামী হিসাবে যদি অধিকার নিয়ে আমাকে ধমকে দিতে? তাহলে তো আর এমনটি ঘটতো না।“
“ অভিমান জিনিসটা খুবই খারাপ, কত যে সম্পর্ক এই অভিমানের জন্য নষ্ট হয়ে যায়! এবার হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে বাড়ীতে গিয়ে নতুন ভাবে সংসার শুরু করা যাক,যেখানে থাকবে না অবিশ্বাস,অভিসন্ধি আর প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেশীকিছু চাওয়া-পাওয়ার আকাঙ্খা। তাহলেই আমাদের অভিমান হলেও আত্মবিশ্বাসের কারনে ভালবাসার টানে সুন্দর শান্তির নীর গড়তে পারব।“ প্রিতম বলল।
দিনের শেষে অস্তগামী সূর্য যেমন ক্লান্ত হয়ে তড়িঘড়ি করে বাড়ী ফিরতে চায়। পখিরা যেমন সব ব্যস্ত বেলাশেষে নিজেদের নীরের টানে। তেমনি মান অভিমান দূরে সরিয়ে দুটি মনও আজ নতুন আসায় ফিরে যেতে চায় সেই নিজেদের পুরোনো গন্তব্যে, এতোদিনের কষ্টের সমাধি দিয়ে সুন্দর জীবনের সুখের সন্ধানে।
অবশেষে প্রিতম ,মৌ কে সংগে নিয়ে সকল মান অভিমান বিসর্জন দিয়ে নিজ বাড়ীতে গিয়ে নতুনভাবে সুখের সংসার শুরু করল।অভিমান মানেই যে বন্ধন ছিন্ন করা নয়,এটা যে সন্তানরা বুঝতে পেরেছে এতে দুইটা পরিবারের অভিভাবকদেরই মুখে হাসি ফুটল।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
অভিমান অনেক সময় সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। তবে মান অভিমান মানুষের থাকবেই। অভিমানের মধ্যেই ভালবাসা অন্তর্হিত থাকে।গল্পে অভিমানের কারণে সংসারে বিপর্যয় নেমে আসে প্রিতম আর মৌ এর জীবনে । পরে অবশ্য নিজেদের ভুল বুঝতে পারে।কিন্তু ততোক্ষণে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়।তবুও তারা মান অভিমান জলাঞ্জলি দিয়ে সংসার শুরু করেছে এতে পরিবারের সকলেই আন্দদিত। গল্পটিতে অভিমানের বিষয়ে সামঞ্জস্যতা রেখেই লেখা রয়েছে।
২০ মে - ২০২০
গল্প/কবিতা:
৪৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪