চৈত্র মাস । চারিদিকে গরমের উত্তাপ । সেইসাথে রোদ্রর  প্রখর ঝলছানিতে চারিদিকে খা খা করছে ।গরমের প্রকোপ সহ্য করতে না পেরে জরিনা বেগম বাহিরবাড়ী এক গাছতলায় গিয়ে বসলেন ।
তাঁর মন যেন আজ কেমন কেমন করছে ।বুকের মধ্যে খালি খালি বোধ হচ্ছে । সংসারের সবাইকে একে একে হারিয়ে তিনি আজ প্রায় একাকীই  হয়ে গেছেন ।একবার আকাশের দিকে, একবার ধু ধু মাঠের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘস্বাস ফেলছেন ।
এমন সময় তাঁর নাতনি এসে বলল,  কি ভাবছো, দাদি ?  কি আর ভাববো, সবাইকে হারিয়ে আজ পাগলের                    মত হয়ে গেছি । বললেন , জরিনা ।দাদির নাম জরিনা বেগম ।নামটা তাঁর মা সখ করে রেখেছিলেন ।
দাদি বললেন, শুন্ তাহলে কি ভাবছি ।তোর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তোর মা  আরেকটা বাচ্চা প্রশবের সময় মারা যায়। বাচ্চাটাও মারা যায় ।তুই এখন  বড়  একা  ।  বড় হলে  বুঝতে  পারবি যে, সবাইকে হারিয়ে কেমন লাগে ।
আমার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে ছিল । বাড়ী ভর্তি লোকজন ছিল । সব সময় ছেলে মেয়েরা খেলা ধূলা আর হৈ হুল্লোর করতো। বাড়ীটি মাতিয়ে রাখতো ।তোর বাবা আমার তিন নম্বর সন্তান ।ছেলেরা সব বড়, তারপর দুই মেয়ে ।
বড় ছেলে অর্থাৎ তোর বড় চাচা বাস একসিডেন্টে মারা যায় পনর বছর বয়সে ।তোর আরেক চাচা পাশেই রাজবাড়ীতে পেয়াদা হিসাবে কাজ করতো । একদিন শুনলাম তাকে সাপে কামরাইছে । তখন তো  সাপের কামড়ালে ডাক্তাররা চিকিৎসা করতো না, রোঝা এনে ঝাড়তো ।তাই করল সবাই, কান্ডরী করে তোর চাচাকে ঘিরে সোয়াইয়া রোঝা ঝাড়–ফুঁক দিতে লাগলো ।কিন্তু কোন কাজ হল না । মারা গেল ।
নাতনি বলল, ঝাড় ফুঁক দিয়ে কি বিষ চেলে যায় ? দাদি বললেন, তখন তো তাই করত । অনেকের সাড়তো, আবার অনেকে মারাও যেতো ।
আমরা খুব গরীব ছিলাম । তোর দাদা এক দোকানে গোমস্তার কাজ করতেন ।তাই দিয়ে কোনরকমে সংসার চালাতেন । ছেলেমেয়েদের ভরনপোষনে তিনি হিমসীম খেতেন । আমি বড় অভাগী। কারন আমার কোন ভাইবোন ছিল না । বাবার অবস্থা তেমন ভাল ছিল না ।বিয়ে হওয়ার দুই বৎসরের মধ্যেই বাবা মা মারা যান।
তোর বড়ফুফুকে বিয়ে দিয়াছিলাম , সামনের ঐ গ্রামে তোর ফুঁফার কি যেন এক বাতাসে শরীরের ডান অঙ্গ অবস হয়ে ঘরে পড়ে আছে আজ প্রায়  দু‘বৎসর । মেয়েটা যে কিভাবে চলে ? তোর আরেক ফুঁফুর বিয়ে দিয়েছিলাম সেই দু‘ক্রোস দূরে বটতলী গ্রামে । সেই জামাই একটা বেসরকারী চাকুরী করত ।একদিন কে যেন মিথ্যা অর্থ জাতিয়াতির অভিযোগ করায়, তার সাত বছরের জেল হয়েছে । চাকুরীটাই তার একমাত্র সম্বল ছিল ।
মেয়েটা আমার বাড়ী বাড়ী কাজ করে ছোট একটা বাচ্চা নিয়ে কোন রকমে দিনাতিপাত করছে ।বললেন, জরিনা দাদি ।
জরিনার দাদির বুকটা এখন পাথর চাপা দেওয়ার মত ।সবকিছুই যেন খালি খালি লাগে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না তিনি ।
একমাত্র নাতিনকে অবলম্বন করে বেঁচে আছেন তিনি।
জরিনা বেগমের ছোট ছেলে একটা বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকুরী করেন। তা থেকে যা পান তাই দিয়ে সংসার চালান ।
জরিনা দাদির বয়স এখন সত্তর ছুঁই ছুঁই । চলা ফেরা করতে পারেন কোন রকমে। তবে স্বজন হারানোর ব্যথা তাঁকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে ।
নিজের পরিবারে সবার মৃত্যুর শোকে দাদির বুকে যেন পাথর চাপা পড়েছে। শোকে তাঁর ভিতরটা খালি হয়ে গেছে ।এই শূন্যতা আর পূরণ হবার নয় ।
বাড়ীটা অবশ্য বেশ বড় । প্রত্যেক ছেলের জন্য আলাদা আলাদা ঘর করা আছে। বাড়ীতে বিভিন্ন ধরনের ফলজ গাছ লাগাইয়াছিলেন দাদি । সেই সব গাছে প্রতি বছরের মত এবারও অনেক ফল ধরেছে ।কিন্তু এগুলো ভোগ করবার কেও নাই ।
ঘরগুলো খালি পরে থাকে । সব মিলিয়ে বাড়ীটি একটি ভুতুরে বাড়ী হয়েছে । ফলবৃক্ষগুলো কালের সাক্ষী হিসাবে নিঠুর ভাবে দাঁড়িয়ে আছে । ফলগুলো পেরে খাবারও কেও নাই ।
একসময় জরিনার দাদি নাতনিকে ধরে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে থাকেন ।তারপর দাদি আস্তে আস্তে কান্না থামিয়ে মাথা উঁচু করে , কি যেন বলতে চান, কিন্তু বলতে পারেন না ।
তারপর দাদি একসময় বলতে শুরু করেন , আমরা তো গরীব মানুষ আমাদের না হয়, সবাই মরে সংসারে শুন্যতার সৃষ্টি হয়েছে ।কিন্তু চোখের সামনে ঐ রাজবাড়ীর কি হল, জানিস্ ?
কি হয়েছিল রাজবাড়ীর ? বলল নাতনি ।
একসময় রাজবাড়ীটি ছিল জনবহুল বসতী ।শুনেছি টাকশালে টাকা থাকতো , টকবকে ঘোড়া আর গেইটের বাহিরে হাতি বাঁধা থাকতো । পিয়- পেয়াদার তো শেষ নাই।সবসময় লোকজনের যাতায়াত ছিল রাজবাড়ীতে। এক কথায় রাজবাড়ীটি সবসময় ছিল সরব।
রাজবাড়ীতে অনেক কক্ষবিশিষ্ট কারুকার্য সম্পন্ন বিল্ডিং ছিল ।রাণীর জণ্য একখানা গোষাঘর ছিল। রাণীর রাগ হলে ঐ ঘরে গিয়া থাকতেন।আবার গোষা ভেঙ্গে গেলে ঐ গোষাঘর থেকে বেরুয়ে আসতেন।রাণীর জন্য অনেক দাসী থাকত। তারা রানীর নির্দেশমত কাজ করত।
রাজবাড়ীতে প্রতিদিন রাজসভা বসত । সেখানে প্রজাদের নালিশ শুনতেন রাজা এবং বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।
একবার রাজামহাশয় তোর দাদাকে রাজসভায় ডেকে পাঠাইলেন । আমরা সবাইতো ভয়ে অস্থির। বললেন,দাদি।এরপর কি হল জানিস্ নাতনি ? তোর দাদার একটু যেতে দেরী হওয়ায় ,রাজামহাশয় বরকনদাস পাঠায়ে ধরে নিয়ে গেলেন। আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই তোর দাদাকে পেয়াদারা ধরে নিয়ে গেল,রাজ সভায়।অপরাধ ছিল, দুইবৎসরের খাজনা বাকী ছিল।
তারপর আমার একথান গয়না বন্ধক রেখে টাকা নিয়ে খাজনা পরিশোধ করে তবেই  তোর দাদাকে নিয়ে এসেছিলাম।
আজ রাজবাড়ীর কি অবস্থা ? কেও নেই ঐ রাজবাড়ীতে। ভুতুরেবাড়ীর মত কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরাতন সেই বিল্ডিং আর কারুকাজকরা গেইট।জনশুন্য রাজবাড়ীটি ।
পূর্নতা থেকেই শুণ্যতার সৃষ্টি হয় । আবার শূন্যতা থেকেও পূন্যতার সৃষ্টি হয়।
দাদি বললেন, আমাদের সংসারে যেমন অনেকেই ছিল, এখন সবাইকে হারিয়ে আমি নি:স্ব ।বুকের মধ্যে হা হা কার করে ।তেমনি রাজবাড়ীতেও জনশূন্য । শূন্যতা বিরাজ করছে।
মানুষ মরে গেলে যেমন বুকের মধ্যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়,তেমনি পৃথিবীতেও জনশূন্য হয়ে খালি খালি ভাবের সৃষ্টি হয়। 
সৃষ্টির রীতিনীতির মধ্যেই এই শূন্যতা ভাব বিরাজিত।এই শূন্যতা খন্ডনের কোন উপায় নাই। ইহা চিরন্তন সত্য,যা মানুয়ের মনের প্রভাব বিস্তার করে । শূন্যতা হলে মানুষের মনের মধ্যে খালি খালি বোধ হয় এবং বুকে যেন পাথর চাপা আছে,সেরকমই মনে হয়।
দাদির মনেও এই শূন্যতা বাসা বেঁধেছে । যা পূরণ হবার নয়।তবুও বেঁচে থাকতে হয় কিছু একটা অবলম্বন করে ।তাই দাদির  বুকে পাথর চাপা ভাব থাকলেও নাতনিকে নিয়ে এবং অন্যদের একই অবস্থার কথা চিন্তা করে নিজে বেঁচে আছে ।এ যেন জীবনের এক অসহনীয় পরাজয়।যা সবার জন্য অবসম্ভাবী ।            
                        
            
            
            
                        
            
            
                        
            
         
        
               
   
            
                
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
                ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
                 পরিবারের সবাইকে হারিয়ে দাদি আজ সর্বসান্ত । তাঁর  অন্তরে শুন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।নাতনীকে অবলম্বন করে এবং রাজবাড়ীর শূন্যতার কথা চিন্তা করে বেঁচে আছে এই বৃদ্ধা মহিলা ।শূন্যতা হলে মানুষের মনের মধ্যে যে খালি খালি বোধ হয় যা দাদির মনেও  এমনটি শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।
            
    
    
                    
        
        
            
            
                 ২০ মে  - ২০২০ 
                                        
                            গল্প/কবিতা:
                            ৪৪ টি
                        
                    
            
            
         
     
    
        
বিজ্ঞপ্তি
        এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
    
    
        প্রতি মাসেই পুরস্কার
        
            বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
        
        
            লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
            
                - 
                    
                    
                        প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
                        প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
                     
- 
                    
                    
                        দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
                        প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
                     
- 
                    
                    
                        তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
                     
 
     
    
        
        বিজ্ঞপ্তি
        “নভেম্বর ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ নভেম্বর, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
        প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী