নিজেকে ভালো ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। কিন্তু যখন বুঝলাম, জীবনকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নেয়ার জন্য যত ভালো দরকার, আমার তত ভালো নেই ..., তখন অবাক হলাম। জীবনের জটিল মুহূর্তগুলো পাড়ি দিতে অনেক অনেক ভালো প্রয়োজন। আমাকে বেশি বেশি করে আরো ভালো হতে হবে। কিন্তু কিভাবে?
শীলাদেবী বলল তার সাথে বেশি বেশি লেগে থাকতে হবে। কিন্তু তার সাথে তো আর কম থাকা হয় না। এর চে’ আর কত বেশি থাকা যায়? তার কথা হলো ...., আগে নিজের ভুলটা বুঝতে শেখো। এটা শিখতে পারলে ভালোর পথে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে। আর যদি এটাও না-পারো, তাহলে নিজের জীবনকে কোনো জ্ঞানীর কাছে সমর্পণ করো। কিছুটা হলেও সে-ই তোমার ভুল শুধরে দিতে পারবে। এখানে দেহের ভুল ও আত্মার ভুলের একটা ব্যাপার আছে।
শীলাদেবীর সাথে সম্পর্কটা গুরুশিষ্যের মতো হয়ে গেছে। এতটাই গভীর হয়েছে যে, কে গুরু আর কে শিষ্য মাঝে মাঝে সেটাও বুঝা যায় না। তবে, এক্ষেত্রে তাকেই এগিয়ে রাখতে হয়। সম্পর্কের এই গভীরতা অনেকের কাছে বিস্ময় আর কৌতূহলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কথা ছিল..., বাসন্তি রং শাড়ি পরে রাণিমাতা মেলায় আসবে। কিন্তু এলো না। ভক্তেরা সব হতাশ হয়ে গান গাইতে লাগলো ....,
‘সে যে কেন এলো না
কিছু ভালো লাগে না,
এবার আসুক
তারে মোরা মজা দেখাবো..,
আর ঐ দিকে রাণিমাতা মজা করে বিয়ে খেতে গেছে। তার লম্বা চুলের বড় খোপায় শাড়ির আঁচল বার বার আলগা হয়ে আসছে। এর সাথে বেহায়া বাতাসের বাড়তি জ্বালাতন তো আছেই। নদীর চর পাড় হতে হবে। সবাই ভাবছে ....,
‘আকাশে প্রখর রবি/
উত্তপ্ত বালুকণা/
কি করে যাইবে রাণিমাতা/
কোমোলো চরণো ফেলিয়া/ ...
রাণিমাতা পৌঁছে গেছে। লালশাড়িতে এক অপরূপ সুন্দরী বালিকা বিয়ের সাজে বসে আছে। যৌতুক নিয়ে দর কষাকষি চলছে। মাইকে গান ভেসে আসছে ....,
‘লাল ময়না তোরে কারণে রে/
সুন্দর ময়না তোরে কারণে রে/
খোলাহাটির বালুচরে/
সায়মানা টাঙাইচে রে ..../
এ্যালা ক্যানে তোর বাবা/
দেওঁ না-দেওঁ করে রে/
লাল ময়না তোরে কারণে রে //
বিয়ের বাঁধনে বাঁধা পড়ে নারীর দূর্দশা আর অসহায়ত্বের সূচনাপর্ব আন্দাজ করে রাণিমাতা বড়ই বিরক্ত ও মর্মাহত হতে থাকে। দুঃখবোধের তীব্র মাত্রা তার বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। রাণিমাতা ভাবতে থাকে জীবনে সে আর বিয়েই করবে না। কিন্তু খলনিয়তি তার পিছু ছাড়ে না।
দুই দেশের মাঝখানে সীমানারেখা হয়ে নদীটা বয়ে চলে গেছে। ঐ দিকে ভারত, এদিকে বাংলাদেশ। ওরা আটভাই একবোন। দুই ভাই বাংলাদেশে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এখন তারা অনেক বিত্তশালী। অনেকদিন পর বোনটি এদেশে বেড়াতে এসেছে। বড়ভাই অনেব দামি একটা শাড়ি উপহার দিল। আর ছোটভাই, --অত দামি নয়, তবে রং চং ঝকমকে একটা শাড়ি দিল।
এতদিন পরে এলাম। আর আমাকে এটা কী শাড়ি দিলে? বড়ভাইকে একথা বলে বোনটি কাঁদতে লাগলো। দামি হলেও শাড়ির রং তার মন ভরাতে পারেনি।
ছোটভাই মনে মনে ভাবে ..., হায় খোদা! এ ধরার বুকে নন্দন কাননে কেন তুমি পাঠালে নারীরূপী কালোসাপ।
বড়ভাই সান্ত্বনা দিয়ে বলে ..., কালকে বাজারের বড় বড় দোকানে নিয়ে যাবো। তুই যত শাড়ি পছন্দ করবি সেগুলো সব কিনে দেবো।
ছোটভাই কলেজের অধ্যাপক। বদলির সুবাদে আমার সাথে তার পরিচয় হয়। তারপর অন্যরকম গভীর সম্পর্ক। চাচা-ভাতিজার সম্পর্ক। ভাগ্যিস তার কোনো মেয়ে ছিল না। তার সাথে সম্পর্কের গভীরতা ও মধুরতা দেখে অনেকেই জানতে চাইত --- তার কোনো মেয়ে আছে না-কি? একদিন তার এক সহকর্মী প্রশ্ন করলো---, আপনার ছেলেপেলে কতজন? তিনি উত্তর দিলেন ..., ছেলে তিনজন, পেলে নাই।
এক ঈদে সেই চাচার সাথে বাজারে গেছি চাচির জন্য শাড়ি কিনতে। ওনার ছাত্রের দোকান। অনেক শাড়ি দেখাচ্ছে। আমরা দেখছি আর গল্প করছি। চাচা বলছে ..., তোমার চাচির অনেক শাড়ি। এবার ঈদে শাড়ি দিতে চাইলে সে বলল লাগবে না। কিন্তু ভাতিজা ... নারী জাতিকে একদম বিশ্বাস করা যায় না। যদি তাকে শাড়ি না-দেই ... তাহলে এটাকে সে উদাহরণ হিসেবে রেখে দেবে। সুযোগ পেলেই মনের উপর কালো মেঘের ঝড় বইয়ে দিয়ে কাঁদবে আর বলবে, আমাকে কি কখনো কোনো ঈদে একটি শাড়িও দিয়েছো?
আমাদের জাতীয় কবি এদেরকে হাড়ে হাড়ে চিনেছিলেন। তাই তো তিনি বলেছিলেন ...,
‘ওরা নারী/
ওরা সতী/
ওরা লোভী/
ওরা ..../
অতি তুচ্ছ ওদের মন/
একজনেতে তুষ্ট নহে/
যাঁচে বহুজন//
কথা চলছে। একটা শাদা শাড়ি আমার নজরে এলো। শাদা জমিন, শাদা পাইড়, শাদার উপর শাদার অপূর্ব কারূকাজ। সব মিলিয়ে শড়িটা খুবই সুন্দর। যেন ওতে একটা স্বর্গীয় অনুভূতি লেগে আছে। আমার কাছে টাকা নেই। চাচার কাছে ধার নিয়ে শাড়িটা কিনলাম। চাচা বলল ..., এটা কি তোমার মাকে দেবে? আমি বললাম ..., না। তাহলে কাকে? জানি না।
শাড়িটা বাড়িতে নিয়ে এলাম। সবাই দেখতে লাগলো। দাদি-নানি কারো জন্যই নয় --- এটা জানতে পেরে ওরা বেশ অবাক হল। শাড়িটা ভালো করে রেখে দিলাম। কয়েক মাস পর পর বের করে দেখতাম আর শুকিয়ে রেখে দিতাম। এতে ভেসে উঠতো কল্পনাময় অনেক মায়াবী মুখ।
অনেক বছর পর ভাবলাম, শাড়িটা কাউকে দেয়া উচিত। কিন্তু কাকে দেবো? যাকে তাকে তো আর দেয়া যায় না। এই শাড়ি পরে পায়ে আলতা মেখে কাউকে সাজিয়ে রাখলে তাকে স্বর্গের দেবীর মতোই মনে হবে। অনেক রূপসীর ভীর ঠেলে বহু পথ পাড়ি দিয়েছি। পরিচিত মহলে দেহমনে সতী এমন একজনেরও সন্ধান পাইনি। তাহলে শাড়িটা কি শীলাদেবীকে দেবো না-কী রাণিমাতাকে দেয়াই ভালো হবে?
অনেকদিন পর আমার দূর সম্পর্কের ভিনদেশী জ্বীন বান্ধবীটা এসে গেছে। বয়সে অনেক বড়। যৌবনের শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে। তার পরেও সে অনেক সুন্দরী, আকর্ষণীয় ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। এদেশে তার বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধবী ও পরিচিতজন রয়েছে। এ্যাস্ট্রলজীর জ্ঞান তার খুব প্রিয়। এর সাথে নিয়তি ও নিয়ন্ত্রণবাদের আলোচনা চলতে থাকলে সবাই চুপ হয়ে যায়। জ্ঞানের বিশাল জগতে একাকী বিচরণের অসহায় অবস্থায় আত্মার সাথে আত্মার আকর্ষণের মাত্রটা তীব্রভাবে অনুভুত হয়। ভাবজগতে বিলাসী ভ্রমন বন্ধুত্বের সম্পর্ককে গভীর থেকে গভীরতর করতে থাকে।
একদিন তাকে বললাম..., আমাকে জ্ঞান দাও। আমি তোমাকে Love you দেবো। সে হেসে বলল ..., তুই আমাকে জ্ঞান দে। আমিই তোকে Love you দেবো। তার Love you মানে সবার সামনে জড়িয়ে ধরে চুমু দেয়া। তারপর হালকা হাসি দিয়ে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া। সে সহজে পরিস্থিতির শিকার হয় না। কিন্তু পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার অপূর্ব ক্ষমতা তার রয়েছে।
বন্ধু-বান্ধবীসহ পরিচিতজনেরা তাকে অনেক উপহার সামগ্রী দিয়েছে। শুধু আমি বাদ পড়েছি। সে আমার খুব প্রিয়, আমিও তার। সে বলেই ফেলল ..., কী ব্যাপার? তুমি আমাকে কিছু দেবে না?
আমি বললাম..., তোমাকে দুটো জিনিস দেবো। একটি হলো এমন দোয়া যাতে স্রষ্টা তোমার যৌবন ফিরিয়ে দিয়ে নবযৌবন দান করেন। এতে সবাই হেসে ওঠে। সে জানতে চায়, .. এরকম ইঙ্গিত কোথাও আছে নাকি?
যত হালকাভাবেই বলি না কেন ..., আমার কথার একটা অন্তর্নিহিত রহস্য থাকবে --- এটা সে বুঝে গেছে। তাকে বললাম, এরকম ইঙ্গিত ঐশী কিতাবগুলোতে আছে। সে এগুলো পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো। সবাই একদম চুপ হয়ে আছে। একেবারেই খামোশ।
আমিই নীরবতা ভেঙ্গে বললাম ...., আর দ্বিতীয় উপহারটি শুধু তোমাকেই দেয়া যেতে পারে। অনেক ভেবে চিন্তে দেখলাম পবিত্র মনের অধিকারী এমন কাউকে সেটা দেয়াই ভালো হবে। বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না।কিন্তু শর্ত হলো ..., পুরোনো হয়ে ছিড়ে গেলে সেটার একটা টুকরো আমিকে দিতে হবে। কী উপহার ..., সেটা জানার আগ্রহ নিয়ে সবাই উৎসুক ভাবে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি সেই শাদা শাড়ির কথা বলতেই সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। হাসি আর থামে না। বান্ধবীটা খুবই লজ্জা পেলো। এরকম পরিস্থিতি তার জন্য খুবই বেমানান। কিন্তু আমি তার এত প্রিয় হয়ে গেছি যে, তার আর বলার কিছুই থাকলো না। তবুও সে পাল্টা শর্ত জুড়ে দিয়ে বলল ...., ছিড়ে গেলে আমার দেশে গিয়ে এ টুকরোটি তোমাকেই নিয়ে আসতে হবে।
কিন্তু আমি যাবো কীভাবে?
সে ব্যবস্থা আমিই করবো।
যাবার বেলা সে বলল ...., শাড়িটা আমি পরবো না। যত্ন করে রেখে দেবো। এটা থাকবে যুগ যুগ ধরে। যদি কখনো তোমার দোয়া কবুল হয়, তাহলে এটা পরে এসে তোমাকে এমন একটা গান শোনাবো যে, তুমি সব পথ হারিয়ে ফেলবে। শুধু আমার পথে চলতে থাকবে। তার শেষ কথা ছিল ...‘তুমি এত ভালো কেন?’
শীলাদেবী আমাকে আরো ভালো হবার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। আত্মার সাথে পরমাত্মার সংযোগের জন্য এটার খুবই প্রয়োজন। তার কথা হলো ..., আমরা সবাই ছুটে চলেছি একটা অন্তহীন যাত্রাপথে। ...Towards almighty.
১৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৬২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪