ছোট - দাঁত পড়ে দাঁত ওঠেনি এমন বা তারো চেয়ে ছোট-বড় মানুষেরা গুটি গুটি পায়ে এসেছিল - এসেছিল তারা সকালবেলা বা কিছু কিছু মানুষের ভোরে - লেপ-কাঁথা না ছেড়ে ওঠার ভোরে তারা এসেছিল, আর এসেছিল তাদের শান্তস্বভাব মায়েরা ; যারা কিনা তাদেরকে গভীর মমতা উজাড় করে কোলে-পিঠে করে মানুষ করে তুলবার চেষ্টায় রত ছিল - মায়েরা বা তাদের বাপেরা হয়তো মনে করতে বাধ্য হচ্ছিল - তারা নিজেরা মানুষের মতো মানুষ হতে পারেনি, বা হলেও তাদের মনুষ্যত্বের জাগরণ, তাদের সন্তানদের সে জাগরণ আরো আরো প্রয়োজন। মায়েদের মনে আরো একটা সুপ্ত বাসনা ছিল - বাসনা ছিল ভালবাসার - অসহায় মানুষ যেমন সহায় মানুষের কাছে কাঙালের মতো হাত বাড়ায় মায়েরা তেমনি হাত বাড়িয়েছিল তার সন্তানদের দিকে।
ভালবাসারা তখন আসলে কালো পটভূমিতে সাদা খড়ির আঁচড়ে দৃশ্যমান হচ্ছিল। যদিও ছিল শীতের সকাল তবুও পুকুরে পড়ছিল টিপ টিপ বৃষ্টির ফোঁটা হয়তোবা রাজপথেও কিংবা সেই সাক্ষী আম গাছের মগডালেও। সদ্য আপাত বিনা বেতনে নিয়োগ পাওয়া মাস্টার রাসেল তখন উচ্ছল মনে সে কালো পটে সাদার আঁচড় কেটে কেটে তার মাকে ভালবাসার পরিচয় বিধৃত করছিল আর সেই সব ক্ষুদে মানুষদের অন্তরে মাকে ভালবাসার শক্তি পয়দা করছিল। যে শিশুর নাম অন্তর ছিল - বাপ-মা তাকে আদর করে ডাকত অন্তু সে তখনও তার চোখের পিছুটি মুছতে মুছতে লক্ষ্য করছিল - অক্ষরগুলো কেমন যেন সব গাছে ঝুলে আছে। সে তার টিচারকে হয়তো বলবে বলবে করছিল যে - আহা স্যার এতো কষ্ট করে অক্ষরগুলো লেখার কি দরকার ছিল বরং পাশের জাম গাছটায় যদি সেগুলো ঝুলিয়ে দিতেন তাহলে বরং আমাদের ভালবাসারা উন্মুক্ত হতো। আমাদের মায়েরা যাদের হয়তোবা মাকে সেভাবে ভালবাসার সুযোগ ঘটেনি তারাও হয়তো এ সুযোগটি কাজে লাগাত। স্যার, আপনি কি হোম ওয়ার্ক করেছিলেন কাল রাতে ? তাহলে আপনার জন্য একটা বেস্ট হোম ওয়ার্ক ছিল যে, আপনি বাজার থেকে চক খড়ির বদলে সাদা পাতলা ফোম কিনে আনতে পারতেন তারপর সন্ধ্যাবেলার যে সময়টা আপনি বাজারের দোকানে দোকানে আড্ডা দেন সে সময়টাতে বসে বসে সেই ফোম কেটে কেটে আমাদের জন্য ভালবাসা নির্মাণ করতে পারতেন।
এবম্বদ ক্ষুদে শিক্ষার্থীটি যখন তার টিচারের নিকট মতামত পেশ করছিল ঠিক তার আগে-পরে চারুকলার বকুল তলায় তরুণ-তরুণীদের আড্ডা বসেছিল। তারা অনেক পড়েছে – অনেক দেখেছে বোধ হয় তাই তারা আড্ডা দিতে দিতে যে ঝাল-মুড়ির স্বাদ উপভোগ করছিল তার কাগজে এবং তারা আড্ডা দেওয়ার জন্য বসার যে আসন তৈরি করেছিল সেই খবরের কাগজের বিশেষ সংখ্যায় শি্ল্পী মূর্তজা বশীরের স্কেচ ‘’রক্তাক্ত একুশে ১৯৫২’’, ‘’রক্তাক্ত একুশে ১৯৭১’’ , দেশের সব বড় বড় চিন্তাবিদ বিদ্যা বিশারদদের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু নিয়ে বাগৃ যুদ্ধের লিখিত রুপ দৃশ্যমান হচ্ছিল ; সে-সব পরিত্যক্ত কাগজে আরো ছিল মহান একুশে ফেব্রৃয়ারির অর্জন – আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রাপ্তির দলীয় ভক্তিগীতি। চারুকলার সেইসব শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি - সেদিকে সেই ছেঁড়া, পরিত্যক্ত কাগজের দিকে যাবে এবম্বদ হতেই পারেনা ; তারা বরং আড্ডা দিতে দিতে প্রিয় বর্ণমালাগুলোর অবয়ব বিভিন্ন মাধ্যম – ফোম, খড়, ধান, ফুল ইত্যাকার সব বস্তুতে তুলে ধরে নিজেদের প্রকৃত মাতৃভাষা প্রীতি প্রকটিত করছিল। আচ্ছা এই সন্তানেরা – এদের কেউ কেউ কি সেদিন রফিক শফিক সালাম বরকত ছিল ?
এমন প্রশ্ন ঝুলছিল ক্ষেপাটে এক অধ্যাপকের কাছে –তিনি কোত্থেকে জড়ো করা এক ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে সব দোকান-পাট, বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষ্ঠানের সাইন বোর্ড বিল বোর্ডের ছবি তুলছিলেন। আজ-কাল এমন সব ছবি তুলতে দেখা যায় বিভিন্ন কোম্পানি কর্তৃক নিয়োজিত কিছু অভাবী যুবকদের মধ্যে। যুবকদের পোশাক-আশাক মলিন, পায়ের গোড়ালি ফাটা, চটি জোড়ায় ক্ষয়ে যাওয়ার চিহ্ন। যুবকদের দিয়ে সাইন বোর্ডের ছবি তোলায় বড় বড় সব কোম্পানি তার কোম্পানির পণ্য প্রচারের কাজটি ঠিক মতো সম্পন্ন হচ্ছে কিনা তা পরখ করার জন্য। কিন্তু ভাষা - যেখানে আমাদের অহংকার জড়িত, আত্ম পরিচয় লুকায়িত তার ব্যবহারটি ঠিক মতো হচ্ছে কিনা তা পরখ করার দায় শুধু মাত্র ঐ ক্ষেপাটে অধ্যাপকের। তাই তিনি ছবি তুলছেন আর আত্মগ্লানি মাখছেন সর্বাঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই পন্ডিত মশায়ের মতো। গ্লানির কারণে অধ্যাপকের চেহারা ধারণ করেছিল সেই অভাবী যুবকগুলোর পোশাক-আশাকের মতো। বকুল তলায় অবাক তিনি তাকিয়ে সেই যুবক-যুবাদের প্রতি। আহা ! এই বাছাদের অক্ষরগুলো যদি বয়ে নিয়ে গিয়ে যদি লাগানো যেত সেই সব সাইন বোর্ডের প্রিয় বর্ণমালাগুলোর পাশে তাহলে কত না গ্লানি কমতো পুরো দেশের সৌন্দর্য্য কত না উজ্জ্বল হতো !
যখন সে ভোরবেলা প্রায় তখন কিছু সেই ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের বয়সীরা খোদার নূরে (আলোয়) নূরান্বিত হয়ে বের হচ্ছিল। তাদের মুখের আভায় মোলায়েম স্নিগ্ধতা, মুখাবয়বে মায়েদের ভালবাসার পরিবর্তে অন্য অতিরিক্ত কিছু। তারা কি তবে তাদের মায়েদের ছেড়ে অন্য কোনো বিশাল মমতার আশ্রয় পাবে যা চিরস্থায়ী হবে তাদের জীবনে ? তবে মানুষের সন্তানেরা তার মাকে ছেড়ে অন্য কোথাও কিভাবে যেতে পারে ! মায়ের ভালবাসার মতো মধুরতা কোথায় জোটে! তবু তাদের মাঝে সেই আলিফ, বা, তা পড়ার অনিবার্যতা পেয়ে বসেছিল। তাদেরকে যতটা না পেয়ে বসেছিল তার চেয়ে বেশি পেয়ে বসেছিল তাদের বাপেদের – বাপেদের চেয়ে বেশি তাদের মায়েদের – যারা কিনা খুব ভোরবেলা তাদের সোনামণিকে ডেকে তুলে হাত-মুখ ধোয়ায়েছি্ল, চাপকলের ঈষত্ উষ্ণ পানি মুখে দিয়ে বলেছিল – ’বাবু তাড়াতাড়ি কুলি কর তিনবার একবার গড়গড়া করে।‘ তারপর ছতর ঢাকা পোশাক পরিয়ে তাকে পাঠিয়েছিল তারও চেয়ে বড় কারো মমতার কাছে। বাবুকে সেই মহত সর্বোচ্চ মমতার আশ্রয়ে পাঠিয়ে বাপ-মা তারা আরেকবার একা হওয়ার সুযোগ পেল লেপ-কাঁথার তলে । আর তখন কিনা শীতের সকাল টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে টিনের চালে, পুকুরে, আম গাছের মগ ডালে। আহা ! এমন আয়েশ সিজনে এই প্রথম এলো বটে।
এমন যে সকালবেলা -মরনিং ওয়াক করা মানুষগুলোর সে অতীব প্রয়োজনীয় কাজটি সম্পন্ন হয়নি তখনও – ঘিঞ্জি শহরে যেখানে মানুষ বাস করার ঠাঁই নেই সেখানেও মনোরম খাল বয়ে যাচ্ছিল আর সেখান দিয়ে কি মনোরম মনোহর বাগান – পায়ে চলা আঁকা-বাঁকা যেন গাঁয়ের মেঠো পথ – শুধু এখানের পথে কখনো কাদা হয় না এই যা – সেই সে পথে মানুষেরা হেঁটে হেঁটে শরীরের কি ব্যাধি তাড়িয়ে ষাট উত্তীর্ণের সাধনায় রত হচ্ছিল। তখন সে শীতের সকালে টিপ টিপ বৃষ্টির ভেতরে ন্যানো, মার্সিডিজ নাকি জি-এক্স করোলা গাড়ির দরজা খুলে অপেক্ষা করছিল এক পোশাকী ইংরেজ সাহেব। তার সাহেবী সাজ চাকুরির জন্য – যাদেরকে তুলবে গাড়িতে, যেখানে যাবে নিয়ে তার সবকিছুই যেন একটা কৃত্রিম খোলস। এরা যেন মায়ের মমতা কখনো পায় নি তাই এমন খোলস জড়িয়ে চলার প্রবণতা সর্বত্র। সবই যখন খোলস তখন নিজেকে খোলস বানাতে অসুবিধা কোথায় সেই সে-সব অত্যাধুনিক মডেলের গাড়ির ড্রাইভার রমজান আলীর। তাই, সে, রাতে ঘুমিয়েছিল যে আরামের লুঙ্গি পরে তা ভোর না হতে খসিয়ে এ সাজ। যেতে তো হবে বংগ দেশের বিলেতি স্কুলে যে ! যেখানে তাদের ছোটবেলার সে বাক বাকুম নেই, আছে ব্যা ব্যা ব্লাক ..... নেই তাদের সে – বাঁশ বাগানের মাথার উপর.., পরিবর্তে আছে টুইংকেল টুইংকেল লিটল...... । প্রিয় বর্ণগুচ্ছ থাকে এদের কাজের লোকদের পরিমন্ডলের ভেতর। কোন এক কবি নাকি ছিল ছোটবেলায় স্কুলে পড়ে থাকবে রমজান আলী যে নিজের বাপ-মা ত্যেজে যে জাতকুল ধর্ম ছেড়ে ইংরেজ হতে গিয়েছিল। আর সে নাকি অনেক বড় কবিও হয়েছিল তার একদা ঘৃণা করার ভাষার। এই যে, সাহেবের বাচ্চাদের সে নিয়ে যাচ্ছে মর্নিং বেল,অক্সফোর্ড ইংলিশ বা সাউথ হেরাল্ড ইংলিশ মিডিয়ামে তারাও মনে হয় একদিন সেই কবির মতো নয় তারও চে্য়ে বড় কেউ হয়ে তার মায়েরই মুখ উজ্জ্বল করবে হয়তো।
২০ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪