প্রিয় অসহায়ত্ব

অসহায়ত্ব (মে ২০২০)

ফাতিমা আফরোজ সোহেলী
  • ৩৫



তোমার জন্যি আমি ঘর ছাড়ছিলাম। তোমার সাথে করি যাব বহুদুর, তোমারে কবুল কইয়া দিছিলাম অন্তর। ঠিক যতখানি আকড়াইয়া ধরছিলা তুমি আমার শরীরডারে তারচাইতেও অনেক বেশী অনুভব করছিলাম তোমারে, আমার কলিজার ভিতর।
তুমিকি বোঝো! ঠিক কতখানি আপন মনে করলে একটা মাইয়া, বাপমায়ের ভিটা ছাইড়া পথে নাইমা আসে, কিসের সন্ধানে!
কি আছিলা তুমি আমার! তোমার মাঝে আমি কি দেখছিলাম!
না, অহন আমি জানি, তুমি জাননা। হের লাইগা, যহন সবাই কইতেছিল, কার লাইগা কান্দস? হ্যায়ত তোরে ছাইরা গেছে, বিক্রি কইরা দিছে, বিশ হাজারে কিন্না আনছি তরে।… আমি চক্ষে তহন ভাসতেছিল সেই পোলাডা…
” সারাদিন বাপের লগে লাংগল চইষাও যে পড়ালেহা ছাড়ে নাই। অনেক অভাবের সংসার আছিল তোমার। বাড়ি ভর্তি ভাই বইন, সৎ মা, দাদা, দাদিরে নিয়া বড় সংসার। না আমিযে খুব ভালা ছিলাম তাও না। তয় গ্রামে আমার বাপজানের খুব নামডাক আছিল। বয়াতি কইয়া ডাকতো সব। বয়াতি ভাই। আমি হেই বয়াতি ভাইর একমাত্র মাইয়া। স্কুল পাশ দিছি, কিন্তু কলেজে যাইতে পারি নাই। কলেজ ভর্তির টাকা তুইলা দিছি তোমার হাতে, তুমি ডাক্তার হইবা, কোচিং করবা। তুমিইযে আমার স্বপন তহন! বাপজানরে মিছা কইরা কইছি, টাকা চুরি হইয়া গেছে। তোমার লাইগা এমন মিছা কইছি বহু বহুবার। যেইদিন তুমি স্কুল যাইতা, কলেজ যাইতা; সেইদিন মায়ে খাওন দিতোনা। আমি তোমার লাইগা খাবার নিয়া বইসা থাকতাম। শ্বশ্মান ঘাটের মরা নদীর ধারে। কত কতদিন, ওই পাড়ে মরা পুড়াইত, আর এই পাড়ে আমি, তোমারে পাশে বসাইয়া, তৃপ্তি কইরা তোমার চিড়া, মুড়ি, খই খাওন দেখতাম। যেইদিন টেংরা মাছের ঝোল দিয়া গরম ভাত নিয়া গেছি ,তোমার চোখের খুশির বান আমারে যে সুখ দিত, সেই সুখ পাইতে আমি সারা জীবন নিজে না খাইয়া তোমারে খাওয়াইতে পারতাম। খাইয়া পানি খাইয়া তুমি যহন আমার দিকে তাকাইতা, সেই চোখে কিযে শান্তি দেখতাম আমি! তুমি মুখে কইতানা, তাও আমার মন কইতো, “আমি; ‘হ আমিই তোমার শান্তি ,তোমার বাঁচনের আঁশ।“ কি কইরা ভুলি কও! কারে করি অবিশ্বাস! তূমিযে ছিলা আমার পৃথিবী।
যেইদিন বাজান কইল, ‘তর বিয়া ঠিক করছি, ম্যাম্বরের পোলা , ঢাহায় থাহে, বালা চাকরি করে। কাইল বিয়া কইরা সাথে কইরা নিয়া যাইবো,” হুইনা চোহে আন্ধার তহন আমার। ছুইটা গেলাম তোমার ধারে। তহন মেডিকেল ভর্তির ট্যেকা নিয়া আসছি ভাইবা তুমি খুশি হইয়া গেছিলা, কিন্তু আমি দিলাম অন্যখবর। হুইনা কেমন গুম হইয়া গ্যেলা। মনে আছে কিচ্ছু কওনাই তুমি। খালি ঠান্ডা চোখে তাকাইয়া কইলা ‘বাড়িত যা।‘ তোমার সেই রুপ আমি আর দেহি নাই। হেই মাছের লাহান ঠান্ডা চোখ আমারে যেন ভরসা দিল। অগাধ বিশ্বাসে ফিরা আইলাম বাড়ি। বিহান বেলা বাড়ির পিছনে আইসা ডাক দিলা। বাজান তহন গঞ্জ থাইকা ফেরে নাই। মায়ে অজু করতাছে, আমি কইলাম”কি?” “পলাইয়া যাবি আমার লগে?” কইলাম ‘পলাইতেই হইব? বাজানরে সত্যডা কওন যায়না!?” কইলা” আমার বাজানরে যায়না।“ বাপের অবাধ্য হইয়া পরালেহা করছি, আয়ের কিছুই করিনা আমি, ম্যাডিকেলে টিইকাও ভর্তি হইবার পারতাছিনা, টাকার অভাবে। এইভাবে তোর কথা কওন যায়নারে।“ কইলাম ,’ তাইলে! পালাইয়া গেলে খামু কি! আমার কাছেওত কিছুই নাই। খালি কানের সোনার দুল আর চেইনডা ছাড়া আরত কিছুই নাই। তোমার চলবো কেমনে! আমিযে তোমার ডাক্তার হইবার স্বপন দেখি তাঁর কি হইবো?’ “হইব, তুই থাকলে সব হইবোরে পাগলী। তুই খালি আমার লগে ল, যাবি? গেলে চল, ধর আমার হাত।“ “অহনই?” “হ অহনই।“ আর ফিরা তাকাই নাই পিছে। পরেরদিন তুমি নারায়নগঞ্জের এক খালার কাছে রাইখা কইয়া গেলা “আইতাছি। তুই থাক। একটা কাম জুটাইয়াই ফিরা আসুম। ম্যাডিকেলে ভর্তি হমু কাইল। তারপর একখান ঘর খুইজা নিয়া তোরে লইয়া যামু।“ কইলা ‘কিছু ট্যাকা ধার দিব খালা। বাসা ভারা নিতে এডভ্যান্সন্ দিতে হয়। বিশ্বাস রাখ ‘আমি কাইল আইতাছি।‘ যাওনের সময় একটা প্যাকেট ধরাইয়া দিল তোমারে খালা, তুমি ফিরা আমারের দেখলা ,তারপর নাই হইয়া গ্যালা।
রাইত যায়, সকাল যায় বিকাল যায়, যায় আবার রাইত,একদিন দুইদিন। খালায় খালি টিপ্পনি করে হাসে তেমন কিছুই কয়না। সুরে গান করে “নাগর আমার নেশায় মাতাল, নেশা ভুইলাছে, নেশার হাতে কলস দিয়া আমায় মাইরাছে।“ আমার মনডায় কিসের যেন কু ডাকে। তুমি ভালা আছোতো! কিছুকি পেডে পড়ল? নাকি নাখাইয়াই কইযে ঘুরতাছ! তিনদিন বাদে খালায় কইলো, আমারে যাইতে হইবো, নিতে আইছে মহাজন। আমি কইলাম তুমি ছাড়া আমি কই যামু? কইলো, তোমার কাছেই নিয়া যাইবও। সেইখানেই হইবো আমাগো বাসর রাইত…। আমি লজ্জায় মইরা যাইতাছিলাম। মনে মনে বিড় কইরা কই, ‘তুমি তাইলে বাসা নিছ, আমারে নিবার জন্য ক্যেন আইলানা?” ফিসফিসানি হুইনা খালায় কয়, “কি কস! বিয়ার আগে একটু দূরে থাকাই ভালা।“ আমি আরও লজ্জা পাই।
তারপর এক গলি থাইকা আরেক গলি, এক ঘর থাইকা আরেক ঘর ,আমার চিৎকার আমার কান্না, আমার আত্মপ্রলাপ, আমার তুমি, তোমারে খোঁজা! প্রথম প্রথম সবাই আমারে কাঁদতে দেইখা কইতো,আমি বোকা, আমি পাগল, তুমি আর ফিরা যাইতে পারুম না, পুরুষ মানুষরে নাকি বিশ্বাস করতে নাই।
আইচ্ছা কও এইসব কথা কি আমার বিশ্বাস করনের কথা? তুমিতো জানো, আমি তখনো পুরুষ মানুষ কি তাই বুঝিনাই। খালি চিনি বুঝি তোমারে। আমাগোর ভালোবাসা কি তাকি মানুষ জানে কও? চুলে তহনো যেই লাল ফিতা খান বান্ধা আমার; সেইটাও কিনা দিছ তুমি! ঈদের চাঁদ দেখলেই তোমারে সালাম করতাম আমি, কইতাম তুমি আমার ঈদের চাঁদ। আমার চাঁদ কেমনে আমারে মাইনষের আকাশে ছাইরা যায়!!
আমি পাথড় হইয়া গেছিলাম। ওরা কইতেছিল পুরুষ মানুষ নাকি ভালোবাসতে জানেনা। খেলতে জানে। আমি বোকামি করছিলাম, কেন তার হাত ধইরা বাইর হইছিলাম।! আমি মানি নাই আমি চিৎকার করছিলাম,” না……।‘ তুমি আমারে নরকে রাখতে পারনা । তুমি ফিরা আইবা। নিয়া যাইবা আমারে। “না … তুমি ভুল না। আমি ভুল না। ‘না…।।“

সময়ের ভীড়ে সেই আমি,হই পতিতা, বেশ্যা। ভদ্র ভাষায় প্রোস্টিটিউট, প্রোস। ওয়ার্ল্ড ক্লাস বারবনিতা আজ আমি। গ্রামের আঞ্চলিক উচ্চারণ আমায় ছেড়ে গিয়েছে সেই কখন। নিজ ঈচ্ছায় আজ উচ্চ শিক্ষিত আমি। আমার ক্লায়েন্টরা শুধুই শরীরের সুখ পেতেই আমার কাছে আসেনা; আমার সাথে গল্প করলে কতো শত কবি সাহিত্যিকের লেখার গভীরিতা পাঠককে ছুঁয়ে যায়! কতো শত পথ খুলে যায় কাজের আমার বুদ্ধিতে, তা ব্যবসায়ী মাত্রই জানেন। আজ আমকে দেখলে তুমি চিনতেই পারবেনা। এখন আমাকে সবাই ডাকে প্রিতমা বলে বা মিজ প্রিমা। আমাকে ছাড়া বড় বড় পার্টিগুলো এখন জমেইনা! বিদেশী ডেলিগেটস, তাঁদের মনোরঞ্জনে আমাকেই প্রয়োজন। কারো খুব গুরিত্বপূর্ন ফাইল উদ্ধার করতে হবে, সেখানেও আমাকেই চাই। তুমি জানো, আমি আজ আকাশ ছুঁতে পারি! আমি যা চাই তাই পাই। চাইলেই বিশেষ কোন তারকা, বা মন্ত্রি-সচিবের একান্তে যাওয়া আমার কাছেই সহজ। আমি অনেক ভালোবাসা পাই, কখন কখনও পাই শ্রদ্ধাও। নিজেই একটা বেশ প্রতিষ্ঠিত এনজিও আছে আমার। অসহায় দূস্থ মেয়েদের যেমন আশার আলো দেখাই, তেমনি যারা অন্তরালে আমার লাইনে এসে পড়ে, তাদেরও আমিই আশার আলো। আমি মেয়েদের বলি কোনো কিছুই হারিয়ে যাবার নয়। শরীর দিয়েছ, তো কি হয়েছে! এটিও একটি কাজ । এটিও একটি শিল্প। আমিই বলি! আমিই মানুষকে উৎসাহ দিই, উদ্দীপনা দিই। বলি জীবনকে ছেড়ে দাও । উপভোগ করো।
তারপরও মাঝে মাঝে কি হয় জানো? যখনই একা হই, একান্ত নিজের সময়ে আমার ফ্লাটের বারান্দায়, কিংবা দূর পাল্লার ভ্রমণে থাকি। এই শুদ্ধ আমার বুকের ভিতরটায় কেমন কইরা ওঠে। হুহু কইরা কান্না বাইর হইয়া আসে। ক্যান আসে?! না বাপ মায়ের লাইগা না, তাগোরেতো আমি ভালাই রাখছি। শহরে ঘর তুলা দিছি। কোন কিছুরই অভাব রাখি নাই।
তাও কান্দি আমি, কি কারন? নাহ কওন যায়না, প্রকাশ্যে আনন যায়না। মাইনষে আমারে অনৈতিক পাগল কইবো। তারাযে আম্তুরে কইছিল, তুমি আমারে বেশ্যা বানাইছ, পতিতা বানাইছ। কিন্ত আমিযে তোমারেই এক বিন্দু ঘৃণা করতে পারিনাই। বড় ভালোবাসিগো! তোমারেই ভালোবাসি। এতো এতো পথ মাড়াইয়াও, কাউরে জায়গা দিতে পারিনাই এই কইলজাডার ভিতরে। ভাবতে পারিনা নাই তুমি ছাড়া আর কাউরে ভালোবাসার মানুষ। ভালোবাসা পাইতে কতো কতো জন হাত বারাইছে, সুন্দর সংসারে দিয়া সামাজিক বউ বানাইতে পায়ে পইড়া কাঁদছে পর্যন্ত! আমি পারিনাই সেই হাত ধরতে। ভালোবাসার মানুষ হইয়া তুমি ছাড়া আর কেউ আমার শরীরটাতে হাত দিবো! যেই মন শুধুই তোমার, ভাবতে পারিনাই আর কেউ আমার মনটারে ছুঁইব। আইজ এতদিন পরেও আমি শুন্যে তোমারেই খুঁজি, তোমারেই কই, কি আছিলা তুমি আমার! তোমারে আমি ঠিক কত ভালোবাসছিলাম!
নাহ, না না, বাসছিলাম তো না, তোমারেই ভালোবাসি আজও, যহন আমি মিজ প্রেমা! তুমি কি আমি জানিনা। তুমি প্রতারক! তুমি খারাপ! তুমি বেইমান! তুমি লোভী! তুমি স্বার্থপর! এইসব কিচ্ছু আমি জানিনা। তোমারেই ভালোবাসি। এটাই শুধু জানি। তাই হাজার স্পর্শেও আমি পবিত্র শুধুই তোমার জন্য। চোখে ঘৃণা না, তোমার বিরহ নিয়া কাঁদি, প্রার্থনা করি, তুমি ভাল আছত! ভালো থাইকো। আমার সব কান্নার বিনিময়ে তুমি ভালবাসায় থাইকো। আমার অস্পৃশ্যের পৃথিবীতে একমাত্র সান্তনা, প্রিয় আসহায়ত্ব তুমি আমার!


আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
পারভেজ রাকসান্দ কামাল লেখাটি বেশ ভাল লেগেছে. প্লট টি আরো জমলে ভাল লাগত. তবু শেষ পর্যন্ত পড়ার আগ্রহ ছিল আপু. লেখার গাঁথুনি সুন্দর. ভাল থাকবেন
ফয়জুল মহী সবাইকে নিয়ে এই মহামারীতে সাবধানে থাকবেন ও ভালো থাকবেন। শুভকামনা প্রিয়।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

ভালোবাসার অসামঞ্জস্যতাও হয়ে উঠে অসহায়ত্ব। কারো কারো জন্য সেটাই গোপন বাঁচার প্রেরণা, প্রিয়তম সুখ , অপ্রকাশ্য।

২৪ সেপ্টেম্বর - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪