আজ দুপুরের পরে হঠাৎ করে আম্মা ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, "ঈদে কী কিনছস?"
একটু অবাকই হলাম, কারণ ঈদ উপলক্ষে নতুন কিছু কেনার পর্যায়টা পার হয়ে এসেছি অনেকদিন আগেই। সন্তানরা কী কিনছে, সেটার ব্যাপারেই এখন বেশি খোঁজখবর নেয়া হয়।
তবে আম্মার সব নাতি-নাতনিরা এই ঈদে কে কী কিনছে, সেটার ব্যাপারে তাঁর খোঁজ-খবর নেয়াতে কিন্তু কোনো ঘাটতি নেই। রোজার আগে আম্মাকে দেখতে যখন ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম, তখন আম্মা তাঁর নাতনীদের জন্য নতুন জামা-কাপড় কিনতে টাকা আমার কাছে দিয়েছিলেন। ঢাকায় এসে নতুন জামা কাপড় কিনে আম্মাকে সেটা জানিয়েছিলাম।
আজ দেখি আম্মা ব্যস্ত ঈদে তাঁর চল্লিশোর্ধ ছেলে কী কিনেছে, সেটি নিয়ে। বললাম, "আমি আবার ঈদে কি কিনব?" শুনে একটু বিরক্তির সাথে তিনি বললেন, "কিছু একটা কেনা দরকার ছিল না?" আম্মাকে যখন জানালাম যে, ঈদ উপলক্ষে একটি গেঞ্জি গিফট পেয়েছি, তখন তিনি থামলেন।
আমি যখন তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি, তখন আম্মা, বড় আপা, বড় আপার দুই/তিন বছরের ছেলেসহ মেজ মামার বাড়িতে গিয়েছিলাম। যেহেতু বড় আপার ছেলের এটি প্রথম যাওয়া, এ জন্য মেজমামা আমার ভাগ্নের জন্য কিছু একটা কিনতে বাজারে যেতে উদ্যত হলেন, আমাকেও সাথে নিয়ে নিলেন। আমি বের হয়ে যাওয়ার সময় আম্মা বললেন, "তোর যেটা পছন্দ হয়, তোর মামাকে বলিস।" এই দোকান ওই দোকান ঘুরে অবশেষে ভাগ্নের জন্য জামা-কাপড় কেনা হল। আর আমার চোখ তখন কেবল আমার উপযোগী ঝুলানো শার্টের দিকে ঘুরতে থাকল। অপেক্ষা করতে থাকি, মামা কখন বলবেন, "তোর কোনটা লাগবে?" কিন্তু না, মামার পক্ষ থেকে উপহার সেবার আর আমার ভাগ্যে জোটেনি। বাসায় এসে তখন আম্মাকে ঘটনা সবিস্তারে বললাম, তখন আম্মার যে চেহারা হয়েছিল, তা চোখ বন্ধ করলে আমি এখনও দেখতে পাই। সেবার উপহার আমি অবশ্য পেয়েছিলাম, তবে তা আমার মায়ের কাছ থেকে।
আমার সাত বছর বয়সী বড় মেয়েকে নিয়ে বাইরে বের হলে তার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি সব দিকেই স্ক্যান করে চলে। সেদিন চটপটি-ফুচকা খেতে গিয়ে দোকানের নাম পেল "মায়ের দোয়া"। এরপর একদিন বাল্ব কিনতে গিয়েও তার আবিষ্কার, দোকানের নাম "মায়ের দোয়া"। এরকম আরও অনেক ক্ষেত্রেই 'মায়ের দোয়া'র উপস্থিতি। তখন তার প্রশ্ন, "দোকানের নাম বার বারই 'মায়ের দোয়া' কেন, বাবা?"
- মায়ের দোয়া নিয়ে ব্যবসা করলে তাড়াতাড়ি উন্নতি হয়, বাবা।
--মায়ের দোয়ার অনেক শক্তি, তা-ই না?
- হ্যাঁ বাবা, যার সাথে মায়ের দোয়া আছে, তার সাথে আল্লাহর রহমতও আছে।
-- মায়ের দোয়া কীভাবে পাওয়া যায়, বাবা?
- সন্তানের জন্য মায়েরা নিজ থেকেই সব সময় দোয়া করেন, চাইতেও হয় না।
-- মা রাগ করলেও কি দোয়া করে?
- মা কখনো সন্তানের উপর রাগ করে থাকতে পারেন না, বাবা। তবে মা রাগ করে, এমন কাজ কিন্তু কখনোই করা যাবে না।
--করব না, বাবা।
বুয়েটের হলে এসে থাকাই আমার বাড়ির বাইরে প্রথম থাকা। আমি হলে এসে থাকাকালীন সময়ে আম্মা মাঝে মাঝে আমাকে চিঠি লিখতেন। সে চিঠির বিষয়ের মধ্যে বেশিরভাগই থাকতো আমার খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কিত। হলে কী খাচ্ছি, খাবার কেমন, কী কী খেতে হবে, ইত্যাদি অনেক কিছু। খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কিত মায়ের এই খোঁজ-খবর নেয়া আমার এই চল্লিশোর্ধ বয়সে এখনো চলছে। হয়তো আমি বুড়ো হলেও এই ধারাবাহিকতা চলবে।
আমার আম্মা সহজে ঢাকামুখী হন না। নানুর অসুস্থতার সময় তাঁকে দেখার জন্য আম্মা একবার ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি ঢাকায় আসবেন, আর তাঁর ছেলে কোথায় থাকে - তা তিনি নিজ চোখে দেখে যাবেন না, এমনটা তো হয় না ! তখন আমি আম্মাকে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে আমার রুমে নিয়ে গিয়েছিলাম। বুয়েটে ছেলেদের হলগুলোতে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, কিন্তু মায়ের বেলায় সাত খুন মাফ। আম্মাকে আমার রুমে নিয়ে গেলে হলমেট ও বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই আম্মার সাথে দেখা করতে আসে। আম্মা তখন সবার সাথে কথা বলে তাদের পরিবারের অনেক কিছু জেনে নিয়েছিলেন, যা একসাথে অনেক দিন থেকেও আমি জানতে পারিনি; বলা যেতে পারে জানতে চেষ্টা করিনি। আসলে ছেলের বন্ধু-বান্ধব তো মায়ের কাছে ছেলের মতোই। কাজেই তাদের মায়েদের খোঁজ তিনি নিবেন, এটাই স্বাভাবিক।
আমার ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার কথা শুনলেই আম্মা প্রতি আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘন্টা অন্তর অন্তর ফোনে খোঁজ নিতে থাকেন। জ্যামের কারণে গাজীপুরের জয়দেবপুর চৌরাস্তা পার হতে অনেক সময় লেগে যায়। জয়দেবপুর চৌরাস্তা পার হওয়ার পর তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। অনেক সময় ময়মনসিংহের বাসায় পৌঁছাতে পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টাও লাগে। আর আম্মার ফোন করাও নির্ধারিত সময় পর পর চলতেই থাকে। আমি ফোন করতে মানা করলে তখন তিনি বড় ভাই বা ভাস্তিকে দিয়ে হলেও ফোনে খোঁজ নিতে সচেষ্ট থাকেন। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় ফেরার সময়েও এই প্রক্রিয়াই চলে। আমি বাসায় পৌঁছানোর পর ফোন দিলে তখন ফোন আসা থামে।
সেদিন অফিসে একটু ব্যস্ত ছিলাম। বেলা একটার দিকে আম্মার ফোন, "তোর শরীর কেমন, ভালো আছিস তো বাবা?"
- হ্যাঁ, ভালোই আছি আম্মা। তোমার কি খবর?
--আমি ভালোই আছি। সকাল থেকে তোর ফোন পাইনি তো ! ভাবলাম, কোনো সমস্যা কি-না? এজন্য ফোন দিলাম।
- অফিসের ঝামেলায় থাকায় আমি তোমাকে ফোন দিতে পারিনি।
--ও আচ্ছা, খাওয়া-দাওয়া করেছিস কি?
- না আম্মা, এখন তো সবে বাজে একটা। আর একটু পরে করব।
--তাড়াতাড়ি সময়মত খেয়ে নে।
"ঠিক আছে, আম্মা" বলে ফোনটা রাখলাম। তখন খেয়াল হল, আসলেই তো সকাল থেকে আম্মাকে ফোন দেয়া হয়নি, যা আমি অফিসে পৌঁছার পর প্রতিদিন করে থাকি।
এর মাঝে একদিন ঢাকায় বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে একটু রাত হয়ে যাওয়ায় হঠাৎ করেই ময়মনসিংহ থেকে আম্মার ফোন, "তুই এখন কোথায়?"
-- একটু বাইরে আমরা। তূমি এখনও ঘুমাওনি?
- এত রাত্রে বাইরে কেন?
-- বন্ধুদের সাথে আছি, আম্মা।
- তাড়াতাড়ি বাসায় যা। গিয়ে আমাকে ফোন দিস।
-- ঠিক আছে, বাসায় গিয়ে ফোন দিচ্ছি।
আমার আম্মার ধরন আমি জানি। বন্ধুদের কাছ থেকে এখনই ছুটে যেতে না পারলে আম্মা আমাকে ফোন দিতেই থাকবেন। তখন বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় গিয়ে আম্মাকে পৌঁছার সংবাদ দেওয়ার পর তিনি বললেন, "এখন আমি ঘুমাতে যাচ্ছি"। তখন রাত বাজে সাড়ে এগারটা, যদিও আম্মা রাত দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে যান।
মা সম্পর্কে যখন লেখার চিন্তা করছিলাম, তখন কেন জানি সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। হয়তো বা অতিরিক্ত আবেগের জন্য, কারণ ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলের নিকট মা হল সবচেয়ে আবেগের স্হান। সঙ্গীত, সাহিত্য, শিল্পকলা সর্বত্রই মা তথা মাতৃস্নেহের জয়গান করা হয়েছে। আর আমি অবশ্যই 'মা' নিয়ে আবেগ তাড়িতদের বাইরে নই।
পৃথিবীর সব মায়েরা আসলে এমনই হয় ! সন্তান মায়ের কাছে সব সময় সেই ছোট্টটিই থাকে, কখনো বড় হয় না, যেমনটি দুই কন্যার বাবা হওয়া সত্বেও আমি এখনো হয়নি।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
গল্প-কবিতা'র পরবর্তী গল্প সংখ্যার বিষয় 'মা' । আমি আমার মায়ের বিভিন্ন ঘটনা নিয়েই এ গল্পটি লিখেছি।
গল্পটি আমার মায়ের ঘটনা নিয়ে হলেও পৃথিবীর সকল মায়েরা আসলে এমনই স্নেহশীল হয়। কাজেই আগামী সংখ্যার বিষয়ের সাথে আমার গল্পটি সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক।
১৬ জুলাই - ২০১৯
গল্প/কবিতা:
১৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪