নানা আলোচনা সমালোচনার মাঝেই স্কুল শিক্ষিকা নাসরিন আকতার অবশেষে ঘোষণা দিলেন "নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতি" গঠনের। কদিন থেকেই তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে তিনি বলছিলেন এই সমিতি গঠনের কথা। তার আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-সহকর্মীরা যদিও তাকে নিষেধ করছিল, কিন্তু তিনি সেটা গায়ে মাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। নিজেকে সমিতির সভাপতি উল্লেখ করে তার ফেসবুক একাউন্ট থেকে লাইভের দ্বারা উক্ত সমিতি গঠনের ঘোষণা দিলেন। সাথে এটাও বললেন, এই সমিতি কেবল ভার্চুয়াল হয়েই থাকবেনা। তিনি দুর্গাপুর উপজেলা শহরে সমিতির অফিস স্থাপন করবেন।
দুর্গাপুর উপজেলার আলিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এক সময়ের সহকারি শিক্ষিকা ছিলেন তিনি। বর্তমানে সেই চাকরি নেই। এখন আলিপুরের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হয়ে আছেন। কাজেই তার ফলোয়ার এবং ফ্রেন্ডের সংখ্যা কম নয়। অতএব তার এই ঘোষণা শেয়ার হয়ে ছড়াতে সময় লাগল না। অনেকে অনেক রকম কমেন্ট করতে লাগল এই পোস্টে। তাদের মধ্যে কিছু কমেন্ট এরকম-
তার বর্তমান স্কুলের সহকর্মী শিক্ষক কমেন্ট করলেন,'আমাদের ম্যাডামের বেশ রসবোধ আছে।'
আরেক শিক্ষিকা কমেন্ট করলেন,'বাহ বিনোদনের চরম লেভেল।'
সাবেক স্কুলের এক শিক্ষক কমেন্ট করলেন,'আপার কি বর্তমানে কোন চাকরি নাই?'
এক আত্মীয় কমেন্ট করলেন,'তোমার সাজা হবে এমন পোস্ট দিলে।'
এভাবে অনেক রকম কমেন্ট আসতে লাগল। নাসরিন আকতার কোন কমেন্টের জবাব দিলেন না। তিনি জানেন যে কোন কাজ করতে গেলে অন্যের কথা গায়ে মাখতে হয়না।
দুইদিন পরে তিনি আরেক পোস্ট দিলেন। নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতি এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তিনি ব্যাখ্যা করলেন। এই পোস্ট আগের পোস্টের চেয়ে আরও দ্রুত ছড়িয়ে গেল।
চারদিন কেটে গেল। নাসরিন আকতারের ফোনে একটি কল আসল। স্থানীয় একটি পেপারের সাংবাদিক তার সাথে কথা বলতে চান। তিনি খুশি হলেন সাংবাদিকের কথা শুনে। মনে মনে ভাবলেন যাক ভালই হল। সাংবাদিকের সাথে কথা বললে তার সুবিধাই হবে। আগামীকাল বিকেলে সেই সাংবাদিককে আসতে বললেন তিনি।
পরদিন বিকেলবেলা। নাসরিন আকতার তার আলিপুরের বাসায় বসে সাংবাদিকের জন্য অপেক্ষা করছেন। একটু পরে সেই সাংবাদিক আসল। তাকে তার বৈঠকখানার ঘরে বসালেন। সাংবাদিক তাকে বলল--
-'অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, আমাকে সময় দেবার জন্য।'
-'ঠিক আছে, আপনি আমার ফোন নাম্বার নিশ্চয় স্কুল থেকে পেয়েছেন?'
-'জ্বী হ্যাঁ।'
-'নিশ্চয় "নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতি" সম্পর্কে আপনার কৌতূহল হয়েছে?'
-'জ্বী হ্যাঁ। এই ব্যাপারে যদি বিস্তারিত বলতেন...'
-'বিষয়টা তেমন জটিল কিছু না। সাধারণ একটা ব্যাপার। আসলে এই সমিতির উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদেরকে সহযোগিতা করা যারা ঘুষ দেবে বা নেবে।'
-'কেন!, ঘুষের মত নৈতিকতাবিবর্জিত একটা বিষয়ে আপনি কেন লোককে সাহায্য করবেন?'
-'দেখুন আমাদের সমাজে "নীতি বা নৈতিকতাবিবর্জিত" বা "সমাজের ক্ষতি করে" এমন কিছু ব্যাপার রয়েছে, যেগুলোকে আমরা বাস্তবতার অযুহাত দিয়ে অনেকটা বৈধ করে নিয়েছি। যেমন সুদ, যৌতুক ইত্যাদি। এগুলো আর আমাদের কাছে কোন ব্যাপার না। তাই আমি মনে করি ঘুষও যেহেতু আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ হয়ে গেছে, তাই এটাকেও আমাদের সামাজিকভাবে মেনে নেয়া উচিত।'
-'কিন্তু এজন্য ঘুষ লেনদেন সমিতি কাকে সাহায্য করবে?'
-' ঘুষ লেনদেন সমিতি তাদেরকে সাহায্য করবে, যাদের ঘুষ লেনদেন করতে ইচ্ছা আছে কিন্তু সাহস পাচ্ছে না।'
-'মানে একটু বুঝিয়ে বলবেন...?'
-'ধরুন সরকারি একটা অফিসে আপনি কাজ করতে গেলেন। এখন দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট অফিসার কাজটি করে দেবার জন্য আপনার কাছে ঘুষ চাইতেও পারছেনা আবার আপনিও আগ বাড়িয়ে ঘুষ অফারও করতে পারছেন না। ফলে দিনের পর দিন পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আপনার কাজটি হচ্ছে না। আবার মনে করুন অফিসারটি ঘুষ চাইল, কিন্তু আপনি ঘুষ দিতে ইচ্ছুক না। এজন্যও আপনার কাজটি হচ্ছেনা। এসব পরিস্থিতিতে আমাদের ডাকলে আমরা সাহায্য করব।'
-'কিন্তু এক্ষেত্রে দুদক বা অন্য কোন সরকারি আইন কর্মকর্তা কি আপনাদের বাঁধা দেবে না?'
-'এক্ষেত্রেও আমি চেষ্টা করছি আমার সমিতিকে যেন সরকার অনুমোদন দেন।'
-'আপনি কি মনে করেন সরকার আপনাকে এসব কাজ করার অনুমোদন দেবে।?'
-'সেটা পরের ব্যাপার। কিন্তু আমি আশা ছাড়ছি না।'
-'আপনার আশা করাটা কি একটু উচ্চাভিলাষ হয়ে গেল না?'
-'কেন? আমাদের দেশে মাদক সেবন তো নিষিদ্ধ, কিন্তু ঢাকা শহরে কিন্তু অনুমোদনপ্রাপ্ত বার তো ঠিকই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে!।'
-'সেটা তো কিছু দেশি বিদেশি লোকের জন্য...'
-'এইতো এবার লাইনে এসেছেন। আপনিই স্বীকার করলেন যে একই কাজ কিছু লোকের জন্য নিষিদ্ধ আবার কিছু লোকের জন্য সিদ্ধ হতে পারে। আমার ঘুষ লেনদেন সমিতিরও ব্যাপারটা অনেকটা এরকম।'
-'সেটা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু এই সমিতি কি সবাইকে একটা নেতিবাচক কাজে উৎসাহ দিচ্ছে না?'
-'সেটা নাহয় আপনি কয়দিন পরেই দেখতে পারবেন...আমার সমিতি ভাল কাজ করছে না খারাপ কাজ করছে!?'
পরদিন জেলাশহরের পেপারে খবরটা প্রকাশিত হল। এর দুইদিন পরে ঢাকার দুটি পেপারে নাসরিন আকতারের খবরটা উল্লেখ করে নিউজ প্রকাশিত হল। ফেসবুকের আইডিগুলোতেও নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতির খবর শেয়ার হতে লাগল।
এক সপ্তাহ কেটে গেল। গত এক সপ্তাহে প্রতিদিনই নাসরিন আকতারের কাছে অনেক ফোনকল এসেছে। চেনা নাম্বার থেকে কল আসলে তিনি তেমন রিসিভ করতেন না। অচেনা নাম্বার দেখলে তিনি কল রিসিভ করে প্রথমেই জানতে চাইতেন তিনি নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতির খবর জানতে ফোন করেছেন কিনা? যদি কলকারী ব্যক্তি হ্যাঁ বলেন তাহলে তিনি তার ফেসবুক আইডি অথবা তার অফিসে আসতে বলছেন। তার বাড়ির নীচতলায় তিনি সমিতির অফিস স্থাপন করেছেন। সেখানে এক ছেলেকে অফিস সহকারি পদে বসিয়ে দিয়েছেন। সিহাব নামের বেকার ছেলেটা চাকরিটা পেয়ে বেজায় খুশি। মানুষকে গর্ব করে বলে বেড়ায় সে নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতির অফিসে অফিস সহকারী পদে চাকরি করে। অফিসে যেসব লোকজন আসেন তারা কেবল নাসরিন আকতারের সাথে কথা বলে যান যে নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতি কিভাবে কাজ করে?
দুর্গাপুরের স্থানীয় একটি পেপারে আজ একটি খবর ছাপা হয়েছে।
"দুর্গাপুর উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার নুরুল হক ঘুষ লেনদেনের দায়ে সাময়িক বহিষ্কৃত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ব্যবসায়ী আনিসুল মাহমুদ এর কাছ থেকে দুর্গাপুর উপজেলার চৌমুহনি মৌজার ৮৮ শতক জমি মিথ্যা তথ্য প্রদান করে নামজারি করার জন্য ঘুষ গ্রহণ করেছেন। নুরুল হকের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে কমিটি গঠিত হয়েছে।"
নাসরিন আকতার স্কুলে বসে খবরটা পড়লেন। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল।
বিকেলে বাসায় এসে তার ফেসবুক ওয়ালে খবরটার অনলাইন ভার্সন শেয়ার করে লিখে দিলেন "ঘুষ লেনদেনের দায়ে ইনি বহিষ্কৃত হয়েছেন। এনাকে চাকরীচ্যুত করা হল, অথচ ব্যবসায়ী আনিসুলের কিছু হল না!"
তার এই পোস্টের পক্ষে বিপক্ষে অনেক কমেন্ট আসতে থাকল। কেউ কেউ বললেন,'সরকারি অফিসে গেলে মানুষকে জিম্মি করে অফিসাররা ঘুষ নেন, সার্ভেয়ারের উচিত সাজা হয়েছে!'
আবার কেউ কেউ বলল,'নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতি থাকতে সার্ভেয়ার ফাঁসলেন কিভাবে?'
নাসরিন আকতার পরদিন আরেক পোস্ট দিলেন--
"দুর্গাপুরের সার্ভেয়ার নুরুল হক ঘুষ নেবার দায়ে চাকরিচ্যুত। সবাই যেহেতু জানে যে সরকারি কর্মকর্তা মানেই দুর্নীতির বাহক তাই এই নুরুল হকের পক্ষে কথা বলার কেউ নাই। নুরুল হক অনিয়ম করে টাকার বিনিময়ে ৮৮ শতক জমি ভুয়া মালিকের নামে এসিল্যান্ড সাহেবের কাছে সুপারিশ করে নামজারি করে নিয়েছেন। নুরুল হক টাকা পেয়েছেন তাই তাকে সাজা পেতে হবে। তবে ব্যবসায়ী আনিসুল মাহমুদ টাকা দিয়ে নিজের সুবিধা করলেন তার কেন সাজা হবে না? সবাই কি ভেতরের কথা জানেন? জানিনা মাননীয় ডিসি সাহেব কি সিদ্ধান্ত নিবেন? তবে সিদ্ধান্ত যাই হোক, যেন কোন একতরফা সাজা না হয়?"
তার এই পোস্টের উপর অনেক লাইক কমেন্ট পড়তে লাগল। অনেকে তাকে নিন্দা করে কমেন্ট করতে লাগল যে ঘুষখোরের পক্ষে সাফাই গাইছেন।
কেউ কেউ বলতে লাগল নাসরিন আকতার ঘুষের ভাগ নিতে শুরু করেছেন।
তার এই পোস্ট শেয়ার হতে হতে হতে এক সপ্তাহ কেটে গেল। নাসরিন আকতারের পক্ষে যেমন অনেক লোক কথা বললেন, বিপক্ষে তেমন অনেক কমেন্ট আসতে লাগল। অনেকে বলতে লাগল ঘুষ লেনদেন সমিতি ঘুষখোরকে সমর্থন দিচ্ছে, নাসরিন আকতারের সাজা হওয়া উচিৎ।
পরদিন দুর্গাপুরের পেপারে নাসরিন আকতার এবং নুরুল হককে নিয়ে খবর প্রকাশিত হল।
"দুর্গাপুরের একজন সহকারি শিক্ষিকা নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতি গঠন করেছেন। তিনি বর্তমানে আলিপুর কিন্ডার গার্টেন স্কুলে কর্মরত আছেন। তিনি বলছেন এই সমিতি ঘুষ লেনদেনে সহযোগিতা করে থাকে। কদিন আগে ঘুষ গ্রহনের দায়ে দুর্গাপুর উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার নুরুল হক বহিষ্কৃত হন। নুরুল হকের বিরুদ্ধে ডিসি অফিসের একটি তদন্ত চলছে। এমনি সময়ে নাসরিন আকতার নুরুল হকের পক্ষে সাফাই গাইছেন। দুর্গাপুর ও আলিপুরের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে বলেন, 'ফেসবুক ব্যবহার করে সবাই যা খুশি তাই করবে এমনটা হওয়া ঠিক না। নাসরিন আকতারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সময় এসেছে।'
পরদিন দুপুরবেলা। ঢাকার একটি টেলিভিশন চ্যানেল থেকে ফোন এল নাসরিন আকতারের কাছে।
-'হ্যালো আপনি কি নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতি এর সভাপতি নাসরিন আকতার ম্যাডাম?'
-'জ্বী হ্যাঁ।'
-'আমাদের চ্যানেলে আজ রাতের টকশো তে নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতি নিয়ে আলোচনা করা হবে। আপনি যদি দয়া করে এক ঘণ্টা সময় দিতেন তাহলে আমরা খুশী হতাম।'
-'টকশো মানে সরাসরি কথা বলার অনুষ্ঠান?'
-'জ্বী হ্যাঁ।'
-'ঠিক আছে।'
-'তাহলে আজ রাত নয়টায় আপনি থাকছেন কিন্তু...'
-'আমার বাড়িতে কিন্তু ইন্টারনেট না কম্পিউটার কিছুই নাই। কিভাবে যোগাযোগ হবে?'
-'আচ্ছা ঠিক আছে আমাদের দুর্গাপুর প্রতিনিধি আপনার সাথে যোগাযোগ করবে।'
এক ঘণ্টা পরে আবার একটা নাম্বার থেকে তার কাছে ফোনকল এল। এটা সেই চ্যানেলের লোক। তার সাথে ঠিক হল আজ রাত সাড়ে আটটায় সে বাড়িতে ক্যামেরা এবং কম্পিউটার নিয়ে আসবে।
আটটার দিকে সেই লোক এল। নাসরিন আকতার সিহাবকে আগেই বলেছিলেন। সিহাব আর সেই লোক ক্যামেরা, ল্যাপটপ সেট করে নাসরিন আকতারের বৈঠকখানায় বসে থাকল। যথারীতি নয়টার দিকে অনুষ্ঠান শুরু হল।
অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা কথা শুরু করলেন---'আজকে আমরা একটা অন্যরকম বিষয় নিয়ে কথা বলব। আপনারা হয়ত অনেকেই জানেন দুর্গাপুর নামক সাধারণ এক উপজেলায় একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষিকা নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটা ছড়িয়ে গেছে। এটা নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক চলছে। বিষয়টা কতটা যুক্তিযুক্ত, কতটা নৈতিক বা নীতিবিবর্জিত আমার এসব নিয়েই আজকে কথা বলব। প্রথমে স্বাগত জানাচ্ছি আমাদের প্রথম অতিথি বিশিষ্ট সমাজসেবক আহসান আলীকে। আচ্ছা আহসান সাহেব, আপনি নিশ্চয় শুনেছেন নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতি এর কথা। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এর কথা। ব্যাপারটা আপনি কিভাবে দেখছেন?'
আহসান আলী বললেন,'আমাদের সমাজ কোন স্তরে পৌঁছে গেছে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি! একটি মফস্বলের জায়গা থেকে একজন সাধারণ স্কুলশিক্ষিকা নিজের নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে কিভাবে এমন ঘৃণ্য একটি সমিতি গঠন করতে পারেন? এমনিতেই আমাদের সর্বস্তরে দুর্নীতিতে চেয়ে গেছে। নৈতিকতা, সততা, সামাজিক মূল্যবোধ এখন মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। তার উপর এমন প্রতিষ্ঠান হলে আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে!'
উপস্থাপিকা বললেন,'কিন্তু নাসরিন আকতার তো এই সমিতির পক্ষে কিছু যুক্তি দিয়েছেন, সেগুলো সম্পর্কে আপনার মতামত কি?'
আহসান আলী বললেন,'তিনি যেটা বলেছেন যে তিনি ঘুষ লেনদেনে সাহায্য করবেন। কেন ঘুষ লেনেদেনে সাহায্য না করে সেটা বন্ধ করার কোন উদ্যোগ নেয়া যায়না?'
উপস্থাপিকা বললেন,'আচ্ছা এটার উত্তর আমরা নিব সরাসরি নাসরিন আকতারের কাছ থেকেই। এখন আমরা যুক্ত হব আমাদের আলিপুরের প্রতিনিধির সাথে। ওখানে আছেন আমাদের আজকের অনুষ্ঠানের ২য় অতিথি নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতির সভাপতি নাসরিন আকতার। হ্যালো নাসরিন আকতার আপনি কি আমাদের শুনতে পাচ্ছেন?'
নাসরিন আকতার তার বাড়িতে থেকে ক্যামেরার সামনে বললেন,'হ্যাঁ বলেন।'
উপস্থাপিকা বললেন,'আমাদের এখানকার অতিথি আহসান সাহেব বলছেন আপনি ঘুষ বন্ধের উদ্যোগ না নিয়ে কেন ঘুষ লেনদেনে সহযোগিতা করার কথা বলছেন?'
নাসরিন আকতার বললেন,'আমাদের দেশের স্তরে স্তরে ঘুষ ছেয়ে গেছে। ঘুষ একটা অলিখিত রীতিতে পরিণত হয়েছে। আমি চাইলেই তো একা ঘুষ বন্ধ করতে পারব না...'
আহসান আলী বললেন,'ম্যাডাম আপনি যদি ঘুষ বন্ধ করতে না পারেন তবে ঘুষ লেনদেনে সাহায্য করতে চাইছেন কেন?'
নাসরিন আকতার বললেন,'দেখুন, আমরা যখন কোন সমস্যায় পড়ি তখন নিজেদের সাধ্যমত চেষ্টা করি সমাধান করতে। যখন ব্যর্থ হই তখন সেটাকে আমরা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেই। কেউ আবার সরকারকে গালি দিয়ে সরে পড়ি। তো আমি মনে করি আমাদের পক্ষে ঘুষ বন্ধ করা যেহেতু সম্ভব না, তাই এটা মেনে নিয়ে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনা উচিৎ।'
আহসান আলী মৃদু হাসতে লাগলেন।
উপস্থাপিকা বললেন,'ঘুষ লেনদেনে কেমন শৃঙ্খলার কথা বলছেন আপনি?'
নাসরিন আকতার বললেন,'যখন কোন বিষয়কে পুরোপুরি নির্মূল করা যায়না তখন সেটাকে বিভিন্ন সীমারেখার দ্বারা শৃঙ্খলিত করা হয়। আমার পরিকল্পনাটাও ঠিক তেমনি। যেমন চুরি বন্ধে চোরকে সাজা না দিয়ে চোরের কর্মসংস্থান করা।'
আহসান আলী বললেন,'তো আপনি কি ঘুষখোরদের জন্য বৈধ কোন উপায় ভেবে দেখেছেন? আমার মতে এমনটা হওয়া উচিৎ নয়। যদি এমনটা করেন তাহলে আমার মনে হয় দুদক আপনাকে ছেড়ে দেবেনা।'
নাসরিন আকতার বললেন,'আহসান সাহেব, ঘুষকে কি আপনি জঘন্য পর্যায়ের কিছু ভাবছেন?'
আহসান আলী বললেন,'অবশ্যই ঘুষকে এবং সাথে যারা ঘুষের পক্ষে কথা বলে তাদেরকেও!'
নাসরিন আকতার বললেন,'আহসান সাহেব, কোন কাজ করতে গিয়ে ঘুষ লেনদেনের এই যে সংস্কৃতি, এটার জন্য আমরা সবাই কিন্তু দায়ী। মানে আমি বলতে চাইছি অফিসাররা ছাড়াও আমরা যারা বিভিন্ন সেবা নিতে যাই, তারাও কিন্তু কিছু অনৈতিক ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারকে ঘুষের অফার করি। আপনি এই যে আজকের এই অবস্থানে এসেছেন, আপনি কি বলতে পারবেন আপনি জীবনে একবারও কোন কাজ আদায় করতে ঘুষ দেননি বা নেননি?'
নাসরিন আকতারের কথা শুনে উপস্থাপিকার মুখের হাসি কিছুটা মিলিয়ে গেল। ওদিকে স্ক্রিনে আহসান আলীর কথাও শোনা গেল না। উপস্থাপিকা চেষ্টা করেও তার কানেকশন পেলেন না। তারপর বললেন,'মনে হয় লাইনটা কেটে গেছে। আচ্ছা ঠিক আছে আমরা এবার দর্শকদের একটা ফোনকল নেই। হ্যালো আপনার নাম বলে প্রশ্ন করুন।'
দর্শক বললেন,'আমি জহির আলী। আমার প্রশ্ন হল নাসরিন ম্যাডামের কাছে। আপনি যদি এই সমিতি চালান তবে আমরা ওখানে যেতে পারব তো? মানে আপনি কি আমাদের সমস্যা সমাধান করতে পারবেন?'
নাসরিন আকতার বললেন, আমি জানিনা আপনি কোথায় থাকেন? তবে আমাদের অফিসে এলে আমরা অবশ্যই আপনার সমস্যা শুনব।'
আরেক দর্শক বললেন,'উপস্থাপিকার কাছে বলতে চাই, নাসরিন আকতার হিরো আলমের মত একটু প্রচারণা চাইছে। অন্য কিছু না। আপনারা টেলিভিশনের লোকজন এদের গুরুত্ব না দিলেই ভাল। এরা এমনিতেই তখন দমে যাবে।'
উপস্থাপিকা বললেন,'ঠিক আছে দেখতে দেখতে আমরা শেষ পর্যায়ে এসেছি। সুপ্রিয় দর্শক, পৃথিবীতে নানা রকমের মানুষ থাকে বলে পৃথিবী এত বৈচিত্র্যময়। সব মানুষ যদি এক রকমের হত, তবে মনে হয় নতুন কিছু সৃষ্টি হত না। আমার মনে হয় নাসরিন আকতার তেমন এক নারী চরিত্র। তিনি ঠিক কি করতে চাইছেন, সেটা আমরা কদিন গেলেই বুঝতে পারব। আজকে এখানেই শেষ করছি। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।'
পরদিন নাসরিন আকতারের কাছে একটা ফোনকল এল। দুর্গাপুর থানার ওসি সাহেব ফোন করেছেন। কিছু কথা বলার জন্য তাকে থানায় আসতে অনুরোধ করলেন। নাসরিন আকতার বুঝে গেলেন তার খেলার সময় শেষ। তিনি ব্যাগে কিছু কাপড় নিয়ে সিহাবকে বললেন, 'কদিন এখানে থাকো। আমার হয়তো কিছুদিন জেলে থাকতে হবে।'
সিহাব তার ম্যাডামের কথা শুনে চোখে জল এনে ফেলল। বলল,'আমি আপনার সাথে যাব।'
তিনি বললেন, 'ধুর ছেলে বাড়িতে কে থাকবে? তোমাকেই থাকতে হবে। আর হ্যাঁ, আমি না আসা পর্যন্ত নীচে বসতে হবে না। সব চাবি দিয়ে রাতে উপরে থেকো।'
স্থান দুর্গাপুর থানা। একটু আগে নাসরিন আকতার থানায় এসেছেন। এখন ওসি সাহবের সামনে বসে আছেন। নাসরিন আকতার তার দিকে তাকালেন। লোকটার বয়স অফিসারদের তুলনায় কম। মনে হয় সদ্য পদোন্নতি হয়েছে। ওসি সাহেবই কথা শুরু করলেন---
-'ম্যাডাম আপনাকে ধন্যবাদ যে আপনি নিজে এসেছেন? নাহলে আমার লজ্জা লাগত...'
-'কেন? একজন অপরাধীকে ধরতে আপনার লজ্জা লাগবে কেন?'
-'একজন ছাত্র হয়ে নিজের শিক্ষিকাকে বাড়ি থেকে তুলে আনা আমার কাছে কাছে লজ্জার ব্যাপার বটে।'
-'খুশি হলাম আমাকে সম্মান দেবার জন্য।'
-'ম্যাডাম বোধহয় আমাকে চিনতে পারেননি? অবশ্য চিনবেন কিভাবে? অতগুলো ছাত্রের মাঝে এক বছর পড়া এক ছাত্রের কথা মনে থাকার কথা না।'
-'আপনি কি আমার ছাত্র ছিলেন?'
-জ্বী ম্যাডাম। আলিপুর স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়েছিলাম।'
-'কিছু মনে করবেন না... আমি মনে করতে পারছি না।'
-'আমি কিন্তু আপনার ছবি দেখে চিনতে পেরেছি। আপনাকে ধরে আনার নির্দেশ আছে। আমি চাইছিলাম আপনি যেন নিজে আসেন। তাহলে আপনার সাথে আর বেয়াদবি করতে হয়না।'
-'নির্দেশটা কে দিল?'
-'মাফ করবেন ম্যাডাম বলা যাবেনা।'
-'ঠিক আছে।'
-'আচ্ছা আপনি যে সমিতি গঠন করেছেন এটা কি জেনেবুঝে করেছেন?
-'হ্যাঁ।
-'কেন এটা করলেন?'
-'আশা করি আপনি আমার সব কিছু জেনে নিয়ে তারপর এখানে ডেকে এনেছেন। তাহলে অযথা আবার জিজ্ঞাসা করছেন কেন?'
-'ম্যাডাম এসব কি না করলে হয়না? এসব সমিতি টমিটি?'
-'না করলেও হয়...তবে...'
-'তবে কি?'
-'আমার ছেলেকে বাঁচাব কিভাবে?'
-'আপনার ছেলে? কি হয়েছে তার আমাকে বলেন?'
নাসরিন আকতার তার ছেলের গল্প শুরু করলেন। ওসি সাহেব ধৈর্য ধরে ম্যাডামের কথা শুনলেন। তারপর বললেন, 'ম্যাডাম, আপনার সমস্যা সমাধান করতে সময় লাগবে। কিছু মনে করবেন না ততদিন আপনাকে পুলিশ হেফাজতে থাকতে হবে।'
নাসরিন আকতার মৃদু হেসে বললেন,'কেন কেউ কি মামলা করেছে?'
ওসি সাহেব বললেন,'জ্বী, আনিসুল মাহমুদ নামে কেউ মামলা করেছেন। তাছাড়া ডিসি সাহেব আপনার উপর নজর রাখতে বলেছেন।'
এক মাস কেটে গেল। থানায় এলেন দুর্গাপুর ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার নুরুল হক। নাসরিন আকতারের মুখোমুখি হলেন তিনি। বললেন---
-'এসব কি? ঘুষ লেনদেন সমিতি আবার কি? কি জঘন্য ব্যাপার!'
-'কেন তুমি ঘুষ নিতে পারবে আর আমি সমিতি গঠন করতে পারব না?'
-'আমি যে পরিস্থিতির শিকার হয়েছি তুমি সেটা মানবে?'
-'সব ঘুষখোর অপরাধীরা নিজের অপরাধের পক্ষে যুক্তি রেডি রাখে।'
-'কিন্তু আমি তো ঘুষ চাইনি। ঐ লোকটাই আমাকে অফার করেছে!'
-'তুমি গ্রহণ করলে কেন?'
-'আমি গ্রহণ করিনি। ও আমার টেবিলে টাকা রেখে উঠে গেছে। আমি এটা ওকে ফেরত দেবার জন্য আমার কাছে রেখেছিলাম।'
-'এই কয়দিন কোথায় ছিলে?'
-'এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ালাম। কিন্তু তুমি এখানে কেন?'
-'আরে তোমাকে ছাড়ানোর জন্যই তো এসব কিছু...'
-'মানে কি?'
-'আমার কাছে তো ঘুষ দেবার মত টাকা নেই। তোমাকে মুক্ত করার জন্যই তো আমাকে এখানে ঢুকতে হল।'
সার্ভেয়ার নুরুল হক চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলেন না। বললেন,'মা তুমি এমনটা কেন করলে? তোমার চাকরিটা কি আর থাকবে?'
নাসরিন আকতার বললেন,'আরে বোকা ছেলে, আমার চেয়ে তোমার চাকরির দরকার অনেক বেশি। চাকরি করে করে তোমাকে লেখাপড়া করালাম। সার্ভে ইন্সটিটিউটে পড়ালাম। তুমি চাকরি পেলে। আমি আর কত চাকরি করব বল? একদিন তো আমাকে অবসর নিতেই হত।'
-'তাই বলে তুমি এমন অপমানজনক বিদায় গ্রহণ করবে?'
-'আমার কথা বাদ দাও, তোমার খবর কি বল?'
-'ঘুষের টাকা ফেরত দিয়েছি। তদন্ত কমিটি আর ডিসি সাহেব কে সব বলেছি। উনি আবার চাকরিতে যোগ দিতে বলেছেন।'
-'খুশি হলাম।'
-'কিন্তু তোমাকে ছাড়াতে জানি না কত টাকা লাগবে। তোমার এই সমিতির খবর সবাই জেনে গেছে। জানিনা কতদিনে তোমাকে বের করতে পারব।'
-'আরে বোকা ছেলে, তুই যেভাবে ছাড়া পেয়েছিস আমিও ঐভাবে ছাড়া পাব। মানুষ কি সবাই খারাপ হয়ে গেছে? নিরাপদ ঘুষ লেনদেন সমিতি সবাইকে জাগিয়ে দিয়েছে...'
(সমাপ্ত)