মাহমুদ তার বন্ধু তারেককে বলল---
-'তুই ভাবীকে নিয়ে এখানে আসবি আমাকে একবারও জানাবি না?'
-'আরে তোকে আগে থেকে জানানোর কি আছে? তুই তো আমার যাকে বলে ক্লোজ ফ্রেন্ড...'
-'সেটা ঠিক আছে, কিন্তু হঠাৎ করে এদিকে কেন? আমার এখানে এতদিন তোকে আসতে বললাম...আসলি না তো, আজকে একেবারে হঠাৎ!'
-'আরে এক সপ্তাহ আগে আমি শুনলাম বীথির বান্ধবীর বিয়ে। কিন্তু কাল শুনলাম বীথির বান্ধবীর বাড়ি আসাকুনিতে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম তোকে আগে না বলে একেবারে গিয়ে চমকে দেব।'
-'তোরা কি এখন আসাকুনি যাচ্ছিস?'
-'শুধু আমরা না তুইও যাচ্ছিস...'
-'ধ্যাত...তোদের ঐ বিয়ের বাড়িতে আমি অনাহূতের মত যাবনা।'
তারেকের স্ত্রী বলল, 'অনাহূত কে বলল? আপনি আমাদের সঙ্গী হয়ে যাচ্ছেন।'
মাহমুদ বলল, 'না ভাবী, তা হয়না।'
তারেক বলল, 'তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। কোন কথা শুনতে চাইনা।'
গাড়ি রিজার্ভ নিয়ে এসেছিল তারেক। সেটাতেই মাহমুদ, তার বন্ধু তারেক আর তারেকের স্ত্রী বীথি একসাথে বিয়ের বাড়িতে পৌঁছল। বীথির বান্ধবী নীরা তাদের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে একজনকে কোন একটা কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিল। সদর দরজা দিয়ে বীথিদের ঢুকতে দেখে নীরা এগিয়ে এসে হাসিমুখে তাদের অভিনন্দন জানাল।
নীরা বলল, 'খুব খুশী হয়েছি তোরা এসেছিস। আমি তো মনে করেছিলাম তোরা আসবি না।'
বীথি বলল, 'আসব না কেন?, তুই আমার স্কুলের বান্ধবী। স্কুলের বান্ধবীকে কি ভোলা যায়?'
নীরা বলল, 'তোরা ভিতরে চল'
বীথি বলল, 'চল, তোর মার সাথে অনেকদিন দেখা হয়নি। আমাকে চিনতে পারবে কিনা?'
নীরা বলল, 'চিনবে, তোর ছবি আমি মাকে দেখিয়েছি।'
সবাই ওরা ভিতরে আসল। নীরা বীথিদের ভিতরের ঘরে নিয়ে গেল। নীরার মার সাথে দেখা করার পরে তারেক আর মাহমুদ ঘর থেকে বাহিরে বের হয়ে বাড়ির উঠানে আসল। এই সময় মাহমুদ এর পাশ দিয়ে একটা মহিলা হেঁটে গেলেন। বয়স আনুমানিক ৩০-৩২ বছর হবে। মহিলাটা হালকা সবুজ রঙের এক শাড়ি পড়েছেন। ছিপছিপে গড়নের মহিলার মুখমণ্ডল কিছুটা লম্বা আকৃতির। চুল অনেকটা খাটো করে ঘাড়ের একটু নিচ পর্যন্ত কাঁটা। মাথার বাম পাশে সিঁথি কাঁটা মহিলাকে দেখে মাহমুদ কিছুটা থেমে গেল। সে পিছন ঘুরে মহিলাটাকে দেখতে লাগল। তারেক বলল--
-'এই বয়সে হ্যাংলার মত মেয়েদের না দেখে, বিয়েটা কর।'
-'আরে তুই যা ভাবছিস তা নয়। আমি ভাল করে দেখতেই পারলাম না। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল।'
-'কাজ সারছে! তুই ঐ চুল খাটো মেয়েটাকে আগে থেকেই চিনিস?'
-'আরে নাহ। তবে কোথায় যেন দেখেছি...'
খাবার সময় মাহমুদ আবার ঐ মহিলাটাকে দেখতে পেল। তাদের পাশের টেবিলে মহিলাটা দাঁড়িয়ে একজনকে কি যেন আস্তে আস্তে বলছে।
মাহমুদ সেদিকে বীথির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, 'ভাবী, আপনি কি পাশের ঐ মহিলাকে চেনেন? মনে হচ্ছে আপনার বান্ধবীর কেউ হবে।'
বীথি একটু মুখ ঘুরিয়ে মহিলাটাকে দেখে নিয়ে বলল, 'চিনি তো...কিন্তু ভাই ব্যাপার কি বলেন তো?'
মাহমুদ বলল, 'না মানে ঐ মহিলাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে...'
বীথি বলল, 'ওটা তো নীরার বড় বোন কল্পনা আপা...'
মাহমুদ বলল, 'তাই নাকি? আচ্ছা...'
বীথি বলল, 'তারেক, বলতো... তোমার বন্ধু এত মেয়ে থাকতে কল্পনা আপার দিকে নজর দিল কেন?'
তারেক হাসিমুখে বলল, 'জানিনা, ও তো তখনও একবার কল্পনা আপাকে দেখে অবাক হয়েছিল।'
মাহমুদ বলল, 'ভাবী আপনার বান্ধবীর বোনকে চেনার কারণটা ধরতে পেরেছি।'
বীথি বলল, 'কি কারণ?'
মাহমুদ বলল, 'খাওয়া শেষ হলে পরে বলছি।'
খাওয়ার পর্ব শেষ হলে বীথিরা নীরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরে নীরা আসলে বীথি নীরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো।
গাড়িতে বসেই মাহমুদ তার ফোন ঘেঁটে একটা ছবি বের করে বলল, 'ভাবী দেখেন তো একে চিনতে পারেন কিনা?'
বীথি বলল, 'দেখি... আরে এটা তো...কল্পনা আপার ছবি মনে হচ্ছে...কিন্তু কল্পনা আপা তো এত সাজেন না।এটা কি তার বিয়ের আগের ছবি? ভাই আপনি এই ছবি কোথায় পেলেন?'
এ সময় তারেক বীথির হাত থেকে ফোন নিয়ে বলল, 'দেখি দেখি...'
বীথি বলল, 'দেখ দেখ...'
তারেক বলল, 'কল্পনা আপার মত অনেকটা দেখতে বটে...তবে'
মাহমুদ বলল, 'ভাবী আপনারা আসল জিনিসটাই খেয়াল করেন নি...'
বীথি বলল, 'কি ভাই?'
মাহমুদ বলল, 'ছবিটা তো সাদাকালো, এখন কেউ সাদাকালো ছবি তোলে?'
তারেক বলল, 'তার মানে এটা কল্পনা আপা না?!'
মাহমুদ বলল, 'এটা হচ্ছে ৫০-৬০ দশকের হিন্দি ছবির নায়িকা নার্গিস দত্তের ছবি।'
বীথি বলল, 'চেহারার তো অনেক মিল আছে। কিন্তু ভাই আপনি এই ছবি ফোনে রেখেছেন কেন?'
তারেক বলল, 'আরে তুমি জাননা আমার বন্ধু অনেক আগে থেকে পুরনো ছবি দেখত। সাদাকালো ছবি আমার তেমন ভাল লাগেনা। কিন্তু মাহমুদ সেগুলোই দেখে। সেই জন্যই বোধহয়...'
মাহমুদ বলল, 'নার্গিস আমার প্রিয় নায়িকা বটে, তার সবগুলো মুভি আমি দেখেছি।
বীথি বলল, 'ভাই এই যুগের ছেলে হয়ে আপনার সাদাকালো ছবি ভাল লাগে?'
মাহমুদ বলল, 'ভাবী আমি তো কালার দেখিনা। আমি দেখি ছবির কাহিনি আর উপস্থাপন। সেই দিক দিয়ে ৫০-৬০ এর দশকের হিন্দি মুভিগুলো কিন্তু অসাধারণ।'
বীথি বলল, 'তাই নাকি? আমার তো সাদাকালো ছবি দেখলেই ঘুম ধরে।'
মাহমুদ বলল, 'আমার সঙ্গে দেখবেন। ঘুম ধরবেনা। আপনি চাইলে আপনাকে রাজ কাপুর, নার্গিস, দিলিপ কুমার, বিজয়ন্তীমালার ছবি দেখাতে পারি।'
তারেক বলল, 'কাজ সারছে...'
মাহমুদ বলল, 'তবে আমি ভাবছি মানুষের চেহারার এত মিল হয় কিভাবে?'
বীথি বলল, 'ভাই দেখেন, আপনি যেন আবার ঐ সাদাকালো ছবির নায়িকা নার্গিস মনে করে কল্পনা আপাকে কল্পনা করে নিয়েন না...হাহাহা...'
তারেকও হাসিতে যোগ দিল। বলল, 'কল্পনা করলে করবে। আপার চেহারা তো সুন্দর, তাছাড়া মাহমুদেরও বিয়ের বয়স চলে যাচ্ছে...'
বীথি বলল, 'তাইতো ভাই, আপনি বিয়ে করবেন কবে?'
মাহমুদ বলল, 'ভাবী আমি এতদিন আমার ব্যবসাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। বাবা যখন চলে যান তখন ফার্মটা এলোমেলো অবস্থায় ছিল। এখন ব্যবসাটাকে গুছিয়ে নিয়ে এসেছি, এখন বিয়ে করব...'
তারেক বলল, 'যাক... তবে মেয়ে দেখা শুরু করি?'
তারেক এবার চোখ টিপে বীথির দিকে তাকিয়ে বলল, 'মাহমুদ যদি বলে তবে আমি নীরার কাছে প্রস্তাব পাঠাতে পারি...হাহাহা...'
বীথি বলল, 'তোমরা কল্পনা আপাকে নিয়ে অতটা মশকরা করনা...আপার জীবনটা বড় কষ্টের...'
মাহমুদ বলল, 'কি হয়েছে ওনার ভাবী?'
বীথি বলল, 'পাঁচ বছর আগে ওনার বিয়ে হয়েছিল। দুই বছর পরে স্বামী মারা গেছে এক্সিডেন্টে। আপা একটা স্কুলে চাকরি নিয়েছেন শুনলাম। এখনও বিয়ে করেননি।'
মাহমুদ বলল, 'খুব খারাপ লাগছে।'
তারেক বলল, 'বেশী খারাপ লাগছে কি? হাহাহা...'
মাহমুদ বলল, 'ধ্যাত...'
দুইদিন কেটে গেল। নবনীল ফার্ম হাউস এর মালিক মাহমুদ সকালবেলা তার অফিস ঘরে বসে আছে। কল্পনার কথা ভাবছে। নার্গিস দত্তের সাথে তার চেহারার এতটা মিল কিভাবে হল? সেই মুখ সেই চেহারা! সেই চাহনি, সেই হাসি! মাহমুদ কম্পিউটার অন করে আওয়ারা মুভি চালু করে দিল। রাজ কাপুর আর নার্গিস জুটির এক অনবদ্য ছবি। মাহমুদ নার্গিসকে ভাল করে দেখতে লাগল। তার মনে ভাসছে কল্পনার কথা। কল্পনাকে নিয়ে নানারকম কল্পনা করতে লাগল সে। অন্যরকম এক অনুভূতির মাঝে কেটে গেল তার সারাদিন। অবিবাহিত মাহমুদের মাঝে এবার নারীপ্রীতি জাগ্রত হল। কতগুলো বছর কাজের মাঝে ব্যস্ত থাকার পরে মাহমুদের আজ মনে হচ্ছে অনেক কিছু মিস করেছে সে। 'পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া' গানের দৃশ্যায়ন করতে লাগল সে মনে মনে। রাজ কাপুরের বদলে নিজেকে নার্গিসের সাথে বৃষ্টিতে ভেজাল সে।
মাহমুদ আজ ফার্মের কাজে তেমন মন বসাতে পারল না। জরুরি কিছু কাজ সেরে নিয়ে বাকি কাজগুলো রেখে দিল। এভাবে কখন যেন রাত এসে গেল। শোবার সময় দেয়ালে টাঙানো ঐ ছবিটার দিকে চোখ আটকে গেল তার। কিংবদন্তী এক নায়িকার প্রতি সাধারণ এক ভাল লাগা থেকেই দেয়ালে ছবিটা লাগিয়েছিল অবিবাহিত মাহমুদ। তবে আজ তার কাছে মনে হচ্ছে ছবিটার প্রতি, কোন একজনের প্রতি এক ধরনের ভালবাসা অনুভব করছে সে।
দুইদিন কেটে গেল। মাহমুদ এর ফার্ম হাউসে এক ক্রেতা মুরগি নেবার জন্য আসলো। মাহমুদ টাকা নেবার সময় লোকটাকে বসতে বলল। মাহমুদ তাকে বলল---
-'ভাই ভাল আছেন?'
-'জী ভাল আছি।'
-'আপনার বাড়ি তো আসাকুনি তাইনা?'
-'হ্যাঁ'
-'আপনার গ্রামের এক মেয়ের খোঁজ নেবার দরকার।'
-'কোন মেয়ে?, নাম কি?, ঘটনা কি?'
-'ঘটনা সামান্য...আমার এক বন্ধু বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছে। মেয়ের নাম কল্পনা।'
-'বাবার নাম কি?'
-'বাবার নাম তো মনে নাই...তবে মেয়ে মাস্টারি করে। শুনলাম কয়দিন আগে ওর ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে।'
-'বুঝছি...কল্পনা ম্যাডাম। ওর আবার বিয়ের কথাবার্তা চলছে?'
-'হ্যাঁ...তো , কেন কোন সমস্যা?'
-'সমস্যা মানে কল্পনা আপার কিন্তু আগে একবার বিয়ে হয়েছিল...'
-'সেটা বলেছে ঘটক।'
-'আপনার বন্ধুর বয়স কেমন? আপার তো বয়স ৩০-৩৫ হবে।'
-'ঐ... ঐ রকমই বয়স হবে।'
-'দেখেন আপনারা খোঁজখবর নেন। মেয়েটার যদি বিয়ে হয়...অনেকদিন ধরে বাপের বাড়িতে আছে। এখন স্কুলে মাস্টারি করে আর বাড়িতে ছেলেমেয়েদের পড়ায়।'
-'কোন স্কুলে পড়ায়? আসাকুনির মোড়ে যেই স্কুল আছে সেখানে?'
-'হ্যাঁ...'
পরদিন বিকালবেলা। মাহমুদ আসাকুনি গ্রামে একেবারে সোজা নীরাদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হল। বাড়ির সদর দরজা খোলা ছিল। সে বাড়ির উঠানে ঢুকে একটা মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, 'কল্পনা আপা বাড়ি আছেন?'
মহিলাটা বলল, 'আপনি কে? কোথা থেকে আসছেন?'
মাহমুদ বলল, 'আমি আলোকপুর থেকে আসছি, ম্যাডামের সাথে কথা ছিল।'
মহিলাটা ভিতরে ঢুকে গেল। একটু পরে কল্পনা বাহিরে আসল। মাহমুদ তাকে দেখেই প্রথম দিনের মত অবাক হলেও আজকে অন্যরকম একটা ব্যথা অনুভব করতে লাগল। এ ব্যথা অজানা আশঙ্কার ব্যথা। কল্পনা মাহমুদকে দেখে বলল---
-'আরে আপনি?! আমাদের বাড়িতে? আসেন ভাই ভিতরে চলেন।'
মাহমুদ কিছুটা আশ্বস্ত হল যে কল্পনা তাকে চিনতে পেরেছে। বসার ঘরে কল্পনা তাকে বসতে দিয়ে বাহিরে গেল। একটু পরে এসে বলল---
-'ছেলেমেয়েদের ছুটি দিয়ে আসলাম। আপনি বীথিদের সাথে নীরার বিয়েতে এসেছিলেন না?'
-'হ্যাঁ। আমি মনে হয় আপনার পড়া নষ্ট করলাম।'
-'আরে না, ওদের ছুটির সময় হয়ে গিয়েছিল। এবার বলেন আমাদের বাড়িতে আপনার মত ধনী লোকের আগমন কেন?'
-'আমি এসেছি আপনার কাছে?'
-'বীথির বাড়ি তো দূরে। সেই অতদুর থেকে আপনি আমার কাছে এসেছেন?! ঘটনা কি ভাই?'
-'আপনি মনে হয় জানেননা আমি বিথীভাবির স্বামী তারেকের বন্ধু হলেও আমার কাজ কিন্তু আসাকুনিতে।'
এ সময় চা আর বিস্কুট চলে এল। কল্পনা বলল--
-'নেন ভাইয়া চা খান। আসাকুনিতে কি কাজ করেন আপনি?'
-'আসাকুনির নবনীল ফার্ম হাউস আমি চালাই।'
-'আমি আপনার ফার্মের নাম শুনেছি। ওখান থেকে মাঝে মাঝে আমরা মুরগি নেই। কিন্তু আপনাকে দেখিনি, আমি অবশ্য নিজে মুরগি আনতে যাইনা।'
-'আসবেন একদিন সময় করে।'
-'ভাই আপনি কি কোন দরকারে...'
-'আসলে আমি এসেছিলাম আমার ভাতিজা কিছুদিন এখানে থাকবে, তার পড়ানোর কাজটা আপনি নিবেন কি না? তাই বলতে। আমি শুনলাম আপনি বাচ্চাদের যত্ন করে পড়ান।'
-'ভাই খুব খুশী হলাম আপনি আমাকে কাজটা দিতে চেয়েছেন বলে, তবে ভাই আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আমি কারো বাড়িতে গিয়ে পড়াইনা।'
-'আমি অবশ্য আপনার পুরো মাসের বেতনটাই দিব, সাথে যাতায়াত ভাড়া।'
-'আমি অত্যন্ত দুঃখিত ভাই...'
-'ঠিক আছে...আমি তাহলে আসি।'
সেদিন রাতের বেলা। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাহমুদ নার্গিসের ছবির দিকে চেয়ে আছে। কল্পনার কথা ভাবছে সে। এক সময় তার চোখ ভারি হয়ে আসল। মাহমুদ হারিয়ে গেল স্বপ্নের রাজ্যে! এক বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সে। নানা রঙের ফুল ফুটেছে সেই বাগানে। ফুলগুলো থেকে মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বাগানে। এমন সময় সে দেখতে পেল বাগানের এক প্রান্তে নার্গিস!। এক ফুলের মালা হাতে নিয়ে তার দিকে হাসিমুখে চেয়ে আছে। একটু পরে নার্গিস তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। মাহমুদ দৌড়ে নার্গিসের কাছে যেতেই নার্গিসও সেখান থেকে দৌড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল। মাহমুদ আবার দৌড়ে তার কাছে গেল। এভাবে নার্গিস একবার দৌড় দেয়, পরক্ষণে মাহমুদও তার পিছু নেয়। একসময় দৌড় দিতে দিতে মাহমুদ হাঁপিয়ে গেল। সে একখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। শুনতে পেল নার্গিস দূর থেকে গান গাইছে---'ঘরে এসেছে আমার পরদেশী...'
দুই দিন পর। মাহমুদ ফোন করল তারেকের স্ত্রী বীথিকে। বলল--
-'ভাবী কেমন আছেন?'
-'আছি তো ভালই...আপনার কি খবর? তারেকের নাম্বার হারিয়ে ফেলেছেন?'
-'না ভাবী, আমার দরকার আপনাকেই...'
-'ঘটনা কি?'
-'ভাবী মনে হচ্ছে আমার বিয়ে করার সময় হয়ে গেছে...'
-'হাহাহা...মেয়েটা কে?'
-'নীরার বোন কল্পনা...'
-'ভাই, আমার সাথে মজা করার জন্য ফোন করলেন? ভালই...'
-'ভাবী মজা না, সিরিয়াস। এখন আপনিই ভরসা...'
-'ভাই আপনার কথা আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না...'
-'ভাবী আপনি আমার অন্তরের খবর জানেন না।'
-'তো আমাকে কি করতে হবে?'
-'আপনি কল্পনাদের বাড়িতে প্রস্তাবটা দিবেন। ওরা যা জানতে চায় বলবেন। আমার সব খবর তারেক জানে, ওকে জিজ্ঞাসা করলেই পেয়ে যাবেন।'
-'কিন্তু ভাই আপনি সব জেনেশুনে...'
-'আমার কোন আপত্তি নাই...'
-'তা তো বুঝলাম... কিন্তু ভাই আপনি চাইলে আমরা অন্য মেয়েও দেখতে পারি।'
-'ভাবী আমার নার্গিসকেই চাই...'
-'কাজ সেরেছে... ঠিক আছে...দেখছি...'
চারদিন কেটে গেল। বীথি খবর পাঠাল নীরাদের বাড়িতে সবাই বিয়ের পক্ষে মত দিলেও কল্পনা আবার বিয়ে করতে রাজি নয়। মাহমুদ কল্পনার ফোন নাম্বার চাইল। বীথি জানাল, 'কল্পনা তার ফোন নাম্বার কাউকে দিতে রাজি নয়। নীরাও বোনের ফোন নাম্বার তার অনুমতি ছাড়া দিতে চাচ্ছে না।'
মাহমুদ হতাশগ্রস্ত হয়ে পড়ল। মনে হল সৃষ্টিকর্তা নার্গিসকে কল্পনার মাধ্যমে তার জন্য পাঠিয়েছে। কিন্তু সেটা সে পাচ্ছে না। মাহমুদ নানা উপায় ভাবতে লাগল। ভাবতে ভাবতে এক সপ্তাহ কেটে গেল। আরও এক সপ্তাহ পরে কল্পনা এক চিঠি পেল---
"প্রিয় কল্পনা,
আমার ভালবাসা নিও। তোমাকে যে মুখোমুখি প্রস্তাবটা দেব সেই সাহস আমি পাইনি। এমন অনেক মানুষ আছে যারা মনের কথা কাউকে বলতে পারেনা, আমি তাদের একজন। তুমি হয়ত আমাকে পছন্দ কর না। সেই জন্যই বীথি ভাবীর প্রস্তাবটা নাকচ করেছ। কিন্তু তুমি বিশ্বাস কর আর নাই কর, এত কিছু জানার পরও আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি। তুমি নায়িকা নার্গিসকে চেন কিনা আমি জানি না। উনি আমার একজন স্বপ্নের নায়িকা। আমার ঘরে তার ফটো টাঙানো আছে। তুমি দেখতে অনেকটা তার মত। আমি তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম অবাক হয়ে গিয়েছিলাম!, দুটো মানুষের মাঝে চেহারার এতটা মিল হয় কিভাবে?!
কল্পনা, আমি বিশ্বাস করি আমার জন্যই তোমাকে সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছেন। নইলে এতদিন ধরে আমি নায়িকা নার্গিসের সৌন্দর্যের পূজারী হব কেন?, আর এতদিন অবিবাহিত থাকব কেন? আর তোমার সাথেই বা তার এত মিল থাকবে কেন? তুমি আমাকে পাগল ভাবলে ভাবতে পারো। আমার ফোন নাম্বার দিলাম। তুমি প্লিজ আমার সাথে কথা বল...
তোমার ভালবাসাবঞ্চিত,
মাহমুদ।"
১৫ দিন পরে মাহমুদ এর কাছে এসে পৌঁছল কল্পনার চিঠি----
"মাহমুদ ভাই,
সালাম নিবেন। আপনার চিঠিটা পড়ে বুঝতে পারলাম আপনি প্রথম দিন অযথা আমার সাথে টিউশনি করানোর অভিনয় করে গিয়েছেন। যাহোক একজন আত্মস্বীকৃত পাগলের এই ভুলটা ক্ষমা করা যায়। তবে আমাকে চিঠি দিয়ে কাজটা ঠিক করেন নি। আমি তো বীথিকে বলেই দিয়েছিলাম আমার সিদ্ধান্ত। তারপরও একজন বিধবা মাস্টারের এমন চিঠিপ্রাপ্তি কিছুটা বিব্রতকর। আপনাকে বলছি ভাই, একজন নায়িকার মুখশ্রীর সাথে আমার চেহারার সাদৃশ্য না খুঁজে এইবার বিয়ে করে ফেলেন। আমি আর নতুন করে সংসারে জড়াতে চাইনা। আপনার জীবনটা আমার মত অগোছালো না। আপনার সুন্দর জীবন নিয়ে আমার সঙ্গে জড়িয়ে পড়বেন না আশা করি। আমি আমার জীবনটাকে একবার গুছিয়ে নিয়েছিলাম। আমার সেই জীবনটা ঝড়ে ভেঙে গেছে ভাই। আপনার সাথে আরেক জীবন গড়ে তুলতে আমার সাহস হচ্ছে না। আপনাকে কষ্ট দেবার জন্য দুঃখিত...
ইতি,
কল্পনা"
চিঠিটা শেষ করে মাহমুদের নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। কোথায় যেন একটা শূন্যতা থেকেই গেল। এতদিন ধরে খুঁজে বেড়ান জিনিসটা যখন হাতের কাছে এসেও ফসকে যায়, তখন মন আর কোন বাঁধ মানে না। মাহমুদের গলা ভারি হয়ে এল। কি করবে এখন কিছুই ভাবতে পারল না সে।
একমাস কেটে গেছে। আজকে সকালবেলা মাহমুদ ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেল বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। আজকে তার কাজে ব্যস্ত হতে মন চাইল না। সে বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে পড়ল। ভাবতে লাগল কল্পনার কথা। উঠে একবার ঘরে গিয়ে নার্গিসের ছবি দেখে এসে আবার চেয়ারে বসে পড়ল। কল্পনার সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি সে। একতরফা ভালবাসা সে জোর করে পেতে চায় না। এতদিন ধরে নায়িকা নার্গিসের সাদাকালো ফটো সে টাঙিয়ে রেখেছে এক ধরনের ভালবাসা অনুভব করেই। সৃষ্টিকর্তা হয়ত নার্গিসের প্রতি তার ভালবাসা দেখেই কল্পনাকে নার্গিসের রূপে পাঠিয়েছেন। মাহমুদ কল্পনাকে কাছে পায়নি, কিন্তু তার ভালবাসা তো দুর্বল নয়। কল্পনা একদিন মাহমুদের ভালবাসা অনুভব করে তার কাছে ফিরে আসবে, এই প্রত্যাশায় মাহমুদ প্রতি রাতে ঘুম না আসা পর্যন্ত নার্গিসের ফটোর দিকে তাকিয়ে থাকে।