রাতের বেলা বালিশে মাথা রেখে মাথার নিচটা হঠাৎ কেমন যেন শক্ত শক্ত মনে হয় আশফাকের। বালিশের নিচে যত্ন করে রাখা কালো যন্ত্রটার কথা মনে পড়ে সাথে সাথে। ডান হাতে আলতো করে বালিশটা উঁচু করে যন্ত্রটা চোখের সামনে ধরে ও। ঘন অন্ধকারেও কুচকুচে কালো বস্তুটা চকচক করে তার চোখের সামনে। কিছু একটা আছে এটার মধ্যে, হাতে নিলেই কিসের যেন একটা সাড়া পড়ে যায় রক্তে। দীর্ঘদিন ঘুমিয়ে থাকা রক্তকণিকাগুলো হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে চঞ্চল হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে মুহূর্তের মধ্যে।
সুইচ টিপতেই ঘরের একমাত্র মলিন বাল্বটা জ্বলে ওঠে, ফ্যাকাসে একটা হলুদ আলোতে ভরে যায় ঘরটা। হাতে ধরে রাখা কালো যন্ত্রটাকে ভালো করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা আশফাক। নবাবগঞ্জের কামাল জোহার কাছ থেকে সাতদিনের জন্য ভাড়া করেছে এটা। কামাল জোহা একদিনের জন্য পঞ্চাশ টাকা করে নেয়, কিন্তু এনএসএফ এর মুফতি ভাইয়ের সাথে পরিচয় থাকার জন্য বেশ সস্তাতেই পেয়েছে সে। সাতদিনের জন্য তাকে দিতে হয়েছে সত্তর টাকা। সেফটি ভাল্বটা খুলে ভিতরের সীসার টুকরোগুলো সব ঠিকমত আছে কিনা একবার দেখে নেয় সে। মাত্র তিনটা সীসার টুকরো আছে এর মধ্যে। গুণে গুণে হিসাব করে রাখা সব। তিনজন মানুষের জন্য তিন টুকরো সীসা। আশফাক জানে এতেই হবে। অতীতে অনেকবার নিজের দক্ষ নিশানার পরিচয় দিয়েছে ও। সেসময় অবশ্য দুটো হাতই অবশিষ্ট ছিল। বাম হাতটা কাটা পড়ার পর এবারই প্রথম। কিন্তু তাতে কী? তার মত পোড় খাওয়া শিকারির জন্য একটা হাতই যথেষ্ট।
পলেস্তারা খসে পড়া বিবর্ণ দেয়ালটায় কোথা থেকে যেন একটা টিকটিকি এসে দাঁড়িয়েছে। বাল্বের ফ্যাকাসে আলোতে বড় অদ্ভুত দেখাছে টিকটিকিটাকে। গুটি গুটি পায়ে কোথা থেকে যেন আরো একটা টিকটিকি বের হয়ে এসেছে, তারপর আরো একটা। তিনটে ফ্যাকাসে টিকটিকি মিলে একটা অদ্ভুত নকশা তৈরি করেছে বিবর্ণ দেয়ালে। আশফাকের হঠাৎ মনে হয়, কে জানে হয়তো টিকটিকিদেরও সংসার থাকে, স্বামী স্ত্রী আর ফুটফুটে একটা শিশু নিয়ে একটা ছোট্ট সংসার। গভীর রাতে সমস্ত পৃথিবী যখন ঘুমে মগ্ন তখন তারা তাদের ছোট্ট কুটির থেকে বের হয়েছে একসাথে একটু খোলা বাতাসের জন্য। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে খোলা আকাশের নিচে একটু সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনার গল্প করার জন্য।
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে আশফাকের ভিতর থেকে। ওর মনে কি সূক্ষ্ম কোনো অপরাধবোধ আছে? একটা সুখের সংসার ভেঙে দিচ্ছে এজন্য অপরাধবোধ। না নেই। অপরাধবোধ কেন থাকবে? ও তো শুধু একজন বিশ্বাসঘাতককে তার প্রাপ্য শাস্তি দিতে যাচ্ছে। একজন বিশ্বাসঘাতককে তার প্রাপ্য শাস্তি।
ওদের পঁচিশজনের দলটার কমাণ্ডার ছিলেন আকবর ভাই। প্রত্যেকটা যুদ্ধের পর নিজের হাতে সব রাজাকারকে গুলি করে নদীতে ফেলে দিতেন তিনি। রাজাকারগুলো পায়ে ধরে কেঁদে কেটে জীবন ভিক্ষা চাইত। আকবর ভাইকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করত না কিছু। নদীর পার দাঁড় করিয়ে সবাইকে গুলি করতেন তিনি নিজের হাতে। তারপর লাথি মেরে লাশগুলো পানিতে ফেলে দিয়ে নির্বিকারভাবে বলতেন,
"স্বাধীন দেশে বিশ্বাসঘাতকের কোনো জায়গা হবে না।"
আকবর ভাই মারা গেছেন মধুপুরের যুদ্ধে। তারপর দেশ স্বাধীন হয়েছে একদিন। কিন্তু সত্যি হয় নি তার কথা। হয়তো মিলিটারিদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে দেশ, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে হয় নি। বরং আরো বেশি জন্ম হয়েছে তাদের।
রেললাইনের পাশে বস্তিতে থাকে জমিলা। যুদ্ধের সময় মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল ওকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ক্যান্টনমেন্ট থেকে উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু দশটা পাঁচটা অফিস করা নিপাট ভদ্রলোক তার স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় নি। বরং ধুমধাম করে বিয়ে করেছে আরো একটা। জমিলার আশ্রয় হয়েছে রেললাইনের বস্তিতে। আশফাককে জমিলা ডাকত ভাইজান বলে। এক রাতে কাঁদতে কাঁদতে জীবনের সব দুঃখের গল্প বলেছিল তাকে। নিঃশব্দে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সব শুনেছিল আশফাক। ঢাকা মেডিকেলে থার্ড ইয়ার পর্যন্ত পড়ে যুদ্ধে চলে আসা কামরুল যখন নীলগঞ্জ নামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে শুধুমাত্র একটা ছুঁড়ি আর একটা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে তার গুলি লাগা বাম হাতটা কেটে বাদ দিয়েছিল, তখন প্রচণ্ড ব্যাথা সত্ত্বেও চিৎকার করে নি সে, দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করেছে। কিন্তু সেদিন রাতে আর পারে নি। কাটা বামহাতটার দিকে তাকিয়ে অব্যক্ত একটা যন্ত্রণায় হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে ওর। পরেরদিন রাতে বড় একটা দা নিয়ে আবার এসেছিল ও জমিলার কাছে। বলেছিল,
"তোকে যে মিলিটারিদের হাতে ধরায় দিছিল, ইউসুফ রাজাকার, তাকে সামনে পাইলে কী করবি?"
"দাও দিয়া মাথাটা এককোপে ফালায় দিমু।" অন্ধকারে জমিলার চোখদুটো জ্বলে উঠেছিল বারুদের মত।
"কেন?"
"কারণ........." আর কোনো কথা বলতে পারে নি জমিলা। শব্দগুলো একটা শক্ত মাংসপিণ্ডের মত আটকে গিয়েছিল তার গলার কাছে। তার অসমাপ্ত কথাটা শেষ করেছিল আশফাক, "কারণ সে তোর সাথে বেঈমানি করছে। কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখ জমিলা। ইউসুফ রাজাকারের বেঈমানির কথা সবাই জানে। সকালে বিকালে মানুষ থুথু ছিটায় তার মুখে। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিশ্বাসঘাতকতা করছে তোর সাথে তোর স্বামী। তোর চরম বিপদের সময় তোর পাশে না দাঁড়িয়ে তোকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলছে, তারপর আর একটা বিয়ে করে সুখে সংসার করতেছে। অথচ তাকে মানুষ বলে ভদ্রলোক, আর তোকে মানুষ বলে বেশ্যা। বাজারের বেশ্যা।"
নিজেকে আর সামলাতে পারে নি জমিলা। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে উঠেছিল নিঃশব্দে। আশফাক অপেক্ষা করেছিল কিছুক্ষণ। নিকোটিনের ধোঁয়ায় লম্বা টান দিয়ে উত্তেজিত মস্তিষ্কটাকে শান্ত করেছিল কিছুটা। তারপর সাথে নিয়ে আসা দা টা জমিলার হাতে দিয়ে বলেছিল, "রাখ এটা। নিজের কাছে রাখবি। সুযোগ বুঝে একদিন তোর ভদ্রলোক স্বামীর ঘাড়ে একটা কোপ দিয়ে আসবি। পারবি না?"
আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে জমিলা হেসেছিল। জীবনের সমস্ত প্রবঞ্চনাকে বুড়ো আঙুল দেখানোর হাসি। তারপর একমাস পর একদিন সকালে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় খবরটা চোখে পড়েছিল আশফাকের।
"দিনের বেলা প্রকাশ্যে রাস্তায় এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করে পুলিশের কাছে ধরা দিলেন নারী।"
খবরটা পড়ে মনে মনে বলেছিল আশফাক, "সাবাশ জমিলা।"
অনেকদিন পর তার কাটা হাতটার ব্যথা কমেছিল সেদিন। মনে মনে সেদিন রাতেই তালিকাটা তৈরি করে ফেলেছিল সে। জমিলার কাজ জমিলা করেছে। এখন তারটা সে করবে। বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি দেবে নিজের হাতে।
সাতাশ বছরের জীবনে মানসীর শরীরের স্পর্শ একবারই পেয়েছিল আশফাক। এপ্রিলের এক তারিখ ছিল সেদিন। মহসীন হলের তিনশ এক নাম্বার রুমে কোনোমতে পাঁচদিন মাথা গুঁজে কাটানোর পর ধ্বংসস্তূপে নেমে আশফাক প্রথমেই এসেছিল মালিবাগ এক নাম্বার লেনে মানসীর কাছে। ড্রয়িংরুমে মাথা নিচু করে চুপচাপ আশফাকের সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত শুনেছিল মানসী। তারপর হঠাৎই একসময় দুহাতে আশফাককে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠেছিল হু হু করে। জীবনে প্রথমবার মানসীর খোলা চুল এসে পড়েছিল আশফাকের মুখে। বধ্যভূমির বাতাসের মধ্যেও তা একটা শীতল স্পর্শ বুলিয়ে দিয়েছিল আশফাকের প্রতিটি ইন্দ্রিয়ে। লক্ষরাত্রি ধরে স্বপ্নে দেখা দৃশ্যটার এমন হঠাৎ বাস্তবায়নে কেঁপে উঠেছিল আশফাক। পরক্ষণেই মানসীর অস্পৃষ্ট যৌবনের রহস্যময় হাতছানি ম্লান হয়ে গিয়েছিল তার কাছে সীমান্তের ডাকে। খোলা ড্রয়িংরুমে দীর্ঘসময় আশফাককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল মানসী। বিদায়ের মুহুর্তে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেই মানসী বলেছিল তার শেষ কথাগুলো, "আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব আশফাক।"
তিনটে টিকটিকির মধ্যে দুটো টিকটিকি অদৃশ্য হয়ে গেছে কখন যেন। বিবর্ণ দেয়ালে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে একটা টিকটিকি। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধূসর বর্তমানে ফিরে আসে আশফাক। চকচকে পিস্তলটাকে বালিশের নিচে রেখে অগোছালো টেবিলের উপর থেকে খুঁজে খুঁজে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত এক হাতে সিগারেট ধরাতে। কিন্তু দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় কায়দাটা খুব চমৎকারভাবে রপ্ত হয়ে গেছে তার। জ্বলন্ত তামাকের পিণ্ডে লম্বা টান দিয়ে বিষাক্ত নিকোটিনের স্পর্শে নির্জীব ফুসফুসটাতে একটু প্রাণের সঞ্চার করে আশফাক। তারপর জমাটবাঁধা বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার সাথে আকাশে পাঠিয়ে দেয় ভিতরের সব গ্লানি।
তালিকার প্রথম নামটার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ চার বছর। চার বছর পর আমেরিকা থেকে আসছে মানসী। সুপুরুষ স্বামী আর ফুটফুটে একটা তিনবছরের ছেলেকে সাথে নিয়ে। এই সুযোগটা হাতছাড়া করা যাবে না। এয়ারপোর্টেই শেষ করে ফেলতে হবে কাজটা। দেরি হয়ে যাচ্ছে খুব বেশি। আরো বেশ কয়েকটি নাম পড়ে আছে তালিকায়।
নভেম্বরের সেই ভয়ংকর রাতের পর এবার এক হাত দিয়েই উত্তপ্ত সীসার টুকরো ছুঁড়বে আশফাক। চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেবে কয়েকটি হৃৎপিণ্ড।
একসাথে তিনটি হৃৎপিণ্ড।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এটি স্বাধীনতা পরবর্তী মানুষের হতাশার গল্প, পাওয়া এবং না পাওয়ার হিসেব মেলানোর গল্প।
১৯ এপ্রিল - ২০১৯
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।