তুমি কি জন্যি জেল খাটিছো, বাবা? চুরি না খুন খারাপি? হাবু চাচা সরল ভাবে আশিক কে প্রশ্ন করে। চায়ের দোকানের সামনে রাখা নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আশিক। বয়স তেত্রিশ। শীর্ন দেহ, মুখ ভরা দাড়িঁ, মাথার চুল উস্ক খুস্ক। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে রং চায়ে চুমুক দেয়া ছাড়া পৃথিবীতে তার আর কোনো বিষয়ে উৎসাহ নেই। আশিকের পাশে বসে আছে কেলো। পান খাওয়া তরমুজের বীজের মতো লাল দাতঁ বের করে সে হাসে। তারপর বলে, আমার মনে হয় ভাইজান রাজ কেসের আসামী। এই জন্য কথা ভাঙ্গে না। হাবু চাচার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয় না। সে প্রশ্ন করে, রাজ কেস মানে কি? কেলোর মুখে হাসিটা তখনো লেগে আছে। চোখ দুটোয় ধুর্ততার ঝিলিক। সে বলে, রাজ কেস মানে নারী ধর্ষন। সিনেমায় দেখেন না, ধর্যনের দৃশ্য থাকবোই। কলেজে থাকতে এক লেখকের বইতে পড়ছিলাম, আমাদের সর্বোচ্চ আনন্দ ধর্ষনক্রিয়ায়। চুপ ব্যটা। নেশাখোর, মাগীর দালাল। হাবু চাচা ধমকে ওঠে, মাস্টারের নামে বাজে কথা বলিস না।
মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডের শেষ প্রান্তে তিনটা রাস্তা তিন দিকে গিয়েছে। হাতের বাম দিকে শিয়া মসজিদ ছাড়িয়ে কিছু দূরে ৱ্যাবের কার্যালয় অবস্থিত। অফিসের সামনে কাচাঁ বাজারে মুনতাজ মিঞার চায়ের দোকান। সেখানে এক বেঞ্চে বসে হাবু চাচা, কেলো আর আশিক চা খাচ্ছে। আশিক নিরাসক্তভাবে বসে থাকলেও হাবু চাচার কন্ঠের স্নেহটুকু টের পায়। সে এই এলাকায় বসবাস করছে প্রায় এক বছর ধরে। বাজার ও তার আশেপাশে ছিন্নমূল কিছু মানুষ এখানে বসবাস করে। আশিক প্রথমে ভেবেছিল, গ্রাম থেকে উম্মুলিত হয়ে আসা এই মানুষগুলো কলকারখানার মজুর অথবা পরিবহন শ্রমিক। কিন্তু এদের সাথে বেশ কিছুদিন থাকার পর সে বুঝতে পারে এইসব মানুষের অধিকাংশরই নির্দিষট কোনো পেশা নেই। এদের কেউ চোর, পতিতালয়ের নারীর যোগানদার অথবা মাদকবিক্রেতা। একাডেমিক ভাষায় লুম্পেন প্রলেতারিয়েত। কেলোর কথায় আশিকের রাগ বা বিরক্তি কোনোটা হয়নি। তবে সে একটু অবাক হয়েছে। আশিক যে জেল খেটেছে, সেকথা এরা কিভাবে জানে?
এখন মধ্যাহ্ন। আকাশে সূর্যের উত্তাপ গণগণে। আশিকের একবার মনে হয়, এই সময় ঠান্ডা কিছু খেতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু চিন্তাটা সে মূহুর্তের মধ্যে মন থেকে দূর করে দেয়। সে যে জীবন বেছে নিয়েছে সেখানে সব রকমের শখ বা বিলাসিতা পরিত্যাজ্য। রাতে আশিক কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছে ফুটপথে ঘুমিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মশার কামড়ে ঘুম না হলে আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। অতীত বা বর্তমান কোনো বিষয় নিয়ে সে চিন্তা করে না। অথবা চিন্তা করতে চায় না।
আশিকের মগ্নতা ভাঙ্গে হাবু চাচার কর্কশ কন্ঠের শব্দে। সে তখন ধমক দিয়ে বলছে, এ্যাই ছুকড়ি, তোকে বাজারের মধ্যি আসতি নিষেধ করিছি , না? আশিক দেখে ওদের সামনে এগারো বারো বছর বয়সের একটা মেয়ে দাড়িঁয়ে আছে। মেয়েটার নাম মনি। আশিকের পথশিশু স্কুলের একজন ছাত্রী। হাবু চাচার মেজ মেয়ে। বাবার ধমক খেয়ে মনি কিছুটা ভয় পায়। তবু মিন মিন করে বলে, মা পাঠাইছে। রান্নার চাল নাই। হাবু চাচা এইবার খেকিয়ে ওঠে, চাল কি আমি পয়দা করুম? কেলো এতক্ষণ মনির দিকে তাকিয়ে ছিল। এইবার সে মিঠে সুরে বলে, আহা, চাচা, করেন কি? সাপের মনির মতোন ফুটফুটে মাইয়্যা। ভয়ে মুখটা শুকায় গেছে। কেলো আরো কিছু বলতো। কিন্তু তার চোখ পড়ে আশিকের উপর। কঠোর দৃষ্টিতে কেলোর দিকে তাকিয়ে আছে। কেলো তখনকার মতো চুপ হয়ে যায়। পাগল মানুষকে ঘাটানো ঠিক না।
পথশিশুদের স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয় বিকালে। ভোর থেকে এইসব ছিন্নমূল শিশুরা কাগজ কুড়ানো, মালবাহী কুলি, হোটেলের বয় বেয়ারা থেকে শুরু করে ওয়েল্ডিং ওয়ার্কশপ বা গ্যারেজে কাজ করে। পড়ন্ত বিকালে তারা স্কুলে আসে। স্কুলটার কোনো নিবন্ধন নেই। আশিক স্কুলের অবৈতনিক শিক্ষক। সে খোজঁ নিয়ে জেনেছে জনৈক চোরাকারবারীর টাকায় স্কুলটা চলে। এই স্কুলে পড়ে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতে কি হবে তা কেউ জানে না। আশিক তাদের অক্ষরজ্ঞান শেখায় আর অঙ্ক করায়। মাঝে মাঝে গল্প বলে। আজ সূর্যের বেশি। কেন যেন আশিক ক্লাসে মনোনিবেশ করতে পারছে না। বোর্ডে কিছুক্ষণ যোগ বিয়োগ করে আশিক বলে, আজ পড়াতে ভাল লাগছে না। এসো আমরা গল্প করি। গল্পের কথা শুনে ছেলেমেয়েরা খুব খুশি। সামনের সারিতে বসা একটা আট নয় বছরের ছেলে খুশির সুরে বলে, স্যার , ভুতের গল্প বলেন। তার দিকে তাচ্ছিল্যে মুখ বাকিঁয়ে বার তের বছরের আরেকটা ছেলে বলে, স্যার, প্রিয়তমা সিনেমার গল্প কন। হলে খুব চলতাছে। আশিক তাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর সুরেলা কন্ঠে ছড়া কেটে বলে,
এক যে ছিল ব্যাঙ্গ
লিকলিকে তার ঠ্যাঙ্গ।
মস্ত বড় হাতিটা কে
মারল কষে ল্যাঙ্গ।
শিশুদের সাথে গল্প করতে করতে আশিক অন্য ভুবনে হারিয়ে যায়। আজ চৈত্র মাসের ষোল তারিখ। নিসারের ১১তম জন্মদিন। নিসারের জন্মদিন পালন করা হত ঘরোয়াভাবে। আশিক আর রঞ্জনা দম্পতির একমাত্র সন্তান নিসার। রঞ্জনা চাইতো এই দিনটার সবটুকু সময় তাদের সন্তানের জন্য বরাদ্দ থাক। ভোরে উঠে সে রান্নাঘরে কাজে লেগে যেত। নিসারের প্রিয় খাবারগুলো রান্না করতো। বিকালে আশিক ছেলের জন্মদিনের কেক আর উপহার নিয়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতো। ধানমন্ডির তিন রুমের সেই ফ্ল্যাটে তখন আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। এইসব স্বৃতি এখন আশিকের কাছে বিলুপ্ত। শুধু সে চেষ্টা করেও নিসার কে ভুলতে পারে না। আশিক যেদিন গ্রেফতার হয় সেদিন ফ্ল্যাটে তার বাবা মা আর রঞ্জনা নিথরভাবে দাড়িয়েঁ ছিল। প্রত্যেকের মুখ ছিল ভাবলেশহীন। শুধু নিসারের চোখে জল ছিল। ফুপিঁয়ে ফুপিঁয়ে কাদঁছিল। ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছিল কৌশিক। আশিকের ছোট ভাই। সাত বছরের ছোট্ট নিসার বিশ্বাস করতে পারে নি যে তার বাবা কোনো অপরাধ করতে পারে। কিন্তু আর সবাই তো বিশ্বাস করেছিল। এমন কি রঞ্জনা। গত তিন বছরের মধ্যে রঞ্জনা তার সাথে কোনো যোগাযোগ করে নাই। জেলে থাকতে আশিক খবর পায় রঞ্জনা তাকে ডিভোর্স দিয়েছে।
মাস্টার একা বসি আছো। সূয্যি যে ডুবে গেছে। হাবু চাচার কথায় আশিকের ঘোর ভাঙ্গে। স্কুল ছুটির পর কখন যে সে মাঠের পাশে বটগাছ তলায় এসে বসেছে তা আশিক নিজেও জানে না। বটগাছ তলার গোড়াটা ইট , সিমেন্ট দিয়ে পাকা করা। রাতে এখানে গাজাঁখোরদের আসর বসে। আশিক হাবু চাচা কে প্রশ্ন করে, আজ বাজারে কেমন আয় হলো, চাচা? হাবু চাচা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, সারাদিন মাছ কুটে দেড়শো টাকা। পরিবারে খাওয়ার লোক ছয় জন। এখন বাজার করে বাড়ি যাব। তারপর চুলায় হাড়ি চড়বে। হাবু চাচা মাছের দোকানে মাছ কাটে। সে মুরগী জবাই এবং ছিলা কাটায় সমান দক্ষ। তবে এই কাজটা সে দয়াপরবশ হয়ে আশিক কে করতে দিয়েছে। মানুষটা একা হলেও তার পেট তো চালাতে হবে। আশিক আবার প্রশ্ন করে, আপনার নাইটগার্ডের চাকরিটা আবার ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করেন। হাবু চাচা বিষন্নভাবে মাথা নাড়ে, ঐ চাকরি আমি আর পাবো না। দুটো খায়ে পড়ে বাচে ছিলাম। শালাদের সহ্য হল না। কর্পোরেশন অফিসে নালিশ করল। আমি নাকি ইয়াবা সাপ্লাই দিতে সাহায্য করি। এদিকে আমার দুই মাসের ঘর ভাড়া বাকী। আশিক প্রশ্ন করে, আপনি এখন কোথায় থাকেন? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর হাবু চাচা দেয় না।
পূর্বে আশিক হাবু চাচার কাছে শুনেছে, নদী ভাঙ্গনের ফলে তাদের পরিবার সর্বশান্ত হয়ে গেছে। হাবু চাচার ভাষায়, তার ভিটে আর দুই শতাংশ ধানের জমির সব গেছে নদীর করালগ্রাসে। গ্রামে থাকতে তিনি বড় মেয়েটার বিয়ে দিয়েছেন। তারপর স্ত্রী ও চার সন্তানের হাত ধরে ঢাকা শহরে এসেছেন। হাবু চাচা মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বলেন, শহরের বাতাস বিষাক্ত। নইলে তার জোয়ান ছেলে কাজকর্ম না করে মাদকাসক্ত হবে কেন? চাচা না বললেও আশিক বুঝতে পারে, ছেলের কারসাজিতে তার নাইটগার্ডের চাকরিটা চলে গেছে।
আশিকের চোখে ভেসে ওঠে, পুরন ঢাকার ঘুপচি একটা দুই রুমের ভাড়া বাড়ির দৃশ্য। আশিকের বাবা ছিলেন পৌর সভার অফিস সহকারী। ঘুষের টাকা স্পর্শ করতেন না। তাই উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও তিনি সংসারে সচ্ছলতা আনতে পারেননি। সন্ধ্যায় বাবা বাড়ি ফিরে আশিক আর কৌশিককে পড়া দেখিয়ে দিতেন। বাবা বলতেন, জীবনে বড় হতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। মানুষের সবচেয়ে বড় পাথেয় সত্য কথা বলা আর সৎ পথে চলা। লোডশেডিংয়ের ফলে ঘরে হারিক্যান জ্বলতো। তার টিমটিমে আলোয় বাবার মুখটা স্নিগ্ধ দেখাতো। আশিক সমাজের প্রচলিত অর্থে বড় হয়েছিল বৈকি।
শিক্ষা জীবনে মেধাবী ছাত্র আশিক মাস্টার্স পাসের পর একটা প্রকল্পে চাকরি পায়। পরিশ্রম করার সামর্থ্যের জন্য অফিসে সবাই তাকে পছন্দ করতো। আশিকের সামনে তখন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি। রঞ্জনার সাথে তার বিয়ে পারিবারিকভাবে হয়েছিল। প্রকল্পের একজন সাইট ইঞ্জিনিয়রের সাথে রঞ্জনার বাবার পরিচয় ছিল। প্রস্তাবটা সে আনে। রঞ্জনা ছিল উচ্চশিক্ষিত। তবে বিয়ের পর আশিকের পরিবারের সঙ্গে সে মানিয়ে নেয়। আশিক তখন উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির সদস্য। সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। আমাদের দেশে অধিকাংশ বাবা মা এই ধরণের স্বপ্ন দেখে সন্তান প্রতিপালন করেন।
আশিকের কর্মস্থল ছিল প্রকল্পের হেড অফিসে। বছর দুয়েক পর তার ঢাকার বাইরে পোস্টিং হয়। তার উপর দায়িত্ত্ব ছিল , নদী ভাঙ্গনের ফলে সর্বশান্ত হয়ে যাওয়া মানুষদের নিয়ে গবেষনা প্রতিবেদন তৈরী করা। এই প্রতিবেদন পরিবেশ অধিদপ্তরে জমা দেয়া হবে। নয় মাস গবেষনাকর্ম পরিচালনা করার পর আশিক প্রতিবেদন তৈরী করে প্রকল্প পরিচালকের কাছে জমা দেয়। গবেষনা কর্ম হাতে পাওয়ার দিন দুয়েক পর পরিচালক তার রুমে আশিককে ডেকে পাঠায়। আশিক কক্ষে প্রবেশ করে পরিচালকের মুখোমুখি চেয়ারে বসে। বসের মুখে কোনো উদ্বেগের চিহ্ন নেই। তিনি শান্তভাবে আশিক কে বলেন, তুমি তো জান গবেষনাকর্ম নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে হয়। আশিক উত্তর দেয়, আমি নিরপেক্ষভাবে নীতি মেনে কাজ করেছি। পরিচালক আবার বলে, তোমার গবেষনাকর্মে উল্লেখ আছে নদী ভাঙ্গনের জন্য প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানুষও দায়ী। সরকারি মদতে প্রভাবশালী মহল নদী থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে। এই কারণে নদীর পাড়ে ভাঙ্গন দেখা দেয়। আশিক বলে, আমি আমার পর্যবেক্ষনে এই বিষয়টা দেখেছি। বস একটু চুপ করে থেকে বলে, এই রিপোর্টের উপর তোমার ইনক্রিমেন্ট এবং প্রমোশন নির্ভর করছে। আমরা তো রাজনৈতিক বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতে পারি। আশিক মৃদু কন্ঠে বলেছিল, আমি যা সত্য বলে জেনেছি তাই লিখেছি। আমার অবস্থান থেকে আমি সরে যাব না। কথাটা শুনে পরিচালক স্মিত হাসেন এবং আশিকের জন্য শুভ কামনা করেন। এই ঘটনার দুই সপ্তাহ পর তহবিল তছরুপের অভিযোগে আশিক গ্রেফতার হয়।
রঞ্জনা কে আশিক সব কথা খুলে বলেছিল। রঞ্জনা চুপ করে শোনে। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সে প্রশ্ন করেছিল, তোমার সব কথা কোর্টে প্রমাণ করতে পারবে। আশিক প্রমাণ করতে পারে নাই। জেলে যাবার আগে বাবার আক্ষেপপূর্ণ খেদোক্তি শুনেছিল, এখন আমি গ্রামে কিভাবে মুখ দেখাবো? এদের চেয়ে প্রাকটিক্যাল ছিল কৌশিক। সে বলেছিল, আজকাল এইসব কোনো বিষয় নয়। তুমি অফিসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমঝোতায় এসো। দামী উকিল যোগাড় করা যাবে। টাকা পয়সা খরচ করা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আশিক তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আমি কোনো অন্যায় করিনি। সুতরাং সমঝোতা করবো কেন? রঞ্জনার ধৈর্য্যের বাধঁ ভেঙ্গে যায়। সে ব্যঙ্গের সুরে বলেছিল, সততা, মহত্ত্ব মানবতা। চোরের তকমা এটে জেলে গেলে এইসব গুণাবলী তোমাকে রক্ষা করবে? আর কোনো কথা বলেনি আশিক। তার সম্মুখে সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রকৃত স্বরূপ উম্মোচিত হয়ে গিয়েছিল।
রাত ক্রমশ বাড়ছে। বটগাছ তলায় গাজাঁর আসর জমে উঠেছে। আশিক উঠে দাড়াঁয়। আজ রাতে ঘুমাবার একটা স্থান খোজঁ করতে হবে। এমন সময় কেলো এসে তার পথরোধ করে। নেশার ঘোরে সে তখন টলছে। কেলো বলে, কি মাস্টার, জলসা দেখতে শখ লাগছে? আইজ রাতে জলসা জমে যাবে। আশিক বিরক্ত হলেও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কেলোর দিকে তাকায়। কেলো তখন বলে চলেছে, হাবু চাচারে বললাম, মনিরে লাইনে নামায় দেন। চাচা আমার কথা শুনলো না। আইজ রাত্রে যে চারজন মাস্তান মনিরে ছিড়ে খাবে। কেলো কথা শেষ হওয়ার আগেই টের পায়, আশিক তার শার্টের কলার চেপে ধরেছে। নিজে কে ছাড়াতে গিয়ে বোঝে, শীর্ন দেহের এই মানুষটার গায়ে অসুরের মতো শক্তি।
কেলোর মুখে দুটো ঘুষি মারে আশিক। টাল সামলাতে না পেরে সে পড়ে যায়। সেই অবস্থায় আশিক তাকে দাড়ঁ করিয়ে বলে, হারামজাদা কি ঘটেছে, ঠিক করে বল। মার খেয়ে কেলো যা জানায় তার সারমর্ম এই, হাবু চাচা ঘর ভাড়া দিতে না পারায় বাড়িওয়ালা তাদের ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। হাবু চাচা রাতে পরিবারসহ ফুটপথে থাকে। গতকাল স্থানীয় চারজন মাস্তান বলে গেছে, তার বড় মেয়ে মনিকে সাজিয়ে রাখতে। এই কথার অন্যথা হলে হাবু চাচার লাশ ভাসবে ঝিলে। মনিও রক্ষা পাবে না।
রাত দুটো বাজে। ফুটপথে ছিন্নমূল মানুষগুলো সারাদিন পরিশ্রমের পর ঘুমিয়ে আছে। এমন সময় দুটো মোটর সাইকেল এসে রাস্তার পাশে থামে। চার জন অস্ত্র সজ্জিত মাস্তান হাবু চাচার সামনে এসে দাড়াঁয়। পাশে মনি মায়ের আচলঁ ধরে তার শরীরের সাথে মিশে আছে। থর থর করে কাপঁছে। কিন্তু মায়ের সাধ্য নেই সন্তান কে রক্ষা করার। বিলম্ব দেখে মাস্তানগুলো বিরক্ত হয়। একজন মুখ খিস্তি করে মনি কে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য হাত বাড়ায়। কিন্তু মনি কে স্পর্শ করার আগে কে যেন সাড়াশিঁর মতো সেই হাত চেপে ধরে। তারপর প্রচন্ড জোরে মোচড় দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। আকস্মিক আক্রমনে চারটে যুবক হতবাক হয়ে যায়। তারা আর যাই হোক প্রতিরোধ আশা করে নাই। তাদের সম্মুখে দাড়িঁয়ে আছে আশিক। কিন্তু সাময়িক বিহ্বলতা কাটিয়ে তারা আশিকের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু হয় ধ্বস্তাধ্বস্তি।
হাবু চাচা বিহ্বলের মতো তাকিয়ে ছিল। তার সমগ্র জীবন শুধু বঞ্চনা আর অত্যাচারের স্বৃতিতে ভারাক্রান্ত। এই প্রথম সে প্রত্যক্ষ করে নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাড়াঁতে পারে। আর তখন তার চোখে পড়ে, মাস্তানদের মধ্যে একজন ছুরি বের করছে। এইবার ঝাপিঁয়ে পড়ে হাবু চাচা। মনি আর তার মা এতক্ষণ নীরব দর্শকের মতো ঘটনা ঘটতে দেখছিল। বাবা কে লড়তে দেখে মনি অস্ফুটভাবে আর্তনাদ করে ওঠে। হাবু চাচার স্ত্রী চীৎকার করে বলে, জাগো বাহে। কুন্ঠে সবাই? রাস্তার ধারের মানুষগুলোর ঘুম আগেই ভেঙ্গে গেছে। তারা জড়তা , গ্লানি ঝেরে ফেলে উঠে দাড়াঁয়। দলবদ্ধভাবে আশিক আর হাবু চাচার কাছে ছুটে আসে। তাদের সম্মিলিত প্রতিরোধের কাছে সন্ত্রাসীরা হার মানতে বাধ্য হয়।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। জনতার চোখে উল্লাস। এই রকম আনন্দ হাবু চাচা বহুকাল আগে দেখেছে। যখন তারা মাঠের সোনালী ফসল কেটে ঘরে তুলতো। এখন থেকে যত বিপদই আসুক তারা একত্রে প্রতিরোধ করবে। উচ্ছসিত হাবু চাচা পাশে তাকায়। আশিক নেই। তার নাম ধরে সবাই ডাকে। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। হাবু চাচা আশিক কে তন্ন তন্ন করে খুজেঁও ব্যর্থ হয়। ঘুমন্ত মানুষগুলোর ঘুম ভাঙ্গিয়ে