দুঃস্বপ্নের জনপদ

স্বপ্ন (জানুয়ারী ২০২৩)

Lubna Negar
  • 0
  • ৪৮
বাবা রশিদ ,রান্নাঘর থেকে আমার দা টা আনতে পারবা ? কথাটা শুনে রশিদের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় । তবু কোনো রকমে প্রশ্ন করে, ছোট চাচা দা দিয়ে তুমি কি করবা? আবুর অস্বাভাবিক মুখখানা এবার সত্যি উম্মত্তের মতো দেখায়। হাঁটু গেড়ে বসে পায়ের শিকলটা একবার নেড়ে চেড়ে দেখে। তারপর অট্ট হেসে বলে, তোমার বাবার ধড় থেকে মাথাটা কাটে ফেলব। এবার আর রশিদ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না । একটা আগ্রাসি ভয় তার পুরো সত্ত্বা গ্রাস করে। এক ছুটে রশিদ গর্তের ধার থেকে পালিয়ে যায় । পিছন থেকে শোনা যায় প্রলাপ আর উম্মত্ত হাসি। কাকে যেন আবু অভিশাপ দিচ্ছে ।

রশিদের বয়স এগারো বছর। এই সময়ের মধ্যে সে পৃথিবীতে সংঘটিত বহু নির্মম ঘটনার সাক্ষী হয়েছে । রশিদের বাবা যখন পাচুনি দিয়ে গোয়ালের গরু গুলকে পিটায় এবং সেই একই লাঠি দিয়ে মাঝে মাঝে তার মাকে মারধর করে তখন রশিদের কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না । সে যে পরিবারে জন্মেছে সেখানে মানবিক বোধের বালাই নেই। তবু কেন যেন আবুর প্রতি এই অত্যাচার সে মেনে নিতে পারে না । আবু বদ্ধ উম্মাদ। গোয়াল ঘরের পিছনে একটা বড় গর্তের মধ্যে শিকল দিয়ে তাকে বেধেঁ রাখা হয়। আবু নিজে মলমূত্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাই এই ব্যবস্থা। শুধু বর্ষাকালে তাকে গোয়াল ঘরে তুলে এনে রাখা হয়। তবে তখন সে সর্বক্ষণ শিকলে বাধাঁ থাকে। দুপুর গড়িয়ে গেছে। মা এখনো রান্নাঘরে। চুলায় কড়াই বসানো। ছ্যাৎ ছ্যাৎ শব্দে মাছ ভাজছে। রশিদ গিয়ে মায়ের পাশে দাড়াঁলো। মা, রান্না হয় নাই? মা জিজ্ঞাসা করলো, কেন, তোর ক্ষিধা লাগছে? বয়ামে মুড়ি আছে। নিয়ে খা। রশিদ মাথা নেড়ে বললো, সকালেও তো মুড়ি খাইছি। একে রান্নাঘরের উত্তাপ, তার উপর ছেলের বায়না । মা এবার রেগে উঠলেন। বললেন, লাট সায়েব হইছস। মুড়ি খাইবার পারস না। তোর বাপ বাড়ি না আসা পর্যন্ত খাওন পাইবি না। রশিদ এইসব চোখ রাঙ্গানি পাত্তা দেয় না। সে বললো, আবু চাচা সকাল থেকে কিছু খায় নাই। নিমেষে চুপ হয়ে গেলো মা। আবু গতকাল রাত থেকে খুব চীৎকার হল্লা করছে। বিরক্ত হয়ে রশিদের বাবা বলে গেছে, আইজ সারাদিন আবুর খাওন বন্ধ। খাওন পাইলে গলায় যুৎ বাড়ে। মা রশিদ কে সেইসব কথা কিছু বললো না। শুধু তার মুখটা বিষন্ন হয়ে উঠলো। রান্নাঘরে দাড়িঁয়ে থাকতে রশিদের ভাল লাগছিল না।

আজ শুক্রবার। স্কুল বন্ধ। স্কুল খোলা থাকলে তবু সময়টা ভাল কাটে। বাড়ির গুমোট পরিবেশের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। মাঠে ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলা যায়। মাঠের কথা মনে হতে রশিদ সেইদিকে ছুট দিলো। ভর দুপুরে মাঠে কেউ নেই। তবু মাঠের ধারে বড় বট গাছের নিচে রশিদ বসে পড়লো। বট গাছের ডালে ঝুলন্ত পাখির বাসা। আবু চাচা রশিদ কে চিনিয়েছিল, এগুলো বাবুই পাখির বাসা। বছর তিনেক আগের কথা। রশিদের বয়স তখন আট বছর। আবু চাচা কলেজ থেকে ফিরে বিকাল বেলা রশিদ কে নিয়ে মাঠের দিকে বেড়াতে বের হতো। সন্ধ্যামালতী গাছের ঝোপেঁ লাল, সবুজ, হলুদ বর্ণের ফড়িং গুলো উড়ে বেড়াতো। স্তব্ধ বিস্ময়ে আবু সেই ঝোপেঁর দিকে তাকিয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে রবি ঠাকুরের প্রশ্ন কবিতার একাংশ আবৃত্তি করতো।

ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে দয়াহীন সংসারে তারা বলে গেল ক্ষমা করো সবে, বলে গেল ভালোবাসো অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো।
আবু চাচা জন্মগত ভাবে শারিরীক প্রতিবন্ধী। তার পা দুটো হাটাঁ চলায় অসমর্থ। তিন ভাইয়ের মধ্যে আবু চাচা সবার ছোট। রশিদের দাদা ছিল স্বচ্ছল কৃষক। ধানী জমি ছাড়াও তার বাজারে ধান চালের আড়ত ছিল। বড় দুই ছেলে কিশোর বয়সে সেই আড়তে কাজে লেগে যায়। আবুকে নিয়ে তার বাবার দুশচিন্তা ছিল বৈকি। কোনো এক সন্ধ্যায় আবুর মা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, পোলাটারে স্কুলে ভর্তি করে দেন। দাদা বলেছিল, পঙ্গু ছেলে। হাটাঁ চলা করবো কেমনে? মায়ের গলায় দৃঢ় প্রত্যয়, বাড়ির পাশে স্কুল। পাকা রাস্তা। ক্রাচে ভর দিয়ে স্কুলে চলে যাইবো। শুরু হলো আবুর কঠিন জীবন সংগ্রাম।
এইসব কথা রশিদ তার দাদির মুখে গল্প শুনেছে। দাদি বৈঠক ঘরের সামনের বারান্দার এক কোণে মাদুরের উপর শুয়ে পড়ে থাকে।

সারা বছর তার গায়ে একটা কাথাঁ দিয়ে ঢাকা থাকে। শীত কালে মশারি বা লেপ কিছু জোটে না। রশিদের মা মাঝে মাঝে কাথাঁটা ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয়। দাদি পক্ষাঘাতগ্রস্থ। তবে তার কথা বলার সামর্থ্য আছে। মস্তিষ্কটা আশ্চর্য্যরকমের সচল। রশিদের বাবা মাঝে মাঝে বারান্দায় এসে দাড়াঁয়। হারুন মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, মা, শরীর ডা ভালা আছে নি? ভালা মন্দ কিছু খাইতে মন চায়? উত্তরে বুড়ি তেড়ে ওঠে, দূর হ হারামখোর। আমার জান থাকতে তোরে জমি লিখে দিতাম না। হারুনের মুখ তখন কৃষ্ণবর্ণ ধারন করে। সেও পাল্টা বলে ওঠে, মর বুড়ি। এক পা কবরের মধ্যি। তবু বুড়ির তেজ কতো? আবু চাচা যখন চীৎকার করে কাকে যেন অভিশাপ দেয় তখন পুরো বাড়ি নীরব হয়ে যায়। শুধু দাদি একা বিড় বিড় করে বলে, হে খোদা, আমারে বোবা কালা বানায় দাও।
বিকালে বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টি হয়েছে। এখন সন্ধ্যা। মা এর মধ্যে বার দুয়েক রশিদ কে সদর রাস্তায় পাঠিয়েছে। যা তো রশিদ, আয়েশা ফিরলো কি না দেখে আয়। আয়েশা রশিদের বড় বোন। সে প্রায় বিকালে পাড়া বেড়াবার নাম করে মনসুরের সাথে হলে সিনেমা দেখতে যায়। রশিদ সেটা জানে। তবে সে মাকে কিছু বললো না। খামোখা অশান্তি বাড়িয়ে লাভ কি? আয়েশার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। পাত্রের সদরে দোকান আছে। আয়েশাও অরাজি নয়। তবু কেন সে মনসুরের সাথে প্রেম করে? রশিদের ছোট মাথায় বিষয়টা পরিষ্কার হয় না। মায়ের কথায় রশিদ তৃতীয়বারের মতো বড় রাস্তায় গিয়ে দাড়াঁলো। কিছুক্ষণ পর সে দেখলো, দূর থেকে একটা রিক্সা আসছে। কাছে আসার পর স্পষ্ট দেখতে পেলো, আয়েশা আর মনসুর ঘনিষ্ঠভাবে বসে আছে। হাসাহাসি করছে। রিক্সা থেকে নেমে দাম চুকিয়ে আয়েশা বাড়ির পথ ধরলো। রশিদকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো, কি রে, তুই আমারে পাহাড়া দেয়ার জন্যি দাড়াঁয় আছিস? রশিদ বললো, বড় আপা তোমার না বিয়ে ঠিক হইছে? তবু তুমি মনসুর ভাইয়ের সাথে প্রেম করো? আয়েশা রশিদের মাথায় চাটি মেরে বললো, তোকে আর মাস্টারি করতে হবে না। সবাই তোর আবু চাচার মতো বোকা মজনু না।


আবু চাচা কি সত্যি নির্বোধ? রশিদ জানে না। বোকা হলে ছোট চাচা জগৎমোহন কলেজে বিকম পড়তো কিভাবে? বছর তিনেক আগের কথা। এস এস সি এবং এইচ এস সি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে আবু চাচা কলেজে বিকম পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছে। এক মাথা ঘন কালো চুল, চোখে সরু মেটাল ফ্রেমের চশমা। আবু চাচাকে রীতিমতো সুদর্শন দেখাতো। খদ্দরের পাঞ্জাবি আর কাধেঁ একটা ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে সে প্রতিদিন কলেজে যেতো। রশিদ জানতো, আবু চাচার ব্যাগে রবি ঠাকুরের সঞ্চয়িতা বইটি ছাড়াও তার একটা কবিতা লেখার খাতা আছে। আবু চাচা লুকিয়ে কবিতা লিখতো। দাদা তখনো বেচেঁ ছিলেন। গ্রামের চায়ের দোকানে মাঝে মাঝে তিনি গিয়ে বসতেন। চায়ের দোকানে উপস্থিত ক্রেতারা বলাবলি করতো, আবু রীতিমতো যুদ্ধ করে লেখাপড়া শিখতাছে। ও আরো বড় অইবো। চাচাজান আপনের ছোট পোলাটা গ্রামের গর্ব। কথাগুলো শুনে দাদার বুকটা জুড়িয়ে যেতো। আনন্দে চোখে জল আসতো। তিনি গোপনে চোখের অশ্রু মুছতেন।

আবু চাচা রশিদ কে তার কলেজের গল্প বলতো, জানিস রশিদ, বড় রাস্তার বাস থেকে নেমেই আমাদের কলেজের সদর গেট। প্রবেশ পথ পার হলে এক পশলা সবুজের সমারোহ। দুই পাশের প্রাচীর ঘিরে কৃষ্ণচুড়া গাছের সারি। গাছগুলোতে যখন ফুল ফোটে তখন মনে হয় আগুন লেগেছে। সবুজের বুকে আগুন রাঙ্গা লাল। আবু চাচার চোখ দুটো স্বপ্নীল হয়ে উঠতো। আয়েশা ছোটবেলা থেকে ইচঁড়ে পাকা। সে মুচকি হেসে রশিদের কানে কানে বলতো, ছোট চাচা ঠিক প্রেমে পড়েছে। বিরক্ত হতো রশিদ। সে তখনো বোঝে না প্রেম জিনিস টা কি? তবে সে আবু চাচার ভক্ত ছিল।

ঘটনাটা শুরু হয় এইভাবে। কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে আবু স্বাভাবিকভাবে ক্লাস করছে। সে বরাবরই লেখাপড়ায় ভালো। প্রথম বর্ষের সমাপনী পরীক্ষায় সে ফার্স্ট হয়। ভালো রেজাল্টের কথা পুরো কলেজে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রচারণার ফলে আবুর বন্ধু ও শত্রু দুইই বৃদ্ধি পায়। একদিন আবু ক্লাসে বসে আছে। স্যার তখনো ক্লাসে আসেন নি। এমন সময় লিটন ও তার চার বন্ধু আবুর সামনে এসে দাড়াঁলো। এক মাথা ঝাকড়াঁ চুল, লিটনের চোখ সব সময় লাল থাকে। আবু বন্ধুদের কাছে শুনেছে লিটন ইয়াবার নেশায় আসক্ত। হল দখল, সীট বাণিজ্য কিংবা প্রশ্নফাসঁ এইসব বিষয়ে লিটন সিদ্ধহস্ত। তবে লিটনের ভাষায় এগুলো বর্তমান রাজনীতির অংশ। আবুর কাছে এসে দাড়াঁতে সে দেখতে পেলো, লিটনের গলায় সোনার চেন। কোনো রকম ভূমিকা না করে লিটন আবুকে জিজ্ঞাসা করলো, এই তুই ফার্স্ট বেঞ্চে বসেছিস কেনো? আবু বুঝতে পারলো লিটন ঝামেলা করতে এসেছে। তবু সে ঠান্ডা গলায় ভদ্রভাবে বললো, বেঞ্চের সীট তো কারও জন্য নির্দিষ্ট নয়। যার যেখানে ইচ্ছা বসতে পারে। লিটন তাচ্ছিল্য ভাবে বললো, ফার্স্ট বেঞ্চে স্মার্ট ছেলেরা বসে। তোর মতো ল্যাংড়া, নুলো নয়। আবু বলবে না বলবে না করেও বলে ফেললো, সেকেন্ড ইয়ারে তিন বার ফেল করে আপনি স্মার্ট হয়েছেন?

লিটন আর যাই হোক এই ধরনের জবাবের জন্য প্রস্তুত ছিল না। রাগে তার লাল চোখ রক্তবর্ণ ধারন করলো। খপ করে আবুর শার্টের কলার ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বললো, তোকে আজ পিষে ফেলে দেবো। আবু প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ক্রাচ ছাড়া সে দাড়াঁতে পারে না। এমন সময় পিছন থেকে একজন রিনরিনে অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো, লিটন ভাই আবুরে ছেড়ে দেন। লিটন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায় তিথি দাড়িঁয়ে আছে। লিটনের হাত শিথিল হয়ে যায়। তিথির বাবা সরকারি দলের এমপি। সে তাদের সাথে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আবুকে ছেড়ে দিয়ে লিটন বললো, তিথি তুমি জানো না। এই বেয়াদপটা আমারে অপমান করছে। তিথি বললো, আবু কি বলেছে আমি শুনেছি। সে মিথ্যা কিছু বলে নাই। আপনি যদি মাস্তানি বন্ধ না করেন তবে আমি অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করবো। অধ্যক্ষ নয় বরং এমপির ভয়ে লিটন তার দলবল নিয়ে সেদিনের মতো চলে গেলো। তিথি আবুর হাতে ক্রাচ দুটো ধরিয়ে দিতে দিতে বললো, আপনার সাহসের প্রসংশা করি। লিটনের মুখের উপর উত্তর দিয়েছেন। বিহ্বলের মতো দাড়িঁয়েছিল আবু। অকারণে তার মনে পড়লো রবি ঠাকুরের গানের একটা কলি,
তুমি কোন কাননের ফুল
কোন গগণের তারা?

শীতের শেষে বসন্ত আসে। গাছের বিবর্ণ পাতাগুলো ঝরে যায়। বৃক্ষ শাখাতে ছেয়ে যায় নতুন কচি সবুজ পল্লব। আবুর মনের অবস্থা ঠিক সেরকম। বহু দিনের কঠিন লড়াই আর রূঢ় বাস্তবতা তার হৃদয়টাকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। সহসা সেখানে বয়ে যেতে লাগলো আনন্দের ঝরনাধারা। প্রতিদিন কলেজে এসে সে প্রতীক্ষায় থাকতো। বেশি সময় অপেক্ষা করার দরকার হতো না। অচিরে সে দেখতে পেতো, ফাইলটা বুকে চেপে ধরে তিথি ক্লাসে আসছে। তাদের কথা হতো করিডোরে, মাঠের বকুল তলায় এবং ক্যান্টিনে। আবু তার কবিতা লেখার খাতাটা তিথি কে দেখিয়েছিল। কবিতাগুলো পড়তে পড়তে তিথি বলেছিল, লিটল ম্যাগাজিনে পাঠিয়ে দাও। ওরা ঠিক প্রকাশ করবে। একদিন তিথি আবু কে জিজ্ঞাসা করেছিল, লেখাপড়া শেষ করে তুমি কি করতে চাও আবু? আবু একটু ইতস্তত করে বলেছিল, আমি শিক্ষক হতে চাই। তিথি বলেছিল, সকালে তুমি ছাত্র পড়াবে। আর বিকালে তোমাদের কামরাঙ্গা গাছের নিচে বসে কবিতা লিখবে। আমি তোমাদের রাঙ্গা গাইটকে খড় দেবো। তারপর তোমার জন্য লেবু চা বানিয়ে আনবো। তিথির মায়াভরা চোখে স্বপ্নের অঞ্জন।
বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো বিষয়টা ঘটেছিল। সত্তর বছর বয়স হলেও দাদা নিজ হাতে জমির কাজ করতেন। একদিন জমিতে নিড়ানি দিয়ে আসার সময় তার মনে হলো, শরীরটা কাপঁছে। পা দুটো চলছে না। কোনো রকমে বাড়ি পর্যন্ত পৌছেঁছিল। তারপর উঠানে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। হাসপাতালে যাবার পথে মৃত্যুবরণ করেন দাদা। ডাক্তার পরে জানিয়েছিল, দাদা হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন। সেই রাতে বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেলো। চারিদিকে শোকের মাতম। আবু তার ঘরে এক কোণে নির্বাক হয়ে বসেছিল। বাবা তার জীবনে শুধু বট বৃক্ষের ছায়ার মতো ছিল না, সে ছিল আবুর সবচেয়ে আপনজন। শোক ভুলতে পরিবারের সদস্যদের বেশি সময় লাগলো না। পরিবারের প্রধান ব্যক্তি মারা গেলে যে পরিস্থিতি হয় এখানেও ঠিক তাই হলো। শুরু হলো সম্পত্তির ভাগ নিয়ে দ্বন্ধ। বড় দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক ভাল না থাকলেও এখন তারা স্বার্থের খাতিরে এক হলো। হারুন সবার সামনে প্রকাশ্যে বললো, আবুরে লেখাপড়া শিখাতে যায়ে আব্বা অনেক টাকা খরচ করছে। এখন এই সম্পত্তির উপর তার কোনো অধিকার নেই। দাদি ক্ষীণ কন্ঠে বলার চেষ্টা করেছিলেন, বাপের সম্পত্তিতে তিন ভাইয়ের অধিকার সমান। কিন্তু তার কথায় কেউ কান দিলো না। দুই ভাই জাল দলিল তৈরী করে আবু কে সর্বশান্ত করার চেষ্টা করতে শুরু করলো। শোকার্ত আবু ব্যথিত বিস্ময়ে ভাইদের কার্যকলাপ দেখছিল। সম্পত্তির প্রতি তার কোনো লোভ কখনো ছিল না। সে তার আপন ভুবনে নিমগ্ন ছিল। আজ বাস্তব জগতে দেখলো, লোভের জন্য মানুষ কতো কদর্য হতে পারে। আবু দুই ভাই কে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, আমার কিছু লাগবে না। যা আছে তোমরা নিয়ে যাও। হারুন মাথা নেড়ে সেয়ানার মতো বলেছিল, মুখে বললি হবে না। দলিলে লিখে দিতে হবে।

বাড়ির এই ঝামেলার জন্য আবু প্রায় ছয় মাস কলেজে যেতে পারে নি। অন্য কোনো বিষয়ে মনযোগ দেয়ার অবকাশ তার ছিল না। কলেজে পৌছেঁ শুনতে পেলো লিটনের সাথে তিথির বিয়ে হয়ে গেছে। দুই মাস আগে তাদের পারিবারিক ভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। খবরটা শুনে আবু বজ্রাহতের মতো দাড়িঁয়েছিল। যে তিথি হেমন্তের ঝরা পাতা দেখে জীবনান্দ দাসের কবিতা আবৃত্তি করতো, আবু কে জীবন সংগ্রামে উৎসাহ যোগাতো, সে লিটন কে বিয়ে করেছে? তবে কি তিথি কে কেউ জোর করেছ?
আবুর এইসব প্রশ্নের উত্তর তিথি নিজেই দিয়েছিল। ক্যান্টিনে বসে কোল্ড ড্রিংকস খেতে খেতে নির্মোহভাবে তিথি বলেছিল, শুধু কল্পনায় ভর করে জীবন চলে না। আর্থিক নিরাপত্ত্বারও দরকার হয়। লিটনের বাবার তিন তলা বাড়ি আছে। তার ভবিষ্যৎ আছে। লিটনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। মানুষ ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সব রকমের অন্যায় করতে পারে। আর তিথি ক্ষণিকের মোহ ঝেড়ে ফেলতে পারবে না? তিথির কাছে যা ছিল ক্ষণস্থায়ী আনন্দ, আবুর কাছে সেটা ছিল বেচেঁ থাকার উদ্দেশ্য। আঘাতটা বেজেছিল মর্মমূলে। আবু তার দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার চেষ্টা করেছিল। একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু মানুষের নির্মমতার কাছে এইবার তাকে পরাজয় স্বীকার করতে হলো। সেই বছর সে অসুস্থার কারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারলো না। দিনে দিনে সে নির্জীব হয়ে যেতে শুরু করলো। রাতের পর রাত ঘুমাতে পারতো না। একা একা হাসতো আর কথা বলতো। আবুর এই অবস্থা তার পরিবারের সদস্যদের চোখে ঠিকই ধরা পড়েছিল। দাদি কাতর কণ্ঠে বড় ছেলেকে বহুবার অনুরোধ করেছিল, পোলাডারে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল। চিকিৎসে করা। কিন্তু হারুন সে কথায় কর্ণপাত করার প্রয়োজন বোধ করেনি। পথের কাটাঁ যদি সহজে দূর হয়ে যায়, তবে কে না খুশি হয়? হারুন বলেছিল , আবু পাগল হয়ে গেছে। ওরে শিকল দিয়ে বান্ধে রাখতি হবে। ক্রমশ আবুর অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। এক সময় সত্যি তাকে শিকল দিয়ে বেধেঁ রাখা হয়।

ছোট চাচা, ও ছোট চাচা, গর্তের ধারে উবু হয়ে বসে রশিদ চাপা গলায় আবু কে ডাকছে। এখন রাত নয়টা বাজে। বাড়ির সবার খাওয়া হয়ে গেছে। শীতের রাতে তারা বিছানায় ঘুমাবার আয়োজন করছে। মা গোপনে রশিদের হাতে কিছু খাবার দিয়ে পাঠিয়েছেন। রশিদ আবার ডাকলো, ছোট চাচা, তোমার জন্য খাবার আনছি। চারিদিক নিশ্চুপ। গর্তের মধ্যে কোনো সাড়াশব্দ নেই। রশিদ ভালো করে কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করলো। তার মনে হলো গর্তের মধ্যে কেউ শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে। তবে কি আবুর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে? রশিদ ভয়ে ভয়ে আবার আবু কে ডাকলো। এইবার সে স্পষ্ট শুনতে পেলো, আবুর গলা দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে। তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। রশিদের বুকের ভিতরটা যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠলো। উঠে দাড়িঁয়ে এদিক ওদিক সাহায্যের জন্য তাকাতে লাগলো। বাড়িতে কাউকে বলবে? এক লহমায় চিন্তাটা সে বাদ দিলো। বাড়ি থেকে কেউ সাহায্য করবে না। কি করবে বুঝতে না পেরে রশিদ রাস্তার দিকে বেড়িয়ে গেলো। বড় রাস্তার পাশে মনসুরের মুদির দোকান। মনসুর দোকানের ঝাপঁ বন্ধ করে বাড়ি যাবার আয়োজন করছিল। পেছন থেকে রশিদ ব্যাকুলভাবে ডাকলো, মনসুর ভাই, মনসুর ভাই। মনসুর রশিদের দিকে একটু অবাক হয়ে তাকালো।

কিরে রশিদ? এতো রাতে তুই বাইরে কি করছিস? রশিদ হাফাঁতে হাফাঁতে বললো, ছোট চাচার অসুখ। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। মনসুর জানে আবু অসুস্থ। সে বললো, তোর বাবা কোথায়?
রশিদ বললো, বাবা আসবে না। বাবা ছোট চাচা কে গর্তের ভিতর শিকল দিয়ে বেধেঁ রেখেছে। মনসুরের চোখমুখ পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলো। আবুর অসুখ সেটা সে জানে । কিন্তু তার প্রতি এই আচরণ করা হয়, সেই খবর গ্রামের কেউ জানে না। মনসুর বললো, রশিদ তুই বাড়ি যা। আমি আসছি। রাত দশটায় হারুণের বাড়ির সদর দরজায় করাঘাত পড়লো। হারুণ স্পষ্টত বিরক্ত হলো। দরজা খুলে দেখে মনসুর আর তার তিন বন্ধু দাড়িঁয়ে আছে। হারুণ বললো, ঈদের ফাংশনের চাদাঁ তো কইছি পরে দিমু। মনসুর কোনো ভূমিকা না করে জিজ্ঞাসা করলো, আবু চাচা কোথায়? হঠাৎ এই প্রশ্নে হারুণ হকচকিয়ে গেলো। ভড়কে গিয়ে বললো, হে অসুস্থ। মনসুর আর সময় নষ্ট করলো না। হারুণ কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়লো। বাড়ির সব লোক ততোক্ষণে জেগে গেছে। হারুণ চীৎকার করছে বাড়ির মধ্যি ঢুকে মাস্তানির ফল ভালো হবে না । মনসুর সোজা গোয়ালের পেছনে গর্তের কাছে গিয়ে টর্চ জ্বালালো। টর্চের আলোয় দেখতে পেলো, আবু অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। মনসুর বলে উঠলো, আপনারা কি মানুষ? কোনো মানুষ হয়ে অন্যের প্রতি এই অত্যাচার করতে পারে?

এক মাস পরের কথা। আজ আয়েশার বিয়ে। শহর থেকে বর যাত্রী এসেছে। ঝলমলে বেনারশি আর জড়োয়া অলংকার আয়েশা সেজেছে। মনসুরের কথা তার মনে নেই। মনসুরের মুদি দোকানটা হারুণ ও তার প্রভাবশালী মহল মিলে জোর খাটিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। সে দোকানটা বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা করছে। সেই টাকায় ঘুষ দিয়ে যদি কোথাও চাকরি হয়। গ্রামে বাস করা মনসুরের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সেই রাতে আবু কে উদ্ধার করে মনসুর ও তার বন্ধুরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। দিন তিনেক পরে আবু মারা যায়। ঘটনাটা নিয়ে গ্রামে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও অচিরে সব নীরব হয়ে যায়। হারুণ কে অবশ্য বেশ অর্থ ঢালতে হয়েছে। আবুর লাশ বাড়িতে এনে তাদের পারিবারিক কবর স্থানে দাফন করা হয়। ডাক্তারের রিপোর্ট অনুযায়ী আবু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। বলা বাহুল্য আবুর নামে থাকা জমির অংশ এখন হারুণের দখলে। আয়েশার বিয়েতে সানাই বাজছে। শহর থেকে ব্যান্ড পার্টি এসেছে। তাদের সম্মিলিত বাজনায় চাপা পড়ে গেছে দাদির অভিশাপ আর হাহাকার।
দুপুর বেলা মাঠের ধারে বট গাছের নিচে বসে আছে রশিদ। তার হাতে আবু চাচার কবিতা লেখার খাতাটা। খাতার শেষের পাতায় রবি ঠাকুরের প্রশ্ন কবিতার শেষাংশটি লেখা রয়েছে। কবি গুরু ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছিলেন, যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

প্রশ্নটি আবুর মনে ঘুরে ফিরে আসতো। আজ সেই প্রশ্ন রশিদের মনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ঈশান কোণে মেঘ জমেছে। চৈত্র মাসের এই ঝড়কে বলা হয় চৈতালি ঘুর্ণি। চৈতালি ঘুর্ণি তো কাল বৈশাখীর পূর্বাভাস।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মোখলেছুর রহমান আপনার ভোট অপসন কেনো যেনো খু৺জে পেলাম না, শুভ কামনা রইল।
ভালো লাগেনি ২৩ জানুয়ারী, ২০২৩
নূসরাত জাহান ঊর্মি ভালো লেগেছে খুব লেখাটি। শুভকামনা রইলো।
ভালো লাগেনি ১৭ জানুয়ারী, ২০২৩
Dipok Kumar Bhadra সুন্দর লিখেছেন । এগিয়ে যান।
ফয়জুল মহী চমৎকার লিখেছেন পাঠে মুগ্ধ হলাম তাই একরাশ মুগ্ধতা রেখে গেলাম

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

আবু অভিশাপ দিচ্ছে

০৩ মার্চ - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ৩৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪