গেন্দু চোর

বাবা (জুন ২০২২)

Lubna Negar
মোট ভোট প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.৪৫
  • ১৯৮
আপনে আবার চুরি করছেন ? চীৎকার করছে আমেনা । তার সামনে ছোটখাটো চেহারার কৃশকায় লোকটি অপরাধীর মতো মুখ করে দরজার সামনে বসে আছে। লোকটি আমেনার স্বা মি। তার তিন ছেলেমেয়ের বাবা। এলাকায় তার নাম গেন্দু চোর । গেন্দু নীরব হয়ে বসে থাকলেও আমেনার কর্কশ কণ্ঠ থামে না । সে বলে , মানুষ রিক্সা চালায় খায় , মিলে কাম করে , জমিতে কামলা খাটে । আর আপনে রাত দুপুরে চুরি করতে যান ? শরম করে না আপনের ? এবার কথা বলে ওঠে গেন্দু, বিড় বিড় করে বলে, ঋণের টাকা শোধ করতে পারি নাই । জমি গেছে মহাজনের পেটে । রিক্সা কেনার টাকা কে দিবো ? ভাড়ায় রিক্সা চালাইলে মালিক রে টাকা দিয়া আমার কয় পয়সা থাকে ?
আমেনা বলে , তাই বইল্যা চুরি করবেন ? ছেলেমেয়ে বড় হইতাছে । হ্যাঁরাও আপনের মতো চোর হইবো।
আমেনার এই কথায় জ্বলে ওঠে গেন্দু। বলে, থাম তুই। দুনিয়া বুরা। মুই একা সৎ হইয়া কি করমু?
সূর্য অনেক আগে উঠে গেছে। সকালের হালকা ঠান্ডা বাতাস এখন রোদে তপ্ত। মিরপুর বস্তির ঘিঞ্জি পরিবেশে এইরকম ঝগড়া নতুন কিছু নয়। যারা সকালে টাট্টিখানায় যাওয়ার জন্য লাইনে দাড়িঁয়েছিল, তারা স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া রীতিমতো উপভোগ করছিলো। রিক্সাচালক নুরু তার পান খাওয়া লাল দাতঁগুলো বের করে ফিচলে হাসি হাসতে হাসতে বললো, ভাবীসাব রাগ করে আর কি করবেন? কথায় আছে না, স্বভাব যায় না মলে।
কসিম মোল্লা সায় দিয়ে বিজ্ঞের মতো বললো, কথাডা কইছেন ঠিকই। দুই মাস আগে চুরি করতে যায়ে গেন্দু ধরা পড়লো। পাবলিক কি মারটাই না মারলো। কিরা কসম দিয়া ছাড়া পায়। এখন দ্যাহেন কই মাছের জান। ফাল পারে। আবার চুরি করতে গেছে।
গেন্দুর চার বছরের মেয়েটি এতোক্ষণ মায়ের পাশে দাড়িঁয়ে সব দেখছিল। অনেক আগে তার ক্ষুধা পেয়েছে। কিন্তু মায়ের রাগ দেখে কিছু বলতে পারে নি। এইবার থাকতে না পেরে মায়ের আচঁলে টান দিয়ে বললো, মা ক্ষিধা লাগছে। এমনি তেতে ছিল আমেনা। এবার সব রাগ গিয়ে পড়লো শামসুর উপর। তার পিঠে দুম দুম করে দুটো কিল মেরে বললো, ক্ষিধা লাগছে, আমারে খা। সবগুলান রাক্ষসের জাত। ভ্যা করে কেদেঁ উঠলো শামসু। তবে মার খাওয়াটা ওর কাছে নতুন কিছু নয়। ঘর থেকে চৌকিতে বসে এতোক্ষণ নীরবে সবকিছু দেখছিল সাদেক। আমেনার বড় ছেলে। বাইরে ঝগড়ার প্রতিটি শব্দ তার কানে আসছিল। কিন্তু তার মুখভঙ্গী নির্বিকার। শুধু একবার তার মনে প্রশ্ন জাগলো, এই তার জন্মদাতা পিতা? ঘৃনায় দুঃখে বুকের ভিতর মোচড়াতে লাগলো। বেলা ক্রমশ বাড়ছে। সকালের ঝগড়ার পর আমেনার রাগ কমে এসেছে। তার খেয়াল হলো, সকাল নয়টার মধ্যে তাকে কাজে বের হতে হবে। তিন বাসায় ঠিকা কাজ করে আমেনা। আর সাদেক যাবে স্কুলে। সাদেক এখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। বয়স দশ বছর। জীবনের চরম অপ্রাপ্তি আর দুঃখের মাঝে ও আমেনা সাদেকের কথা ভেবে আনন্দ পায়।
টিনের হাড়িতে পান্তা ভাত ছিল। সেই ভাত তিন ভাগ করে ছেলমেয়েদের খেতে ডাকলো। করিম আর শামসু সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে এসে মেঝেতে বসে পড়লো। শামসুর কান্না থেমেছে। ওরা দুইজন খেতে শুরু করেছে। সাদেক চৌকিতে ঠায় বসে আছে। আমেনা তাকে ডাক দিয়ে বললো, ও সদু, আয় খায়ে নে। ইস্কুলে দেরী হইয়া যাবে। সাদেক মাথা নেড়ে বললো, আমি আর স্কুলে যাবো না। একটু অবাক হয়ে আমেনা জিজ্ঞাসা করলো, কেন বাপ কি হইছে? এতোক্ষণ নীরব থাকার পর সাদেক কান্না জড়ানো কন্ঠে বললো, স্কুলে স্যার গতকাল ক্লাসে আমারে প্রশ্ন করছিল, তোমার বাবা কি করে? আমি উত্তর দিতে পারি নাই। ক্লাসের সবাই হাসাহাসি করছে।
আমেনা কি বলবে বুঝতে পারে না। একটু আগে খুব রাগ হয়েছিল। এখন তার মুখে গাঢ় বেদনার ছাপ পড়লো। ঘরের দাওয়ায় বসে ছিল গেন্দু। কথাগুলো তার কানে গেছে। গেন্দু আস্তে আস্তে ঘরে প্রবেশ করলো। সাদেকের দিকে তাকিয়ে তার বুকটা মমতায় টন টন করে ওঠে। শ্যামবর্ণ ছেলেটি বাবার মতোই কৃশকায়। চোখ দুটো মায়ায় ভরা। সাদেক তাদের প্রথম সন্তান। ওর যখন জন্ম হয় তখন গেন্দুর বাবা বেচে ছিল। তারা ছিল গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্ত। জমি তখনো চার ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হয়নি। তারা চার ভাই বাবার সাথে খেতে কাজ করতো। সময়ের পরিক্রমায় বাপ মরলো। চার ভাই বিয়ে করে পৃথক হলো। তারপর শুরু হলো জমি নিয়ে ভাগাভাগি আর দ্বন্ধ। দ্বন্ধে গেন্দু অন্যদের সাথে পেরে ওঠেনি। তাই ভিটেটুকু ছাড়া তার ভাগ্যে আর কিছু জুটলো না। ঋণের দায়ে সেই ভিটে গেছে মহাজনের পেটে। এরপর সে বউ ছেলের হাত ধরে ঢাকায় চলে আসে জীবিকার সন্ধানে। শহরের বৈষম্য, নির্বিকারত্ব আর অর্থনৈতিক দুরাবস্থার ফলে আজ সে চোর। এখন সন্তানের চোখে জল দেখে তার মাথায় হাত দিয়ে বললো, দুঃখু পাইয়ো না বাপজান। এই দুনিয়াই চোখের জলের কোনো দাম নাই। দুনিয়া চলে জোর যার মুল্লুক তার রীতিতে।
থামেন আপনে। ঝংকার দিয়ে উঠলো আমেনা। পোলার সামনে এইসব কথা কওনের কাম নাই। গেন্দু ছেলের কাছ থেকে সরে আসে। বিড় বিড় করে বলে , হ বাপ, এইসব শুনে কাম নাই। তুমি লেখাপড়া করবা। মানুষ হইবা। আল্লাহর দরবারে হাত জোড় করে তাই বলি। শবে বরাতের দিন আমেনার কাজ সেরে ফিরতে বেশ দেরী হয়ে গেলো। মালিকের বাড়িতে নানা রকম রান্না হয়েছে। আমেনার উপর ভার ছিল রুটি বানাবার। আজকে খাটুনি বেশি হলেও আমেনার আনন্দ লাগছিল। মালিকের স্ত্রী তিনটি আইসক্রিমের প্লাস্টিকের খালি বাটি ভরে খাবার দিয়েছে। ঘরে পৌছাঁনো মাত্র শামসু আর করিম মায়ের কাছে দৌড়েঁ এলো। খাবারগুলো ছেলেমেয়ে দের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে আমেনা গেন্দুকে ডাক দিলো, কই আসেন। খাইয়া লন। দ্বিতীয়বার ডাক দিতে হলো না। গেন্দু এসে হাত ধুয়ে সাদেকের পাশে বসে পড়লো। খেতে খেতে গেন্দু বললো, হালুয়াটা জব্বর হইছে। জানো বাবারা, গ্যারামে থাকতে আমাদের হাট থেকে মাছ কিনতে হইতো না। বাড়ির পাশে গাঙ্গ। সেইখানে আমরা মাছ ধরতাম। এতো বড় বড় কই, মাগুর আর শোল মাছ। তোমগো দাদি হেই তাজা মাছ যা সোন্দর কইরা রানতো। শামসু আর করিম খেতে খেতে বাবার কথা শুনছিল। গেন্দুর কথাবার্তায় খাওয়ার প্রসঙ্গ বেশি আসে। কিন্তু আজ আমেনাও ঝগড়া না করে গেন্দুর কথা শুনছিল। স্বামী সন্তানদের খাবার বেড়ে দিতে দিতে সে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনে ফেললো।
খাওয়া শেষ করে সবার আগে উঠে গেলো সাদেক। হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। আজকের দিনটা তার ভালো যায় নি। সকালের ঝগড়ার প্রসঙ্গটা সে ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু স্কুলে যাবার পথে বস্তির কয়েকটা ছেলে তার পথরোধ করে দাড়াঁয়। ওদের মধ্যে পান্ডা গোছের ছেলেটির নাম রুবেল। বয়স বারো বছর। এই বয়সেই গাজাঁ খাওয়া শিখে গেছে। সে ব্যঙ্গ করে বলছিল, কিরে সদু? তোর বাপ করে চুরি। আর তুই যাস স্কুলে। তার চেয়ে আমাদের সঙ্গে চল। বই গুলান বেচলে সিনেমার টিকিটের পয়সা হইয়া যাবে। অপু বিশ্বাসের নতুন ফ্লিম আইছে।
সাদেক মাথা নেড়ে শান্ত ভাবে বলেছিল, আমি যাবো না। রুবেল তাচ্ছিল্যের স্বরে বলেছিল, কেন? যাবি নে কেন? ও বুঝছি, চোরের পোলা হইয়া বিদ্বান হইবার চাস? সাদেক কথা না বাড়িয়ে স্কুলের দিকে হাটঁতে শুরু করেছিল। অপমান বোধের চেয়ে ও বুকের মধ্যে যন্ত্রনা হচ্ছিল বেশি।
খবরটা এনেছিল কসিম মোল্লা। হন্তদন্ত হয়ে একদিন বিকালে ছুটে এসে তাদের ঘরের সামনে দাড়িঁয়ে বলেছিল, ভাবীসাব, সর্বনাশ হইয়া গেছে। বড় ড্রেনের পাশে গেন্দুর লাশ পড়ে ছিল। কাল রাইতে চুরি করতে যাইয়্যে বোধহয় মাইর খাইছিল। পুলিশ আসি লাশ নিয়ে চইল্যা গেছে। একটা আর্ত চীৎকার করে বসে পড়েছিল আমেনা। শামসু আর করিমের তখনো সব বোঝার বয়স হয়নি। কিন্তু মায়ের কান্না দেখে তারাও কান্না জুড়ে দিয়েছিল। তাদের কান্নায় বস্তির বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। কেবল সাদেক ঘরের এক কোণে নির্বিকার ভাবে বসে ছিল। তার কেন যেন মনে প্রশ্ন জাগছিল, মানুষের জীবন এতো তুচ্ছ? এতো ঠুনকো? মর্গ থেকে লাশ আনতে গিয়ে রাত হয়ে গিয়েছিল। সেই রাতেই আমেনা তিন ছেলেমেয়ে সহ লাশ নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বস্তিবাসীরা নিজেদের মধ্যে চাদাঁ তুলে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিল।
এই ঘটনার পর দশ বছর কেটে গেছে। সাদেক এখন কলেজে পড়ে। গেন্দু মারা যাবার পর আমেনা গার্মেন্টসে অপারেটরের চাকরি পায়। সে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ঐ বস্তিতে থাকে। গেন্দুর কথা সবাই ভুলে গেছে। বস্তিবাসীরা এখন সাদেক কে নিয়ে গর্ব করে। তাদের বস্তির একটা ছেলে অনার্স পড়ে। শুধু সেই দিনের কথা ভুলতে পারে না সাদেক। মনের নিভৃত কোণে কোথায় যেন একটা যন্ত্রনা বিদ্ধ হয়ে আছে।
কলেজের করিডোরে ছেলেমেয়েরা দাড়িঁয়ে আছে। ক্লাস শুরু হবার সময়ের বেশ কিছুক্ষণ আগে তারা চলে আসে। উদ্দেশ্যে পরষ্পরের সাথে গল্প করা। ছাত্র জীবনের নির্মল আনন্দের মধ্যে এই বিষয়টি অন্যতম। ওদের কাছ থেকে একটু দূরে নোটিশ বোর্ড দেখছিল সাদেক। এখন সে ইংরেজি বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। দুই বছর হতে চললো। কিন্তু এখনো সাদেকের সঙ্গে তেমন কারো বন্ধুত্ব হয়নি। অনেকে তার সাথে কথা বলে। সাদেক সংক্ষেপে উত্তর দেয়। কি একটা অদৃশ্য দূরত্ব তাকে তাড়া করে ফেরে।গত মাসে প্রথম বর্ষ পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। সাদেক ফার্স্ট হয়েছে। তারপর থেকে ছেলেমেয়ে দের কাছে তার গুরুত্ব বেড়ে গেছে। কিন্তু সে আগের মতোই আছে। সেই একই রকম চুপচাপ, উদাসীন।
আপনি কি করিডোরে দাড়িঁয়েও লেখাপড়া করেন? পেছন থেকে একটা মিষ্টি কণ্ঠ প্রশ্ন করলো। সাদেক ঘাড় না ফিরিয়েও বুঝতে পারলো কণ্ঠটি তৃণার। মূহুর্তে তার হৃৎকম্প শুরু হলো। তৃণা সাদেকের সাথে একই ক্লাসে পড়ে। খুব মিশুক। ক্লাসে সবার সাথে তার বন্ধুত্ব। তৃণার সাথে সাদেকের খুব বেশি কথা হয় না। কিন্তু দূর থেকে তৃণা কে দেখলে সাদেকের মনে একটা ভালো লাগার অনুভুতি হয়। চেষ্টা করেও অনুভুতি টা সে তাড়াতে পারে না। পেছনে তাকিয়ে দেখলো তৃণা আজকে নীল রঙ্গের একটা তাতেঁর সালোয়ার কামিজ পড়েছে। সাজ সজ্জার কোনো বালাই নেই। তবু সাদেকের মনে হলো এই মেঘলা দিনে শ্যাম বর্ণা তৃণা কে ঠিক রবি ঠাকুরের কৃষ্ণকলির মতো লাগছে। তৃণার মুখে স্নিগ্ধ হাসিটি তখনো আছে। সে বললো, স্যার তো আজ ম্যাকবেথ পড়াবেন। আপনার হাতে ডিকেন্সের বই?
সাদেকের খেয়াল হলো, সৌম্যের কাছ থেকে সে চার্লস ডিকেন্সের এ টেল অব টু সিটি বইটা পড়তে নিয়েছিল। আজ বইটা ফেরত দেবার কথা। তৃণা কে বললো, ডিকেন্সের বইগুলো পড়তে আমার ভালো লাগে। আপনি বইটা পড়েছেন?
তৃণা বললো, না, ডিকেন্স আমার কাছে কঠিন মনে হয়। তবে জেন অস্টিনের বইগুলো পড়তে ভালো লাগে।
সাদেক বললো, জেন অস্টিন নিঃসন্দেহে ভালো। তবে ডিকেন্সের মানবিক বোধ আমাকে আকর্ষন করে। শিল্প বিপ্লবের পর ইংল্যান্ডে যে পুজিঁবাদী সমাজ গড়ে উঠেছিল , তা মানব সভ্যতার অগ্রগতি কে নির্দেশ করে। কিন্তু এই পরিবর্তনের আরও একটা দিক আছে। শিল্প কারখানার প্রয়োজনে যে শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়, তাদের জীবন ছিল দুঃসহ দারিদ্র্যের এবং বঞ্চনার। ডিকেন্স এই শ্রমিক শ্রেণীর বঞ্চনার কথা মানবিক ভাবে তার উপন্যাসে তুলে ধরেছেন।
অবাক হয়ে গেলো তৃণা। চোখ বড় বড় করে বললো, আপনি তো অনেক কিছু জানেন। ক্লাস শেষ হলে চলুন ক্যান্টিনে যাই। চা খেতে খেতে কথা হবে। সাদেক নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কি সত্যি শুনছে? তবু সে ইতস্তত করলো। মুখে বললো, আজ থাক। অন্য একদিন যাবো। আজ আমার টিউশনি আছে।
বস্তিঘরের চৌকির উপর শুয়ে ছিল সাদেক। তার পাশে করিম ঘুমিয়ে আছে। এখন মধ্যরাত। তাদের ঘরের জানালা দিয়ে আকাশের চাদঁ দেখা যায় না। তবে রাস্তার টিউব লাইটের আলোয় ঘরটি আলোকিত। সাদেকের মনে তীব্র দ্বন্ধ চলছে। দেড় মাস হলো তৃণার সাথে তার বন্ধুত্ব হয়েছে। দুইজন একসাথে ক্লাসের বিরতির সময় করিডোরে বসে গল্প করে। ক্যান্টিনে চা খায়। তৃণা একটু অন্য ধরণের মেয়ে। তার আগ্রহের বিষয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি থেকে শুরু করে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত। তাদের যে মতভেদ হয় না তা নয়। তৃণার প্রিয় লেখক বুদ্ধদেব বসু। সেদিন সে বলছিল, বাংলা কবিতা কে আধুনিক পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য বুদ্ধদেব বসুর ভূমিকা অনন্য। কিন্তু সাদেকের প্রিয় লেখক মানিক বন্দোপাধ্যায়। তার মতে, বুদ্ধদেব বসু নিঃসন্দেহে অসাধারণ। কিন্তু তিরিশের দশকের এইসব সাহিত্যিকের লেখার ধারা কলাবৈকল্যবাদী। তারা শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাসী। মানিক বন্দোপাধ্যায় সামাজিক অবক্ষয়ের কথা লিখেছেন ঠিকই। কিন্তু তিনি সমাজব্যবস্থা কে মেনে নেন নি। তিনি বৈষম্য এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কথা বলেছেন।
কথায় কথায় কতো সময় কেটে যায় কেউ হিসাব করে না। সাদেকের জীবনে এতো মধুর সময় আর আসে নি। কিন্তু এই হৃদয়াবেগের মধ্যে কোথায় যেন একটা দ্বন্ধ ছিল যা আজ তীব্র হয়ে উঠেছে। সাদেক বুঝতে পারছে তারা দুই জন প্রেমে পড়েছে। তবে সত্য কথাটা নিজের কাছে স্বীকার করার সাহস তার নেই। তৃণার কাছে কথা প্রসঙ্গে জানতে পেরেছে, তার বাবা সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। কিন্তু সাদেক তার নিজ পরিবারের কথা কিছুই তৃণা কে বলে নি। কি সে বলতে পারে ? সাদেক কি বলতে পারে তার বাবা গেন্দু চোর। চুরি করতে গিয়ে গণ পিটুনিতে মারা যায়। এইসব কথা কি উচ্চারণ করা সম্ভব? কিন্তু বিষয়টা লুকিয়ে তো তৃণার সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় না। যতো কষ্টই হোক তৃণার সাথে সে কথা বলা বন্ধ করে দেবে। নিজেকে তার অস্পৃশ্য বলে মনে হচ্ছিলো।
বরাবরই ক্লাস শুরু হবার কিছুক্ষণ আগে চলে আসে সাদেক। আজ তার বেশ দেরী হয়ে গেছে। মানসিক অস্থিরতাই সারা রাত তার ঘুম হয়নি। অবশেষে সে একটা সিধান্তে পৌছেঁছে। করিডোরে তৃণা দাড়িয়েঁছিল। সাদেক কে দেখে হাসলো। বললো, আজ কিন্তু আমি তোমার আগে চলে এসেছি। সাদেক কিছু বললো না। একটু অবাক হলো তৃণা। মনযোগ দিয়ে সাদেক কে দেখলো তৃণা। তাকে উদভ্রান্তের ন্যায় দেখাচ্ছে। তৃণা জিজ্ঞাসা করলো, কি ব্যাপার? কোনো সমস্যা হয়েছে? সাদেক তার কথার জবাব না দিয়ে বললো, ক্লাস আছে। আমি যাই। সারাটা ক্লাসে তৃণার মন বসলো না। সাদেক তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কারণ টা কি? ক্লাস শেষ হলে সাদেক সবার আগে বের হয়ে গেলো। তৃণা তাকে দূর থেকে অনুসরণ করছে। কলেজ প্রাঙ্গনের বকুল গাছ তলায় সাদেক ঘাসের উপর বসে আছে। কয়েক দিন আগেও তারা দুইজন এখানে বসে গল্প করেছে। তৃণা তার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করলো, তোমার কিছু হয়েছে সাদেক? সাদেক উঠে দাড়াঁলো। তারপর তৃণার দিকে তাকিয়ে সরাসরি বললো, আমার মনে হয়, আমাদের মধ্যে আর কথাবার্তা না হওয়া উচিত।
যেনো একটা ধাক্কা খেলো তৃণা। কোনো রকমে জিজ্ঞাসা করলো, কেন? সাদেক বললো। তোমার আর আমার মধ্যে যে সম্পর্কটা গড়ে উঠতে চলেছে, সেটাকে বলা হয় নর নারীর প্রেম। তুমি কি স্বীকার করো? তৃণা আস্তে করে বললো, হ্যাঁ। সাদেক বললো, এই কারণে সম্পর্ক টা এখানেই শেষ করে দেয়া উচিত। তৃণার মনটা যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠলো। সে প্রশ্ন করলো, কেন? সাদেক এতোক্ষণ শান্তভাবে কথা বলেছে। এইবার সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালো। ক্রদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলো, তুমি কি আমার সম্বন্ধে সব কিছু জানো? আমার বাবা ছিল চোর। গণ পিটুনিতে মারা গেছে। আমার মা গার্মেন্টসে কাজ করে। আমরা বস্তিতে থাকি। কথাগুলো বলে নিজে কে আর সামলাতে পারলো না সাদেক। থর থর করে কেপেঁ উঠলো। উদগত কান্না চাপতে সে প্রায় দৌড়েঁ সেখান থেকে চলে গেলো। কেউ তার পিছু নিলো না। তৃণাও নয়। তৃণা তখন বকুল গাছ তলায় হতভম্বের মতো দাড়িঁয়ে আছে।
এই ঘটনার পর প্রায় পাচঁ মাস কেটে গেছে। সাদেকের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। এই পাচঁ মাসে তৃণা আর সাদেক পরষ্পরের সাথে কথা বলে নি। সাদেক এখন নিজে কে আরও গুটিয়ে নিয়েছে। নতুন বর্ষে ক্লাস করতে এসে সৌম্যের কাছে খবরটা শুনলো সাদেক। তৃণার বিয়ে হয়ে গেছে। ওর স্বামী একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। পিএইচডি করার জন্য সে ইংল্যান্ডে চলে গেছে। সঙ্গে গেছে তৃণা। খবর টা শুনে সাদেক নির্লিপ্ত ভাবে দাড়িঁয়ে রইলো। সে যে সমাজে বাস করে সেখানে এইরকম হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। হঠাৎ কি মনে হওয়ায় সৌম্য বললো, তৃণা তোকে একটা উপহার দিয়ে গেছে। এই নে ধর। কৌতুহলি সাদেক পার্সেলের মোড়ক খুলে দেখতে পায়, তৃণা তাকে একটা বই দিয়ে গেছে। বইটার নাম লে মিজারেবল। লেখক ভিক্টর হুগো।
সেদিন অনেক রাতে বইটা পড়তে পড়তে লে মিজারেবল উপন্যাসের নায়ক জা ভালজাঁর কথা সাদেক ভাবছিল। ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে ফ্রান্সের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা ভয়াবহ অভাব আর বঞ্চনার মধ্যে জীবন যাপন করতো। দূর্বিসহ দারিদ্র্যর জন্য জা ভালজাঁ এক টুকরো রুটি চুরি করে। সেইজন্য তাকে উনিশ বছর জেল খাটতে হয়। সাদেক ভাবছিল, চুরি করা নিঃসন্দেহে ঘৃণ্য কাজ। যারা অনেক পেয়েও লোভের জন্য চুরি করে তাদের কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু যারা অভাবের তাড়নায় চুরি করতে বাধ্য হয় তাদের কে কি সে ঘৃণা করতে পারে? আজ বহু দিন পর সাদেকের বাবার কথা মনে পড়লো। সবার কাছে ঘৃণার পাত্র গেন্দু চোর কি মমতায় না তার সন্তানদের ভালোবাসতো। লে মিজারেবলের জা ভালজাঁ নিজের সাধনায় হয়ে উঠেছিলেন নতুন যুগের স্থাপতি। মানবতার প্রতীক। সাদেক কি পারবে তারঁ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আলোর পথের যাত্রী হতে? এক নতুন জীবনের প্রত্যাশা সাদেক কে বেচে থাকতে অনুপ্রেরণা যোগালো।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Jamal Uddin Ahmed অনেক অভিনন্দন।
ফয়জুল মহী একটি প্রশংসনীয় লেখা উপহার দিয়েছেন । গহীন উপলব্ধি,সুন্দর বুনন l

০৩ মার্চ - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ৩৫ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.৪৫

বিচারক স্কোরঃ ২.৪৫ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ৩ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী