মঈনের মন খারাপ। আজ তার জন্মদিন। অথচ সকাল থেকে মনের কোণে মেঘ জমে আছে। ডিসেম্বর মাসে মঈনের জন্মদিন। আর এই মাসে শুরু হয় স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা। তারপর একই মাসে রেজাল্ট। মঈন ছাত্র হিসাবে মাঝারি মানের। দুইজন প্রাইভেট টিউটর ও প্রতিদিন কোচিং করার পরও তার পক্ষে শতকরা 65 ভাগের বেশি নম্বর তোলা সম্ভাব হয় না। মঈনের বাবা সিফাত রহমান একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন ।বাবার মাইনের একটা বড় অংশ খরচ হয় মঈনের লেখাপড়ার পিছনে । গতকাল মা মঈনের জন্মদিনের কথা তুলতেই বাবা খেকিঁয়ে উঠে জবাব দিয়েছিলেন, বেতনের অর্ধেক টাকা খরচ হয় তোমার ছেলের পিছনে, অথচ রেজাল্ট হচ্ছে ঘোড়ার ডিম । এখন আবার জন্মদিনের খরচ দিতে হবে । মা আর কথা বাড়াননি । বাবা যেটুকু বলেননি সেটুকু পুষিয়ে দেন মা । মঈনের বড় খালার ছেলের নাম তুষার ।সে ঢাকার একটি নামকরা স্কুলে পড়ে । ক্লাসের ফা্র্স্টবয় । মঈনের সমবয়সী। এই তুষারের জন্য পরোক্ষভাবে মঈনের জীবন বিষময় হয়ে উঠেছে । কারণ, মা থেকে শুরু করে মামারবাড়ির আত্নীয়-স্বজন সবাই তুষারের সাথে মঈনের তুলনা করে । মা কথায় কথায় বলেন, তুষার ক্লাসে প্রথম হতে পারে আর তুমি পার না । মাথায় গোবর ভরা । মা এবং বড় খালার মধ্যে বড় খালা অপেক্ষাকৃত বেশি সুন্দরী ছিলেন । তাই নিয়ে ছেলেবেলা থেকে দুই বোনের মধ্যে রেষারেষি ছিল । পরে সৌন্দর্যের গুণে বড় খালার সাথে ডাক্তার পাত্রের বিয়ে হয়। তখন থেকে অসম অর্থনৈতিক অবস্থানের জন্য দুই বোনের মধ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায় । বর্তমানে তারা সন্তানদের নিয়ে প্রতিযোগিতা করছেন । এর প্রভাব পড়ছে ছেলেমেয়েদের মধ্যেও। কে কার চেয়ে ভাল জামা পড়বে বা পড়ালেখায় এগিয়ে যাবে, এই নিয়ে তুমুল প্রতিদ্বন্ধিতা চলছে।
মঈন লেখাপড়ায় অমনোযোগী নয়। সে বেশ খেটেই লেখাপড়া করে । কিন্তু ভাল রেজাল্ট করার প্রতিযোগিতায় সে কেন যেন পিছিয়ে থাকে । বাড়ির মতো স্কুলের পরিবেশটাও যন্ত্রণাদায়ক । সেখানে ইদুঁর দৌড়ের মতো সারাক্ষণ পড়ার পিছনে ছুটতে হয় । ক্লাসে কারো সাথে বন্ধুত্ব করা যায় না । সবার সাথে সবার প্রতিযোগিতা । ছেলেরা পড়াশোনায় যারা ভাল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে মুখিয়ে থাকে । বাড়ি থেকে বাবা-মায়েরা বলে দেন ভাল ছাত্রদের সাথে মিশবার জন্য । এতে একদিকে যেমন স্ট্যাটাস বাড়ে, অন্যদিকে বুদ্ধিমান ছাত্ররা নিজেদের ভিতর কথা বললে তাদের বুদ্ধি আরো ক্ষুরধার হয় । তাছাড়া এই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটিতে অধিকাংশ ছেলেই বড়লোকের । মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মঈনের সাথে তারা কথা বলার মতো বিষয় খুজেঁ পায় না। এই তো সাজ্জাদ আর মারুফ ।দুইজন একই সাথে ঘোরে , একই সাথে বসে । ক্লাসের ফাকেঁ বসে গল্প করে । সেদিন পিছনে বসে মঈন শুনছিল তাদের কথা । ল্যান্ড রোভার না মর্সিডিজ কোন ব্র্যান্ডের গাড়ি ভাল তাই নিয়ে আলোচনা করছিল ওরা । গাড়ি তো দূরের কথা, মঈনদের বাসায় একটা কম্পিউটারও নেই । সজীব মঈনের পাশে বসে । মঈন তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে । কিন্তু কম্পিউটার গেমসের বাইরে সজীব আর কোনো বিষয়ে আগ্রহী নয় । মঈনের গল্পের বই পড়তে ভাল লাগে । বাসায় মহম্মদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন আর রূপকথার কিছু বই আছে । সে সেগুলো বার বার পড়েছে । কিন্তু, মা যখন রান্না করে আর বাবা অফিসে থাকে তখন মঈন এসব বই লুকিয়ে পড়ে । তাদের বাসার নিয়ম মতে, বই দুই প্রকার- পাঠ্যবই আর আউট বই ।বড় মামা বলেন ,পাঠ্যবই যত পড়া যায় ততো লাভ । বিশেষ করে ইংরেজি বই । চাকরির বাজারে ইংরেজি ছাড়া টেকা যায় না । বড় মামা যশোরে থাকেন । সেখানকার তিনি বড় ব্যবসায়ী । যে কয়দিন ঢাকায় আসেন মঈনদের বাসায় থাকেন । এই কয়টা দিন মঈনের কাটে ভয়ে ভয়ে । কারণ বড় মামার সাথে দেখা হলেই তিনি ইংরেজি ট্রান্সলেশন ধরেন আর অধিকাংশ সময় মঈন ভুল করে । তখন মায়ের মুখ অন্ধকার হয়ে যায় । বড় মামার আরেকটা বিষয় হল তিনি আউট বই পড়া একদম পছন্দ করেন না । তার বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। আরেক ছেলে ঢাকায় একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ে । তারা কখনও আউটবই পড়ে না । বড় মামার ছোট ছেলের নাম রাকিব । সে বড় খালার বাসায় থেকে পড়াশুনা করে আর সুইটির সাথে প্রেম করে । সুইটি বড় খালার একমাত্র মেয়ে । তার সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী । আত্নীয়-স্বজনরা বলাবলি করেন ,রাকিবের চোখ ঐ সম্পত্তির দিকে । এসব বিষয়ে মঈনের কোনো আগ্রহ নেই ।এর চেয়ে ক্রিকেট খেলা দেখা অনেক আনন্দের । মঈনের খুব ইচ্ছা করে ক্রিকেট খেলতে । কিন্তু ঢাকা শহরে শিশুদের জন্য খেলার মাঠের সংখ্যা খুব কম । স্কুলেও কোনো মাঠ নেই । মঈন তাই বাড়িতে বসে টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখে। অফিস ছুটি থাকলে বাবাও খেলা দেখতে বসে যান । যেদিন ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে খেলা থাকে সেই দিনটা মঈনের দারুন কাটে । বাবা ভারতের ভক্ত । খেলা দেখতে দেখতে মঈনকে বাবা বলেন , ধোনির ব্যাটিং দেখেছিস । একাই দলকে জিতিয়ে দিতে পারে । সেই সাথে সুন্দর উইকেট কিপিং । এই না হলে খেলোয়াড় । ভারত জিতলে উত্তেজনা আর আনন্দে বাবার মুখ জ্বল জ্বল করে । আর টিম ইন্ডিয় কোনো খেলায় হেরে যায় সেদিন বাবা মুষড়ে পড়েন । কেমন যেন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকান । মঈনের মনে হয়, বাবা জীবনের অপ্রাপ্তির বেদনাকে ক্রিকেট খেলা দেখার আড়ালে ঢেকে রাখতে চান । সিফাত সাহেবের জন্ম কুমিল্লা জেলার বন্ধক গ্রামে । বাবা জব্বার আলী ছিলেন কৃষক । ছয় ভাইবোনের মধ্যে সিফাতের অবস্থান তৃতীয় । জব্বার আলীর সামন্য জমি ছাড়া আর কোনো সম্বল ছিল না । তিনি ছিলেন পরিশ্রমী আর বুদ্ধিমান ।সময়টা আশির দশক । জব্বার আলী ভেবেছিলেন তিনি যদি একটি ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে পারেন তাহলে সে আমলা হতে পারবে । এই চাকরি পাবার সুবাদে তার পরিবারটি গ্রামের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে । সেই চিন্তা থেকে সিফাত রহমানের পড়াশুনা শুরু হয় । কিন্তু স্নাতক সন্মান শ্রেণীতে পড়ার সময় দাদা মারা যান ।মঈনের বড় চাচা ছোটবেলা থেকে অসুস্থ। তার খরচসহ সমগ্র পরিবারের হাল ধরতে হয় সিফাত রহমানকে । তার পক্ষে সন্মান শ্রেণীর পড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি । ডিগ্রী পাস করে শুরু হয় চাকরি খোজাঁর পালা । মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও সরকারি চাকরি তার কাছে অধরাই রয়ে যায় । এখন সিফাত রহমান একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন । এছাড়াও তাকে দুটো টিউশনি করতে হয় । সংসারের প্রয়োজনে উদায়াস্ত খাটতে থাকা সিফাত রহমানকে দেখে কে বলবে একদিন সে তরুণ ছিল । বন্ধুদের সাথে শচীন টেন্ডুলকারকে নিয়ে আলোচনা করত । কলেজের ফাংশনে গান গাইত। দেশ-সমাজ-রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাত । সবই দগ্ধ হয়ে গেছে সংসারের চুলোয় । জীবনের ঘানি টানতে টানতে সিফাত রহমানের কাছে বেচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাড়াঁয় তার ছেলে মঈন । মঈনকে ঘিরে তিনি মনে স্বপ্নবীজ বোনেন । ছেলে তার আশা পূরণ করবে । তার জীবনের অপ্রাপ্তিগুলোর পূর্ণতা দেবে মঈন । এইজন্য তিনি ছেলেকে সাধ্যমতো সবই দিয়েছেন । কিন্তু মঈনের রেজাল্ট আশানুরূপ নয় । আজ অফিসে বসে কাজ করতে করতে তার অনুশোচনা হচ্ছিল । ছেলেটার জন্মদিন, অথচ আজই তাকে বকলেন । অফিসের কাজে মন বসছিল না সিফাত সাহেবের । বার বার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছেন কখন ছুটি হবে । মনে অভিমান হয় মঈনের । কই সে তো বাবার কাছে কম্পিউটার দাবী করেনি । সাজ্জাদ বা তুষারের মতো বিলাসী জীবনও চায় নি । শুধু বাবা যদি তাকে একটু বুঝত । পরীক্ষার রেজাল্টের বাইরেও তো সে একজন মানুষ । বদ্ধ ঘরে বসে থেকে পড়া মুখস্থ করতে আর স্কুলে প্রতিযোগিতা করতে মঈনের আর ভাল লাগে না । বাবা বাড়ি ফিরলেন বেশ রাত করে । মা মঈনের জন্য পায়েস রান্না করেছেন । মঈন ছুয়েও দেখে নি । নিজের ঘরে চুপ করে শুয়ে ছিল সে । বাবা কাপড় না পাল্টে মঈনের ঘরে প্রবেশ করলেন । টেবিলের উপর রাখলেন মঈনের জন্মদিনের উপহার । সায়েন্স ফিকশনের তিনটি বই। মঈনের বিছানার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন , আমার উপর রাগ করেছিস ,খোকা । দেখ যে যুগ পড়েছে সেখানে ভাল রেজাল্ট না করলে কম্পিটিশনে টিকে থাকা যায় না । মঈন বলল, আমার প্রতিযোগিতা করতে ভাল লাগে না । তো কি করতে ভাল লাগে- জানি না । বাবা এবার মঈনকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, জীবনে কষ্ট করতে হয় ,বাবা । এই যে নয়টা থেকে পাচঁটা পর্যন্ত অফিস করি, দুটো টিউশনি করি সবই তোর জন্য । তুই যাতে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারিস । সমাজে দশ জনের মধ্যে একজন মঈন হতে পারবে কি না তা সে জানে না । তবে এই মূহুর্তে ক্লান্ত বাবা কে জড়িয়ে ধরে তার স্নেহটুকু পেতে মঈনের ভাল লাগছিল ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
জীবনের অপ্রাপ্তি আর বাবাার ভালবাসার গল্প ।
০৩ মার্চ - ২০১৯
গল্প/কবিতা:
৩৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“ ” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ , থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।