দীপশিখা

মা (মে ২০১৯)

Lubna Negar
  • ৩৭
আমি মধ্যবিত্ত ঘরের একজন সাধারণ মেয়ে i কালিদাসের শকুন্তলা বা রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য নই I অবশ্য এখন যুগ পাল্টে গেছে i সময়ের আবর্তনে রবি ঠাকুর বিস্মৃত একটি নাম I আমার শৈশব কেটেছে বিংশ শতাব্দির অন্তিম প্রান্তে i বাবা সরকারি চাকরি করতেন i ঢাকা শহরে মোহাম্মদপুরে তিন রুমের একটা কোয়ার্টারে আমরা থাকতাম i বাড়িটি তিন তলা i নিচের তলা আমাদের জন্য বরাদ্দi বাড়িতে মায়ের ঘরে একটা ক্যাসেট ছিল i আমাদের তখনও কম্পিউটারের সাথে পরিচয় হয় নি i তবে ড্রয়িং রুমে রঙীন টেলিভিশন ছিল। স্যাটেলাইট চ্যানেলের সুবাদে ততোদিনে আমরা ভারতীয় ফিল্ম স্টার মাধুরী কা জলদের চিনতে শুরু করেছি। আমরা চোলি কা পিছে- জাতীয় গান শুনে বড় হওয়া জেনারেশন।
আমার মা অন্যদের তুলনায় একটু ভিন্ন প্রকৃতির ছিলেন। ছেলেবেলায় নানীর মুখে গল্প শুনেছি, মেধাবী ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও কলেজে ওঠার পর মায়ের বিয়ে হয়ে যায়। শ্বশুড়বাড়ি এসে তার আর পড়ালেখা হয় নি। আমরা পর পর দুই বোন। অতঃপর বহুল প্রতীক্ষিত পুত্র সন্তান শুভর জন্ম। মা ঘরকন্নার সব কাজ নিজের হাতে করতেন। আমাদের সব ভাইবোনের প্রতি তিনি ছিলেন সমান স্নেহশীলা। সারাদিন কাজের শেষে দুপুরের পর মাকে একটু বিশ্রাম নিতে দেখতাম। শুনতে পেতাম, তখন তিনি ক্যাসেটে রবীন্দ্র সংগীত শুনছেন। পাশের ঘর থেকে একটা গানের কলি ভেসে আসত, এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়-
আমি আর বড় আপু বাড়ির কাছে একটা সাধারণমানের স্কুলে পড়তাম। লেখাপড়া নিয়ে প্রতিযোগিতার ঢেউ আমাদের স্কুলেও এসে লেগেছিল। রেজাল্ট ভালো করলে চাকরি পাওয়া যাবে, যার ফলে বিয়ের বাজারে ভালো পাত্র জুটবে – এই মন্ত্রে বড়রা আমাদের দীক্ষিত করতেন।
পাঠ্যবই পড়ে বেগম রোকেয়ার কথা জেনেছি। কিন্তু শুধু পরীক্ষায় পাস করার জন্য আমরা তার কথা পড়তাম।
দাদী-ফুফুর চিন্তাধানায় ছিল ধরাবাধা ছক। সতু অবশ্যই লেখাপড়া করবে । তারপর বড়জোর চাকরিও করতে পারে। কিন্তু, এই সমস্ত কাজের পেছনে মূখ্য উদ্দেশ্য হল বিয়ে। তাদের মতে, সংসার জীবন যাপন করা নারীর পরম ধর্ম। দাদী আর ফুফু যখন একসাথে বসতেন তখন তাদের আলোচনায় একটা আক্ষেপের সুর শুনতাম, মেয়েটা ফর্সা হল না । মাথায় চুলও ঘন হয়নি। পাশের বাড়ির তুলি ওরই সমবয়সী। অথচ, কি সুন্দর মোরব্বার আচার বানায়। মা আমাকে ডাকতেন কৃষ্ণকলি বলে। খুব কষ্ট হলে কাছে বসে বলতেন, মন খারাপ করিস না । আমাদের দেশের মেয়েরা এখনও প্রথার শৃংখলে বন্দী। তোর দাদী-ফুফুরা এদের থেকে ব্যতিক্রম নয়। লেখাপড়া মন দিয়ে কর । চেষ্টা কর স্বাবলম্বী হওয়ার ।
মায়ের রান্নার হাত ছিল অপূর্ব। পাশাপাশি তিনি সেলাইও করতেন । কিন্তু, এসব কিছু ছাপিয়ে মায়ের যে দিকটি আমাকে অবাক করে দিত , সেটা হল তার বই পড়ার অভ্যাস। আমাদের ড্রয়িং রুমে শোকেসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের রচনাবলীর পাশাপাশি ম্যাক্সিম গোর্কির মা গ্রন্থের মতো বইও তার সংগ্রহে ছিল। অবসর সময় মা বসে বই পড়তেন। মায়ের বই পড়ার অভ্যাস আমার মধ্যেও প্রভাব ফেলেছিল। ইতোমধ্যে পড়া হয়ে গিয়েছিল, বিভূতিভুষণ বন্দোপাধ্যায়ের পথের পাচাঁলি আর হোমারের অডিসি। অডিসিয়ূসের দুঃসাহসিক অভিযান আমাকে কল্পনাপ্রবণ করে তুলত। আমার মনে হতে শুরু করল, পাচঁ রকমের আচার বানাবার মধ্যেই শুধু মানুষের জীবনের সার্থকতা নিহিত থাকতে পারে না।
বড় আপা ছিল অপূর্ব সুন্দরী । দুধে আলতা গায়ের রং। দাদী বলেন, বড় আপা ছোট ফুফুর মতো দেখতে হয়েছে। আমার ছোটভাই শুভ লেখাপড়ায় খুব ভাল। বাবা ওর জন্য কোচিং ছাড়াও তিন জন প্রাইভেট টিউটর বরাদ্দ রেখেছেন। আত্নীয়-স্বজনরা বলেন, এই দুই ভাইবোন হল পরিবারের ভবিতব্য। বড় আপার ভাল বিয়ে হবে। আর শুভ চাকরি করে অনেক টাকা আয় করবে। অন্যদিকে, আমি শুধু কালোই নই অনেক চেষ্টার পরও ভাল রেজাল্ট করতে পারি না। এস. এস সি পরীক্ষায় জি পি এ-5 এর ছড়াছড়ি হলেও আমার ভাগ্যে সেটা জুটল না। রেজাল্ট হল অতি সাধারণমানের। বাবা বললেন, তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। সবাই একবাক্যে আশা ছেড়ে দিল। শুধু মা নিরাশ হলেন না। বললেন,হতাশ হতে নেই,মা । পৃথিবীতে কত মানুষ তো লড়াই করে বড় হয়। মায়ের সমর্থনেই সেদিন কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম।
এই সময় একটা ঘটনা ঘটল। বড় আপার সামনে এইচ. এস সি পরীক্ষা। আপা পরীক্ষা না দিয়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেলল। বাবা শুনে রেগে আগুন। আত্নীয়-স্বজনের কাছে মুখ দেখাবেন কি করে। পরে শোনা গেল ছেলেটি বুয়েটের ছাত্র । তখন আস্তে আস্তে সবাই ব্যপারটি মেনে নিল। ফুফু তো বড় আপার বুদ্ধির প্রসংশা করলেন-ইঞ্জিনিয়ার ছেলে কে শিকার হিসেবে ধরার জন্য। শুধু মা নিরব রইলেন। কোনো মন্তব্য করলেন না।
এইচ. এস সি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হল । বরাবরের মতোই আমার সাধারণ রেজাল্ট। আত্নীয়-স্বজনরা বলতে শুরু করলেন, ওকে পড়াবার দরকার নেই । বিয়ে দিয়ে দিলেই হয়। কালো মেয়ে। বয়স হয়ে গেলে পাত্র জুটবে না ।এবার বাবা ও তাদের মতে সায় দিলেন। আমার তখন বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না। আমার খুব ইচছা ছিল উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে । এই সময় মা আমার পাশে দাড়াঁলেন। আমার চির মৃদুভাষী মা বাবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করলেন । দৃঢ়ভাবে বললেন, সতুর যখন পড়ার ইচ্ছা তখন ও পড়বে। মায়ের অনুপ্রেরণায় কঠোর পরিশ্রম করে সেবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলাম।
এখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করি। দুই বছর আগে মা চির শান্তির কোলে আশ্রয় নিয়েছেন। আমার ছোটভাই শুভ এখন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ের পরই সে স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। তার সুরম্য ফ্ল্যাটে বাবা-মায়ের স্থান হয়নি। বড় আপা মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসে সম্পত্তির ভাগ চাইবার জন্য। মা মারা যাবার পর বাবার স্ট্রোক করে। তারপর থেকে তিনি শয্যাশায়ী। আমি তার দেখাশুনা করি। মাঝে মাঝে মায়ের কথা মনে হয়। মায়ের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন বেগম রোকেয়া। তাঁর মতো মহিয়সী নারীরা দীপশিখা জ্বেলে আমাদের দূর্গম পথকে আলোকিত করে গেছেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রণতূর্য ২ আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা মনে হলো।আসলে মায়ের কোন তুলনাই হয় না।ভোট ও শুভকামনা আপনার জন্য। আমার কবিতায় আমন্ত্রণ রইল।মন্তব্য করলে অনুপ্রানিত হবো।
মুহম্মদ মাসুদ বেশ ভালো লাগলো। আমার পাতায় আমন্ত্রণ রইলো।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

একটি মেয়ের চলার পথে মা কিভাবে ,সহযোগিতা করেন এবং তাকে অনুপ্রাণিত করেন তাই নিয়ে এই গল্প।

০৩ মার্চ - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ৩৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪