মিলান শহরের মাঝরাত। টকটকে লাল ওয়াইনের গ্লাস আর একটা জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসে ওয়াকার সিজার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শেক্সপিয়ার’ পড়ানো অধ্যাপক বাবার রাখা ‘সিজার’ নামটা বেশ মানিয়ে গেছে ইতালির মিলানে। এখানে তাকে একনামে চিনে অনেকে। শুধু ইতালি কেন, ইউরোপজুড়ে তার নামডাক। তার তোলা ফটোগ্রাফি, আঁকা চিত্রকর্ম বিক্রি হয় কড়কড়ে ইউরোতে। তার লেখা সমালোচনার জন্য মুখিয়ে থাকে তরুণ শিল্পীরা। জাদুঘর বা চিত্র একাডেমীতে দেওয়া বক্তৃতা বোদ্ধাদের কাছে যাকে বলে ‘হট কেক’।
মাঝরাত মানে সিজারের দিন শুরু। অন্যান্য অনেক শিল্পীদের তুলনায় তিনি এখানে ব্যতিক্রম। রাত দশটায় তার বিছানায় যাওয়া চাইই। তিনটা থেকে সাড়ে তিনটায় আবার তিনি জেগে উঠবেন। ছোটবেলার অভ্যেস। তার দাদু ছিলেন ব্রিটিশ আমলের তুখোড় রাজনীতিবিদ। ছোটবেলায় নাতি ঘুমাতো দাদুর সাথেই। তিনটা বাজে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ার উপলক্ষে জেগে উঠার অভ্যাস সংক্রমিত হয় সিজারের মধ্যে। জীবনে কোনদিন ভোরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা হয়নি তার। বিশ্বাস, জীবনযাত্রা, ঠিকানা পাল্টেছে তার। অনেক অভ্যাসও বদলে গেছে। কিন্তু মাঝরাতে ওঠা ঢুকে গেছে জীনে।
তার সামনে বেশ কিছু ফটোগ্রাফি। তিনি বিচারক। ছবি এসেছে সারা পৃথিবী থেকে। বেশ কিছু জনরা ছিল। ‘পিছুটান’ বিষয়ের উপর তোলা ছবিগুলো এসেছে তার মেইলে। তিনি বসেছেন আঁটসাঁট বেঁধে। বিচারক হিসেবে তিনি খুব কড়া, খুঁতখুঁতে আর ‘পারফেকশনিসট’। এটা তারও পরীক্ষা। প্রথম দুইটা ছবি পেয়েছে যথাক্রমে দশে সাড়ে পাঁচ আর তিন করে। তাকে খুশি করা মুশকিল। তৃতীয় ছবিটা মনিটরে ভাসতেই তার ভুরু কুঁচকে যায়। বিরক্তি ভর করে মুখে। নদী, ধানক্ষেত, লুঙ্গিপরা কৃষক, খেতের আইলে বসে নামাজ পড়ছে। এই দৃশ্য পৃথিবীর একটি দেশেই পাওয়া যায়। সিজারের ইচ্ছে করে নম্বরের ঘরে একটা বড় শূন্য বসিয়ে দিতে।
ওয়াকার সিজার এখন বিচারক। তার অধিকার নেই কোন পক্ষপাতিত্ব কিংবা অন্যায় বিচার করার। তাহলে কী আর পার্থক্য থাকে তার আর শিল্পকলার সেই কর্তার? নিজেকে সংযত করেন তিনি। মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলোর কথা। চারুকলা থেকে মাত্রই পাশ করেছে সে। বিভাগে সবচেয়ে বেশি নম্বরও তার। দেশের নামকরা চিত্রশিল্পী সাইদ হুদা তার শিক্ষক। তখন সে পুরোদস্তুর চিত্র আঁকিয়ে। ফটোগ্রাফির নামও শুনেনি। হুদা স্যার নিজে বলেছিলেন শিল্পকলা একাডেমীতে চাকরি হয়ে যাবে। পরেরদিন দেখা করতে। জীবনযুদ্ধে প্রথম হোঁচট খাওয়া সিজার জানতে পারেন, ‘মামা’ থাকলে ঢাকা শহরে পদার্থ বিজ্ঞানে পাশ করা ছেলেও প্রধান চিত্র সংগ্রাহক পদে চাকরি পেয়ে যেতে পারে।
ওয়াইনের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে সিজার ছবিটা জুম করেন। বিকেল বেলার দৃশ্য। নদীতে একটা লঞ্চ। বিয়ের সাজে সেজেছে। বাংলাদেশে এখনও নদীপথে বিয়ের আয়োজন হয়? আরেকটু জুম করতে বিয়ের কনেকেও দেখা যাচ্ছে। তাকিয়ে আছে পিছন দিকে। সে কারও কথা ভাবছে? সুমি’র মত? বেকার সিজার যখন দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছিল চাকরির জন্য, আর হেরে যাচ্ছিল প্রতিদিনের যুদ্ধে, তেমন একদিন বিকেলে শেষ দেখা হয়েছিল সুমি’র সাথে। বিয়েটা আর আটকাতে পারেনি মেয়েটা। আয়কর বিভাগের জাঁদরেল সেই অফিসার যখন সেদিন সুমি’কে বউ করে নিয়ে গিয়েছিল, এই লঞ্চের মেয়েটার মত এমন পিছনে তাকিয়েছিল সে? পিছুটান ছিল কিছু তার?
সিজার এখন মন দিয়ে দেখছেন রঙের খেলা। আকাশের নীল, নদীর ধূসর, মাঠের সবুজ মিলে চমৎকার এক ছবি। ছেলেবেলায় গ্রামে যাওয়া হতো শুধু দুই ঈদে। রঙের সাথে প্রেম সেখান থেকেই। বড় হয়ে কয়েকবার তাকে গ্রামে যেতে হয়েছে। সমস্যাটা হয়েছিল ঠিকানায়। শহরে বড় হলেও তার স্থায়ি ঠিকানা ছিল গ্রামে। পাসপোর্ট করতে গিয়ে জানল সে, তাকে গ্রামে যেতে হবে। ‘ভেরিফিকেশন’ নামের সরকারি ঘুষের মারপ্যাঁচে তার ঝামেলা বাঁধে পুলিশের সাথে। শুধু পাসপোর্টই নয়, লিখিত আর মৌখিকে উত্তীর্ণ হওয়া বিসিএস’টা ভেস্তে যায় তার ‘দুশ্চরিত্রে’র জন্য।
ছবির ঠিক কেন্দ্রেই নামাজের আসনে বসা এক কৃষক। পিছনে দাঁড়িয়ে একটা ছোট ছেলে। লোকটা তার বাবা না হয়ে যায় না। তার হাতে কি? একটু মুড়ি কিংবা গুড়? নামাজ হলে কৃষকটা ছেলেকে কোলে তুলে নিবেন? ছেলেকে কোলে নেওয়ার অনুভূতি জানা নেই সিজারের। সন্তান নেওয়া হয়ে উঠেনি এই বিভূঁইয়ে। তবে অন্য একটা অভিজ্ঞতা আছে তার। ঢাকা তখন উত্তাল। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। তার বাবা নিয়মিত কলাম লিখতেন পত্রিকায়। ছাপতে হলে কাটছাঁট করতে হতো। এর পরেও শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূল হতে হয় তাকে। রাজপথে সেই হরতালের দুপুরে তাই যেন তার উপরেই আছড়ে পড়ে সন্ত্রাসীদের দল। পিতার মৃতদেহের খাটিয়া যেন ছিল এক পাহাড় ভারের। পৃথিবীটা খুব খালি খালি মনে হচ্ছিল তার। কানাডায় রাজনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে ভিসাটাও হয়ে যায় এভাবে। এরপর বৃত্তি, ফটোগ্রাফি শেখা। এর পরেরটা ইতিহাস।
সিজার মনিটর থেকে উঠে আসেন জানালায়। বাইরে বরফ পড়ছে নাকি? অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছেনা ঠিক। বরফ পড়ায় শব্দ হয়না। ঠিক যেমন গন্ধ হয়না হৃদয় পোড়ায়। তিনি তো দেশকে দূরে ঠেলে দিতে চাননি। দেশে গণতন্ত্র আসে। তিনি আবার আসেন তার মাতৃভূমিতে। মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে তিনি একটা আর্ট ফার্ম গড়ে তুলেছিলেন। তথ্য, সংস্কৃতি, পররাষ্ট্র, অর্থ আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দরজা তার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। তিনি যাওয়ার আগেই চাউর হয়ে যেত, এটা ‘ফরেন মাল’। পকেট নিংড়ে ফাঁকা করে দিয়েছিল তাকে রাষ্ট্রের ভৃত্যরা। সাথে ছিল বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের চাঁদাবাজি। একদিন মুখথুবড়ে পড়ে তার ফার্ম। কয়েক সপ্তাহ ড্রয়ারে পড়ে থাকা বার্লিন থেকে আসা সেই থিসিসের অফারটা আর অবহেলা করতে পারেননি সিজার।
এরপর থেকেই ‘বাংলাদেশ’ নামটার সাথে তার নিশ্চুপ অসহযোগ। মা চলে গিয়েছিলেন বাবার আগেই। আর তার কিসের পিছুটান। বাবা নামটা ভালোই রেখে গিয়েছিলেন। চট করে কেও বাঙালি ভাবতে পারে না। ইউরোপের যেখানেই বাঙালির আনাগোনা সেখান থেকে তার প্রস্থান। নাগরিকত্ব বদলে গেছে অনেক আগেই। এখন তিনি বিশ্ব নাগরিক। ফেসবুকে পর্যন্ত কোন স্বজাতি বন্ধু নেই। যেই সাইটে এই দেশটার উল্লেখ সেটাতেই তার ব্লক।
আবার তিনি বসেন মনিটরে। কৃষকের চেহারাটা কি আরেকটু জুম করা যায়? লোকটা কি দাদুর মত দেখতে? চমকে উঠেন সিজার। পিছনে তার বাবা? ছোটবেলার বাবা? তার পিছনে এই মনিটরে তাকিয়ে সিজার। মিলানের এই ঘরটাতে কেমন যেন গন্ধ আসছে। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছেন সিজার। পাকা ধান থেকে এমন সোঁদা গন্ধ হয়। মাথা ভোঁভোঁ করছে সিজারের। লঞ্চের হুইসেলের শব্দ আসছে না? ইউরোপের দামি ক্রুজ নয়, বাংলার কালো ধোঁয়া ছাড়া সস্তা লঞ্চ। মনিটর নড়েচড়ে উঠে। দাদুর নামাজ শেষ। তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। পিছনের ছেলেটা এসে জড়িয়ে ধরেছে গলা।
‘দাদু ভাই, কই গেলা? আসবা না দাদুর কাছে? দেশের মাটিতে খালি পায়ে হাঁটুম আমরা। এই মাটি তোমার মায়ের মতন। সাত রাজার ধন মানিক। তোমার গর্ব। তোমার অহংকার। এই মাটি ছাইড়া কেও সুখে থাকতে পারে, বোকা’!
ওয়াকার সিজার ঘামছেন দরদর করে। ‘বিচার করা’ তার লাটে উঠেছে। ‘পিছুটান’ নামের ট্রোজান হামলা করেছে মস্তিষ্কের অলিতে গলিতে। জাইরাসে জাইরাসে। তিনি ভুলতে বসেছেন তার ক্ষোভ, হতাশা আর জমিয়ে রাখা ঘৃণা। হেরে যাচ্ছেন নিজের কাছে।
অথচ, মিলানে বসে তিনি এই পরাজয়কে উপভোগ করছেন তারিয়ে তারিয়ে।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
স্বদেশকে নিয়ে শুধু রোমান্টিসিজম অন্ধপ্রেম নয়, বাস্তবের পৃথিবীতে হোঁচট খাওয়া কারও কারও থাকে ক্ষোভ, বিরক্তি এমনকি ঘৃণা। দেশকে দূরে ফেলে দিতে চায় সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসলেই কি পারে। তেমন একজনের কাছে মিশ্র অনুভূতির গল্প 'পিছুটান'। 'আমার দেশ আমার অহংকার' বিষয়টা এসেছে প্রাসঙ্গিক কিন্তু প্রচ্ছন্ন হয়ে।
২৩ সেপ্টেম্বর - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
৪২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪