খড়িয়া বাজার সোমবারের হাটে মধু পাগলা বিষের বেসাতি করে। ‘ইন্দুর, তেউলাপোকা কোন ছাড়, আড়াই মণি জব্বর পালোয়ান হইবে সাবাড়’। এই বিজ্ঞাপন শুনে ছেলে ছোকরার দল জড়ো হতে থাকে। বিষ বিক্রি হয় সামান্যই। গত বকরি ঈদের দুই সোমবার পরে যেমন ক্রেতা ছিল মাত্র একজন। হাট জমার আগেই দুপ্তারার সালেক মিয়ার ছোট মেয়ে সালেনূর সালোয়ারের খুট থেকে অতিসন্তর্পণে দশ টাকার একটা নোট বের করে বলেছিল, ‘কাকু, এক পোটলা বিষ দেও। ইন্দুর মরবতো’?
লালমাটিয়ার ছোট ফ্ল্যাটটায় দুইটা মাত্র থাকার ঘর। সালেনূর অবশ্য থাকে রান্নাঘরে। তিনবেলা খাওয়া আর মাসে তিনহাজার টাকা। এই চুক্তিতে এসেছে সে। ‘মামা, কাম কিছুই নাই। সাহেব ডেভেলপার আর ম্যাডাম পার্লারের ব্যবসা করে। দুই পোলা থাকে দার্জিলিং, মানে ইন্ডিয়া। একটা পড়ে কলেজে, আরেকটা স্কুলে। তোমার মাইয়া দুইটা বাসন মাজব, ঝাড় দিব, রান্না করব, টিভি ছাইড়া সিরিয়াল দেখব আর পেট ভইরা খাইয়া চেগাইয়া ঘুম দিব। তুমি কইলে কাইলই দিয়া আহি’। বাবা শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ডেভেলপার কি জিনিস মত্তিন’? সেই ডেভেলপারের ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে শুয়ে কামিজের ভেতর থেকে সালেনূর বিষের প্যাকেটটা নেড়েচেড়ে দেখে।
দুই ঘণ্টা পর। সালেনূর ঘামছে দরদর করে। গরমে ওড়নাটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। এই বাসায় অবশ্য ওড়নাটা না থাকলে ম্যাডাম ভয়ঙ্কর রাগ করে। স্যার রাগ করে ওড়না থাকলে। এক টান দিয়ে কাপড়ের বস্তুটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে তারপর তার কথা শুরু হয়। এখন অবশ্য ওড়নাটা না পরলেও চলে। জীবিত কেও কি ফ্ল্যাটে আছে? আজ বৃহস্পতিবার রাত। এই রাতে সাহেবের বন্ধুদের পার্টি বসে। লাল-নীল জলের ফোয়ারা বসে। ম্যাডামই গ্লাসে গ্লাসে ঢেলে দেয় মদিরা। আজ সাথে ছিল মুরগি ভাজা। সালেনূর অনেক যত্ন করে ভেজেছে এসব। রুটিন তার মুখস্ত। অতিথিরা যাবে দেড়টার দিকে। স্বামী স্ত্রী ড্রয়িং রুমে থাকবে আরও মিনিক কুড়ি। একজন আরেকজনকে অশ্রাব্য গালাগালি করবে। হাতে থাকবে মদের গ্লাস। সালেনূর হয়ত এসে গ্লাস ভরে দেবে। একসময় অচেতন পড়ে থাকবে দম্পতি। ফ্রিজ থেকে একটা মদের বোতলে আজ আগেই বিষ মিশিয়ে রেখেছে সালেনূর। আলাদা একটা বোতল। অর্ধচেতন অবস্থায় স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ কি ধরা পড়ে? সালেনূর তাই ভাবে, বেঁচে নেই কেও আর। নাকি সে স্বপ্ন দেখছে? দুটো মানুষ হত্যা করে ফেলেছে একা সে, বিষয়টা খুব বিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না।
খুব অস্থির লাগছে। দরজা খুললেই নিশ্চিত হওয়া যায় কিন্তু ভয় করছে খুব। ছোটবেলায় একবার বিষ খাওয়া মানুষ দেখেছিল সালেনূর। মুখভরতি ফেনা, মল-মূত্রে একাকার আর ঘামে ভেজা শরীর। দেখে ছোটরা বমি করে দিয়েছিল। বড়রাও অনেকে। সালেনূর ছোটই ছিল, কিন্তু সে তাকিয়েছিল নির্বিকার। দেশের আইনে এখনও সে ছোট, মানে শিশু। তবে ষোল বছরের মেয়ে শিশুটাকে সাহেব নিংড়ে দিত যুবতীর মতোই। আর ম্যাডাম যে কত চড়, ঘুষি আর লাথি মেরেছে, তাও মনে রেখেছে এই শিশু। তবে এর জন্য অবশ্য খুন করেনি তাকে। সাহেবের কুকর্ম কি তিনি কিছুই জানতেন না? বাধা তিনি দিয়েছেন কোনদিন? নাকি তারও কোন দুর্বলতা ছিল? সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে, আর কলা গাছও ডুবে যেতে পারে।
দাঁড়িয়ে দরজা খুলবে এমন সময় নিজে থেকে খুলে যায় ওটা। ম্যাডাম দাঁড়িয়ে হাসছেন। মুখ-ভরতি ফেনা, ঘামে ভেজা শরীর, অবিন্যস্ত চুল আর একটা সুতোও নেই শরীরে। ‘সালুনি, ও সালুনি, কি বিষ দিয়েছিলি মাগি? বিষটা এত টক আর ইঁদুর ইঁদুর গন্ধ। মদটা পেটে যেতেই সব গুলিয়ে উঠেছিল। এই এতোগুলো বমি করে দিয়েছি ড্রয়িং রুমে। আয় দেখে যা, বাম দিকের বড় সোফাটার হাতল ঘেঁষে এখনও লেগে আছে বমি। বমি তে কি আছে জানিস, হারামজাদি? মদ, মুরগি ভাজা, বাদাম, চিপস, সবজি ভাজা, ভাত, বীর্য, সব মেখে আছে। তোর হাতে সব পরিস্কার করব, না না চাটাবো। আয় মাগি, বমি চাটবি আয়। এই এসোতো, চুল ধরে টেনে নিয়ে যাও বজ্জাতিটাকে’।
সাহেবকে দেখে ভয়ে কাঁপতে থাকে সালেনূর। নগ্ন দেহ শুধু নয়, এক রাতেই যেন আঙুলের নখগুলো হয়ে গেছে কুকুরের মত। চোখ দুটো জ্বলছে যেন ভূতের সিনেমার কোন দৈত্য। সালেনূরের ঘাড় বাঁকা হয়ে যাচ্ছে, হাত-পা খিচুনি’র মত তড়পাচ্ছে। সাহেব এসে ধপ করে হাত বসিয়ে দিল কামিজের বাঁ দিকটায়। বাম স্তনে ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে সালেনূর। অথচ কোন বাধা দিতে পারছেনা সে। হাত, পা, এমনকি মুখ, যে মুখ দিয়ে এক খাবলা থুথু মেরেছিল সাহেবের মুখে, যেদিন প্রথমবার ধর্ষিত হয় সে, তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। টেনে টেনে সব জামা ছিঁড়ে নিল সাহেব, কিংবা সাহেবের ভূত। অনেক ভূতের গল্প শুনেছে সালেনূর। ছায়া ভূত, কঙ্কাল ভূত, ধোঁয়া ভূত। মানুষরূপী ভূত হয় নাকি? নাকি ওরা ভূত নয়? বিষের প্রভাবে মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যাওয়া জলজ্যান্ত মানুষ। মানুষ কি ভূতের চেয়ে ভয়ঙ্কর হতে পারে? একটা সময় সালেনূর অনুভব করে তার দৃষ্টি ফিকে হয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখা পেশাব উরু বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। স্তনে, ঠোঁটে, যোনিতে প্রচণ্ড আঘাতের ব্যথা কমে আসছে। তার কি ঘুম পাচ্ছে? নাকি জ্ঞান হারাচ্ছে সে?
শুক্রবার সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে। আজানের শব্দে ঘুম ভাঙে গৃহকর্ত্রীর। ফজর নয়, জুমার আজানে। দরজা খুলতেই মেজাজ বিগড়ে যায় তার। রাতে পান করা মদের ‘হ্যাং-ওভার’ কেটে যায় এক মুহূর্তেই। ড্রয়িং রুম অগোছালো পড়ে আছে। এদিক সেদিক ময়লা। টেবিলে উচ্ছিষ্ট সরানো হয়নি। রাগে গজগজ করতে করতে রান্না ঘরে ঢুকেই আঁতকে ওঠেন ভদ্রমহিলা। চিৎকার করে স্বামীকে ডাকতে গিয়ে দেখেন ভয়ে গলা থেকে শব্দ বের হচ্ছেনা। দৌড়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঘুমন্ত স্বামীর চুল ধরে টানতে থাকেন ম্যাডাম।
‘ওঠ, কুত্তার বাচ্চা ওঠ। লুইচ্চচা কি করেছিস রাতে’? সাহেব কিছু বুঝে ওঠার আগে ঠাস করে চড় মেরে বসেন স্ত্রীর গালে।
‘তোর জ্বালায় ঘুমুতেও পারব না? তোর বাপ মরছে, না মা মরছে’?
‘বাপ মরলেতো ভালোই হত। তুই কি করেছিস রাতে’?
‘কি করেছি মানে, তোমার সাথেই তো মাল গিললাম। এখন আবার কি হল’?
‘তুই সালুনি’র ঘরে যাস নি? মাগিটার সাথে আবার শুয়েছিলি তুই? তোকে তো ডিভোর্স আমি করবোই, এখন মার্ডারের মামলাও সামলা কুত্তার বাচ্চা’।
‘মার্ডার? কীসের মার্ডার? কে মরেছে’?
‘রান্না ঘরে গিয়ে দেখে আয়। তোর মা মরে পড়ে আছে মেঝেতে। খুন করতে গেলি কেন হারামজাদা’?
সাহেব দৌড়ে যায় সেই ঘরে। চিৎকার করে ডাকে স্ত্রীকে।
‘আমি কাল আসিনি এই ঘরে। কিছু করিনি ওর সাথে। তুই ওকে খুন করেছিস। এখন কি হবে’?
‘আমি খুন করব কেন? আর জামা কে খুলেছে, আমি? ঠোঁটে, বুকে, নিচে কে রক্তাক্ত করেছে, আমি? ইউ ব্লাডি পারভার্ট। আমি এক্ষুনি ফোন দিচ্ছি পুলিশকে’।
‘তুমি বিশ্বাস কর, আমি আগে তিনবার ওকে ধর্ষণ করেছি, বাট নট অ্যাট লাস্ট নাইট। একটু মাথা ঠাণ্ডা কর। কাল রুমে এসেছিল নাসির, রুম্মান আর জিকো। ওদের মধ্যে কেও’?
‘ওদের বিদেয় করেই আমরা শুতে গিয়েছি। তোমার আর মিথ্যে বলতে হবেনা। পোস্ট-মর্টেম করলেই বোঝা যাবে ভ্যাজাইনাতে কার স্পার্ম। আচ্ছা দেখতো, এটা কীসের প্যাকেট’।
‘হীরা মার্কা কীটনাশক। ইঁদুর, তেলাপোকা’র যম। বিষ? বিষের প্যাকেট? এটা খেয়ে আত্মহত্যা করেছে’?
‘আত্মহত্যা কেও ন্যাংটো হয়ে করে? নিজেই সারা শরীরে খামছে খামছে? অবশ্য, একটা ব্যাপার...’
চোখের পাতা নড়ছে না কারও।
‘ও’র মা যখন দিতে এসেছিল ওকে একটা কথা বলেছিল’।
‘কি, কি বলেছিল’?
‘মেয়েটার খিঁচুনি, মানে মৃগী রোগ আছে। হাসপাতালে ভর্তিও হয়েছিল ছোটবেলায়, কয়েকবার। নিয়মিত ওষুধও নাকি খেত। ও’র মা বলেছিল, আমরা যেন মারধোর না করি। মানসিক চাপ, উত্তেজনায় নাকি আবার হতে পারে এমন। তাহলে কি কাল আবার খিঁচুনি হয়েছিল’?
‘হ্যা’।
‘তাই হবে। কিন্তু তুমি এতটা নিশ্চিত হলে কিভাবে’?
সাহেব নির্বিকার ড্রয়িং রুমে চলে আসেন। সিগারেটের কাঠিতে একটা বড় টান দিয়ে ধোঁয়ায় ভরিয়ে দেন চারপাশ।
‘পোস্ট-মর্টেম হবে বোঝাই যাচ্ছে। স্পার্ম কিন্তু পাওয়া যাবেনা। এর আগেই তো খিঁচুনি শুরু হয়ে গিয়েছিল’।
‘মানে, রাতে তুমি গিয়েছিলে রেইপ করতে’।
‘আমি তো আর জানতাম না এই মৃগী রোগের কথা। তাই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তুমি হাতে গ্লভস পরে জামা পরিয়ে দাও। খিঁচুনি হয়ে নিজের শরীর নিজে খামচেছে। এমন আগেও হয়েছে। গ্রাম থেকে টাকা দিলেই পড়শি সাক্ষী পাওয়া যাবে। পুলিশ, মিডিয়া আমার হাতে আছে। আত্মহত্যার মামলায় তেমন কিছুই হবেনা আমাদের, আই প্রমিজ’।
ধর্ষক স্বামী’র জন্য ঘৃণার চেয়ে প্রত্যুৎপন্নমতি স্বামী’র জন্য গর্ব ঠিকরে বেরোয় ম্যাডামের চোখ থেকে।
কিছু ভদ্র মুখোশধারী মানুষের মনের কদর্যতা, নোংরামি আর অশ্লীলতা ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি এই গল্পে। অসহায় মানুষের এই অশ্লীলতার কাছে পরাজয়ের গল্প 'অশরীরী'।