তাড়া

ভাঙ্গা মন (নভেম্বর ২০১৯)

Ahad Adnan
  • ৬৪
স্টকহোমে এই সময়টা বরফে ডুবে থাকে। এমনিতে ঠাণ্ডার দেশ, এখন যেন বাতাসে তরল নাইট্রোজেন ভাসছে। মানুষগুলোও এই শীতল আবহাওয়ার মত। রুক্ষ, নিস্প্রাণ। এই দেশের লোকদের মনে হয় যন্ত্র, রোবট যেন একেকটা। মন নেই, হৃদয় নেই। তাই বুঝি মন ভাঙার কষ্টটাও নেই। ধীরে ধীরে আমিও যান্ত্রিক সুইডিশ হওয়ার চেষ্টা করছি।
ফোনটা বেজেই চলেছে। ইমোতে মা কল করছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। শীতে এখানে সবার মেজাজ বিগড়ে থাকে। আমার অবশ্য ‘মন’টা উড়ুউড়ু করছে। ধ্যাত, গেঁয়ো ‘মন’ জিনিসটা থেকে বের হতে পারছিনা। আজকের পর অনেকটাই পারব মনে হচ্ছে। এই দেশে এসেছি ছয়মাস হয়ে গেছে। এই একশ আশিটা দিনে আমি অনেক আধুনিক হয়ে উঠেছি। আমি এখন যখন তখন হাসি না, দেশে ফোন দিই না, দেশ থেকে মা-বাবা ফোন করলে একবারে ধরি না। হাত দিয়ে খেতে এখন ঘেন্না লাগে আমার। আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে অবাঙালি বাড়ছে। দেশের কারও পোষ্টে লাইক, কমেন্টও করিনা আজকাল। অনেককে তো আনফ্রেন্ডই করে দিয়েছি। দেশে থাকতে আমাকেও খুব কাছের একজন প্রথমে আনফ্রেন্ড, পরে ব্লক করে দিয়েছিল। মনটা ভেঙে গুড়োগুড়ো হয়ে গিয়েছিল। আমার এখন অভিযোজন চলছে। প্রক্রিয়াটা শেষ হলেই বেঁচে যাই। তখন আমার কোন মন থাকবে না। আর কেও মন ভাঙতে পারবে না আমার।
রুম-হিটার চলছে পুরোদমে। বাইরে তাপমাত্রা মাইনাস আঠেরো, ভেতরে প্লাস আঠেরো। আমি একটার পর একটা পুশ-আপ করে যাচ্ছি আর ঘামছি দরদর করে। আটানব্বই, নেরানব্বই, একশ। চিকন মেয়েলি কণ্ঠে গান ভেসে আসছে। ক্যারিবিয়ান সুর। অনেকটা কুমার বিশ্বজিতের ‘বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে’র মত লাগছে। জেনিফার মেক্সিকোর মেয়ে। কণ্ঠটা মিষ্টি নয় মোটেও। এই শহরে কোকিল নেই, কোকিলকণ্ঠীও নেই।
ফোনটা বেজেই চলেছে। কেও কি অসুস্থ? নাকি কোন এক্সিডেন্ট? যাকগে, আমি ডাক্তারও না, পুলিশও না। দেশের ফোন ধরে মুড খারাপ করার কোন মানে নেই। শাওয়ারের শব্দ আর গান দুইটাই থেমে গেছে। জেনিফারকে একটা নাইটি গিফট করেছি, টকটকে লাল। শ্যামলা মেয়েটাকে গোসলের পর লাল জামায় পরী’র মত লাগবে। আবার ভুল করলাম। এই শহরে পরী নেই। পরী থাকে ঢাকায়। ভার্সিটিতে পড়ে। রিকশায় বসে হাত ধরে থাকে। ঝড়ের দিনে হুড তোলা আড়ালে চুমু দিলে কপট রাগ করে। সেই পরীকে নিয়ে একদিন আমি ঘর বাঁধি। তারপর একদিন সে আমার মন ভেঙে দিয়ে চলে যায়। স্টকহোম খুব নিশ্চিন্ত শহর। এই শহরে কোন পরী নেই।
জেনিফারকে দেখে আমার মুখ হা হয়ে যায়। মাথা নিচু করে ফেলি। বাঙালি ছেলের বোকামি দেখে হেসে ফেলে মেয়েটা। তিনমাসের মেলামেশার (প্রেম শব্দটার অপমান করা উচিত হবে না) পর আজ আমরা একটা বদ্ধ কামরায় আটকে আছি। মন বলে কিছু নেই। শরীরটাই সব। এই রকম বদ্ধ কামরায় আরেকবার আটকে গিয়েছিলাম এক পরী’র সাথে। আলেকজান্ডারের মত বিপুল বিক্রমে হুঙ্কার দিয়ে রেখেছিলাম বিয়ের কয়েকমাস আগে থেকে। অথচ সেই রাতেও আমি মাথা নিচু করে ফেলেছিলাম। পরী বলেছিল, ‘আহারে, বাবু লজ্জা পেয়েছে’। জেনিফার বলল, ‘সো সুইট’।
আমরা দুইজন এখন এক চাদরের নিচে। আমার হাত খেলা করছে বাদামি চুলের বাগানে। এভাবে বিলি কেটে দিলে ঘুমিয়ে যেত পরী। জেনিফার ঘুমিয়ে গেলে অবশ্য বিপদ। নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাই অবাঙালি মেয়েটাকে। ও কিছু না বুঝেই মুগ্ধ হওয়ার ভান করে।

“আমরা তখন কলম্বাস, হাত ছুঁয়ে দেখি আদিম আদ্র নির্জনতম দ্বীপের শিখর,
আমরা তখন পানামের ইটে মাখামাখি জড়ানো শতবর্ষী বটের শিকড়।
আমরা তখন পতাকা সাজি, সবুজ আমার বুকে গুটিসুটি মারা তুমি এক লাল,
আমরা তখন ব্যাস্ত জীবন তুড়ি মেরে উড়ানো আলসে প্রেমের অবেলার কাকতাল”।

‘হোয়াট দ্যা হেল হ্যাজ বিন ভাইব্রেটিং আন্ডার ইয়োর পিলো’ বলেই বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করল জেনিফার। ‘ওহ, ইটস ইয়োর মম। জাস্ট পিক ইট আপ বেবি। ইট কুড বি সামথিং ভেরি আর্জেন্ট। অ্যাম নট লিভিং, বাই দ্যা ওয়ে’। অগত্যা ধরতেই হল ফোনটা। ‘শুভ, আজ তোর হলিডে, ভেবেছি বাসায় আছিস তাই ফোন করলাম। ঘুমিয়ে ছিলি বুঝি। আমাদের টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে। মগবাজারে বাসের ধাক্কায় একটা সিএনজি দুমড়ে মুচড়ে গেছে। ভেতরে মা, মেয়ে দুইজনেই স্পট ডেথ। সুমি, শশী আর নেইরে বাবা’। বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন মা। ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড? আর ইউ ক্রাইং’? আমি চোখে হাত দিয়ে দেখি জল। অশ্রু জিনিসটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। এতদিনের জমানো অশ্রু আমি আর আটকে রাখতে পারছিনা। অথচ জেনিফারকে দেখাতেও পারবনা। আমার একটা মন আছে কিংবা ছিল, ভাঙা মন, এই সত্যটা জানতে দেবনা কাওকে।
স্টকহোমের মাইনাস আঠেরোর বরফে ঢাকা পথে আমি দৌড়াচ্ছি। পিছনে তাড়া করছে আমার অতীত। আমার সন্দেহ ভরা সংসার, যান্ত্রিক মিলনের রাত, একে অন্যের পরকিয়া’র অস্তিত্ব আবিষ্কারের সম্ভাবনা, ঝগড়া, সন্তান, সব ঠিক হয়ে যাওয়ার মিথ্যা সান্ত্বনা, আবার ঝগড়া, তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ, মামলা, ডিভোর্স। শুধু একটা চাদরে জড়ানো জেনিফার অবাক চিৎকার করে দেখল আমি বের হয়ে যাচ্ছি। অপরাধবোধ আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। ‘আমাকে ক্ষমা করে দিও সুমি’ চিৎকার করতে করতে আমি ছুটছি। আমার চোখে শ্রাবণধারা। বুকে চৈত্রের আগুন। মনের মধ্যে কালবৈশাখী ঝড়। বুকের বা দিকটা চিনচিন ব্যথা করছে। ডাক্তার বলে এখানে হৃদপিন্ড নামে একটা মাংসপিন্ড থাকে। বোকা আমি জানি এখানে মন থাকে। এখন সেখানে হাতুড়ি শাবলের শব্দ হচ্ছে। কে যেন ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে এই মনটা আমার।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নাজমুল হুসাইন আমরা তখন ব্যাস্ত জীবন তুড়ি মেরে উড়ানো আলসে প্রেমের অবেলার কাকতাল”। ভালো লাগা রইলো প্রিয় লেখক।
Hasan ibn Nazrul বাহ অত্যন্ত চমৎকার। বিচিত্র জীবনের বিচিত্র ঘটনা। আসলে যে যেখানে আছে সময়ের ব্যবধানে সেখানকার পরিবেশের সাথে মিলিয়ে ফেলে। কিন্তু সকালে পান্তা খেলে সারাদিন যেমন পান্তার ঢেকুর উঠে, তেমনি আমাদের চিরচেনা রূপটি যত আড়ালেই থাকুক সময় মত তা বেরিয়েই আসে। শুভ কামনা আপনার জন্য
Abdul Hannan মনোমুগ্ধকর,প্রানবন্ত লেখা হৃদয়ে রেখাপাত করে,অনেক অনেক দোয়া রই।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

ভাঙা মন নিয়ে একটি ছেলে পরিচিত লোকজন, পরিবেশ ছেড়ে পাড়ি দেয় দূরদেশে। অতীতকে ভুলে থাকার জন্য করে যায় প্রাণপণ চেষ্টা। কিন্তু মন নতুন করতে ভাঙতে তাড়া করে ফেরে সেই অতীতের রেশ।

২৩ সেপ্টেম্বর - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ৪২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪