পৌষালি

উষ্ণতা (জানুয়ারী ২০১৯)

Ahad Adnan
  • 0
  • ৫৪
সকালের রোদ একটু একটু করে চোখে পড়ছে আসাদের। অনেক কষ্টে চোখটা খুলে সে। পৌষের সকাল, বেলা বুঝতে কষ্ট অনেক। এমনিতেই কয়েকদিন ধরে কুয়াশা পড়ছে খুব। তার উপর রাতের সেই অত্যাচার। লাঠির বাড়ি, ঘুষি, চড়, লাথি, ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠে। চোখ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আসে।
তবে মাথাটা কাজ করছে ঠিক মতই। সব মনে পড়ছে এক এক করে। সুমিদের বাড়ির পিছনে সরিষা খেত। হলুদ পাকা ফুলে আগুন ধরেছে। সেই খেতে আসাদ লুকিয়ে ছিল রাত এগারোটার দিকে। কথা ছিল মুঠোফোনে কল দিলেই পালিয়ে আসবে সুমি। কল দিয়েছিল সে। কিন্তু সুমির বদলে লাঠি, রাম-দা নিয়ে ছুটে আট-দশটা ছেলে।
আসাদ চোখ খুলে, দাঁড়ায়। গ্রামের শেষ মাথায় নদীর ধারে ফেলে রেখেছিল ওকে। মাথাটায় চিনচিন করে একটা ব্যথা হচ্ছে। কপালে হাত দিয়ে দেখে জমাট রক্ত। হাত-পা জায়গায় জায়গায় কালচে নীল, ফুলে আছে। হাড় কয়টা ভেঙেছে কে জানে। তবে অবাক ব্যাপার হচ্ছে, গ্রামের পৌষের সকাল, কিন্তু শীত করছে না মোটেই। মিহি রোদ উষ্ণতার চাদরে জড়িয়ে রেখেছে তাকে।
অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। এরচেয়ে অবাক ব্যাপার আসাদ হাঁটতে পারছে একটু একটু করে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস হচ্ছে, মস্তিষ্ক এখনও শুধুমাত্র সুমি’র কথাই ভাবছে। মেয়েটা কি তার বিশ্বাসের সাথে প্রতারণা করেছে? নাকি, বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে নির্মম বাস্তবতা? সুমি কি জানে, আসাদের এই অবস্থার কথা? নাকি এক রাতেই প্রেমিকের কথা ভুলে গেছে বিয়েবাড়ির বউটা।
আজকেই বিয়ে হওয়ার কথা সুমির। গ্রামের প্রচণ্ড প্রতাপশালী চেয়ারম্যানের মেয়ে আর স্কুলের প্রধানশিক্ষকের একমাত্র ছেলেটা যখন পাঁচ বছর গোপন প্রেম করে একসময় বুঝতে পারে কেও মেনে নিচ্ছে না এই সম্পর্ক, তারা যখন অবাক আবিষ্কার করে, একজনকে ছাড়া বাঁচবে না আরেকজন, একদিন ঠিক করে পালিয়ে যাবে। সেটাও বিয়ের ঠিক আগের রাতেই। বিশ্বাস বস্তুটা অনেকটা শীতের ভোরে রোদের উষ্ণতার মত। এটি আড়মোড়া ভেঙে জাগিয়ে তুলতে পারে। যুদ্ধ করার শক্তি দিতে পারে। সেই বিশ্বাসের জোরেই ওরা নতুন উজ্জ্বল দিনের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে চায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিটা এখনো পেরোতে পারেনি ছেলেটা। চেয়ারম্যান বাড়ির মেয়েদের পড়ালেখা টেনেটুনে এসএসসি। এক সুমিই স্কুল শেষ করে পা রেখেছে কলেজে। শীতটা শেষ হলেই এইচএসসি পরীক্ষা। অথচ একদিন হঠাৎ চেয়ারম্যান এসে বলে, ‘সুমির মা, তোমার মাইয়ার বিয়া ঠিক কইরা আইলাম। অনেক বড় সম্বন্ধ। এমপি সাবের শালা দাম্মাম থেইকা ফেরত আইছে। এই শীতেই বউ ঘরে তুলতে চায়। আমারে প্রস্তাব দিল এমপি সাব, ভাবতে পারো? এমপি সাব নিজে প্রস্তাব দিছে, বাপরে বাপ! আলহামদুলিল্লা কও। সুমি, একটু এদিক শোন তো মা’।
তবে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া অনেক কঠিন। ওরা ওদের পরিবারে পর্যন্ত বলেনি কিছু। বলতে পারেনি। হয়ত বলা যেত। কিন্তু অনেকগুলো ‘যদি’ ওদের পথ আটকে দেয়। সবুজ, সুমির ছোট ভাই এই মাত্র কয়েকদিন আগে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় হাতেনাতে ধরা পড়ে নকল সহ। ‘যদি’ প্রধানশিক্ষক তাকে কানধরে বের না করে দিত, ‘যদি’ তিনি চেয়ারম্যান সাহেবের সম্মানের কথা মাথায় রাখতেন। অথবা ‘যদি’ চেয়ারম্যান নিজে প্রধানশিক্ষককে সবার সামনে অপমান না করতেন, ‘যদি’ কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে গলায় ধাক্কা না দিতেন। এই দুই পরিবারের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বৈপরীত্য কিছুই হয়ত বাধা হত না, কিন্তু ‘যদি’গুলো খুব বিশ্রীভাবে চোখ রাঙাচ্ছিল। চেয়ারম্যানের কিছু দুর্নীতির কথা ইদানিং লেখা হচ্ছিল জাতীয় পত্রিকায়। ফেসে গেছেন তিনি ভালোভাবেই। এখন এমপি সাহেব শেষ ভরসা। চল্লিশের কাছাকাছি বয়সি শ্যালক একটা খুনের মামলায় একযুগ ধরে বিদেশে পালিয়ে আছে। দুইজন মিলে তাই দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর হিসেব কষতে বসেন। বেচারা সুমি। আসাদের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ থাকে না তার।
সবকিছু ঠিকমত গুছিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সুমি সন্ধ্যা থেকে মনমরা হয়ে থাকবে। বিয়ের আগের রাতটা থাকবে প্রিয় দাদি’র সাথে। দাদি’র ঘরটা বাড়ির একেবারে শেষ মাথায়। কেও আসে না এই ঘরে। ঘরটা থেকে পিছনে গেলেই সরিষা খেত। গ্রামে পৌষে ছয়টা বাজতেই রাত নেমে যায়। এগারোটা মানে মাঝরাত। সাড়ে দশটায়ও সুমি মেসেজ পাঠিয়েছে, সব ঠিক আছে। তারপরেও কি করে এমন হল, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়না আসাদ। উত্তরটা জানা খুব দরকার। এই উত্তর না জানলে, একটা জীবন বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে যাবে সব হারানো ছেলেটার। উষ্ণতায় মোড়ানো জীবনে নেমে আসবে মরণের মত শীতলতা।
খুব ধীর পায়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সরিষা খেতে আসে আসাদ। ফোন রাতেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বিয়ে বাড়ির সামিয়ানা। লোকজনের ভিড়। বরযাত্রা এসে গেছে হয়ত, তাই এত লোক, ভাবে সে। ভালোবাসা, বিশ্বাস, উষ্ণতা শব্দগুলো কি সব মিথ্যা? খুব শীত শীত লাগে তার। দুঃসাহস কিংবা পাগলামি থেকেই হয়ত আরেকটু এগিয়ে যায় সে। ঠিক তখনই কেও একজন দেখে ফেলে।
‘ওই হারামজাদা আবার আইছে। ধইরা বাঁধ শয়তানটারে’।
কিছু বলার আগেই আবার আসাদের গায়ে চড় থাপ্পড় পড়তে থাকে। ওকে টেনে নিয়ে আসা হয় চেয়ারম্যান বাড়ির উঠোনে। রাতের না শুকানো ঘা গুলো আবার জেগে উঠে। দুর্বল শিরাগুলো টগবগ করতে থাকে। বিধ্বস্ত আসাদ অনেক কষ্টে মাথা তুলতে চায়। আর তাকিয়েই চমকে উঠে। উঠোনে কফিন, একটা লাশ ঢেকে রাখা হয়েছে। পৌষালি লোবানের উষ্ণ গন্ধে আসাদের মাথা ঘুরতে থাকে।
চেয়ারম্যান শুধু একবার গর্জন করে উঠে, ‘এই হারামিটার লেইগা আমার মাইয়া গলায় ফাঁস দিছে। রাম-দা টা বাইর কর। আমি নিজে ওরে জবাই দিমু’।



আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নাজমুল হুসাইন valo laga roilo,onekta citro natto mone holo.amar patay amontron asben somoy pele.
ভালো লাগেনি ২৮ জানুয়ারী, ২০১৯

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

এই গল্পে 'উষ্ণতা'কে এনেছি ইতিবাচকতা হিসেবে। বিশ্বাস, নির্ভরতা, সহায় হিসেবে। এই উষ্ণতা মানুষকে সাহস দেয়, এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দেয়, যুদ্ধ জয়ের রসদ জোগায়। এই উষ্ণতা হারিয়ে গেলে জীবনে অাসে শীতলতা। মৃত্যুর মত শীতলতা।

২৩ সেপ্টেম্বর - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ৪১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪