ক্ষুদ্রতার ব্যাপ্তি

কৃপণ (নভেম্বর ২০১৮)

আহসানুল হক শোভন
  • 0
  • ৪৬
এক.
সামাদ শিকদারের শার্ট দুইটা। প্যান্টও দুটো। একসেট শার্ট প্যান্ট পরে তিনদিন অফিস করেন। তারপর ধুতে দেন। তার স্ত্রী মায়মুনা শিকদার ঘামের গন্ধে নাক কুঁচকান। সামাদ তাতে গা করেন না। ঘনঘন জামাকাপড় ধুলে জলদি নষ্ট হয়ে যায়। বাড়ির সবাইকে তিনি জামাকাপড় কম ধুতে বলেন। যদিও কেউ তার কথা কানে তোলে না। বন্ধের দিন তিনি বাড়িতে থাকলে কোন কাপড়চোপড় ধুতে দেন না। কাপড়চোপড় কম ধুলে অনেকদিক থেকে সুবিধা। মাসে কাপড় ধোয়া সাবান কম লাগে। পানি খরচওকম হয়। সামাদ শিকদার মিতব্যয়ী মানুষ। অপচয় তিনি একদমই পছন্দ করেন না। অপচয়কারী হল শয়তানের ভাই। একবার একটা কাপড় পরে সেটা ধুয়ে ফেলা, অতিরিক্ত সাবান নষ্ট করা এসবই তো অপচয়। লোকে আড়ালে আবডালে তাকে কৃপণ বলে ডাকে। তিনি গা করেন না। তার বাড়ির চুলায় আগুন না জ্বললে কী মানুষ এসে তাদের খাবার দিয়ে যাবে? কক্ষনো না। তাই যে যাই বলে বলুক, তিনি গায়ে মাখেন না।

মায়মুনা রান্নাঘরে রান্না করছে। এর মধ্যে সামাদ সাহেব এসে বার দুয়েক উঁকি মেরে গেছেন। একবার বলেছেন, রান্নায় তেল কম দিতে। তেলের দাম বাড়তি। পরেরবার এসে চুলার আঁচ কমাতে বলেছেন। দ্বিতীয়বার আসায় মায়মুনা মুখ ঝামটে বলেছেন, “তাহলে তুমি নিজে এসে রান্না করো। এমনিতেই সিঙ্গেল বার্নার দিয়ে রান্না করতে কত ঝামেলা। এত বলার পরেও ডাবল বার্নার নিচ্ছ না।”
“আহা! দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস ফুরানোর পথে। সবাই এইভাবে সমানে দুইচুলায় আগুন জ্বেলে রান্না করলে সময়ের আগেই গ্যাস ফুরিয়ে যাবে। তখন আমাদের আবারও সেই খড়ির চুলার যুগে ফিরে যেতে হবে। তাছাড়া গতবছর আর এই বছর মিলিয়ে গ্যাসের দাম কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে।”
“গ্যাসেও কী মিটার লাগানো আছে নাকি? জোরে জ্বাল দিলে বিল বেশি আসবে?”
“ইয়ে.. তা অবশ্য নেই। তারপরও এটা প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়।”

এরপর সামাদ সাহেব তার স্ত্রীর সাথে আর কথা বাড়াননি। তবে যাবার সময় রান্নাঘরের বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে গেছেন। বাইরে কী সুন্দর ঝকঝকে সূর্যের আলো। এমন রৌদ্রজ্জ্বল দিনে বোকা না হলে কেউ কৃত্রিম আলো জ্বেলে রাখে?

সুমন রান্নাঘরে এসেছে।

“মা, তুমি আব্বাকে বলছিলা?”
“কী বলব?”
“আমার স্মার্টফোনের কথা।”
“ক্যান, তোর না ফোন আছে?”
“ওইটা তো বাটনওয়ালা ফোন। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, স্ন্যাপচ্যাট এসব কিছুই চলে না।”
“কী সব নাম বলিস!কিছুই মাথায় ঢুকে না।”
“তোমার ঢুকান লাগবে না। এইগুলা ক্লাসের কাজে লাগে।”
“বলছিলাম। তুই তো জানিস তোর আব্বা কী রকম মানুষ। তুই স্কুলে যাস, বাসায় আমি চিন্তায় থাকি। তাই বলে কয়ে অনেক কষ্টে এই ফোনটা কিনে দেবার ব্যবস্থা করেছিলাম।”
“সেটা তো মা ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়কার কথা। এখন আমি ক্লাস টেনে। চার বছর ধরে একই ফোন ব্যবহার করি। ক্লাসের ছেলেরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে।”
“করুক। তোর নতুন ফোন কিনার এত ইচ্ছা জাগলে তুই নিজে গিয়ে তোর বাবাকে বল।”
“ওরে বাবা, ওই কিপ্টা লোককে আমি বলতে পারব না।”
“সুমন!” মায়মুনা খুন্তি হাতে ঘুরে দাঁড়ান। “নিজের বাবা সম্পর্কে এইসব কী ধরণের কথা?”
“এইটা আমার কথা না, মা। এলাকার সবাই বাবাকে এই নামেই ডাকে।”

কথাটা বলার পর সুমন আর রান্নাঘরে দাঁড়ায় না। সে বুঝতে পেরেছে কথাটা শুনে তার মায়ের মন খারাপ হয়েছে।

দুই.
একটা সময় স্নিগ্ধাও তার বাবার কাছে এটা সেটা কেনার জন্য টাকাপয়সা চাইত। এখন আর চাইতে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর কয়েকটা টিউশনি করতে শুরু করেছে। নিজের টাকায় স্মার্টফোন কিনেছে। নিজের রোজগার করা টাকা খরচ করতে যেমন আনন্দ, তেমনি কষ্ট। স্বাধীনভাবে কিছু কিনতে পারায় আনন্দ লাগে। আবার টাকাগুলো হাত থেকে চলে যাবার পর কষ্ট লাগে। টাকা বাঁচাতে স্নিগ্ধা সরকারী ব্যাংকে একটা সঞ্চয়ী এ্যাকাউন্ট খুলেছে। এদের অনলাইন ব্যাংকিং সার্ভিস বিশেষ সুবিধার না। এ্যাকাউন্ট খোলার পর অন্যান্য ব্যাংকগুলোর মত ডেবিট কার্ডও দেয় না। তাই চাইলেও হুটহাট এটিএম বুথে গিয়ে টাকা তোলা যায় না। ব্যাংক আওয়ারে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা তুলতে হয়। এই পদ্ধতি অবলম্বন করার পর থেকে স্নিগ্ধার এ্যাকাউন্টে বেশ কিছু টাকা জমেছে।

আজ বাসা থেকে বের হয়ে ছাত্রীর বাসায় যাবার পথে স্নিগ্ধার মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠল। দূপুরবেলাসে ভাত খায়নি। মূলা শাক, পেঁপে ভাজি আর পানির মত পাতলা ডাল দেখে মেজাজ খারাপ হয়েছিল। পেঁপে ভাজির রঙ রুগীর খাবারের মত। এমনিতেই সে লো প্রেশারে ভোগে। একবার ভাবল রাস্তায় স্ন্যাকস টাইপ কিছু কিনে খাবে। তারপর ভাবনাটা বাতিল করে দিলো। ছাত্রীর বাসায় পড়ানোর ফাঁকে নাস্তা দিবে। অযথা টাকা আর সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না।

তিন.
সামাদ শিকদারের পেটে চিলিক দেয়া ব্যথা করছে। সময়ের সাথে সাথে ব্যথার পরিমাণটাও বাড়ছে। একসময় এমন অবস্থা দাঁড়াল যে তিনি হাতের ফাইল ফেলে অফিসের মেঝেতে শুয়ে গড়াগড়ি দিতে শুরু করলেন। অফিস সহকর্মীরা ধরাধরি করে তাকে প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে গেল। সামাদ শিকদার হাসপাতালের চাকচিক্য দেখে চোখ কপালে তুলে বললেন, “আরে, আমাকে এখানে আনছেন কেন? সামান্য পেটে ব্যথা। গ্যাস্ট্রিকের কারণে হতে পারে। এক গ্লাস পানির সাথে একটা ওমিপ্রাজল খেলেই ঠিক হতে যেত। মাঝে মাঝে শুকনা মুড়িতেও ভাল কাজ দেয়।”

ফিরোজ রাগ দেখিয়ে বলল, “স্যার, আপনি চুপচাপ শুয়ে থাকেন। নিজের অসুস্থতা নিয়েও কিপটামি? এমন মানুষ আর দেখি নাই।”

ফিরোজ ছেলেটা সামাদ সাহেবের অনেক জুনিয়র। এতদিন ছেলেটাকে তিনি ভাল বলেই জানতেন। আজ বিপদের দিনে বোঝা গেল, ছেলেটা অতিশয় বেয়াদব। অথচ সামাদ সাহেব মনে মনে স্নিগ্ধার সাথে এই ছেলের বিয়ের চিন্তা প্রায়ই করেন। বিয়ে করিসনি, তাই এখনও পাখনা মেলে উড়ছিস। বিয়েটা কর, তারপরে দেখব পাখনা কই যায়! সামাদ সাহেব মনে মনে ভাবলেন।

ইমার্জেন্সিতে বসা ডাক্তার অনেকগুলো টেস্ট করতে দিল। এতগুলো টেস্ট দেখে সামাদ সাহেব যারপরনাই বিরক্ত হলেন। ইমার্জেন্সিতে বসা ছেলেটার বয়স এখনও ত্রিশ পেরোয়নি। এই ছেলে ডাক্তারির কী বুঝে? বোঝে না বলেই অযথা এতগুলো টেস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। তিনি একটা টেস্টও করাবেন না। এদিকে ওরা আবার কেবিনে দিতে চাইছে। শুধু কেবিন ভাড়াই দিনে সড়ে তিন হাজার টাকা। ডিউটি ডাক্তারের ভিজিট, ওষুধ, স্যালাইন, খাবার,এসবের বিল আলাদা। খরচের কথা চিন্তা করে সামাদ সাহেবের পেটে ব্যথার পরিমাণ আরও বেড়ে গেল।

পরদিন দূপুরে ডিউটি ডাক্তার এলেন। এই ডাক্তার বয়স্ক। ছ্যাংড়া টাইপ নয়। অভিজ্ঞতা আছে।

“ডাক্তার সাহেব, পেটের ব্যথাটা সেরে গেছে। আমাকে আজকে রিলিজ দিয়ে দেন।”
“আপনার পরিবারের সদস্যরা কই?” ডাক্তারের মুখ গম্ভীর।
“ছিল তো। ছেলেটা বাইরে কই জানি গেছে। ছেলের মা ক্যান্টিনে গেছেখাবার আনতে। কেন ডাক্তার সাহেব? কী হয়েছে আমাকে বলেন।”
“আপনার পেটে একটা টিউমার ধরা পড়েছে। টিউমারটাআকারে বেশ বড়। ইমিডিয়েটলি অপারেশন করাতে হবে।”

সামাদ সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল।

“অপারেশনে খরচ কত পড়বে?”
“প্রাথমিক খরচ লাখখানেকের মত। এর বাইরে ওষুপত্র, হাসপাতালের বিল ইত্যাদি মিলিয়ে দুইলাখের মত ধরে রাখতে পারেন।”
“দুইলাখ!” টাকার অংক শুনে সামাদ সাহেবের মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে।
“অপারেশনের পর আপনাকে অবজারভেশনে থাকতে হবে। আমরা দেখব নতুন করে টিউমারের আবার গ্রোথ হয় কিনা। সেক্ষেত্রে টাকার পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। আগে থেকে জানিয়ে রাখলাম, যাতে টাকা যোগাড় করার জন্য হাতে সময় পান।”

সামাদ সাহেব চুপ করে খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলেন। অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে দশ লক্ষ টাকার একটা পারিবারিক সঞ্চয়পত্র করেছিলেন। তিনমাস পর পর কিছু টাকা ইন্টারেস্ট পান। আর কয়েকবছর পর ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। স্নিগ্ধারও বিয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে। মেয়ের বিয়ের সময় টাকাপয়সা লাগবে।

সামাদ সাহেব ডাক্তারের দুইহাত আঁকড়ে ধরলেন, “ডাক্তার সাহেব, প্লিজ টিউমার অপারেশনের কথাটা আমার ফ্যামিলির কাউকে জানাবেন না। আপাতত আমাকে রিলিজ দিয়ে দেন। অপারেশনটা আমি কিছুদিন পরে করাব।”
“বলেন কী? যত দেরী করবেন, অবস্থা তত ভয়াবহ দিকে মোড় নিবে।”
“টাকা ম্যানেজ করতে আমার কয়েকটা দিন সময় লাগবে। এই কয়দিন হাসপাতালের বিল বাড়িয়ে তো লাভ নেই, তাই না? আমাকে আজকে রিলিজ দিয়ে দেন।”
“আজ তো রিলিজের সময় পার হয়ে গেছে। তারপরও আপনি রিলিজ নিতে চাইলে কালকের দিন পর্যন্ত পুরো বিল পে করতে হবে। বেটার আপনি আজকের রাতটা থেকেই যান। আমি রিলিজ পেপারে লিখে দিচ্ছি। আপনি কাল সকাল এগারটার মধ্যে বিল পে করে চলে যাবেন।”

চার.
ছাত্রী পড়িয়ে হাসপাতালে এসে করিডোরে স্নিগ্ধার তার মা মায়মুনা শিকদারেরসঙ্গে দেখা। মা মেয়ে মিলে সামাদ সাহেবের বিছানার কাছে গেল। মেয়েকে দেখে সামাদ সাহেবের মুখে হাসি ফুটে উঠল।

“আরে, কী কাণ্ড! তোরা সবাই মিলে এভাবে আমাকে দেখতে আসলে বাসায় কে থাকবে? কিছু চুরি গেলে?”
“সুমন বাসায় আছে।”
“ওর উপরে আমি কোন ভরসা পাই না। কখন কোন বন্ধুর ডাকে কোথায় চলে যায়।”
“বাবা, এখন কেমন লাগছে?” স্নিগ্ধা তার বাবার পাশে বসে দুই হাত দিয়ে সামাদের একটা হাত মুঠোতে নেয়।
“একদম ভালরে, মা। বলেছিলাম না গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। ডাক্তার আজ রিলিজও দিয়ে দিয়েছে। কাল সকালেই বাসায় চলে যেতে পারব। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন বাসায় যা। মায়মুনা তুমিও যাও। একটা রাত আমি একা থাকলে কিছু হবে না।”
“না, রাতে আমি তোমার কাছেই থাকব। ওরা দুই ভাইবোন আজ বাসা পাহারা দিক।”
“কিন্তু..”
“চুপ থাক! সারাদিন শুধু খরচের চিন্তা। একটা রাতে আমি ক্যান্টিনে কয়টাকার ভাত খাব? দরকার হলে আজ রাতে আমি কিছু খাব না।”

স্বামীর ওপর রাগ দেখিয়ে স্নিগ্ধাকে সাথে নিয়ে মায়মুনা করিডোরে বেরিয়ে এলেন।

“দেখেছিস, এই অসুস্থতার মধ্যেও মানুষটা কেমন করে?”
“বাদ দাও তো, মা। ওটা বাবার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।” বলতে বলতেই স্নিগ্ধা একবার দুলে ওঠে।
মায়মুনা ঝট করে স্নিগ্ধার একটা হাত টেনে ধরেন, “কিরে, কীভাবে হাঁটিস? এক্ষুনি তো পড়ে যাচ্ছিলি।”
“কী জানি মা। কয়েকদিন ধরে মাথাটা হঠাৎ হঠাৎ ঘুরে উঠে।”
“দেখি, চল তো। তোর প্রেশারটা মাপাই।”

প্রেশার মাপার পাশাপাশি স্নিগ্ধাকে ডাক্তার কিছু প্রশ্ন করলেন। স্নিগ্ধা জানাল তার ডান কানে শুনতে প্রায়ই সমস্যা হয়। মাথার একটা পাশ ভার ভার লাগে। প্রেসক্রিপশনে ডাক্তার কয়েকটা টেস্ট লিখে দিলেন।

“মা, শুধু শুধু ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে। যতগুলো টেস্ট দিয়েছে, এগুলোর কথা শুনলে বাবা নির্ঘাৎ হার্ট এ্যাটাক করবেন।”
“অসুখকে অবহেলা করতে নেই। টেস্টগুলো করিয়ে ফেল। আলমারিতে আমার কিছু টাকা জমেছে। ওখান থেকে দিব।”

টেস্টগুলো করিয়ে স্নিগ্ধাকে বাসায় পাঠিয়ে মায়মুনা কেবিনে ফিরে গেলেন। টেস্টের রিপোর্ট আগামীকাল সন্ধ্যায় দিবে।

পাঁচ.
সামাদ সাহেব ফুরফুরে মেজাজে বিছানায় বসে আছেন। সকালে ডাক্তার এসে একটা সুখবর শুনিয়েছেন। গতকালের রিপোর্টটা তার ছিল না। কোন এক সামাদ খন্দকারের। বয়সও একই। শিকদার আর খন্দকারে উল্টাপাল্টা হয়ে রিপোর্ট বদলে গেছে। সামাদ সাহেবের হয়েছে পেপটিক আলসার। তেমন কোন জটিল রোগ নয়। নিয়ম মেনে খাওয়া-দাওয়া আর ওষুধ খেলেই সেরে যাবে। শুনে সামাদ সাহেবের বুকের ওপর থেকে দশমণি ওজনের পাথরখণ্ডটা সরে গেছে।

“কী, বলেছিলাম না আমার কিছু হয়নি? আরে, আমি আরও অনেকদিন বাঁচব।”

স্বামীর মুখে হাসি দেখে মায়মুনার মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। যাক, হাসপাতালে আসার উছিলাতে হলেও মানুষটার সাথে ঘনিষ্ট কিছু সময় কাটানো গেছে। বাসায় থাকলে সারাক্ষণ ক্যাটক্যাট করে। এখানে সারাক্ষণ শান্ত আর উৎফুল্ল মেজাজে ছিল।

সুমন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে এনেছে। মায়মুনা রিলিজ স্লিপ নিয়ে বিল দিতে গেলেন। বিলের কাগজ দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে গালাগাল ছুঁড়তে ছুঁড়তে সামাদ শিকদার সিএনজিতে এসে উঠলেন। সুমন দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার বাবার পাশে চাপাচাপি করে বসে। আজ তার স্মার্টফোন থাকলে কত সহজে একটা উবার ডাকা যেত!

বিকালে ছাত্রী পড়ানো শেষ করে স্নিগ্ধা গেল তার রিপোর্টগুলো আনতে। রিপোর্ট হাতে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারের সামনে রাখা চেয়ারগুলোর একটাতে গিয়ে বসল। একসময় তার ডাক এল।

“আপনার মা সাথে আসেনি?” রিপোর্ট দেখে ডাক্তার গম্ভীর মুখে জানতে চাইলেন।
“না। আমার বাবা আপনাদের হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। দূপুরের আগে বাবাকে রিলিজ করিয়ে বাসায় নিয়ে গেছেন। তাই আর সাথে আনিনি। কেন স্যার?”
“আপনার যে সমস্যাটা হয়েছে, তার ইমিডিয়েট চিকিৎসার প্রয়োজন।”
“কী সমস্যা, স্যার?”
“আপনার সম্ভবত এ্যাকোয়্যাস্টিক নিউরোমা হয়েছে। তারপরও আমি কনফার্ম হবার জন্য এমআরআই করাব।”
“জ্বি?” নামটা স্নিগ্ধার অপরিচিত। শুনে সে কিছুই বুঝল না।
“এ্যাকোয়্যাস্টিক নিউরোমা কানের ভেতর দিয়ে.. আই মিন মস্তিষ্কের নার্ভের কাছে একটা টিউমার। টিউমার হলে ইমিডিয়েটলি অপারেশন করাতে হবে। তবে তার আগে এমআরআই করিয়ে নিশ্চিত হতে চাই। সম্ভব হলে আপনি কাল সকালেই এমআরআই করিয়ে ফেলুন।”

চেম্বার থেকে বের হবার পর স্নিগ্ধার মাথা আরও বেশি ঘুরতে থাকে। একটা চেয়ার ধরে কোনমতে নিজেকে সামলাল। অপারেশন, বিল, এতগুলো টাকার ধাক্কা। বাবা জানতে পারলে নির্ঘাৎ.. স্নিগ্ধা আর ভাবতে পারে না।

ছয়.
স্নিগ্ধা চুপিচুপি তার মাকে জানিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ব্যাংকে তার পঁয়ত্রিশ হাজারের মত টাকা জমেছিল। সুমনকে দিয়ে তুলে আনিয়েছে। মায়মুনা তার জমানো এগারো হাজার টাকা নিয়ে হাসপাতালে চলে এসেছেন। সামাদ সাহেব অফিসে। মেয়ের ব্যাপারে তাকে কিছুই জানানো হয়নি। একটু আগে স্নিগ্ধার এমআরআই রিপোর্ট ডাক্তার দেখেছেন। তিনি যা ভেবেছিলেন, ঠিক তাই। টিউমারটার গ্রোথ মধ্যম পর্যায়ে। অপারেশন করাতে কিছুটা ঝুঁকি থাকলেও এইটুকু ঝুঁকি নিতেইহবে।

সামাদ সাহেব হাসপাতালে এসে ডাক্তারের সাথে কথা বলে সব জেনেছেন। অপারেশনে বেশ বড় অংকের টাকার প্রয়োজন পড়বে। এখনও টাকার সঠিক পরিমাণটা ডাক্তারের পক্ষে বলা সম্ভব হচ্ছে না।

“আব্বু, তুমি চিন্তা করো না। টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
“মা রে, তুই জানিস কত টাকা লাগবে?”
“লাখখানেকের মত লাগতে পারে। আমার পঁয়ত্রিশ আর আম্মুর এগার। বাকিটাও আমি ম্যানেজ করে ফেলতে পারব।”
“তোরা সবাই কি আমাকে এতটাই অমানুষ ভাবিস? নিজের সন্তানের জীবনমরণের প্রশ্নেও টাকা বাঁচানোর চিন্তা করব?” সামাদ শিকদার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। সেদিন স্নিগ্ধা যেমন করে তার একটা হাত মুঠোতে নিয়ে বিছানার পাশে বসে ছিল, ঠিক তেমনি করে তিনি স্নিগ্ধার একটা হাত তার দুই হাতের মুঠোতে নিয়েবাচ্চাদের মত কাঁদতে লাগলেন।

সাত.
সামাদ শিকদার তার দশ লক্ষ টাকার সঞ্চয়পত্র ভেঙেছেন। এতগুলো টাকা একা নিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছিলেন না, তাই ফিরোজকে সাথে এনেছেন। সিএনজিতে দুজন চুপচাপ বসে। নীরবতা ভেঙে ফিরোজ হঠাৎ বলে উঠল, “স্যার, অফিসে সবাই আপনার পেছনে আপনাকে কৃপণ বলে ডাকে। আমি নিজেও বলি। কথাটা আজ ফিরিয়ে নিলাম। আমাকে ক্ষমা করবেন।”

“আরে.. না, না। ঠিকই তো বলে। কৃপণকে কৃপণ না বলে কী বলবে?”
“না স্যার। ঠিক বলে নাই। আমাদের সমাজে কেউ মিতব্যয়ীতা করলেই তাকে আমরা কৃপণ বলে খোঁচাখুঁচি করি। অথচ সময়মত মিতব্যয়ীতা করেছিলেন বলেই মেয়ের অপারেশনের টাকাটা যোগাড় করতে গিয়ে আপনাকে কারও কাছে হাত পাততে হয়নি। তিন বছর হল আমি চাকরীতে ঢুকেছি। এই তিন বছরে আমি না হলেও লাখ দুয়েক টাকার মত জমাতে পারতাম। তা না করে এদিক সেদিক হাবিজাবি খেয়েছি, অপ্রয়োজনে ব্র্যান্ডের দামী জিনিস কিনেছি, ছয়মাস পর পর ফোনের মডেল বদলেছি। আজ আমি একটা বিপদে পড়লেঅন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। আমাকে ক্ষমা করে দিন, স্যার।”
“ছেলে করে কী? হাত ছাড়ো।” সামাদ সাহেব মরমে মরমে মরে যান।
“স্যার, আপনি ক্ষমা না করলে আমি হাত ছাড়ব না।”
“আচ্ছা, ক্ষমা করলাম। আমি কারও উপর রাগ পুষে রাখি না।”

সামাদ সাহেব ফিরোজের মুখের দিকে তাকালেন। ছেলেটা লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছে। ফিরোজকে নিয়ে তিনি আবারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। তিনি ঠিক করলেন, স্নিগ্ধার অপারেশনটা ভালয় ভালয় হয়ে যাবার পর ফিরোজ ছেলেটার সাথে এই ব্যাপারটানিয়ে কথা বলবেন।

সিএনজিটা হাসপাতালের কাছাকাছি চলে এসেছে। ভেতরে বসা অপেক্ষাকৃত বয়ষ্ক যাত্রীর চোখে সন্তানের আরোগ্য লাভের উৎকণ্ঠা। আর অন্য যাত্রীর চোখে নিজেকে ভেঙে আবার নতুন করে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয়।
--সমাপ্ত--
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত ভাই , সুন্দর ভাবনা , সুন্দর লেখনী । ভালো লাগলো । ভোট সহ শুভকামনা রইল ।
মুহাম্মাদ লুকমান রাকীব প্রিয় কবি/লেখক. অাপনাদের জন্য নতুন ওয়েব সাইট www.kobitagolpo.com তৈরি করা হয়েছে নতুন অাঙিকে। এখানে বর্তমান প্রতিযোগীতার জন্য নির্ধারিত “বাবা-মা” শিরোনামে লেখা জমা দেয়ার জন্য অামন্ত্রণ করা হচ্ছে। অাগ্রহীগণ ২৫ নভেম্বরের মধ্যে www.kobitagolpo.com এ লিখা জমা দিন। প্রতিযোগীতায় সেরা নির্বাচিত ৬ জনকে সম্মাননা দেয়া হবে।।।
শামীম আহমেদ শুভ কামনা আর ভোট রইল।আসবেন আমার পাতায়,আমন্ত্রণ রইল।
প্রজ্ঞা মৌসুমী মিতব্যয়ী হওয়ার পক্ষে যুক্তিগুলো ছিল স্বচ্ছ, গোছানো। আর অসুখপর্ব পড়ে মনে হচ্ছিল বেশ আটঘাট বেঁধেই লিখতে বসেছিলেন। আমি পাঠক হিসেবে পুরোপুরিই সন্তুষ্ট। অনেক শুভকামনা
রঙ পেন্সিল ভাল লাগলো। শুভকামনা অনেক

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

কৃপণ অর্থ ব্যয়কুন্ঠ, অনুদার, মিতব্যয়ী। আমাদের সমাজে কেউ মিতব্যয়ীতা করলেই তাকে আমরা কৃপণ বলে খোঁচাখুঁচি করি। কৃপণ ব্যক্তিদের নিয়ে সমালোচনা করাটা কি আসলেই খুব জরুরী? আমি আমার গল্পের মাধ্যমে দেখিয়েছি, একজন মিতব্যয়ী ব্যক্তির কষ্টার্জিত সঞ্চয় কীভাবে তার দুর্দিনে কাজে আসে।

৩১ আগষ্ট - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪