এক.
মুক্তি বেণী দুলিয়ে গলিতে হেঁটে বাসায় ফিরছে। মুক্তিকে আসতে দেখে পাভেল গেটের একপাশে নিজেকে প্রায় মিশিয়ে ফেলে। প্রতিদিন মুক্তিকে সে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে, সেটা ওকে বুঝতে দেয়াযাবে না। মেয়েরা কারও হৃদয়ের দুর্বলতা ধরে ফেললে, তার অনুভূতিগুলো নিয়ে খেলা শুরু করে। সেসুযোগ কোনভাবেই মুক্তিকেদেয়া যাবে না।
একই গলির বাসিন্দা হওয়ায় মুক্তির সাথে পাভেলের পরিচয় আছে। প্রতিবছর ওদের দুই পরিবারের মধ্যে কোরবানীর মাংস, শবেবরাতের হালুয়া-রুটির আদানপ্রদান ঘটে। পাভেল কোরবানীর মাংস মুক্তিদের বাড়িতেদিতে যায়। মুক্তি শবেবরাতের রাতে বড় একটা ওড়না মাথায় দিয়ে ট্রেতে হালুয়া-রুটি সাজিয়ে পাভেলদের বাড়িতে দিতে আসে। পাভেলকে সে ‘পাভেল ভাই’ বলে সম্বোধন করে। সম্বোধনটা এলাকার বড় ভাই হিসেবে। সে অনুযায়ী তাকে সম্মানও করে। তাই মুক্তিকে লুকিয়ে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে সে সম্মানটুকু ভূলুণ্ঠিত করতে চায় না পাভেল।
গত কয়েকদিন যাবৎ পাভেল ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে না। দেশে বেশ বড়সড় গণ্ডগোলের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ভাষণের পর পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টে গেছে। নিতান্তই জীবিকার প্রয়োজনে বাইরে বের হলেও সবাই সবার দিকে কেমন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। সবার মনে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কখন কী হয়! কখন কী হয়!
পাভেলের বাবাকয়েকটা দিন ওকে ভার্সিটিতে যেতে নিষেধ করেছেন। সমস্যা হল, বাসায় বসে একদমই সময় কাটছে না। মুক্তিকে ওদের বাসা থেকে কেন এখনও কলেজে যেতে দিচ্ছে, সেটা ভেবে পাভেলের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। মুক্তির যদি কোন ক্ষতি হয়ে যায়, পাভেল কী নিয়ে বাঁচবে?
দুই.
মুক্তি এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। কলেজে পরীক্ষার্থীদের জন্য স্পেশাল কোচিং করানো হচ্ছে, সে কারণেই প্রতিদিন কলেজে যেতে হয়। তবে মুক্তির কেন জানি মনে হচ্ছে, এ বছর ওদের পরীক্ষা হবে না। না হলেই বাঁচে। পড়তে বসলেই পাভেল ভাইয়া মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়। কিছুদিন আগেও অবস্থা এতটা ভয়ঙ্করছিল না। দিন যত গড়াচ্ছে, ওর অবস্থাও ততই খারাপের দিকে যাচ্ছে। যদিও পাভেল ভাইয়ার সামনাসামনি পড়লে তাকে কিচ্ছুটি বুঝতে দেয় না।
পুরুষ মানুষ মেয়েদের মন পাবার জন্য নানান কায়দা কানুনের আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু কেউ যদি একবার টের পেয়ে যায় যে, মেয়েটি তার প্রতি দুর্বল তাহলে সেই মেয়ের মূল্য তার কাছে এক আনাও থাকে না। এই সুযোগটা মুক্তি কোনভাবেই পাভেলকে দিবে না। পৃথিবীর সকল অবহেলাসে সহ্য করে নিতে পারবে, কেবল পাভেলের অবহেলা সহ্য করতে পারবে না।
ঢাকার পরিস্থিতি ভাল না। শুনেছে যে কোন সময় শহরে আর্মি নামতে পারে। পরীক্ষা যদি না হয়, তাহলে কোচিংয়েযাওয়াটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। তারপরও মুক্তি একদিনও মিস দেয় না। এটার পেছনেও পাভেল ভাইয়া। মুক্তি ফেরার পথে মানুষটাকে গলির কোথাও না কোথাও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। মুক্তিকে দেখা মাত্রই পাভেল ভাইয়া অবশ্য নিজেকে আড়াল করার যথেষ্ট চেষ্টা করে। বোধহয় মুক্তির সাথে কথা বলতে চায় না। তারপরও মুক্তি দেখে ফেলে। অনেকদূর থেকে সে মানুষটার অস্তিত্ব অনুভব করে। প্রতিটা মানুষের শরীরের নাকি আলাদা একটা গন্ধ থাকে। মুক্তি পাভেলের শরীরের গন্ধ পায়।
এই ব্যাপারটা ওর কাছে খুব অদ্ভুত বলে মনে হয়। কলেজে বান্ধবীদের সাথে এটা নিয়ে কয়েকবার কথা বলতে গিয়েও বলেনি। ওরা জানতে পারলে ওকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করবে। যদিও ওরা এর চাইতেও অনেক আজেবাজে বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, তবুও।
তিন.
সারারাত ধরে বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ হয়েছে। রাস্তা থেকে শোনা গিয়েছে মিলিটারি কনভয় চলাচলের জোরালো শব্দ। পাভেল ছাদে গিয়ে দেখে আসতে চেয়েছিল। তার বাবা তাকে যেতে দেয়নি। ওরা সবাই দরজা জানালা বন্ধ করে সারারাত ভেতরের ঘরটায় একসাথে গুটিসুটিমেরে কাটিয়েছে। পাভেলের বাবা এহতেশাম উদ্দিন বলেছেন, মরতে যদি হয় সবাই একসাথে মরব। পাভেল, তুই বাইরে কোনদিকে যাবার চেষ্টা করবি না।
পাভেল অনেক কষ্টে রাতটা পার করেছে। রাতে কী হয়েছে, সেটা জানার জন্য ওর ভেতরটা অস্থির হয়ে আছে। সকাল হবার খানিকক্ষণ আগে গোলাগুলির আওয়াজ থেমেছে। বেলা বাড়ার পরও অন্যান্য দিনের মত রাস্তা থেকে রিকশা সাইকেলের টুংটাং বেলের আওয়াজ শোনা যায়নি। শুধু সকালবেলা বাসার সামনে দিয়ে একটা রিকশায় আজ কারফিউয়ের ঘোষণা দিতে দিতে চলে গেছে।
২৭শে মার্চ মাত্র কয়েকঘন্টার জন্য কারফিউ তোলা হল। একজন দুজন করে মানুষ বাসা থেকে বেরিয়ে আসছে। গৃহবন্দী থাকতে হলেও ঘরে আনাজপাতির প্রয়োজন। পাভেলের বাবা নিজে বাজার করে নিয়ে আসার জন্য বের হয়েছেন। বাবা বেরিয়ে যাবার পর সুযোগ বুঝে পাভেলও বেরিয়ে পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশের অনেকগুলো চেকপোস্ট। পাভেল ওদিকে যেতে গিয়েও চেকপোস্ট দেখে ফিরে আসে। মেয়েদের বেগম রোকেয়া আর সামসুন্নাহার হলে গভীর রাতে গেট ভেঙ্গে ঢোকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ধর্ষণের পর কেউ মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার পেয়েছিল কিনা, কারোরই জানা নেই। মেয়েদের অনেককে চুলের মুঠি ধরে টেনে বারান্দায় নিয়ে এসে তিনতলা থেকে নিচে ফেলে দেয়া হয়।
নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার ২৩, ২৪, ২৫, ৪০ নম্বর ভবনে ছিল শিক্ষকদের আবাস। রাতে পাক সেনারা জীপ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। একে একে শিক্ষকদের হত্যা করে। ২৭শে মার্চ সকালে ১২ নম্বর ভবনের পানির ট্যাংকি থেকে উদ্ধার করা হয় শিক্ষকদের পঁচে যাওয়া গলিত লাশ।
রাস্তায় শুকিয়ে যাওয়া চাপ চাপ রক্ত। হাঁটতে হাঁটতে পাভেল হাতিরপুল হয়ে কাওরান বাজারের দিকে গেল। এখানে রেললাইনের দুই ধারের বস্তিতে লক্ষ লক্ষ লোক বসবাস করত। এখন রেললাইনের দুইধারে নারী, পুরুষ, শিশুর লাশ আর লাশ। গত দুই দিনে কেউ লাশগুলোর সৎকার করেনি। মাংস পঁচার বীভৎস গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। পাভেল রেললাইনের ওপরই হড়হড় করে বমি করে ফেলে।
চার.
মুক্তির জানালায় টুকটুক করে শব্দ হচ্ছে। শব্দটা খুব আস্তে হওয়ায় মুক্তি প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারেনি।
“কে? কে ওখানে?”
“আমি পাভেল। জানালাটা একটু খোল।” ওপাশ থেকে নিচু স্বরে পাভেলের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়।
মুক্তি সন্তর্পণে জানালাটাখোলে।
“পাভেল ভাই, এত রাতেআপনি?”
“ভাবলাম যাবার আগে তোমার সাথে একটু দেখা করে যাই।”
“এত রাতে কোথায় যাবেন? দেশের অবস্থা ভাল না।” মুক্তির কন্ঠে উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে।
“দেশের অবস্থা যেন ভাল হয়, সে কারণেই যাচ্ছি। আমরা না গেলে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে। আরও মানুষ মরবে। ওরা গুলি করে পিঁপড়ার মত মানুষ মারছে।”
“পাভেল ভাই, আপনি যাবেন না। যাবার মত আরও মানুষ রয়েছে।”
“সবাই এটা ভেবে ঘরে বসে থাকলে কারোরই আর যাওয়া হয়ে উঠবে না। মুক্তি, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। যদি আর কখনও বলার সুযোগ না পাই, তাই কথাটা আজকেই বলে যেতে চাই।”
“পাভেল ভাই, আপনাকে আমারওকিছু কথা বলার ছিল।”
“হ্যাঁ, বল।”
“না, আগে আপনারটা বলেন। তারপর আমারটাবলব।”
“মুক্তি.. মুক্তি..” পাভেলের গলা শুকিয়ে আসে।
“পাভেল ভাই, বলেন।” মুক্তি দ্রুত লয়ে শ্বাস নিতে থাকে।
“মুক্তি, মুক্তি, আমি..আ-আমি.. তোমাকে ভালবাসি। অনেকদিন ধরে। অনেক বছর ধরে। কখনও সাহস করে বলতে পারিনি। তুমি যদি আমার ভালবাসা গ্রহণ না কর। তুমি যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও..”
“এতদিন কেন বলেননি, পাভেল ভাই? কেন বলেননি? আমি কীভাবে আপনার ভালবাসা ফিরিয়ে দিতাম? আমিও যে আপনাকে অনেক ভালবাসি।”
“তুমিও কেন বল নাই? কেন বল নাই?”
“আপনি পুরুষমানুষ হয়ে বলতে পারেননি। আমি মেয়েমানুষ হয়ে কীভাবে বলতাম, বলেন? এতগুলো দিন বুকের ভেতর এই কথাটা চেপে রেখে আপনার সামনে গিয়ে বারবার ফেরৎ এসেছি। আজ বলতে পেরে অনেক হালকা লাগছে।”
“মুক্তি, মারে.. কার সাথে কথা বলতেছিস?” দরজার বাইরে থেকে মুক্তির বাবা বশীর মৃধারগলার আওয়াজ পাওয়া যায়।
“কেউ না, আব্বা। জানালার ফাঁক দিয়া মশা ঢুকে। মশারে গালি দিতেছিলাম।”
“মশারে গালি দিয়া লাভ নাই। মশারী টানায়া ঘুমা। রাত অনেক হইছে।”
“জ্বি আচ্ছা, আব্বা।”
জানালার গ্রিলের ফাঁক গলে পাভেল ওর হাতঢুকিয়ে মুক্তির গাল স্পর্শ করে। মুক্তির গালটা ভেজা ভেজা লাগছে। মুক্তি কাঁদছে। অন্ধকারে সে বুঝতে পারেনি।
“তুমি কাঁদছ?”
“না, কাঁদি না। আপনি আসার আগে বাথরুম থেকে মুখে পানি দিয়ে আসছিলাম।”
“আচ্ছা শোনো, আমার এখন চলে যাওয়া উচিৎ। এবার বিদায় দাও।”
“চাচাচাচী আপনাকে বাধা দেয়নি?”
“আব্বা আম্মা কেউ জানে না। জানলে আসতে দিত না। যাই।”
“যাই বলতে নেই। বলেন আসি। আবার কবে আসবেন?”
“জানি না। কোথায়থাকব, সেটাই তো জানি না। যদি ঢাকায় আসি, তাহলে তোমার সঙ্গে অবশ্যই দেখা করতে আসব। আসি।”
পাঁচ.
১৭ই জুন। পাভেল ওদের দলের কয়েকজনের সাথে ঢাকায় এসেছে। এই মুহূর্তেসে নিজেদের বাড়ির ঘরগুলোতে খালি পায়ে হাঁটছে। বাসায় ওর বাবা-মা কেউ নেই। প্রতিটা রুমের জিনিসপত্র মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। দেয়ালে গুলির দাগ। মেঝেতে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত।আলনার নিচে বাবার একটা লুঙি পড়ে থাকতে দেখে পাভেল হাঁটু গেড়ে সেটা তুলে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে।
“আব্বা-আ-আ..” এতক্ষণ ধরে বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্টগুলো আর্তচিৎকার হয়ে বেরিয়ে আসে।
“পাভেল, আওয়াজ করিস না। নিজেকে সামলা। এখানে আর থাকাটা ঠিক হইতেছে না। চল।”
“যাব। তবে যাবার আগে আরেকজনের সাথে দেখা করে যেতে হবে।”
“আজকে আর সময় নাই। পরিস্থিতি ভাল হইলে, পরে আবার আসিস।”
“তোরা সবাই চলে যা। আমি দেখা করে এসে তোদের সাথে যোগ দিব।”
“জায়গাটা কই? এখান থেকে দূরে?”
“না, এই গলিতেই। বশীর মৃধার বাড়ি।”
“ওই রাজাকারের বাড়িতে এখন কেন যাবি? ওর বাড়িতে গেলে তো আমাদের অস্তিত্ব ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
“তবুও আমাকে যেতে হবে।”
“কী ব্যাপার! বিশেষ কেউ?”
পাভেল পাথরের মত কঠিন। এই মুহূর্তে অনুভূতি প্রকাশ করার মত মনের অবস্থা ওর নেই।
ঢাকার বাইরে থাকাকালীনসময়ে পাভেলের কানে এসেছে, বশীর মৃধা শান্তি কমিটিতে যোগদান করেছে। তার কাজ মূলত হিন্দু মেয়েদের ধরে ধরে পাকিস্তানি ক্যাম্পে সরবরাহ করা। তবে কোন এক অজানা কারণে কিছুদিন যাবৎ তার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
সেদিনের মত আজ আর পেছনের জানালায় টোকা দিতে হল না। পাভেল এগিয়ে গিয়ে সদর দরজার কড়া নাড়ল। বশীর মৃধা নিজেই দরজা খুললেন।দরজার বাইরে দাঁড়ানোমানুষটাকে দেখে চমকে উঠলেন।
“বাবাজি, তুমি আসছ? আমারে মাইরা ফালাও বাবাজি। আমি পাপ করছি। আমারে মাইরা ফালাও।”
“মুক্তি কোথায়? আমি মুক্তির সাথে দেখা করতে আসছি।”
“মুক্তি নাই, বাবা। আল্লাহ আমার পাপের শাস্তি দিছে। মেজর শরাফত মুক্তিরে তুইলা নিয়া গেছে।”
পাভেলের বুকটাতে কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে একটা বাড়ি মারে।
“আমি পাপ করছি বাবা। তোমাদের পরিবারকে এত বছর ধইরা চিনি। তারপরও তুমি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিছ বইলা আমি নিজে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরে তোমাদের বাড়ি চিনাইয়া দিছি। ওরা তোমারে না পাইয়া তোমার আব্বা আম্মারে মাইরা থুইয়া গেছে।”
হাফিজ অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, এতবড় একটা সংবাদেও পাভেলের চেহারায় কোন ভাবান্তর ঘটে না।
“আমি কত মায়ের বুক খালি কইরা মাইয়াগোরে মেজর শরাফতের ক্যাম্পে নিয়া দিয়া আসছি। তারপরও মেজর শরাফত আমার নিজের মেয়েটারে ছাড়ল না। জানি না, আমার মাইয়াটা বাঁইচা আছে না মইরা গেছে।”
“পাভেল, আর সময় নষ্ট করিস না। এইখান থাইকা চল।”
পাভেলের ডানহাতটা ভোজবাজির মত কিছুটা ওপরে উঠে নিচে নেমে আসে। বশীর মৃধার গলার মাঝখানে রক্তের একটা ক্ষীণধারা দেখা যায়। পাভেল তার হাতের ছুরিটা দিয়ে বশীর মৃধার গলায় একটা পোঁচমেরেছে। বশীর মৃধা প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। ব্যথা অনুভূত হবার পর গলা চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়েছে। দুই হাত রক্তে মাখামাখি। কথা বলার চেষ্টা করায় গলা দিয়ে খক খক আওয়াজ বেরুল।
“চল। দেরী হয়ে যাচ্ছে।” পাভেল নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে।
ছয়.
“তুই কি পাগল হইছিস? আমরা মোটে ছয়জন। মেজর শরাফতের ক্যাম্পে সেনার সংখ্যা জানিস?”
“তোদের কারও আমার সাথে আসার দরকারনেই। এই ব্যাপারটা আমার ব্যক্তিগত। সে কারণে আমি একাই যেতে চাই।”
“মরতে যাবি?” হাফিজ রাগতস্বরে জানতে চায়।
“আমার জন্য এটা সুইসাইড মিশন। মুক্তি বেঁচে আছে কিনা, যে কোন মূল্যে এই তথ্যটা আমার জানা দরকার।”
“জেনে কী লাভ? তাছাড়া তথ্যটা অন্যভাবেও জানা যাবে।”
“মুক্তি বেঁচে থাকলে, যেভাবে পারি ওকে বাইরে বের করে নিয়ে আসব। এটা করতে গিয়েযদি আমি মরেওযাই, দুঃখ থাকবে না।” হাফিজের কোন কথাই আর কানে ঢুকছে না পাভেলের।
“বুঝচ্ছি, তুই এখন কোন কথাই শুনবি না। ঠিক আছে। রাতে যাবার দরকার নেই। ভোর হবার ঘন্টাখানেক আগে আমরা ওদের ক্যাম্পে হামলাচালাব। ওই সময়টাতে পাহারায়ঢিলপড়ে।”
মেজর শরাফতের ক্যাম্পে জনা বিশেক পাক সেনা উপস্থিত ছিল। বাকিদের সম্ভবত অন্য কোথাও পাঠানো হয়েছে। অতর্কিতে হামলা করে প্রথম ধাক্কাতেই পাভেলরা ওদের পাহারারত গোটা দশেক সেনাকে শুইয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাকিরা শেল্টার নিয়ে পাল্টা গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছে। হঠাৎ হাফিজের হাতে একটা গুলি এসে লাগে।
“আমার জন্য চিন্তা করিস না। আমরা ওদের ব্যস্ত রাখছি। যে কাজের জন্য এসেছিস, সেই কাজ তাড়াতাড়ি করে আয়। এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। গোলাগুলির শব্দ শুনে যে কোন মুহূর্তে ওদের ব্যাপআপ টিম চলে আসবে।”গোলাগুলির শব্দ ছাপিয়ে হাফিজ চেঁচিয়ে বলে।
মেজর শরাফত কোথায়, কে জানে। গুলির আওয়াজ শুনে ব্যাটা কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। তালাবদ্ধ একটা ঘরের ভেতর থেকে মেয়েদের গলার আওয়াজ শোনা গেল। পাভেল রাইফেলের বাঁট দিয়ে পর পর কয়েকবার আঘাত করে তালাটা ভেঙে ফেলে। ভেতরে চার পাঁচজন মেয়ে দেয়ালের এক কোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারও গায়ে কোন পোশাক নেই। সবাই নগ্ন। পাভেল ওর গায়ের শার্টটা খুলে ওদের দিকে ছুঁড়ে দেয়। এই মুহূর্তেওর হাতের কাছে দেবার মত আর কিছু নেই।
“ভয় পাবেন না। আমরা আপনাদের বাঁচাতে এসেছি। আপনারা দ্রুত এখান থেকে বের হয়ে যান। ওইদিকে আরও মুক্তিবাহিনীর সদস্য রয়েছে।”
মেয়েগুলোর মধ্যে মুক্তি নেই। মুক্তির কথা কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও কোন লাভ হল না। দিনের পর দিন অমানুষিক অত্যাচারে ওরা ঠিকমত কথাই বলতে পারছে না। মেয়েগুলো বেরিয়ে যাবার সময় একদম শেষের মেয়েটা হঠাৎ পাভেলের দিকে ঘুরে বলল, এই নামে একটা মেয়ে এখানে ছিল। যেদিন রাতে ওরা মেয়েটিকে ধরে এনেছিল, তার পরেরদিনই মেয়েটা আত্নহত্যা করে।
কথাটা শোনার পর পাভেলের শেষ আশার প্রদীপটাও দপ করে নিভে যায়। ঘরটা থেকে বেরিয়ে আসতেই ওপাশের আরেকটা কামরা থেকে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা লম্বাচওড়া জাঁদরেল চেহারার একজন লোক বেরিয়ে আসে। পোশাকে লাগানো বিভিন্ন ব্যাজ দেখে পাভেল বুঝতে পারে, এই লোক সাধারণ কোন সৈন্য নয়। সম্ভবত এই লোকটাই মেজর শরাফত। লোকটার হাতে শোভা পাওয়া পিস্তলের চকচকে নলটা পাভেলের দিকে তাক করা।
“সালে বাঙালি মুক্তি, তুম লোগোকা ইতনা হিম্মত। হামারা ক্যাম্প মে আ কার হামলা কারতে হো।”
মেজর শরাফত আর পাভেল একই সাথে গুলি চালায়। পাভেলের রাইফেলের গুলিতে মেজর শরাফত ছিটকে কয়েকহাত দূরে গিয়ে পড়ে। পাভেল তার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের কাছটা হঠাৎ ভেজা ভেজা বলে মনে হওয়ায় হাত দিয়ে বুঝতে পারে, সেখানে রক্ত। ওর বুকে গুলি লেগেছে। ভালই হল। বাবা নেই, মা নেই, মুক্তিও ওকে একা করে দিয়ে চলে গেছে। ওর আর বেঁচে থেকে কীলাভ? শুধু একটাই আফসোস থেকে গেল। স্বাধীন বাংলার সূর্যটা দেখে যাওয়া হল না। তবে ওর দৃঢ় বিশ্বাস, ও না থাকলেও হাফিজরা নিশ্চয়ই সেই স্বপ্নটা পূরণ করতে পারবে। ওদের যে পারতেই হবে।
সাত.
ধবধবে সাদা একটা টানেল। ওই মাথায় কী আছে, দেখা যায় না। জ্ঞান ফিরে পাবার পর বেশ কিছুক্ষণ হল টানেলটা ধরে পাভেল সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সত্যিই কি এগোচ্ছে? নাকি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে? আশেপাশের দেয়ালগুলো একই রকম।সব ধবধবে সাদা। দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আরও বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর পাভেলের মনে হল, একটু সামনে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। পাভেল পা চালিয়ে দ্রুত সামনে এগোয়। যাক, কারও দেখা তো অন্তত মিলল। আরেকটু কাছে যেতেই মানুষটাকে সে চিনতে পারে, মুক্তি।
“মুক্তি, তুমি..”
“হ্যাঁ, আমি।” মুক্তির মুখে হাসি।
“তুমি এখানে.. তুমি এখানে কীকরছ?”
“তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।”
“তুমি জানতে আমি আসব?”
“একদিন না একদিন তো আসতেই হত। সেই অপেক্ষাতেই ছিলাম। তবে এত তাড়াতাড়ি আসবে, কল্পনাও করিনি।”
“আমরা এখন কোথায়?”
“জানি না। তবে এইটুকু বুঝতে পারছি, আমাদের এই টানেলটার শেষ মাথায় পৌঁছাতে হবে। দাও..” মুক্তি ওর একটা হাত পাভেলের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
“কীদিব?”
“আরে গাধা! তোমার হাতটা দাও।”
পাভেল ওর হাতটা মুক্তির হাতের ওপর রাখতেই মুক্তি ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে।
পাভেল আর মুক্তি দুজন হাত ধরাধরি করে ধবধবে সাদা টানেলটা ধরে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। টানেলের শেষ মাথায় কী আছে, ওরা জানে না। সেটা নিয়ে ওদের তেমন কোন মাথাব্যথাও নেই। দুজন দুজনকে আবারও ফিরে পেয়েছে, এইমুহূর্তে এটাই ওদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
--সমাপ্ত--