সমুদ্র লতা

বাংলাদেশ (ডিসেম্বর ২০১৯)

রঙ পেন্সিল
  • 0
  • ৪৯
এক.

ধোঁয়া ওঠা গনগনে গরম হারিসের প্লেটের দিকে কেবল হাত বাড়িয়েছি,'আংকেল' বলে একটা নরম মেয়েলী ডাক শুনে মাঝপথেই হাতটা থেমে গেলো। আস্তে করে হাতটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম। মখমলের পর্দা সরিয়ে একটা মুখ মজলিশের দিকে ঝুঁকে আছে। শরীরের বাকি অংশ পর্দার পেছনে। মেয়েটার মাথায় কালো হিজাব। হিজাবের কড়া শাসনের বেঁড়া ডিঙিয়ে এক গোছা লালচে বাদামী চুল কপালের এক পাশে ছড়িয়ে আছে।
গায়ের বা চুলের রং কোনটাই বাঙালীদের মত নয়। তারপরও কেন যেন মনে হলো মেয়েটা বাঙালী। চোখের এমন রহস্যময়ী গভীরতা কোন বাঙালী মেয়ের না হয়েই পারেনা।

ডাক শুনে মজলিশের প্রায় সব পুরুষের চোখই দরজার দিকে ঘুরে গেলো। আজ এ বাড়ির মেয়ের বিয়ে পরবর্তী অনুষ্ঠান। মাইজারে বসবাসরত প্রায় সমস্ত চেনাজানা বাঙালী পরিবার এখানে একত্র হয়েছে। পুরুষেরা সবাই মজলিশে বসে খাওয়াদাওয়া করছি,মেয়েরা সব অন্দরমহলে।
মজলিশে সাধারণত কোন মেয়ে আসেনা,তাই স্বভাবতই সবাই কৌতুহলী চোখে মেয়েটিকে দেখছিলো। মেয়েটি তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে একবার সবার উপর থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।
মেয়েটি যাকে আংকেল বলে ডাকলো তিনি আজমল সাহেব। আমার চেনাজানা। এবার বুঝতে পারলাম কে এই মেয়ে। আজমল সাহেবের ভাগ্নী। নাম বোধহয় সারা বা সায়রা এ ধরনের কিছু।
আজমল সাহেবকে নীচু গলায় মেয়েটি কিছু বলাতে তিনি পকেট হাতড়ে সম্ভবত গাড়ির চাবি বের করে মেয়েটির হাতে দিলেন। মেয়েটি ভেতরে চলে গেলো।

বাসায় ফেরার পথে গাড়ি চালাতে চালাতে সারাক্ষন মেয়েটির কথা ভেবেছি।
মেয়েটিকে এই প্রথম দেখলাম। এর আগে অনেকবার এর কথা শুনেছি কিন্তু কখনো পরিচয় হয়নি। মেয়েটি নিজে বাঙালী অথচ বাঙালীদের দুচোখে দেখতে পারেনা। এ তথ্যটা মুখে মুখে শুনেছিলাম,তখন ওকে দেখার কিছুটা কৌতুহল ও হয়েছিলো। আজ মেয়েটিকে দেখে মনে হলো কথাটা শোনা কথা হলেও একশো ভাগ সত্যি। কাউকে অন্তস্তল থেকে ঘৃনা না করলে কারো পক্ষে ওভাবে কারো দিকে তাকানো সম্ভব নয়।
কিছুদিন হলো মা বাবা কাতারেই কিছু বাঙালী পরিবারের মধ্যে আমার জন্য পাত্রী খুঁজছে।

ঐ মেয়েটিকে দেখার পর বুঝেছি এর হাত থেকে আমার মুক্তি নেই। তাই দেরী না করে মাকে বললাম ওর কথা। মা কন্ঠে একরাশ হতাশা ঢেলে বললেন, সারাকে তাদের খুব পছন্দ ছিলো,কিন্তু সারা নিজ মুখে অনেকটা আস্পর্ধা মেশানো গলায় জানিয়ে দিয়েছে কোন বাঙালী ছেলে বিয়ে করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর আর কথা এগোয়নি।


দুই.

মেজাজটা কিছুক্ষন ধরে খিচড়ে ছিলো। ক্যাপাচিনো কফির কাপে এক চুমুক দিতেই উষ্ণ একটা আনন্দ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। এমনই হয় আমার। মন বা মেজাজ খারাপ দীর্ঘস্থায়ী হয়না।
সারা কিছুই খাচ্ছেনা। লা ভিলাজিও'র রেস্টুরেন্টে বসে আছি। বিয়ের এই তিন মাসের মধ্যে এখানে অনেকবার এসেছি। নিগুঢ় ভাবে খেয়াল করে দেখেছি এ জায়গাটা সারার খুব পছন্দ। কিন্তু আজ কেমন চুপচাপ বসে আছে। এখন ও আমার স্ত্রী,অথচ ওকে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিনা। যতই ওর মনের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছি ততই সবকিছু কেমন পিছলে যাচ্ছে।
আজ বেরোনোর সময় প্লান করেছিলাম এখানে এসে ওকে বিশেষ কিছু কথা বলবো। কথার ফাঁকে নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতাও। বিয়ের পর এখন পর্যন্ত এসব বলা হয়নি। সারা শুনতে না চাইলেও আমাকে বলতে হবে।
কফি শেষ করে আমরা লেকের পাশে এসে দাড়ালাম।
মাথার উপর কৃত্তিম আকাশ। আকশের নিচে যন্ত্রচালিত পুতুলের মত সারা দাড়িয়ে আছে। কি ভাবছে এত? জিজ্ঞেস করলেও উত্তর পাবোনা জানি,তাই কিছু বললাম না। টের পাচ্ছি আস্তে আস্তে আবার আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
বিয়ের আগে মনে হয়েছিলো একটা বাঙালী মেয়েকে কব্জায় আনা এমন কি কঠিন ব্যাপার! কিন্তু এখন যখন কিছুতেই ওর সাথে পেরে উঠছিনা তখন এই বরফের মানবীকে হঠাৎ হঠাৎ অসহ্য ঠেকছে।
সারাকে আমি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিয়ে করেছি ঠিকই অথচ আমাদের বিবাহিত সম্পর্কটা ঠিক স্বামী স্ত্রীর মত না। আমার প্রতি সারার কোন উষ্ণতা নেই,কোন প্রতিক্রিয়া নেই। আছে শুধু অনন্ত ঘৃনা।

আমি সারার হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে ডাকলাম, 'সারা শোনো।' সারা আমার দিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকালো।
সারার সেই দৃষ্টির সামনে কেমন যেন শীত শীত লাগছে। যা বলতে চেয়েছিলাম তা সব তালগোল পাকিয়ে গেলো। বিয়ের পর আজ প্রথম মনে হলো সারাকে বিয়ে করে কোন ভুল করলাম নাতো!

তিন.

বিমানবন্দরের সমস্ত ঝামেলা চুকিয়ে যখন সারাকে নিয়ে বাইরে বের হলাম তখন বাংলাদেশে সবেমাত্র ভোর হয়েছে। চারদিকে আলোয় মাখামাখি স্বচ্ছ কুয়াশা।
ভোরের এই নিষ্কলুষ পরিবেশ দারুণ লাগছে। ১৬ই ডিসেম্বর পেরিয়ে গেলেও সকালের নরম রোদে এখনো বিজয় বিজয় গন্ধ লেগে আছে।
এবার অনেকদিন পরে দেশে এলাম। ইচ্ছে ছিলো ডিসেম্বরের শুরুতে আসার,কিন্তু ছুটি জটিলতায় দেরী হয়ে গেলো।
দাদা,দাদি মারা যাবার পর আর আসা হয়নি। এবার এসেছি সারার জন্য।
সারা আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহন করতে না পারুক তাতে ক্ষতি নেই,সারা চাইলে ওকে অবশ্যই আমাদের এই রোজকার অকিঞ্চিৎকর জীবন থেকে মুক্তি দেব। কিন্তু একজন মানুষ আজীবন নিজের শেকড় জানবে না,শেকড়ের টান অনুভব করবেনা এর চেয়ে দুঃখের আর কি হতে পারে?
এসব সাত পাঁচ ভেবে অফিস থেকে মাসখানেকের ছুটি নিয়ে দেশে এসেছি।
বিমানের ছয় ঘন্টার ভ্রমনে এসব কথাই সারাক্ষণ ভেবেছি কিন্তু কিভাবে শুরু করবো মাথায় আসছেনা।

এবার মিরপুরে আমাদের বন্ধ ফ্লাটে না উঠে হেমায়েতপুরে ছোট দাদুর বাড়ি উঠেছি।
শেষবার দাদুকে যেমন দেখে গিয়েছিলাম এখনো ঠিক তেমনই আছেন। গায়ের জোর আর মনের জোর দুটোই আগের মতই টনটনে। বাঁজখাই গলাটাও। এখনো আগের মত সামাজিক কজকর্ম করছেন।
আমরা এ বাড়িতে উঠেছি বলে দাদু খুব খুশি হলেন। বিশেষ করে সারার জন্য।
দেশের মাটিতে পা রেখেই সারাকে আমি নিবিড়ভাবে খেয়াল করতে শুরু করেছি। ওর চোখের তারায় যে ঘৃনার পর্দা ঝুলে আছে তাতে এখন পর্যন্ত কোন কাঁপন টের পায়নি। জানিনা কতটুকু সফল হবো। হয়তো পুরো ছুটিটাই মাটি হবে।

বিকেলে ভাতঘুম থেকে উঠে দেখলাম রুমে সারা নেই। বাইরে থেকে ওর গলার আওয়াজ পাচ্ছি। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি দাদী আর সারা উঠানে পাটি পেতে বসে আছে। সারা একটা কাঁঠাল গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে। ওর চোখে হাসি।
অনেক অনেক দিন টানা বৃষ্টির পরে উষ্ণ রোদ উঠলে যেমন লাগে ঠিক তেমন একটা অনুভূতি হলো আমার। বিয়ের পর সারাকে হাসতে দেখেছি কিন্তু সে হাসির রেশ চোখ পর্যন্ত কখনো পৌছায়নি। দাদী আর সারা যে ঠিক কি নিয়ে কথা বলছে জানিনা তবে সারার এই অনন্দে ভেজা চোখ দেখে আমার ভীষণ ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। তবে কি দেশের মাটিতে পা রাখতে না রাখতেই জমাট বরফ গলতে শুরু করলো?
প্রচন্ডরকম ভাল লাগা নিয়ে আমি আস্তে করে জানালার ধার থেকে সরে এলাম।

চার.

এ বাড়িতে শুধু দাদু আর দাদি থাকেন। এই বয়সেও দাদু, দাদির নিজস্ব বোঝাপড়াটা দারুন। গার্হস্থ আর প্রাত্যহিক জীবন যে কারো এত চমৎকার হতে পারে তা তাঁদের না দেখলে বোঝা যেত না।
দাদুর ছেলেমেয়েরা যে যার জায়গায় কর্মব্যস্ত। কদাচিৎ গ্রামে মা বাবার কাছে আসার সময় পান। দাদু একজন মুক্তিযোদ্ধা। হয়তো সে কারনেই এখনো প্রচন্ডরকমের আত্মনির্ভরশীল। তাই এই বৃদ্ধ বয়সেও ছেলেদের কাছে না গিয়ে নিজেদের মতো করে এখানে থাকছেন। দুজন কাজের লোক আছে বাড়িতে,তারাই মূলত বাড়িঘর, জায়গা জমির দেখাশোনা করে।

গতকাল রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দাদু বলে গিয়েছিলেন আজ খুব ভোরে সারাকে পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাবেন। সারার সংগ পাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে আমিও সংগী হয়েছি।
ঘুম ঘুম চোখে হাটতে হাটতে আমরা বাড়ি থেকে অনেকদূর চলে এসেছি। দাদী ভাপা পিঠা বানানোর আয়োজন করছেন তাই আমাদের সংগী হতে পারেন নি।
আমাদের সামনে বিস্তৃত জলাভূমি। যেদিকে চোখ যায় শুধু শাপলা আর শাপলা। এই শিশির ভেজা স্বাধীন ভোরের ও যে আলাদা স্বাদ আছে তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অধিকার কোন বাঙালীর নেই। এটা অবশ্য দাদুর কথা। দাদুর মতে,প্রকৃতির সংস্পর্শ আত্মাকে পুনরুজ্জীবিত করে। মানুষের তো একটাই জীবন। এই অমূল্য জীবনকে মুঠির মধ্যে আলগোছে ধরে না রেখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দমকা হাওয়ার মত বাঁচা উচিৎ। তবেই না মানবজীবন সার্থক।
আমাদের বাঁয়ে দাদুর জমি। ধান ক্ষেত। ধানক্ষেতের ওপাশে খানিকটা বিলের মত জায়গায় প্রচুর কচুরিপানা ফুল ফুটে আছে। দিনের প্রথম আলোর নরম ছোঁয়ায় কচুরিপানা ফুলের নীলচে বেগুনী রং অপূর্ব লাগছে। রাস্তার পাশে মাটির বুকে জড়িয়ে আছে অসংখ্য লজ্জাবতী লতা। কি দারুন গোলাপি ফুল ফুটেছে। ইচ্ছে করছে মুঠি মুঠি ফুল ছিড়ে সারা কে দেই।
দাদু আর সারা একটা ডিংগি নৌকায় চড়ে বসেছে। সারার হাতেও একটা বৈঠা। ওর মুখের ডান পাশে সূর্যের ঝিলিমিলি রোদ লেগেছে। এক গোছা খোলা চুল মৃদু হাওয়ায় উড়ছে। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি।
শাপলার ফুল মাড়িয়ে মাড়িয়ে ডিংগি এগিয়ে চলছে। নৌকার মাথা ঠিক রাখতে বৈঠা হাতে সারাকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে।
সারার অবস্থা থেকে দাদু দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে অট্টহাসি হাসছেন।
দাদুর হাসির শব্দে এক ঝাঁক কাদাখোঁচা আর বালি হাস উড়ে গেলো। আমি চমকে উঠলাম। আশ্চর্য ! এত গুলো পাখি এই জলাশয়ে ছিলো অথচ টেরই পেলাম না!
রাশি রাশি শাপলা ফুল নিয়ে সারা যখন নৌকা থেকে নামলো তখন ওকে মনে হচ্ছিলো ও এ পৃথিবীর কেউ না। স্বর্গের দরজা খোলা পেয়ে হয়তো কোন অতি মানবী আমাদের এই ছোট্ট সুন্দর রূপকথার মত দেশটাতে চলে এসেছে।

পাঁচ.

নিস্তব্ধ রাত। বহুদূর থেকে হঠাৎ হঠাৎ দু একটা গাড়ির আওয়াজ ভেসে আসছে। পূর্ন চাঁদ আকাশে। ভরা জোৎস্নায় মাখামাখি সব। উঠান জুড়ে গাছের বড় ছায়ার নাচন। হঠাৎ দেখলে গা ছমছম করে ওঠে। এমন মন কেমন করা রাতে আমি চন্দ্রগ্রস্তের মত সারার আবছা অবয়বের দিকে তাকিয়ে আছি।

সারা কাঁদছে। অঝোর ধারায় কাঁদছে। দাদি সারার মাথায় হাত রেখে অনড় বসে আছেন। দাদু একটু দূরে বসে আকাশের দিকে চেয়ে আছেন।
আমাদের সম্পর্কের ফাঁকটুকু দাদু, দাদীর কাছে গোপন থাকেনি। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি কেউ যেন না বোঝে,অথচ তাঁদের অভিজ্ঞ চোখ ঠিকই ধরে ফেলেছে। দাদু আমাকে আলাদা ডেকে জানতে চেয়েছিলেন। প্রথমে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু কি ভেবে সবই বলে ফেললাম।

সারার বাবা মা পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিলেন।
তখন দুজনে সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছেন,ফুটন্ত রক্তে তখনো ঝিম ধরেনি। তাই দুজনের পরিবার থেকেই যখন তাদের বের করে দেয়া হলো তখনও ভেংগে পড়েননি তারা,ছোট্ট করে সংসার পেতেছিলেন দুজনে। বছরের ছয়টি ঋতুই ঠিকঠাক কাটছিলো তাদের। উষ্ণতায় আর ভালবাসায়। কিন্তু সারার জন্মের চার বছর পরে একদিন সব গুলো ঋতুই শীত হয়ে এলো সারার মায়ের জীবনে।

সারার বাবা এখনও জার্মানিতে দ্বিতীয় স্ত্রীর সংগেই আছেন। সারার মা অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে সারাকে নিয়ে কিছুটা সুস্থির হয়েছেন। তিনি কাতারে একটা বাংলাদেশী স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
মেয়ে সারাকে নিয়ে বেশ ভালই কাটছিলো জীবন।
কিন্তু ঝরা পাতা ওড়ানোর মত একটা দমকা হাওয়া এবার সারার জীবনটাকেই এলোমেলো করে দিলো।

কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সারার সংগে এক বাংগালী ছেলের আলাপ হয়। আলাপ একপর্যায়ে প্রেমে গড়ায়। অতঃপর দুই পরিবার থেকেই বিয়ের জন্য চাপ আসে। সারা তো এক কথায় রাজীই ছিলো। কিন্তু হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেলো কেউ বুঝতে পারলোনা। বিয়ের তারিখ পর্যন্ত ঠিক হয়েছিলো,অথচ ছেলেটি বিয়ের দুদিন আগে সারাকে কিছু না জানিয়ে কানাডায় চলে যায়। যাওয়ার আগে মেসেঞ্জারে সারাকে ছোট্ট করে লিখে গেলো, 'It’s not love'।
তারপর থেকে সারার মাঝে বাংলাদেশ নিয়ে একধরনের তীব্র ঘৃনা শুরু হলো। নিজের বাবা আর নিজের প্রেমিকের এমন অভিনব আচরনে সারা একসময় আর নিজেকেই বাংগালী বলে স্বীকার করতে চাইতোনা।
বাংলার ছাপ শরীর থেকে মুছে ফেলতে কালো চুলের গোছা বাদামী করিয়ে নিলো,বাদামী কন্টাক্ট লেন্স পরা শুরু করলো। আর আরবীটা জানা থাকায় কালো বোরখা আর হিজাবে পুরোদস্তুর কাতারি তরুনী বনে গেলো।

ছয়.

সারাকে স্মৃতিসৌধ দেখাতে নিয়ে এসেছি। আমি ওকে কোন ইতিহাস বলিনি,স্মৃতিসৌধের সাতটি ত্রিভুজ আকৃতি মিনারের মানে বলিনি। বলিনি সাতজোড়া দেয়াল কেন ক্রমশ ছোট থেকে বড়ক্রমে সাজানো হয়েছে। আমি চাই সারা নিজে থেকে এ দেশ সম্পর্কে আগ্রহী হোক,ঔৎসুক্য আসুক,সপ্ন দেখুক।
গেট থেকে বেরোতে বেরোতে ভাবছি কাল ওকে শহীদ মিনারে নিয়ে যাবো। পরক্ষণেই মনে হলো, না। বছরের একটা দিন ছাড়া শহীদ মিনার যে অনাদরে পড়ে থাকে সে করুন রূপ সারাকে দেখানো ঠিক হবেনা।
প্রতিটি দেশেরই এপিঠ ওপিঠ থাকে। আমি সারাকে শুধু এক পিঠ দেখাতে চাই।
সারা যদি আমাকে মেনে নেয় তাহলে কোন এক একুশে ফেব্রুয়ারি নিশ্চয়ই যাবো। ভাষা আন্দোলনের মহান শহীদদের প্রতি দুজনে একসাথে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবো।

সারা আর আমি বাচ্চাদের একটা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মাত্র স্কুল ছুটি হলো। বাচ্চারা ঝালমুড়িওয়ালা,ফুচকা ওয়ালা,আইসক্রিম ওয়ালাকে ঘিরে ধরেছে। ঝালমুড়িওয়ালার হাতের কাজ সারা অবাক চোখে দেখছে। কত দ্রুততা আর নিপুন ভাবে মুড়ি মাখিয়ে,ঝাকিয়ে কাগজের কোণাকৃতি ঠোঙায় ভরে একেকজনের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। একটা মুড়িও স্থানচ্যুত হচ্ছেনা।
ঝালমুড়ির ঘ্রাণ আমাকেও স্কুল দিনের কথা মনে করিয়ে দিলো। আমি বাচ্চাদের ভীড়ে ঢুকে পড়ে অনেক ঝামেলা করে শেষ পর্যন্ত কিনতে পারলাম।
কাগজের চামুচ দিয়ে উঠিয়ে একবার মুখে দিতেই মনে হলো স্বাদটা ঠিক আছে কিন্তু কিছু একটা নেই! হ্যা যা ধরেছিলাম তাই। পিয়াজ। আশ্চর্য! পিয়াজ ছাড়া ঝালমুড়ি হয় নাকি? ভুল করে দেয়নি নাকি পিয়াজের খুব দাম বাংলাদেশে?
খেতে খেতে ঝালমুড়ির ঠোঙাটা সারার দিকে বাড়িয়ে দিলাম,সারা মুখ ফিরিয়ে নিলো।
সারার এই আচমকা মুখ ফিরিয়ে নেয়া দেখে হঠাৎ করে আমার মনে হলো সারা বোধহয় জোর করে আমাকে ঘৃনা করছে। জোর করতে হচ্ছে কারন ওর ঘৃনার বোধে সম্ভবত একটু একটু করে মরচে ধরছে।

সন্ধার দিকে বাড়িতে ফিরে দাদু,আমি আর সারা উঠানে বসে আছি।
দাদু আজ মাওয়ার ঘাটে গিয়ে পদ্মার রূপালী ইলিশ এনেছেন। দাদি এখন সেই ইলিশ রান্না করছেন। বাতাসে ইলিশের এমন একটা দারুন গন্ধ বেরিয়েছে যে আমার হঠাৎ করে সেই শৈশবে শোনা মেছোভূতের গল্পের কথা মনে পড়লো। মনে হলো এখনি একটা লম্বা হাত এসে নাকি সুরে বলে উঠবে, এক..টা মাছ দে না..ক..ত দি..ন মা..ছ খাই..নি....।

দাদুদের বাগানে একটা ছাতিম গাছ আছে। এখন কি ছাতিম ফুল ফোটার সময়? মাদকতা মেশানো ফুলের গন্ধে চারপাশ যেন জমে গেছে। বুকের মধ্যে কেমন যেন টনটন করে ওঠে।
দাদু সারার পাশে এসে বসেছেন। হয়তো সারাকে কিছু বলবেন। সারা মুখ নীচু করে বসে আছে।


সাত.

আজ শুক্রবার। সকালের আলো ফোটার আগেই আমরা চারজন বেরিয়েছি। ডেমরার জামদানী হাটে যাবো। দাদু,দাদী সারাকে একটা শাড়ি উপহার দিতে চান।
ঢাকায় এতগুলো দোকান রেখে একটা শাড়ির জন্য ডেমরায় যেতে হচ্ছে। দাদুর রকম সকমই এমন। নিজের মত সবাইকে শিকড়ের খোঁজ করতে বলেন। শাড়ি কেনার পাশাপাশি শাড়ির কারিগরদের জীবনচিত্রও সারাকে দেখিয়ে আনবেন। একবার ভেবেছিলাম শাড়ি কেনার সময় আমার না থাকলেও চলবে,কিন্তু সাথে তাঁত পল্লী ঘুরে আসার লোভ সামলাতে পারলাম না।
দাদুর ধারনা হয়েছে একদিন হুট করে হয়তো আমরা কাতারে চলে যাবো তাই আগেভাগেই সব সেরে রাখতে চাইছেন।
গতকাল প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত দাদু সারার সাথে কথা বলেছেন। এই স্মৃতিচারণের বয়সেও দাদুর বিচক্ষণতা দেখে আমি অবাক হয়েছি। দাদু সারাকে কোন প্রশ্ন করেননি। নিজের মত করে নানান কথা বলেছেন। ভাষা আন্দোলনের কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা, 'জয় বাংলা' স্লোগানের কথা,বিজয়ের কথা,দেশের কথা,পতাকার কথা,সংস্কৃতির কথা,জীবনবোধের কথা।
দাদু সারাকে কোন উপদেশ দেননি,কোন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করেননি,কিছু ভুলে যেতে বলেন নি। শুধু আশ্চর্য রকম শান্ত গলায় এ দেশের প্রতিটি অধ্যায় সারার সামনে একটু একটু করে মেলে ধরেছেন। 'বাংলাদেশ' নামের ইতিহাস যেমন ব্যাখা করেছেন তেমনি এই রুপসী বাংলার প্রকৃতির কথা শুনিয়েছেন। দেশের বর্তমান অবস্থা বোঝানোর পাশাপাশি পাহাড়ি বৃষ্টির বর্ণনা দিয়েছেন,পদ্মা মেঘনার ভাঙন,সুন্দরবনে মানুষের সাথে বাঘ-কুমিরের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কথা বলেছেন। বাউলগান, বাংলাদেশের মানুষের অতিথিয়তা আর সরল সহজ গ্রামীণ জীবনের কথা পুঁথি পাঠের মত করে শুনিয়েছেন।
দাদুর মুখে এসব কথা শুনতে শুনতে কেমন তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম। ক্ষনিকের জন্য হলেও ভুলে গিয়েছিলাম মুদ্রার অপর পিঠের কথা।

জামদানী পল্লী ঘুরে শীতলক্ষ্যায় এসেছি নৌকা ভ্রমণ করতে। সূর্যটা মাঝ আকাশ বরাবর। চারদিকের হৈচৈ আর হাঁকডাকে সূর্যের আঁচ কয়েকগুন বেড়েছে বলে মনেহলো।
দাদু এক নৌকার মাঝির সাথে কথা বলছেন। দর কষাকষি করে যখন নৌকা ঠিক করা হলো তখন সারা বেঁকে বসলো। নদীর কালচে পানি দেখে ও কি ভাবলো জানিনা তবে নৌকায় উঠতে আর রাজি হলোনা।
বাড়ি ফিরবো বলে যখন গাড়ির কাছাকাছি এলাম ঠিক তখনই একজন লোক হাতে কি একটা নিয়ে পেছন থেকে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে এলো। কাছে আসার পর চিনতে পারলাম। নৌকার সেই মাঝি।

আট.
আমাদের সামনে লোনা পানির জলাভূমি। তার ওপাশে বাঁকখালি নদী।
বাংলাদেশের অন্যান্য নদীগুলোর মতই পলি জমে জমে এ নদীটাও প্রায় মরতে বসেছে। তবে এখনো দুবেলা জোয়ারভাটা হয় বলে রক্ষা। এখন নদীতে জোয়ার এসেছে। নদী ছাপিয়ে জলরাশি জলাভূমি ছাড়িয়ে জেলেদের উঠানে ঢুকে পড়েছে। নদীর উপর কয়েকটা সী-গাল ঘুরে ঘুরে উড়ছে।
আকাশের ধুসর পটভূমিতে রাতের শিকার শেষে এক ঝাঁক বাদুড় উড়ে গেলো। সারা তন্ময় হয়ে দেখছে। আমি নিবিড়ভাবে সারাকে লক্ষ্য করছি। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে সারার মুখে এক আশ্চর্য নরম সারল্য ফুটে উঠেছে।
পাহাড়ের পেছন থেকে একটু একটু করে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। হাজারটা রং লেগেছে পৃথিবীতে। বিদ্যুতের তারের উপর বেশ কিছ শালিক বসে নিজেদের আলাপ সেরে নিচ্ছে। দু চারটা ঘুঘুও যোগ দিয়েছে ওদের সাথে। কিচ কিচ চিক চিক। একটু একটু করে জেগে উঠছে পৃথিবী। শুরু হচ্ছে আরেকটা নতুন দিন।

সারা আর আমি দিন দুয়েক আগে এখানে বেড়াতে এসেছি। কক্সবাজারে এসে হোটেলে না উঠে এবার এক বন্ধুর জোরাজুরিতে ওর বাড়ি উঠতে হয়েছে।
সমুদ্র সারাকে টানেনা।
তাই আজ দুদিন হলো এখানে এসেছি অথচ একবারও সমুদ্রে যাইনি। সমুদ্র একা দেখা যায়না। সারার হৃদয়ে জমা সুপ্ত ঘৃনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ও এখনো আমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহন করতে পারছেনা।

নির্জন বিকেল।
সারাকে নিয়ে শহরের বাইরে ঘুরতে এসেছি। ও আজ গাউন ছেড়ে দাদুর দেয়া শাড়িটা পরেছে। শাড়ির উপর একটা শাল জড়িয়েছে। একটু আড় চোখে খেয়াল করে দেখলাম অনামিকায় বিয়ের আংটিটাও আছে।
সেদিন সেই নৌকার অচেনা মাঝিটি সারার দিকে একটা আংটি বাড়িয়ে দিয়েছিলো। আমাদের বিয়ের আংটি।
সারার হাত থেকে সেদিন আংটিটা কোনভাবে পড়ে গেয়েছিলো অথবা ও ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছিলো। মাঝিটি সেটা দেখতে পেয়ে তুলে নিয়ে আমাদের পেছন পেছন দৌড়ে এসে ফেরত দিয়ে যায়।

আংটি হাতে পেয়ে সারা কেমন হতভম্ব হয়ে যায়। তারপর থেকে ও আরও বেশি গম্ভীর হয়ে যায়। কি যেন ভাবে সারাক্ষণ। বাড়ি ফিরে শুধু দাদুকে একবার প্রশ্ন করেছিলো, why did he return it?
আমরা হাটঁতে হাটতে পিচঢালা রাস্তা ছেড়ে নোনা মাটির রাস্তায় নেমে পড়লাম। রাস্তার দুধারে প্রচুর বেগুনী ঘেঁষা গোলাপি ফুল ফুটেছে। সমুদ্র লতা। গাড় সবুজ পাতার ভেতর থেকে উদ্ধত ভংগিমায় ফুটে আছে। কয়েকটা গঙ্গা ফড়িং এক ফুল ছুঁয়ে আরেক ফুলে উড়ছে।
সারা এক হাতে শাড়ী সামলে কিশোরী মেয়ের মত লোভী দৃষ্টিতে ফুল দেখছিলো। আমাকে ওর দিকে তাকাতে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, Look at the Beach morning glory! What better than that is to survive!
বিয়ের পরে এই প্রথম সারা আমার সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বললো।
বাংলার চিরসবুজ পটভূমিতে বাসন্তির মাঝে কালো রঙা জামদানীতে সারাকে যে কি সুন্দর লাগছে! ঠিক যেন একটা 'হলুদ সোনাবৌ' পাখি। আমার কেমন যেন পাগল পাগল লাগছিলো।

শেষ বিকেলের সোনা রঙা আলো এসে পড়েছে ওর চোখে মুখে। সেই আলোতে ক্ষনিকের জন্য দেখতে পেলাম সারার চোখ থেকে ঘৃনার পর্দাটা টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়লো।
আচমকা আমার বুকের মধ্যে একটা নিখাদ সুখ চিন চিন করে উঠলো। নিশিতে পাওয়া মানুষের মত একের পর এক ফুল ছিড়ে সারার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলি, আমার সোনার বাংলা....আমি তোমায় ভালবাসি....।









আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মোখলেছুর রহমান ভোটিং বন্ধ।শুভ কামনা রইল।
সেলিনা ইসলাম চমৎকার লাগলো গল্প! গল্প বলতে বলতে দেখে নিলাম দেশের অপরূপ সৌন্দর্য! যা গল্পের মাধুরীকে বাড়ীয়ে দিয়েছে শতগুণ। সারা স্বজাতি চিনতে ভুল করলেও,শিকড়ের সাথে পরিচিত হয়ে সেই ভুল ভেঙে গেছে দেখে বেশি ভালো লাগলো। প্রবাসে একটা ব্যাপার বেশ শোনা যায়-"বাঙালিরাই বাঙালিদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে,বিশ্বাসঘাতকতা করে!" অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।
Gazi Saiful Islam গল্পটা ভালো, ভাষাও। আশাকে অনুরোধ করব আমার গল্প ‘দীপাদের বাতিঘর’ পড়ার জন্য, পুরোটাই রাজনীতির কিন্তু প্রেমের, ব্যর্থ প্রেমের

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

'বাংলাদেশ' নিয়ে একটু ভিন্নভাবে গল্পটি লিখেছি।

০৩ আগষ্ট - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ১৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪