পদ্মলোচন

উষ্ণতা (জানুয়ারী ২০২২)

পুলক আরাফাত
  • 0
  • ৫৭
ভোর ছয়টা বাজে। বারান্দায় ছোট্ট বাগানটায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে দীপ্তি। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। প্রায়ই ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছে সাতাশ মাস বয়সী প্রীতি। প্রথম সন্তান; আর একারণেই খেয়ালটা খুব বেশিই। প্রীতি এখনো ঘুমে। বারান্দায় গ্রিলে ঝুলিয়ে রাখা ফুলের টবে বিভিন্ন ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে দীপ্তির খুব ভালো লাগে। ইদানিং নিজের প্রতি খেয়ালটা একটু কম। বাচ্চার প্রতিই তার সমস্ত খেয়াল।

চারদিকে ঘন কুয়াশা। গতকাল বৃষ্টি হয়েছে খুব; সেজন্যই কুয়াশা। যেন জোর করে ঘাড় ধরেই শীত নামাবে এ বৃষ্টি। প্রকৃতি খেয়ালি নয়, খুব হিসেবি। মানুষ প্রকৃতির মোচড় বুঝে। মানুষের মন সবসময় প্রকৃতির আনাচে কানাচে থাকে। মানুষ যখন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রতিবেশ পরিবেশ একাংশে হয় সমর্থন দেয় না হয় বাদবাকি বিচ্ছিন্নে বিরোধিতা করে। সৃষ্টিকর্তার মানুষকে দেয়া সবচেয়ে বড় উপহার হলো মন। মনের কারণেই মানুষের আবেগ, উপস্থিতি-অনুপস্থিতি, সবকিছু। সৃষ্টিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার মতো ক্ষমতা এসেছে মন দিয়ে সৃষ্টি করার কারণেই। মানুষ সুন্দরের পূজারী। দেখতে ভালো হলে মোহে আচ্ছন্ন থাকে। মোহ থেকে হয় প্রেম। কিন্তু মানুষ যখন একে অপরকে ভালোবাসে তখন কিন্তু সুন্দর মনের পরিচয় পেয়েই ভালোবাসে। দেহের সৌন্দর্য চিরদিন থাকে না। নির্দিষ্ট এর সীমানা। অপরদিকে মৃত্যু অবধি মনের সৌন্দর্য অটুট থাকে। হঠাৎ সৌন্দর্য দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়। কিন্তু মনের সৌন্দর্যে হয় অভিভূত।

দীপ্তি বারান্দায় সন্ধ্যামালতি ফুলগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলোই ভাবছিল তন্ময় হয়ে। শুধু এসব নয় নিজের উজ্জ্বল অতীতেও খানিক ডুবেছিল। কখন যে সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে খেয়ালই নেই। সকাল আটটায় ওকে বেরুতে হয়। পরিপাটি হতে হতে সাড়ে সাতটা বেজে যায়। কাজের মহিলাটিকে দীপ্তি আপা বলে ডাকে। পরোটা আর সবজি বা ডিমভাজি করতে বলে নিজে প্রস্তুত হতে থাকে। দুই বাথরুমে দু’জন ঢুকে। গোসল সেরে দীপ্তির বর ডাইনিং টেবিলে বসে মুখে একটুখানি পরোটা গুঁজে দিয়েই দ্রুত নাস্তা সারতে তাগাদা দিচ্ছে। “কই, তোমার হলো? সাড়ে আটটা বাজিওনা, বুঝলে? আটটার পরে বেরুলে কিন্তু রাস্তায় জ্যাম হয়। পৌনে আটটা কিন্তু বেজে গেছে।“ “এক মিনিট নিশীথ, হয়ে গেছে।“ হাত আর মুখে খানিকটা সানস্ক্রিন লোশান মেখে দ্রুত নাস্তা শেষ করে পানি খেয়ে চটজলদি বের হতে যাবে অমনি প্রীতি কেঁদে উঠলো। ও ভাঙা ভাঙা গলায় বলছে, “আম্মু, আজ অফিসে যাবা না।“ মেয়েকে দুই গালে আর কপালে চুমু দিয়ে কাজের লোককে বললো ঠিকমতো খেয়াল রাখতে। “রেবু আপা, কোন সমস্যা হলে আমাকে একটা কল দিবেন। আপনি নাস্তা করে নেবেন, আমরা আসি।“ কাজের মহিলা রেবু একেবারে নিজের সন্তানের মতো প্রীতিকে আদর করে। দীপ্তির বর নিশীথ একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে। আর দীপ্তি একটা সুপরিচিত হসপিটালের প্রশাসনে কাজ করে। সারাদিন অফিস করে এসেই দু’জন প্রীতির খপ্পরে পড়ে। “আম্মু, বাইরে যাবো।“ ছোট্ট শিশুটার আবদার কি করে ফেলে সে? স্বামী-স্ত্রী দু’জনই রিকশা করে একটু ঘুরে আসে। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের বিনোদনকেন্দ্রে নিয়ে যায়। সে মোবাইলে কার্টুন দেখে দেখে খায়। ল্যাপটপের জন্য পাগল। কার্টুন দেখে দেখে খেতে অভ্যস্ত হলে চোখের খুব ক্ষতি হয় বাচ্চাদের। পরেও এই অভ্যাস থেকে যায়। কম্পিউটার আসক্তি ভালো বিষয় নয়।

অফিসে বক্সে করে খাবার নিয়ে যায় দীপ্তি। দুপুরের দিকে খাবারটা ঠাণ্ডাই হয়ে যায়। খাবার পর গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়ে নেয় সে। অফিসে যাবার পর সকালে আর বিকেলের দিকে শসা-গাঁজর-সবুজ আপেলের সালাদ খায় সে প্রতিদিন। এটা তার মেটাবলিজম ঠিক রাখে। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে ঠোঁটে হালকা করে মধু মেখে ঘুমোয়। এতে ঠোঁট মসৃণ আর লালাভ থাকে। সপ্তাহে দু’চারদিন চোখের উপর শসাকুঁচি দিয়ে রাখে নির্দিষ্ট সময়। বাচ্চার কারণে ঘুম কম হলে কালচে ভাব দূর করতে। বলা যায় যথেষ্ট স্বাস্থ্য ও রূপ সচেতন দীপ্তি। বয়স সাতাশ চলছে। দীপ্তি ওর খালাতো ভাইকে নিয়ে একদিন এক নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিফরম জমা দিতে গিয়ে দেখে অভ্যর্থনা সেকশানের তিন তরুণী এমন সালাদ খাচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর। আর তিনজনই একজনের চেয়ে আরেকজন সুন্দরী। যেন বেছে বেছে নেয়া হয়েছে তাদেরকে। খুবই স্মার্ট এবং সুভাষী। এটা দেখেই দীপ্তি সালাদ খাওয়া অভ্যাস করে নিয়েছে।

প্রতিটি মানুষের মাঝে আছে আলাদা ব্যক্তিসত্ত্বা। প্রতিটি মানুষ আলাদা আলাদা। গতানুগতিক কিছু মিল তো থাকবেই। একজন মানুষ তার বিপরীত চরিত্রের মানুষের প্রতি বেশি আকৃষ্ট থাকে। অনেকে আবার নিজের বৈশিষ্ট্যের সাথে বেশ মিল এমন মানুষের প্রতিও আকর্ষণ অনুভব করে। রাস্তা দিয়ে কোন সুন্দরী তন্বী কোন বিশেষ উপলক্ষ্যে সেজেগুজে দল বেঁধে হেঁটে গেলে কিছুক্ষণের জন্য ছেলেরা মোহে পড়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে ছেলেরা পছন্দ করে সুন্দর মনের পরিপাটি, সাংসারিক আর প্রায় সবদিকে দক্ষ মেয়েদের। স্বাভাবিকভাবে মেয়েরাও কিন্তু তেমনি পছন্দ করে। মেয়েরা বিশ্বস্ত আর দায়িত্ববোধ আছে এমন ছেলেদের সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। কোন কোন নারী-পুরুষের বয়স যতোই বাড়ুক রসবোধটা সারাজীবন থেকে যায়।

দীপ্তির সংসারজীবন বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে প্রীতি অসুস্থ হয়ে যায়। সারাটা দিন অফিসে কাটায় কিন্তু মনটা পড়ে থাকে বাসায়। মায়ের মন। বাসায় শ্বশুর-শাশুড়ি যতক্ষণ পারে সময় দেয়। কাজের লোক রেবু সন্ধ্যা ছয়টায় চলে যায়। সারাদিন থাকে। বাসার যাবতীয় কাজ করে। বাসায় এসেই প্রীতিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো নিশীথ। টুকটাক কিছু সমস্যা বুঝে ডাক্তার ওষুধ দিয়ে দিলো। সকালে নিজের হাতে ওষুধ খাইয়ে তারপর অফিসে যায় দীপ্তি। আবার রাতে খাবার পর খাইয়ে দশটা-সাড়ে দশটার মাঝেই শুয়ে পড়ে। দশদিনের ভেতর সুস্থ হয়ে গেলো প্রীতি। নিশীথেরও কম দায়িত্ব নয়। বাজারসদাই করা, বৃদ্ধ বাবা-মা’র এটা সেটাসহ নিজের পরিবারের সবকিছুর বেশ একটা অংশ নিজের কাঁধে। দু’জন চাকরী করে যে টাকা উপার্জন করে তার অবশিষ্ট আর কিছুই থাকে না মাস শেষে।

বিকেল হলেই প্রীতি দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেয়। বারবার জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে আর দরজার আশপাশ করতে থাকে কখন ওর মা-বাবা আসবে তা নিয়ে। আজ হঠাৎ পড়ে গিয়ে পায়ে অল্প ব্যথাও পেয়েছে। সাথে সাথে পরম মমতায় কোলে তুলে নেয় রেবু। কাজের লোক রেবুর পাঁচ বছর বয়সী ছোট একটা ছেলে আছে। কয়েক হাজার টাকার জন্য সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বাসায় কাজ করে। সারাটা দিন তারও ছেলেটার জন্য খারাপ লাগে।

মানুষের কিছু অনুভূতি আছে যা প্রায় একইরকম যদিও মানুষ ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন রুপে গড়া। মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষাও ভিন্ন ধাঁচের। কেউ টাকার পেছনে ছুটে বিলাসি জীবনযাপন করতে চায়। কেউ চায় সম্মান সাথে ছোট্ট একটা নীড়। টাকা ছাড়া পৃথিবীতে চলা যায় না। তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে এক বোতল পানি কিনতে লাগে পনেরো টাকা। কিন্তু টাকারও জ্বালা আছে। কেউ কেউ টাকার চিন্তায় ঘুমোতে পারে না। নিশীথের এক মামাতো ভাই আছে যে কিনা ছোটবেলায় মাটির নিচে টাকা লুকিয়ে রাখতো পলিথিন পেঁচিয়ে আর এর পাশে একটা চারাগাছ লাগিয়ে রাখতো যাতে ভুলে গেলেও জায়গাটা খুঁজে পায়। টাকাই সবকিছু নয়। টাকা দিয়ে কেউ কি আত্মতৃপ্তি কিনতে পারবে? টাকা হলো বেঁচে থাকার প্রয়োজন যা শুধুমাত্র অন্নসংস্থান আর যাপিত জীবনে যতোটুকুই না ততোটুকু বিলাসিতার জন্য। কেউ আছে এক টাকার জন্য পাঁচ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করে না।

আজ শুক্রবার, নিশীথের ছুটির দিন। হসপিটালের চাকরিটা দীপ্তি ছেড়ে দিতে চাইছে। হসপিটালের চাকরি আর পুলিশের চাকরিতে ছুটি বলতে কিছু নেই। সময় ভাগ করা থাকলেও সবসময়ই যেন দায়িত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ নিবদ্ধ। অন্য কোথাও চাকরির চেষ্টা করছে দীপ্তি। বাচ্চাটাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছে না। বাচ্চারা অনুকরণপ্রিয়। বাচ্চাদের যাই শেখানো হয় তাই তারা ধারণ করে করে বড় হয়। বাচ্চাদের মন কোমল। ছোটবেলা থেকে যেমন ধরণের পারিবারিক শিক্ষা পায় বয়সানুক্রমে ভবিষ্যতেও ঠিক তেমনি প্রতিফলন ঘটে। তাই বাচ্চাদের সামনে নেতিবাচক কোনকিছু করতে নেই।

রবিবার, নিশীথের অফিস যাবার সময় হলো। তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে এমনভাবে পড়লো নিশীথ যে গোড়ালিতে মারাত্মক ব্যথা শুরু হয়ে গেলো। দ্রুত তাকে দীপ্তি তার হসপিটালে নিয়ে গেলো। এক্সরে করে দেখা গেলো গোড়ালিতে চিঁর ধরেছে। ডাক্তার যা করার করে নির্দিষ্ট দিনের পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বললো। শীতকাল এলে অনেকেই ব্যাডমিন্টন খেলে। ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে নিশীথের এক সহকর্মীর পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। সে কি অবস্থা। বেচারি বহুদিন ভুগেছে।

প্রাইভেট চাকরি আর তাই যতদিন ছুটি কাটাবে কোন বেতন পাবে না বলে নিশীথদের এ’কটা দিন আর্থিকভাবে একটু কষ্ট হবেই। তার বাবা ছোটোখাটো সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। অল্পস্বল্প পেনশন পান। এটা দিয়ে তো আর সংসার চলে না। নিজেদের এটা সেটার জন্য খরচ করেই যা পান শেষ হয়ে যায়। দীপ্তি অফিসে চলে গেলে মা দেখাশোনা করে। প্রীতি এসে বাবার পাশে শুয়ে পড়লো। “বাবা, আজ তোমার ছুটি তাই না?” কথা তেমন স্পষ্ট নয় এখনো ওর। “হ্যাঁ মা, আমার অনেকদিনের ছুটি।“ “আম্মু ছুটি পাবে কবে?” “তোমার আম্মুর ছুটি শুধু যতক্ষণ তুমি কাছে পাও ঠিক ততক্ষণ।“ প্রীতি এমন উত্তরে চুপসে গেলো। তবে হঠাৎ করে বাবাকে সারাদিন কাছে পেয়ে ওর যেন অনেকটাই স্বস্তির উষ্ণতা। মাকে তেমন কাছেই সে পায় না। সন্ধ্যের পর বাসায় আসে। এসেই রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে যায়। শাশুড়িকে তেমন কোন বেগ পেতেই হয় না। দিনের বেলায় বিকেলে একটুআধটু দাদার সাথে বাসার পাশের খোলা মাঠে হাঁটাহাঁটি আর কিছুটা দৌড়ঝাঁপ দিয়ে শান্ত মনে বাসায় ফিরে আসে প্রীতি। ওর বাসার পাশের ফ্ল্যাটে বয়সে ছ’মাস বড় এক বাবুর সাথে ওর বন্ধুত্ব হয়েছে। যখন নিচে নামে দু’জন একসাথে নামে।

বন্ধুত্ব ব্যাপারটি অন্য ধাঁচের। সহজেই কাউকে বন্ধু বানাতে নেই। চলেফিরে বুঝে বন্ধু নির্বাচন করতে হয়। এমনও আছে কারো জীবনে দুই থেকে তিনজন বন্ধুই যথেষ্ট। অনেক ছেলেমেয়ে আছে দলবেঁধে সময় পেলেই আড্ডায় মাতে। আর আড্ডার বিষয়বস্তু যে কতকিছু নিয়ে তার কোন ঠিক নেই। হতে পারে অনেকসময় সবমিলিয়ে মানুষ হাঁপিয়ে যায় আর ঠিক তখন বন্ধুরা যেন অমৃতসম। অনেকের আবার বন্ধুভাগ্য নেই। আসলে ব্যাপারটা তেমন না। বিষয়টা হলো যদি কাউকে পাওয়া যায় প্রায় নিজের মানসিকতার মতোই হতে পারে ছেলে কিংবা মেয়ে যার সাথে মনের কথা বলা যায়; বিশ্বাস করা যায়; আস্থা রাখা যায়; কোন বিপদেআপদে সহায় হয় এমন মানুষই বন্ধু হবার যোগ্যতা রাখে। আর যদি পরিচিত অর্থে সহকর্মী, প্রতিবেশী অথবা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু হয় যার বা যাদের মাঝে কখনো হিংসার লেশ খুঁজে পাওয়া না যায় তা সে যেকোনো ব্যাপারেই হোক সে বা তারাই কিন্তু বন্ধু। বন্ধুত্বের মাঝে থাকতে হয় উদারতা, সহমর্মিতা আর অনুধাবন করার মতো আত্মিক বিশেষ মানবিক বৈশিষ্ট্য। বলেনা সুখ-দুঃখের সাথী। অনেকসময় বন্ধুত্ব বয়স মানে না, সম্পর্ক মানে না। যেকোনো মানুষ যেকোনো অনুপাতে বন্ধু হতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কি শুধুই সাংসারিক আর পারিবারিক আবহে আবদ্ধ? বন্ধুত্বের কি নয়? এ সম্পর্ক ভিন্ন রকমের উষ্ণতায় পরিপূর্ণ।

দীপ্তি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো অন্য কোথাও প্রশাসনেই চাকরি খুঁজে নেবে। কিন্তু না, এমন পরিস্থিতিতে সে আর পারছে না। মনটা সারাদিন দু’জনের জন্য ব্যতিব্যস্ত থাকে। অফিসে গিয়ে তিন চারবার ফোন দেয় নিশীথকে। কাজের লোক রেবুকে প্রায়ই বলছে কোন সমস্যা যাতে না হয় কারো। নিশীথের গোড়ালিতে প্লাস্টার করা। আচমকা এমন দুর্ঘটনা ঘটবে সে ভাবতেই পারেনি। চলতে ফিরতে থাকা মোটামুটি উষ্ণ জীবনটাতে যেন বিরস ধাক্কা খেলো সে। সময়ের মোচড় বুঝা আসলেই দুঃসাধ্য। প্রতিমুহূর্তের হিসেব কষে রাখা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেইবা পারে। মানুষের বিশেষ বিশেষ ভবিতব্য ঘটনার খবর মানুষ জানতে সক্ষম। কারণ পাঁচটি বিষয় ছাড়া সৃষ্টিকর্তা মানুষের মাঝে এমন ধরণের শক্তি দিয়ে দিয়েছেন। সুযোগ করে দিয়েছেন। কিন্তু মনের খবর কি মানুষ রাখতে পারে?

দীপ্তি আজ গোটা চারেক চিকেন সেন্ডউইচ কিনে নিয়ে বাসায় ফিরেছে। প্রীতির খুব প্রিয়। ওভেনে গরম করে প্রীতিসহ সবাইকে খেতে দিলো। দীপ্তি সকালে অফিসে যাবার সময় রেবুকে বলে যায় ঠিক দুপুরে ঘুম থেকে উঠার পর প্রীতিকে অর্ধেকটা চকোলেট যেন খেতে দেয়। এতে ও একটু চনমনে থাকে। আসলে চকোলেট, চা, কফি এগুলো শরীরে কৃত্তিম শক্তিমত্তা তৈরি করে বেশ কিছুক্ষণের জন্য। আর এ’যুগের বাচ্চারা চিপ্স পছন্দ করে। কিন্তু এসবে থাকে ট্র্যান্সফ্যাট। শরীরের জন্য ভালো নয়। শারীরিক সমস্যার মাঝে সবথেকে বেশি যে সমস্যায় মানুষ ভুগে তা হলো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। ফাস্টফুড খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে দৈহিক এ সমস্যা আরও বাড়ে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে হরমোনের সমস্যা যা ঘরে ঘরে। কেউ সমস্যার ধরণ বুঝে, কেউ অজ্ঞতার কারণে বুঝে না। ইন্টারনেটে এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা আছে। সমস্যা হলে কিন্তু মানুষ ঠিকই এন্ডক্রাইনলজি বিশেষজ্ঞের কাছে ছুটে।

মায়ের উষ্ণতায় শিশুরা দ্রুত বেড়ে উঠে। এটা প্রাকৃতিক ব্যাপার। দীপ্তি প্রীতিকে যথেষ্ট সময় দিতে পারে না চাকরির জন্য। যখন বাসায় আসে মাকে কাছে পেয়ে প্রীতির আনন্দের সীমা থাকে না। কি করবে? নিশীথের একার উপার্জনে যে পুরো সংসার চলে না। আজ সকালে দীপ্তির অফিসে যাবার সময় রেবু হঠাৎ কান্না শুরু করে দিলো। “কি হয়েছে, রেবু আপা? কাঁদছেন কেন?” মাথায় হাত রাখতেই আরও কাঁদতে শুরু করলো রেবু। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মানুষ যখন মনে খুব বেশি দুঃখপোষণ করে তখন ফুঁপিয়ে কান্না আসে। আর যখন খুব বেশি আনন্দ পায় তখন প্রাণ খুলে হাসে। মুচকি হাসি সবার সুন্দর। সবচেয়ে বেশি স্বস্তি পেলে একটানা হাসে। রেবুর কান্না একটু থামলো। কাঁদতে কাঁদতেই বললো ওর পাঁচ বছর বয়সী ছেলেটা আজ এখানে আসার কিছুক্ষণ আগে একটা চোখে খুব ব্যথা পেয়েছে। দৌড়াদৌড়ি করছিলো, হঠাৎ চোখে গুঁতো খেয়েছে। রক্তক্ষরণও হয়েছে। “চলেন তো দেখি, চলেন। আমি ওকে এখনি চক্ষু হসপিটালে নিয়ে যাবো। আপনি এমন অবস্থায় কেন আসলেন? আমাকে একটা কল দিলেন না কেন? সাথে সাথে হসপিটালে নেবার দরকার ছিল তো।“ হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো ছেলেটাকে। বেশ সময় নিয়ে চোখের পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। ডাক্তার যা বললো তাতে বুঝা গেলো ডান চোখটার অবস্থা খুবই নাজুক। চোখের মণিটা খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চোখের দুটো উপশিরা কেটে গেছে। অপারেশান করতে হবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির চিকিৎসা ব্যবস্থার এ যুগে হয়তো বিকল্প উপায় রয়েছে কিন্তু ধকলটা সারাজীবন ধরে বইতে হবে। অপারেশানে কিছু টাকা দিয়ে রেবুকে সহায়তা করলো দীপ্তি। ডাক্তার ছেলেটাকে চশমা দিয়েছে। কয়েকদিন পর হসপিটাল থেকে ছাড়া পেলো। রেবু সুবিধা অনুযায়ী কাজও করেছে আর ছেলের কাছেও এসেছে। চোখ যে অমূল্য সম্পদ। চোখ না থাকলে পৃথিবীটা আঁধার আর অর্থহীন। সৃষ্টিকর্তা চোখ দিয়েছেন সুন্দর এ পৃথিবীটা প্রাণভরে দেখার জন্য মনের নিদারুণ অনুভূতি মিশিয়ে।

নিশীথ সুস্থ হয়েছে, আবার অফিস যাওয়া শুরু করেছে। ঠিক আগের মতোই প্রীতির প্রতিদিনের জীবনযাপন। আজকালের বাচ্চারা একটু হাইব্রিড। ওদের অনুভূতি প্রখর। প্রীতি বিকেলে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। দেখে এক মহিলা তার বাচ্চাকে জোরে একটা চড় মেরেছে। কতো আর বয়স হবে, চারের মতো। রেবু প্রীতিকে বিস্কিট খাওয়াচ্ছিল। বাচ্চাটা কথা শুনছে না তাই চড় মেরেছে। বাচ্চাটা হাউমাউ করে কাঁদছে। প্রীতি আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় এ দৃশ্য রেবুকে দেখালো। রেবু জানালার কাঁচ লাগিয়ে পর্দা টেনে দিলো। খাওয়ানো শেষ করে বিছানায় শুইয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। নিজেও একটু ঘুমিয়ে নিলো।

চাকরিজীবী মায়েদের এই একটাই সমস্যা বাচ্চা লালনপালন করতে। দীপ্তি ওর এক কলিগের পরামর্শে বাসায় দুটো রুমে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে নিলো। মোবাইলের মাধ্যমে অফিসে বসে ও এখন সবসময় প্রীতির খেয়াল রাখতে পারে। মাঝে মাঝে প্রীতিকে ডাক দেয়, প্রীতি আশ্চর্য হয় মা’র ডাক শুনে আর অদ্ভুতভাবে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রীতির জন্য দীপ্তির মাঝে মাঝে কান্না চলে আসে। এতোটুকুন বাচ্চাটা রেখে ওর আর কাজ করতে ভালো লাগে না। কিন্তু কি করবে, জীবনের খেয়ালি বাস্তবতা যে বড়ই নির্মম। বাসায় এসে যখন যত্ন নেয় ঠিক তখন প্রীতির চোখে অসহায় এক আবদারের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়। এ প্রতিচ্ছবি মা-বাবার উষ্ণতা ছাড়া বেড়ে উঠতে থাকা এক শিশুর চোখের করুণ প্রতিচ্ছবি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মাইদুল সরকার নাগরিক জীবনের গল্প।±+++
সারোয়ার শোভন ভালো লাগল। ভোট রেখে গেলাম। আমার কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।
ফয়জুল মহী বাহ্ মনোমুগ্ধকর লেখা, বিমোহিত হলাম শুভকামনা

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

এই গল্পটিতে আমি তুলে ধরেছি পরিবারে বেড়ে উঠতে থাকা একটি শিশুর চিত্র যে কিনা মায়ের উষ্ণতা থেকে বঞ্চিত। মা-বাবার ভালোবাসায় বিশেষ করে মায়ের ভালোবাসায় আর সাহচর্যে যে প্রগার উষ্ণতা থাকে পৃথিবীর আর কোন সম্পর্কে তা থাকে না। প্রেমেও উষ্ণতার ব্যাপার থাকে। কিন্তু মায়ের আদর, সোহাগ, যত্নে যে প্রাকৃতিক উষ্ণতার বেষ্টনী থাকে তা যে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। শিশুরা দ্রুত বেড়ে উঠে আর অনেক সহনশীল হয় মায়ের আদরে বড় হয়ে উঠতে পারলে। এ ব্যাপারটি তুলে ধরতেই এ গল্পের প্রয়াস।

২৪ জুলাই - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ২২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪