সহস্রা

ভয় (সেপ্টেম্বর ২০২১)

পুলক আরাফাত
  • 0
  • ৩৩
এখন ভাদ্রমাসের তাল-পাকা রোদ, মাঝে মাঝে আবার টুকটাক বৃষ্টি। আকাশটা সাদা মেঘের উড়াউড়িতে কোলাহলের মাত্রায় বিষণ্ণ হলেই কোত্থেকে যেন কালো মেঘ এসে ভর করছে। সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে সহস্রা, তখন ছাদে পায়চারি করতে করতে তার হাতে থাকে প্রিয় কবিতার বই আর এক মগ ঘন দুধের কফি। বেশ খোলামেলা মনের মেয়ে। হাসিখুশি অমায়িক। ছোটবেলায় যখন ওর মা ওর সাথে কথা বলতো তখন কথায় কথায় খালি হাসতো দেখে মেয়ের নাম রেখেছিলেন সহস্রা। মানে হাসতে পারে এমন সহস্র মেয়ের মাঝে সে হলো অন্যতম। সত্যিই তাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে এখন ইংরেজি ভাষায় দ্রুত কথা বলা আর কম্পিউটারের অফিস অ্যাপ্লিকেশান নিয়ে কোর্স করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছিল ওর জুড়ি মেলা ভার, মানে ও এতো সুন্দর একটি মেয়ে যে কিনা যেকোনো ছেলের হৃদয়ের রাণী হতে পারে এক নিমেষে। কিন্তু ছেলেটিরও তো সেরকম যোগ্যতা লাগবেই।

আজ সহস্রার মন কেমন যেন উড়ুউড়ু করছে। যাকে বলে প্রেমে হাবুডুবু খেতে ইচ্ছে করছে। কাউকে গভীরভাবে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। কফিতে চুমুক দিতেই কফির ঘ্রাণে আচ্ছন্ন সে। যে কবিতার বইটি সে পড়ছে তার নাম এখানে বলা যাবে না। বললেই বিপদ। বিপদ নয় মানে একটু ভয় কাজ করছে। সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি ছিল বাইরে। প্রচণ্ড বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে সহস্রার খালার বাড়িটার সামনের রাস্তাটি এমনকি নীচের বারান্দা পর্যন্ত ডুবে গিয়েছিলো। বইয়ের লেখক ঢাকা থেকে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে বইগুলো পাঠিয়েছিলো। সহস্রার চোখে কেন যেন এক তিতিক্ষার ঘোর কাজ করছিলো কখন সে বইগুলো হাতে পাবে। তাই বৃষ্টি থামলেই সাথে সাথে ছাতা নিয়ে বের হয়ে গেলো প্রায় হাঁটুসমান পানি ডিঙ্গিয়ে রিকশা করে সুন্দরবনের লোকাল শাখায় গিয়ে কবিতার বইগুলো নিয়ে আসলো। তারও আগে কিছু কাহিনী আছে। যে লেখকের বই পড়ার এতো আগ্রহ সহস্রার, সেই লেখক তাকে কিছু পাথর সেট করা অলঙ্কার পাঠিয়েছিলো। খুবই খুশি হলে মেয়েদের যেমন লাগে তেমন লাগছিলো সেদিন সহস্রার।

লেখকের নাম প্রত্যুষ। নামটা শুনলে মনে হবে হিন্দু হিন্দু। কিন্তু না, সে মুসলমান। নামে কি আসে যায়, কিংবা মনে কি আসে যায়? মানুষ যদি অন্তরের গভীর থেকে কোন কাজ করে সেটাই আসল, সেটাই প্রকৃত। গোলাপ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুল। গোলাপের আছে নানান রঙের বাহার। আর আছে গাঁদা ফুলের। অন্তর, মন, হৃদয়-এই তিন পর্যায় কখনো এক হতে পারে না, একজ নয়। মানুষ যখন চিন্তা করে তখন করে মন থেকে, যখন কোনকিছু নিয়ে ভাবে তখন হৃদয় দিয়ে ভাবে- তখন কিন্তু মন দিয়ে ভাবে না। মানুষ যখন কাউকে আশীর্বাদ করে তখন অন্তর থেকেই করে। তাই এই তিন প্রকারের যোগসাজশেই হয় গভীর ভালোবাসা। মোহ নয়, ভালোলাগা নয়, প্রেম নয়।

সহস্রা বাসায় এসেই প্রত্যুষের লেখা বইগুলোর দ্রুত মোড়ক খুলতে লাগলো কি যেন এক গভীর মোহে। প্রেমে পড়ে মানুষ আঘাত পেলে চোখ বেয়ে অশ্রু নামে। ভালোবাসলে অশ্রু নামে না। ভালোবাসি বুঝাতে চেষ্টা করে বারবার বিভিন্নভাবে। অস্বীকৃতি আসলে কষ্ট পায় মানুষ, কিন্তু কাঁদে না। কাঁদে প্রেমে ব্যর্থ হলে। মানুষের হৃদয়ের রূপ ভিন্নাকৃতির।

যাই হোক, আজ সহস্রার এতো খুশি লাগছে- প্রিয় মানুষের যৌগিক-পার্থিব-অপার্থিব-প্রেমজ সব কথা যা কিনা ভালোবাসার সাদা কাগজে, আবেগ যা কিনা গল্পের মোড়কে সেগুলো পড়বে। কিছু কিছু কবিতা যেন গল্পকেও হার মানায়। গল্প কিছুটা বিশদে চরিত্রগত ব্যাখ্যায়। কবিতা সার্বিকতায়। একেকজনের কাছে একেকটি কবিতার পঙক্তি একেকরকমের। হতেই পারে। কোনকিছুই করার নেই। কবিতার ধরণই এরকম। প্রত্যুষ অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত কবির মতোই বলে, ”যদি পুনর্জন্ম হয় আবারও কবিই হতে চাই।“

প্রথম কবিতাটি পড়ে আনন্দের ত্রিসীমানায় যেন ভেসে গেলো সহস্রা। তখন রাত ঠিক নয়টা বাজে। সে ঠিক করলো প্রতিরাতে যখন প্রত্যুষের সাথে কথা বলবে, কথা বলা শেষ করে ঠিক তখনি একটি করে কবিতা পড়বে। এটি হবে তার জন্য এক অতিভীষণ ভালোলাগা। প্রত্যুষ অবশ্য বেশী রাত জাগে না। রাত একটার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে। আবার সকালে উঠে নামাজ পড়ে ছাদে গিয়ে একটু হাওয়া খায়। তারপরই মায়ের হাতের বানানো নাস্তা খেয়ে আদা-তুলসিপাতার চা খাবে প্রতিদিনকার এই হলো তার সকাল বেলার রুটিন। তারপরই কম্পিউটারে বসে গুগলে সকালের তাজা তাজা খবর আর কবিতা পড়া অন্যদের সেই সাথে রাজনৈতিক খবরাখবর বুঝে নেয়া এটাও যেন তার প্রায় নৈমিত্তিক এক খেয়াল। প্রত্যুষ তার মায়ের কাছে সবকিছুই শেয়ার করে, বাবার কাছেও। ছোট বোনটার কাছেও। যদিও সবকিছু শেয়ার করার মাঝে একটা সীমাবদ্ধতা রাখে সে।

প্রত্যুষ খুব সাহসী লেখক। রাজনীতি করে স্কুলজীবনের শেষ বছর থেকেই। তার বিরোধীপক্ষরা তাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে হেনস্তা-অপদস্ত-অপমান করতে চায়। প্রত্যুষকে তারই এক বড় ভাই বলে দিয়েছে অনেক আগেই- “কেউ যদি তোমাকে নিয়ে বকাঝকাও করে তুমি রাগ পেয়ো না।“ আরেক রাজনৈতিক বড় ভাই বলেছিলো ভিন্ন এক অসম্ভব মূল্যবান কথা। সেই কথা হলো- “প্রত্যুষ, সতর্ক হও, সচেতন হও। সতর্ক আর সচেতন হবার জন্য যদি একটা প্রেম করে ছ্যাকাও খাওয়া লাগে তাও খাও, তবুও সতর্ক আর সচেতন হও।“ এমন কথা প্রত্যুষের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক পর্যন্ত বলেননি। কিন্তু তাঁরা বলেছেন।

প্রত্যুষের একটা ভয় আছে। আর তা হলো হারানোর ভয়। মান-সম্মানও তো মাঝে মাঝে হারিয়ে যায়। যদিও একবার গেলেও পুনর্বার ফিরে আসে সেটা। চরিত্র গঠন হলো নিজের কাছে। চরিত্র হারিয়ে গেলে সব হারিয়ে যায়- এই কথাটি অনেকাংশেই ভুল। কারণ মানুষ যদি চেতনার প্রাণী হয়ে থাকে, মানুষ যদি মনভিত্তিক প্রাণীই হয়ে থাকে তবে কেন বলা হলো কথাটি অনেকাংশেই ভুল তার প্রমাণ বারংবার মিলবে।

সহস্রার আজ জ্বর আর সর্দি। কিছুই ভালো লাগছে না। রাত এগারোটা বাজে। ইচ্ছে করছে তবুও ফোন দিতে ইচ্ছে করছে না প্রত্যুষকে নিজের এই অবস্থায়। সাথে সাথে প্রত্যুষের কল বেজে উঠলো। আশ্চর্য ব্যাপার, টেলিপ্যাথি নাকি?

“কি করছো সহস্রা?” “আর বলো না সকালে ঘুম থেকেই উঠেছি সর্দি-জ্বর নিয়ে। সারাটা দিন মাথা ব্যাথা, খুব অস্বস্তিই লাগছে। জানো, আমি তোমাকে মাত্রই কল দিতাম। তুমিই দিয়ে বসলে।“ “তাই নাকি! হুম, এটাকেই বলে অন্তরের টান, বুঝলে কিছু?” “বুঝেছি বাবা, বুঝেছি।“ “জানো সহস্রা, তুমি-আমি না মোহনার মতো। হয় তুমি সাগর অথবা আমি-হয় তুমি নদী অথবা আমি।“ “বাহ! দারুণ তো। এই কথাটি শোনার পর আমার ইচ্ছে করছে এখনই তোমার কাছে চলে আসতে, প্রত্যুষ।“ “একেবারেই বউ হয়েই এসো। এখন নয়। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কিন্তু একটু ভিন্ন স্বাদ খোঁজার চেষ্টা করে সম্পর্কে, জানো তো। আসলে এক্ষেত্রে কিছুই করার নেই। যাক, ওদেরটা ওরা বুঝুক, আমাদেরটা আমরা বুঝি। জানি তোমারও মাঝে মাঝে খুব ঘনিষ্ঠ হতে ইচ্ছে হয় আমার সাথে। কিন্তু না, এখন নয়। বিয়ের পর চুটিয়ে প্রেম করবো। এটাই সবেচেয়ে আকর্ষণের, সবচেয়ে সুমধুর, সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত। তখনি বুঝা যায় স্বামী কি আর স্ত্রী কি। আমি কি একটুও ভুল বলেছি?“ “নো, নেভার।“ “ঘুমানোর চেষ্টা কর। শরীর ঠিক হয়ে যাবে, হালকা মেডিসিন নিতে পারো- শুধু প্যারাসিটামল আর ডেসলর। শুভরাত্রি সহস্রা। সকালে আবার কথা হবে, তবে তুমি কল দিয়ো, ঠিক আছে?” “ঠিক আছে।“

সম্পর্কের সবেচেয়ে উন্নত আর অফুরন্ত ভালোলাগার মতো দিক হলো একজনের প্রতি আরেকজনের আত্মবিশ্বাস আর অতুলনীয় ভালোবাসা। কষ্ট পেলেও বুঝিয়ে বলা যে তুমি আমাকে এই কষ্টটা দিয়েছো। তাহলেই এক নিমেষেই আরেকজন কেঁদে জড়িয়ে ধরবে প্রিয়জনকে। মনের মানুষ হতে গেলে যে প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হয়, প্রগাঢ় হতে হয়। ভালোবাসলে সারাজীবন মন থেকে, হৃদয় থেকেই শুধু নয়, অন্তরের গহীনতম স্থান থেকেই ভালোবাসতে হয়। তবেই সত্যিকারের ভালোবাসার পরিচয়টা ফুটে উঠে যৌক্তিকভাবে। মরে গিয়ে ভালোবাসার পরিচয় কীরকম তা প্রমাণ করা যায় না, বরং বেঁচে থেকে অসামান্য ধ্রুবতার অক্ষয়ে গড়া অহর্নিশ ভালোবাসার প্রমাণ রাখা যায় সর্বদিকে সর্বমাত্রায়।

একবার বন্ধুদের পুনর্মিলনীতে প্রত্যুষের এক খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু অকপটে বলেছে- “আমার স্ত্রী তো আমার গায়ের উপর ওর পা না তুলে ঘুমাতে যাবার চেষ্টা না করলে ওর যেন ঘুমই আসতে চায় না।“ খুব রোমান্টিক কথা।

মাঝে মাঝে প্রত্যুষের ভয় হয়, না জানি কারও ছত্রছকে ওর আর সহস্রার ভালোবাসায় কেউ কালিমা লেপে দেয়, দ্বিধাবিভক্ত আর অন্যমনস্ক করে দেয়। ভয় পাওয়া যায় খুব সহজেই। কিন্তু ভয়কে জয় করতে গেলে লাগে বুকের পাটাতনে দুর্নিবার সাহস। সাহসকে কখনো আবার অতিসাহসে রূপ দেবার দরকার পড়ে না। কারণ, সাহস নিজেই অতিসাহস হয় সময়ানুপাতে। তাই শত বাঁধা পেরিয়ে সুন্দর গোছানো এক দম্পতি হবার স্বপ্ন প্রত্যুষ আর সহস্রার মনে সবসময় রঙিন পেন্সিলের মতো আঁকাআঁকি করতে থাকে।

হ্যাঁ, কিছুটা ভয় তো থাকবেই। সেটা হলো প্রজন্মের বৈসাদৃশ্য। বাবা-মা প্রথমেই প্রশ্ন করবে ছেলে কি করে। উত্তরে যদি বলে একটা ভালো চাকরি করে কোথাও, তাহলে খুব খুশি হন তাঁরা। কিন্তু যখন শুনেন যে ছেলে রাজনীতি করে আর সাথে সাথে লেখালেখি করে তখন তাঁরা কুঞ্চিত হয়ে যান। স্বাভাবিক। ছেলের যদি সবকিছুও থাকে তবুও ভাবেন তাঁরা যে কোন দরকার হলে সেই তো তার বাবা-মা’র কাছেই হাত পাততে হবে একটু বড় অংকের টাকা হলে। টুকটাক চালিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু যখন বাচ্চা হবে, এটা লাগবে-সেটা লাগবে তখন বারবার কি চাওয়া যায়?

এটা এক ধরণের ভয়, আর্থসামাজিক ভয়। এই ভয়কে কে দূর করবে?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী সুষমামণ্ডিত কথামালায় অনিন্দ্যরূপ লেখা, অপরূপ ও অনিন্দিত।
ভালো লাগেনি ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

এই গল্পের মাঝে আমি ফুটিয়ে তুলেছি বিভিন্ন রূপকে বিভিন্ন চিত্রায়নে ভালোবাসার বহুমাত্রিকতা। জীবনের বোধ, ভালোবাসার জন্য আপেক্ষিক সংগ্রাম, উষ্ণতা খোঁজার চেষ্টা, দূরবিন্দুকে কাছে টানার অভূতপূর্ব অনিকেত। ভালোবাসার মাঝেও যে কল্পনা লাগে তার প্রতিচিত্র। কল্পনা করা ছাড়া ভালোও বাসা যায় না। ভালোবাসা চিরসবুজ, এমনকি বয়সেরও বাঁধা মানে না। জাগতিক ভালোবাসা আক্ষরিক অর্থে সৃষ্টিশীল তখনি যখন ঐশ্বরিক কোনকিছু তাতে লুকিয়ে জাপটে ধরে অন্তরকে। অন্তরের ভালোবাসাই প্রকৃত ভালোবাসা। যে ভালোবাসার কোন ক্ষয় নেই, কিন্তু ভয় আছে হঠাৎ হারাবার।

২৪ জুলাই - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ২২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪