রতন মিয়ার ছোট্ট চায়ের দোকানটাতে প্রতিদিনই মানুষের আড্ডা। তার দোকানে একটা ডিশলাইনের টিভি আছে। মানুষ চা-বিস্কুট আর পাউরুটি খায় সাথে মনোযোগ দিয়ে নাটক-সিনেমা দেখে। কলিম মিয়া মারামারির দৃশ্য এলে বাতাসে হাত-পা ছুঁড়ে মারে, যেন কেউ তার সামনে উপস্থিত থাকলে একটা মার সে খালি খালি দিয়েই দিতো এমন অবস্থা। কলিম মিয়া কৃষি কাজ করে। রতন মিয়ার বন্ধু সে। রতন মিয়া বেশিদূর পড়তে পারেনি। এই চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিল। টুকটাক হিসেব সে করতে পারে। দোকানটা এমনিতেই ছোট তার উপর কিছু বাকি তাকে দিতেই হয়। আজ দেবো কাল দেবো করে অনেকে দিতে চায় না। যদিও পরে শোধ করে কিন্তু খুব তাগাদা দিয়ে আদায় করতে হয়। রতন মিয়ার ঘরে তিন সন্তান। দুই ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়েটা সবার ছোট। সকালে বাড়ি থেকে বের হবার সময় মেয়েটা রতন মিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলবে, “আব্বা আমার লাইগা কিন্তু লজেন্স আনবা।“ মেয়েটার বয়স পাঁচ। একেক দিন তার একেক বায়না। রতন মিয়া তার মেয়েকে খুব আদর করে। দুই ছেলের মাঝে বড় ছেলের বয়স দশ আর ছোট ছেলের বয়স আট। ওরা দু’জনই স্কুলে পড়ে। ছোট্ট দোকানটা সামলে প্রতিদিন যতোটুকুই রতন মিয়ার রোজগার হয় তার লাভটা গুনে গুনে তাকে বাজার সদাই করে খরচ করে কিছুটা টাকা সঞ্চয় করতে হয় দুর্দিনের জন্য। তার দুই ছেলে পড়ে সরকারি স্কুলে। তাই ওদের দু’জনকে নিয়ে তার তেমন কোন দুশ্চিন্তা নেই।
রতন মিয়ার দোকানে আজ অনেক মানুষের সমাগম। আজ জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলা চলছে। ফাঁকে ফাঁকে সবাই চা খাচ্ছে, অনেকে সিগারেট টানছে। সবার নজর টিভির দিকে। কলিম মিয়া এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে আসলো। হাই তুলতে তুলতে দোকানে ঢুকলো। রতন মিয়াকে চা দিতে বলে কলিম মিয়া বলে, ”এই খেলাডার নিয়ম-কানুন আমি বুঝি না, খালি ছক্কা-চাইর মারলে আর আউট অইলে সবাই ফালাফালি করে এইডাই বুঝি।“ রতন মিয়া বলে, “তোর বুঝার দরকারও নাই, আমরা চিল্লাইলে তুইও চিল্লাইবি।“ তামিম ইকবাল যেই একটা ছক্কা মারলো অমনি সবাই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলো।
রতন মিয়ার ঘরে আজ বাজার সেইরকম। আজ অনেক লাভ হয়েছে। বাজার থেকে সে একটা আস্ত মোরগ এনেছে। এনেছে কালিজিরার চাল পোলাও রান্না করার জন্য। আর যা যা দরকার তার সবই এনেছে। বাজারগুলো বউ কল্পনার কাছে দিয়ে সে গেলো পুকুরঘাটে গোসল করতে। এই পুকুরটা পাড়া-প্রতিবেশী সবাই মিলে দিয়েছে। কিছু মাছও চাষ করে এতে। বড় হলে বিক্রি করে সবাই টাকা ভাগ করে নেয়। কল্পনা রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। মেয়ে রিনি মা’র পাশে বসে আছে। বসে বসে রান্না দেখছে। মাংসের তরকারির গন্ধ পুকুরঘাট পর্যন্ত গিয়েছে। রতন মিয়া তার বউকে বলে, “ও কল্পনা, মোরগের তরকারিত কি দিছো গো, এমন সুন্দর বাসনা বাইরইছে?” কল্পনা উত্তর দেয়, “কিতা দিয়াম, হগল সময় যা দেই হেইগুলাই দিছি। কই যেন আইজ আফনের মনডা ভালা হেল্লাইগগা সুন্দর বাসনা ফাইচুইন। তাড়াতাড়ি গোসল কইরা আয়াফরুইন।“
“করিম-হেলিম বাবাজানেরা তুমরা দুইজন হুইন্না যাও”, রতন মিয়া তার দুই ছেলেকে ডাক দিলো। “তুমরার পড়ালেহার কি খবর কওছেন দেহি।“ দু’জনই উত্তর দিলো, “ভালাই”। “খাতা-কলম যা লাগে আমারে কইবা আমি আইন্না দিয়াম। মনে রাইখখো পড়ালেহাত ফাহি দিলে তুমরাই পস্তাইবা। আমি কিতা কইছি বুইজ্জা লইয়ো। যাও আত-মুখ ধইয়া আও। সবাই মিইল্লা একসাথে খায়াম। কই গো কল্পনা, রান্ধন অইছে?“ “আর দশ মিনিট, খালি পোলাওডা বাহি”, রিনির মা উত্তর দিলো। রান্না শেষে সবাই গরম গরম পোলাও-মাংস খেতে বসলো। রিনি খুব আস্তে আস্তে খায়। খায়ও অল্প। রিনিকে তার মা মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। সকালের জন্য কিছুটা তরকারি কল্পনা তুলে রাখলো। লাউ গাছটায় অনেকগুলো ফুল ফুটেছে। ভাবছে সকালে লাউ ফুলের বড়া বানাবে। লাউ ফুলের বড়া খেতে খুব মজা। কল্পনা বেশ সাংসারিক। বাড়ির পাশে উঠোনের এককোণে পেঁপে গাছ লাগিয়েছে। গাছে লম্বা লম্বা পেঁপে ঝুলে আছে। আছে চুকাই গাছ, পেয়ারা গাছ আছে কয়েকটা। বরই গাছটাও তার হাতেরই লাগানো। বেশ বড় আর মিষ্টি বরই হয়।
রতন মিয়ার প্রতিদিন সমান যায় না। একেকদিন একেকরকম তার রুজি রোজগার। একটা চায়ের দোকান থেকে এর চেয়ে বেশি সে আর কিইবা আশা করতে পারে। কলিম মিয়া রতনকে মাঝে মাঝে বুঝায়। বলে, “রতন তুই এই দোহান দিয়া কেমনে কি করবি? তোর আইজ ভালা তো কাইল খারাপ। কাইল ভালা তো পরশু খারাপ। তুই অন্য কিছু কর রে।“ “কিতা করতাম কছে দেহি?” কলিম বলে, “অনেক মাইনষেই অহন অটো চালায়। তোর এতো কষ্ট করার কি কোন দরহার আছে? তুই তোর দোহানডা বেইচ্চালা। বেইচ্চা তোর সঞ্চয়ের টেহা মিলাইয়া একটা পুরান মোটামুটি চলনসই অটো কিন। অটো ভাড়া দিবে আর বইয়া বইয়া খাইবে।“ রতন বলে, ”এইতা তুই কিতা কছ? আমি মানুষ ছাড়া থাকতাম পারি না। আমার অভ্যাস অইয়া গেছেগা। মানুষ না দেখলে আমার ভালাই লাগে না। অক্করেই না।“ “আরে বেটা তোরে আমি খারাপ বুদ্ধি দেইনাই। আমার কওয়া আমি কইলাম। বাহিডা তোর ইচ্ছা।“
বাড়ি ফিরে রতন মিয়া ভাবতে লাগলো কি করা যায় তা নিয়ে। তার কাছে কলিমের বুদ্ধিটা মন্দ লাগেনি। দোকানে থাকলে সবার সাথে হাসিতামাশায় সময় কেটে যায়। মানুষের সাথে গল্পগুজব করতে পারে। দোকান বিক্রি করে দিলে মানুষের সঙ্গ হারাবে সমস্যাটা এই যা। রতন মিয়া তার বউয়ের সাথে বিষয়টা নিয়ে রাতে আলাপ করলো খানিক। কল্পনা বললো, “দোহানডা কতো আগের। আফনের বাফও চালাইছে। হেই দোহান যদি বেইচ্চাই ফালান মনডা কি আফনের খালি খালি লাগতনা?”
রতন মিয়া শেষ পর্যন্ত কলিমের কথাটাই মাথায় নিলো। একবারের জন্যও গভীরভাবে ভাবলো না কলিম মিয়া কেন এই বুদ্ধিটা দিলো তাকে। সে ভাবলো গায়েগতরে না খেটে টাকা আসবে, মন্দ কি? প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমান টাকা তো সে পাবেই। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন গাড়ির এই যন্ত্রাংশ সেই যন্ত্রাংশ বদলাতে হবে তখন সে জঞ্জাল কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পাবে। এমনিতেই সে গরীব মানুষ। দোকানটা তো তাও তার একটা সম্বল। তাও রতন মিয়া দোকানটা বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলো। দোকানে ঝুলিয়ে দিলো দোকান বিক্রি করা হবে।
কিছুদিন পর রতনের দোকান মালামালসহ বিক্রি হয়ে গেলো। রতন কলিমের পরামর্শে একটা অটো কিনে বসলো। প্রথম বেশ কিছুদিন রতন আয়েসে ঘুরেফিরে টাকা উপার্জন করলো। একদিন হঠাৎ রাত গভীর হয়ে গেছে ড্রাইভার আর অটো নিয়ে ফিরে না। রতন মিয়া মহাচিন্তায় পড়ে গেলো। সারারাত জেগে বসে থাকলো রতন। বুঝতে তার আর বাকি রইলো না ড্রাইভার অটো নিয়ে পালিয়েছে। সহায়সম্বল সব মিলিয়ে সে অটোটা কিনেছিল। এখন তো তার মাথায় হাত। এখন সে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। কল্পনা বললো, ”আমার মন কইতাছে কলিম মিয়ার এই চুরির সাথে যোগ আছে। হে আফনেরে বুদ্ধি দিলো আর আফনে কেউর কথা না মাইন্না কেউরে না জিগায়াই কিন্নাইল্লাইন অটোডা!” “বউ তুমার কথা হাছা অইতাফারে। আমি যাইতাছি।“ মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো রতন মিয়ার।
রেগেমেগে কলিমের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত রতন। জোর গলায় কলিমকে ডাকছে রতন মিয়া। কলিম মিয়া ঘর থেকে বাইরে এলো। “কি রে, এতো সহালে তুই! কিতা অইছে?” “তুই আমার অটোডা চুরি করাইলি”, বলেই রতন উঠোনে পোঁতা বাঁশ তুলে সোজা কলিমের মাথায় আঘাত করলো। মাটিতে পড়ে গেলো কলিম। মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে লাগলো। কলিমের বউ চিৎকার দিয়ে উঠলো, “ও আল্লাহ্ গো, রিমার বাপরে মাইরালছে গো!”
পাশের বাড়ির কেউ একজন থানায় ফোন দিলো। পুলিশ এসে কলিমকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। আর রতন মিয়াকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গিয়ে হাজতে ভরে দিলো। রতন মিয়া জোরে জোরে বলতে লাগলো, “স্যার, কলিইম্মা আমার সব শেষ কইরা দিছে। আমার মাথা ঠিক আছিলনা স্যার।“ “ওই বেটা চুপ। তুই মানুষ মাইরা ফেলতে চাস“, দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য উত্তর দিলো।
কিছুদিন পর জেল থেকে মুক্তি পায় রতন মিয়া। বাড়ি ফেরার সময় পরিচিত আশপাশের মানুষ কেমন যেন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে। যেন মনে হয় সবাই তাকে নতুন দেখছে। যেন অচেনা এক মানুষ। রতন তার বিক্রি করা দোকানটার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। নতুন দোকানদার তাকে দেখেই বললো, ”ওই রতন, যা এইখান থাইক্কা যা।“ দোকানি তাও তো কিছু একটা বলেছে। কিন্তু পরিচিত সব মানুষগুলো তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে কেন? রতন মিয়া কিছুই বুঝতে পারছে না। এ যেন চেনা পৃথিবীতে অচেনা।
রতন মিয়ার সংসারের অবস্থা বেহাল। তার সব স্বপ্ন এক ঝড়েই শেষ। কি করবে এখন রতন মিয়া? কীভাবে বেঁচে থাকবে সমাজে? তার চোখেমুখে অসহায়ত্বের প্রতিচ্ছবি। রাজ্যের দুর্ভাবনা ভর করেছে তার মাথায়। জীবনযাপনের জন্য তাকে হয়তো আরও নীচে নামতে হবে। এক শূন্য হাহাকার তার মনকে গ্রাস করে ফেলেছে। তার একার জন্য তেমন চিন্তা নেই। কিন্তু পরিবারের ভরণপোষণ কীভাবে করবে সে?
এই পৃথিবীতে অনেকে অনেকভাবে বেঁচে আছে। সমাজে ধনী মানুষ আছে, আছে গরীব মানুষও। দিনান্তে সারাদিনের রোজগারের টাকায় কিছু মানুষ তাও কতো আনন্দে-আহ্লাদে পরিবারের মানুষদের সাথে নিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে। কারো কারো কাছে সামান্য আয়টাও যেন অনেক শান্তির, অনেক মর্যাদার। কিন্তু যখন দুর্ভাগ্য এসে ভর করে তখন যেন অর্জিত শান্তিটুকুও নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক এমন অবস্থায় মানুষ তখন কি করবে ভেবে পায় না। নিজেকে তখন মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায়দের একজন।