১
সূর্যটা যখন চোখ কচলাতে কচলাতে পূবের জানালায় অবস্থান নিয়েছে ততোক্ষণে অরুনের ঘুম ভেঙ্গেছে।
গেল ভাদ্রে অরুনের বয়স পাঁচে পড়েছে। পাঁচ বছরের এই ছোট্ট শিশুটি ইতিমদ্ধেই জেনে গেছে তার জীবনের চৌরাস্তা কোথায় এসে মিলিত হয়েছে। শুধু সেই রাস্তার কোন প্রস্থে তার অবস্থান আর রাস্তার দৈর্ঘই বা কত সেটা তার এখনও অজানা।
ঘুম থেকে উঠে অরুন বিছানায় কিছুক্ষণ বসে থাকে। এই কয়দিনে অরুন কেমন পরিচিত হয়ে গেছে ঘরটার সাথে। দেওয়ালের পৃষ্ঠে হালকা নিল রঙের পেইন্ট, দেওয়ালকে খুড়ে লেপ্টে আছে একটি জানালা, জানালার সামনে একটি খালি ফুলদানি। খালি ফুলদানিটা অরুনকে স্মরণ করে দিচ্ছে সময়ের চরম স্বার্থপরতার কথা।
আগে অবশ্য অরুন এই ঘরে থাকত না। মা আর বাবার সাথে থাকত। মা চলে যাওয়ার পর এই ঘরে স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে অরুন নাম লিখিয়েছে। অবশ্য স্থায়ী হবার আগে অরুন কয়েকদিন তার দাদির কাছে ছিল। কিন্তু দাদি কি এক অজ্ঞাত সমস্যার কারণে অরুনকে নয়নের কাছে রেখে আসে। নয়ন অরুনদের প্রতিবেশির ছেলে। নয়নের মা অরুনদের বাসায় কাজ করে।বয়স আনুমানিক ছয় বছর হবে। কয়েকদিন অরুন নয়নের কাছে থাকার পর নয়ন অভিযোগ করে অরুন রাতে ঘুমের মধ্যে মা মা বলে চিৎকার করে ওঠে। নয়ন আরও যোগ করে যে এই ব্যপারটা নয়নের জন্য ভয় এর কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে। সুতরাং, তার সাফ কথা, সে আর অরুনের সাথে ঘুমাতে পারবে না।
২
নয়ন ছেলেটা চঞ্চল। বয়সের তুলনায় শারীরিক গড়ন একটু বেশি। মা চলে যাওয়ার পর নয়নকে অরুনের খুব কাছের মনে হয়। কয়েকদিন একসাথে রাতে ঘুমানোর জন্য অরুন নয়নের প্রিয় পাত্র হয়ে গেছে। প্রতিদিন নিয়ম করে এসে অরুনের সাথে দেখা করা আর নতুন নতুন খেলার বাইনা নিয়ে আসা নয়নের জাতীয় কর্তব্য হয়ে দাড়িয়েছে। আজকে সকাল বেলা রুটিনমাফিক নয়ন এসে বলল, জানো অরুন ভাইয়া, তোমাদের পুকুর পাড়ের শিমুল গাছটাতে খুব বড় একটা মৌমাছির বাসা হয়েছে, যাবে দেখতে? কথাটি শুনে অরুন কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়। অনেক্ষন অরুনের কোনো সাড়া না পেয়ে নয়ন আবার বলল,
চল অরুন ভাইয়া, অনেক বড় হয়েছে, নিচ থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
অরুন বলল, না আমি যাব না, তুমি যাও।
বেশিদিন আগের কথা নয়। এইত সেদিন, যখন মা ছিল। উপরের ঘরে মা নয়নকে বাংলা অক্ষর চেনাচ্ছেন। এমন সময় অরুন চিৎকার করে বলে ওঠে, মা, দেখ মৌমাছি । মা এক গাল হেসে বললেন, এটা মৌমাছি নয় রে আমার পাগলটা, বোল্লা।
সেদিনের পর থেকে অরুন মৌমাছি এবং বোল্লার পার্থক্যটা ধরতে পারে। কিন্তু সেদিন ভুল মৌমাছির জন্য যে উচ্ছাস্টা ছিল, আজ নয়নের কাছ থেকে মৌমাছির সংবাদেও অরুনকে খুব একটা টানে না।
এর মধ্যে দাদি এসে বলল, কই রে আমার রাজপুত্রটা কি ঊঠে পড়েছে না কি!
দাদির এই আলগা সোহাগ অরুনের ভাল লাগে না। মা যখন ছিল তখন এমনটা তার মনে হয়নি। বরং তখন দাদিকে তার ভালই লাগত। কিন্তু মা যাওয়ার পর প্রথম যেদিন অরুন দাদির কাছে শোই সেদিনই অরুন বুঝতে পেরেছিল দাদির আদরের প্রকৃতি।
৩
রাতের পাওনা আদায় হয়েছে নিশ্চয়। তারপর নতুন দিনের হিসাবনিকাশ শুরু হয়।
দাদি আজ সকাল থেকেই ব্যস্ত। ব্যস্ততার সাথে এক চিমটি খুশির আমেজ দাদির প্রতি কদমে প্রকাশ পাচ্ছে।
বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার করা হচ্ছে। নয়নের মাকে এনে সকাল থেকেই দাদি বিভিন্য পদের রান্নার আয়োজন করছেন। হঠাত করে নয়নের ফুফু এসে হাজির হয়েছে। সব মিলিয়ে বাড়ির পরিবেশে আজ অন্যরকম ভাব।
সকালে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। সামনের জানালা দিয়ে অরুন তাকিয়ে থাকে। জানালা দিয়ে যতটুকু আকাশ দেখা যায় অরুন দেখে সেই আকাশে কিছু কাল মেঘের বিচ্ছিন্য উড়াউড়ি। বৃষ্টির সাথে মাখামাখি করে মেঘেদেরও আনন্দ আর ধরে না।
তোলপাড় করে নয়নের আগমন হয়। অরুন দেখে নয়নের চোখেমুখে এক ধরনের বিস্ময় ক্রিয়া করছে।
অরুন ভাইয়া, তাড়াতাড়ি এসো , তোমার নতুন মা এসেছে।
নতুন মা এবং পুরাতন মা এ ব্যপারে নয়নের মনে দ্বন্দ্ব নতুন নয়। দাদির মুখে সে আগেই শুনেছিল তার না কি নতুন মা আসছে। অরুন ভাবে, এটা যদি তার নতুন মা হয় তবে কি তার মা পুরাতন ছিল! না, নতুন মা পুরাতন মা বলে কিছু নেই। মা কখনো পুরাতন হয় না, মায়ের কোনো বিবর্তন হয় না। নয়নেরও মা ছিল। সে না পুরাতন, না নতুন।
৪
সকালের এক পশলা বৃষ্টিতে পৃথিবীর সবে স্নান হয়েছে। তারপর সুর্যের গর্জনে উষ্ণ হয়েছে ভেজা শরীর।
বড্ড বিরক্তিময় লাগছে আজকের দিনটা অরুনের কাছে। বাড়ি লোকে লোকারণ্য। সকলের মুখে একটা অস্পষ্ট প্রতিদ্ধনি আজ অরুনের নতুন মা এসেছে। দাদি কয়েকবার ডেকে গেছে, ফুফুও এসেছিল। উদ্দেশ্য? নতুন মায়ের সাথে দেখা করা।
বাবা এসে বললেন,
অরু, আয় তোর মা এসেছে। তোকে ডাকছে।
হায়! তিন মাসের মাত্র অঙ্গহানি । কী হয়েছিল? খুব বেশি দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল?
সুমন সিকদার, অরুনের বাবা। অনেকটা নিয়ম রক্ষার পণ করেই ঘরে নিয়ে এসেছিলেন ছায়াবীথি, অরুনের মাকে। ছায়াবীথি এবং সুমন এই দুটি নামের সাথে একাঙ্গিত হয়েছিল জ্যোৎস্নাকুল। অরুনের জন্মের পর জ্যোৎস্না যেন ভোর হতে চায়তো না। কিন্তু জ্যোৎস্নার সাথে রজনীর সম্পর্ক চিরস্থায়ী নয়। এক রাতে অজানা রোগে ছায়াবীথি পৃথিবীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে।
ছায়াবীথির মৃত্যুর কয়েকদিন পরই সুমন বাড়িছাড়া হয়। পাড়ার লোকেরা বলতে লাগলো, অরুনের মায়ের মৃত্যুশোক সহ্য করতে না পেরে মানুষটা ঘর-ছাড়া হয়েছে। মানুষের মনের অপ্রমাণিত ধারণার সঠিক প্রমাণ প্রায় তিন মাস পর অরুনের বাবা লাল শাড়ির মোড়োকে মুড়িয়ে নিয়ে আসলেন।
৫
অন্ধকার জাগ্রত। অরুন তার ঘরে জাগ্রত। মা যাওয়ার পর প্রায় পনের দিন হবে অরুনের সাথে অন্ধকারের নিবিষ্ট অন্তরঙ্গতা। অথচ অন্ধকারকে অরুন ভয় পেত। রাতে ঘুমানোর সময় বাতি নিভানো হলে অরুন ভয়ে মায়ের বুকের মধ্যে লেপ্টে থাকতো। এখন অন্ধকার অরুনকে ভয় দেখেনোর সাহস করে না। পূর্ণিমার রাতে ছাদে যেয়ে মা বলতো, দেখ অরু, কত সুন্দর চাঁদ! কত সুন্দর চিরিদিকে জ্যোৎস্না পড়েছে! এখন অরুন পুর্ণিমা আমাবস্যার হিসাব রাখার প্রয়োজনবোধ করে না।
অরুন ভাবে, এইতো সেদিনও অরুন সব সময় মায়ের আচলে পড়ে থাকতো। অথচ আজ অরুন দিব্যি একা থাকে।
একদিন মা বলেছিল, আচ্ছা অরু, আমাকে ছাড়া তুই যে একদণ্ড থাকতে পারিস না, আমি তোকে ছেড়ে চলে গেলে কী করে থাকবি?
মা যে তাকে রেখে চলে যেতে পারে এই কঠিন কথাটা অরুনের ছোট মস্তিষ্কে কখনোই আসতো না। অবুঝ হয়ে সে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। মা ব্যপারটা বুঝতে পেরে কপালে মুখে কয়েকটি চুমু একে বলতো, নারে যাব না, তোকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারি! মা চলে গেছে। অরুনকে একা রেখেই গেছে।
পুবের জানালাটা খোলা আছে। অন্ধকার ক্রমশ তার অস্তিত্ব ফিরে পাচ্ছে। সময় ক্লান্ত হয়ে অরুনের দুই চোখে নেমে পড়ছে। অরুন অপেক্ষা করছে আরও একটি নতুন দিনের।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
পৃথিবীতে টিকে থাকা মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ এর মত। চ্যালেঞ্জকে চ্যালেঞ্জ করেই মানুষ টিকে থাকে পৃথিবীতে।
০৩ জুন - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪