সৌমিনী ঘুরে এসেই ভাত চাইতে লাগলো। মা পাতিল থেকে দুমুঠো ভাত প্লেটে দিতেই রেগেমেগে সৌমিনী বলতে লাগলো তরকারি কই। হুদা ভাত আমি খামু না। প্রত্তিবার খালি হুদা ভাত আর ভাত।
লতা কোন কথা না বলে চৌকাঠে বসে দরজার সাথে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কোন কথা বলছে না। চিন্তায় চিন্তায় শুকিয়ে যাচ্ছে সে।
মা! ও মা! তরকারি দিয়া যাও। হুদা ভাত ক্যামনে খামু?
না! লতা কিছুই শুনছে না। চিন্তায় মশগুল। দূর আকাশের কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
মা! ও মা! কি অহেছে?
না, কিচ্ছু অয়নি। তুই যা, ভাত খা।
ভাত কি দিয়া খামু?
কি দিয়া খাবি মানে? আমার মাথা দিয়া খা।
সৌমিনী কাঁদো কাঁদো হয়ে ভাতে নুন মিশিয়ে খেতে লাগলো। আর বলতে লাগলো আমার আব্বায় থাকলে আমার লেইগা মাছ কিইন্না আনতো।
লতা কথাটি শুনেই বলতে লাগলো, তুইও তোর বাপের লগে মরতি। আমি বাঁইচা যাইতাম। যত দুঃকু আল্লায় আমারে দিচে।
বাসাবাড়িতে কাজ করে লতা। রিকশাচালক স্বামী গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে। ঢাকার বুকে ছোট্ট মেয়ে সৌমিনীকে নিয়েই তার সংসার। কিন্তু এখন বেঁচে থাকাটাই দুষ্কর।
বাংলাদ্যাশে নাকি করোনা ভাইরাস ঢুকেচে। প্রাণঘাতি ভাইরাস। একবার অইলে আর বাঁচন যাইবো না। এজন্যে বাড়ির মালিকেরা কাজে যেতে মানা করেচে। কিন্তু সংসারের যেই একডা অবস্থা বাসা ভাড়া দিতেই হিমসিম খেতে অইবো। তারপর দু'দুটো মুখ, দুটো পেট। কথাগুলো লতার মাথা মগজে ঢুকে কিলবিল কিলবিল করছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
সপ্তাহ খানেক পর।
মা! আমি আর থাকবার পারছি না। খুউপ ক্ষিধে লাগচে। খাওন না পাইলে আমি কিন্তু মইরা যামুনে। কাঁদতে কাঁদতে বলছে সৌমিনী।
লতা সৌমিনীকে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে চোখের পানি ফেলছে। মেয়ের কথার উত্তর তার জানা নেই। গত দুইতিন দিন আগে ভিড় ঠেলে যেটুকু আটা, চাউল পেয়েছিল সেটা শ্যাষ অইয়া গ্যাছে। এখন কি খাইবো? এদিকে বাড়িওয়ালাও বলে গেছে বাসা বাড়া দিতে। নইলে...।
কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে সৌমিনী। লতা পাশের রুম থেকে ১০০ টাকা চুরি করে গাঁইটে বেঁধে সৌমিনীকে নিয়ে পালিয়েছে।
ট্রাক ড্রাইভারের পা ধরে কান্নাকাটি করে কোনরকম পিছনে উঠে বসেছে। গ্রামে যাইবো। সৌমিনী জন্ম নেওয়ার পর এই প্রথম গ্রামে যাওয়া। কিন্তু লকডাউন হওয়ায় ড্রাইভার নিজেও নিতে চায়নি। সারা রাস্তায় পুলিশ থাকে। কিন্তু লতার কান্নাকাটিতে তাকে নিতেই হয়েছে।
বাস চলছে। বহু দূরের পথ। পথের দূর। রাত ডিঙিয়ে জোৎস্নার সাথে ভাব জমিয়ে ট্রাক চলছে। আর জাতাঁকলে পিষ্ট হওয়া পিচ ডালা রাস্তা বিদায় দিচ্ছে শহরের।
ভোর সূর্যের দেখা। খুব কাছাকাছি সে আলো। যে আলোয় পৃথিবীর দিন হয়। আর দিনের শুরু হয় ব্যস্ততা, মহামারী, টানাপোড়েন। আরও কতো কি?
আলোর ঝলকানিতে ঘুম ভেঙে যায় লতার। না, তখনও ঘুম ভাঙেনি সৌমিনীর। এখনও ঘুমিয়ে রয়েছে। বাসের হেলপার চড়া গলায় বারবার নামতে বলছে। তখন সৌমিনীর ঘুম ভেঙেছে। ঘুম থেকে উঠেই বলল, মা! আমার ক্ষিদে লেগেছে। আমাকে কিচু খেতে দাও।
বাসস্ট্যান্ডে কোন দোকান খোলেনি। লতা হেলপারকে বললো, ভাই! আমার মেয়েডার ভীষণ ক্ষুিধে লাগছে। যদি আমাকে দশডা টাকা ফেরত দিতেন...।
হেলপার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে পকেট থেইক্কা দশটা টাকা আর ট্রাকের বক্স খুলে একটা রুটি-কলা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, যেখানে যাবেন। তারাতাড়ি যান। পুলিশ কিন্তু আইয়া পড়বো।
সৌমিনীকে কোলে নিয়ে হাঁটছে। খুঁড়ে খুঁড়ে হাঁটছে । হাঁটতে হাঁটতে খুবই ক্লান্ত সে। শরীরটা টলমল করছে। খাওয়া দাওয়া নেই। পানির পিপাসা লেগেছে খুব।
রাস্তায় কোন গাড়িঘোড়া নেই। মানুষও নেই। শুধু মাঝে মধ্যে দুই একটি ট্রাক যাচ্ছে।
অবশেষে অনেকখানি রাস্তা হেঁটে গ্রামের রাস্তার গড়ান দিয়ে নামতেই পা পিঁচলায়ে ধানক্ষেতে পড়ে যায় লতা। না, হুঁশ নেই। নিশ্বাস মাঝেমধ্যে এসেই চলে যাচ্ছে। সৌমিনী পাশের ডিপকল থেকে চোইলে করে পানি এনে মুখে ছিটিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফেরে লতার।
ধানক্ষেতের আইলে বসে আছে দুইজন। সৌমিনী জিজ্ঞেস করলো, মা, এগুলো কি?
লতা উত্তর দিলো, এগুলো ধান।
ধান থেকে কি অয়?
ধান থেইক্কা ভাত অয়।
তয় এতো এতো ভাত থাকতো আমাগোর ভাতের অভাব ক্যা?
মানুষের রঙিন চশমার ভিড়ে বেঁচে আছে। জীবন থেকে জানটুকু ঠোঁটেঠোঁটে নড়বড়ে। এই আছে এই নেই। একদম নেতিয়ে যাওয়ার মতো। রঙিন চশমার মতো মানুষ দুঃখকষ্ট গুলোও এলোমেলো অগোছালো এলোপাতাড়ি। কেউ সুখদুখমাখা, রোগশোক, বিলাসবহুল বিলাসিতায়, কেউ হাসি-তামাশায়, আবার কেউ কেউ পেটের ক্ষুধার রোগে ভুগে কষ্ট নিবারন করছে। ঠিক যেন ক্ষুধাকে আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন হিসেবে খাওয়াদাওয়া। যে খাওয়াদাওয়ায় দেহ আত্মা কলিজা, কারোরই তৃষ্ণা মেটে না।