এক অখ্যাত চাষি অধ্যুষিত গ্রাম মহেনগড়।এই গ্রামে থাকে পিতৃমাতৃহীন কানাই। কানাই এর বয়স বারো কিংবা তেরো। বাপ-মা না থাকায় ও ছোট থেকেই এর ওর বাড়ীর এঁটোকাঁটা খেয়ে বড় হয়েছে।একটু বড় হতেই ও কখন যেন সকলের বিনে পয়সার চাকর হয়ে গেছে।
হয়ত কখনো কানাই কারো জমির শক্ত মাটি ভাংছে এমন সময় পাশের জমির জগাই মাহাতো কানাইকে বলল -"আমার খেতের আগাছা কটা এট্টু তুলে দেতো।আমি ততখন এট্টু খেয়ে আসি বাড়ি দে।' কিংবা এলাকার কামার ভোলা হঠাৎই এসে বলল, -"হ্যাঁরে কানাই, এই পঞ্চাশটা টাকা ধর। আমার মা মরার আগে ইলিশ মাছ খেতে চেয়েছে। গঞ্জের হাট থেকে আজ রাতের মধ্যে একটা বেশ নধর দেখে ইলিশ নে আয় যা।আর হ্যাঁ,এক পয়সাও নিজে না গেলা হয়। যা ফিরবে সব নে আসবি।নয়তো চাবকে লাল করে দেবো।" কিন্তু তিনি এটুকু ভাবলেননা যে এই ছোট্ট বাচ্চাটাকে দিয়ে এভাবে কাজ করানোর তাঁর কোন অধিকার নেই।কিংবা তার হাতখরচ টা অন্তত দেওয়া উচিত।
যদিও কানাই এসমস্ত কিছুই মুখ বুজে মেনে নেয় আর ভাবে এ গ্রামের খেয়েই সে বড় হয়েছে। তাই গ্রামের লোকের কথা মানা তার কর্তব্য। কানাই এর কোন থাকার জায়গা না থাকায় মন্দিরের দাওয়ায় শুয়ে থাকে।কানাই এর মনে ভয়ডর বলতে কিছু নেই। সেদিন রাতে কানাই মন্দিরের দাওয়ায় শুয়েছিল আকাশের দিকে চেয়ে।জ্যোৎস্না মাখা তারা জ্বলা আকাশ।সেদিকে চেয়ে কানাই এর মনে পড়ল সকালবেলার কথা;-
হারু দাসের জমিতে অনেকের সংগে পাকা ধান কাটছিল কানাই।হারু দাস বলেছিল ধান কাটায় সাহায্য করলে দুপুরে তাকে খেতে দেবে।এই ভাবেই কানাই এর দিন চলে।তাই সে কাজ করছিল ;কিন্তু হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায় সে।জ্ঞান ফিরতে হারু দাস কানাই কে কাজ থেকে তাড়িয়ে তো দেয় সংগে এ'ও বলে "কোথেথকে সব এসে জোটে, শুধু শুধু সময় নষ্ট করলে। শুভ কাজে এইসব বাপমাখেকো অনামুকো কে নিতে আছে?না জানি এবার কোন বিপদ না আসে।"
মানুষের নানা কথা শুনে শুনেই কানাই বড় হয়েছে।কিন্তু হারু দাসের ওই "বাপমাখেকো ছেলে" কথাটা তার এত মনে লেগেছিল যে,জ্যোৎস্না মাখা আকাশের দিকে চেয়ে তার চোখ থেকে ঝরঝর করে জল গড়াতে লাগলো। আজ তার মায়ের জন্য বড় অভাব বোধ হচ্ছিলো।মাকে কানাই কখনো দেখেনি। কিন্তু স্বপ্নে বহুবার মাকে দেখে মায়ের একটা হাল্কা অবয়ব তার মনে গেঁথে গেছিলো। মনে মনে সেই অবয়বকে ঘিরে সে তার যাবতীয় দুঃখ -অভিযোগ জানাচ্ছিল। মন্দিরের অন্যদিকেই হারু দাসের বাড়ী। হঠাৎই সেদিক থেকে একটা খসখস শব্দ ভেসে এল।আর এই শব্দটার ফলেই কানাই এর জীবনে নেমে এল ঘোর বিপর্যয়!! কানাই শব্দ লক্ষ্য করে চেয়ে দেখলো একটা লোক হারু দাসের বাড়ির উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় নামছে পা টিপে টিপে। লোকটার কাঁধে একটা বস্তা। কেমন যেন সন্দেহ হল কানাইয়ের। ও মন্দিরের দাওয়া থেকে নেমে লোকটার দিকে যাবে কী,সে কানাইকে দেখে দৌড় দিতে গেল।কানাই নিশ্চিত বুঝতে পারলো লোকটা হারু দাসের বাড়ী থেকে কিছু চুুুরি করে পালাচছে।কানাই আর দেরি না করে মুহূর্তের মধ্যে একটা ছোট ইঁট লোকটার পা লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলো আর লোকটাও একটা চীৎকার করে পড়ে গেল মাটিতে। তার কাঁধ থেকে বস্তাটা পড়ে গেলো মাটিতে।কানাই ছুটে গেলো তার দিকে। কিন্তু তার আগেই লোকটা বস্তাটা না নিয়েই দৌড় দিলো। এমন সময় চীৎকার শুনে হারু দাস লণ্ঠন হাতে বাইরে বেরিয়ে কানাইকে ওই বস্তার সংগে দেখে ভাবে যে কানাই চুরি করে পালাচ্ছে। আর এই ভেবে সে সংগে সংগে চেঁচিয়ে লোক জড়ো করে।তারপরে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল "সকালে দুটো কথা বলিচি বলে একবারে আজকেই রাতে চুরি করতে এয়ছিল কানাই আমার বাড়িতে।এর কী সাজা হবে গ্রামের লোকেরাই বলুন।" হ্যাঁ,গ্রামের লোকেরা বললো'ও এক 'খুব সরল' সাজার কথা।কোন যুক্তিতর্ক ছাড়াই কানাইকে গ্রামের লোকেরা বলল"আরে যে হাঁড়িতে খাস, সে হাঁড়িই ভাঙলি। আমাদের সকলের খেয়ে বড় হলি আর আমাদেরই বাড়ীতে চুরি করলি।আজ হারুর ঘরে চুরি হয়েছে, কাল আমাদের ঘরে হবে।তার থেকে ওকে কাল সকালেই এখান থেকে বিদেয় করতে হবে!" তারপর দিন সকালে কানাইকে গ্রামছাড়া করল গ্রামবাসীরা।কানাই হাঁটতে হাঁটতে গ্রাম শেষে বয়ে চলা আধুলি নদীর বাঁধের ওপর গিয়ে বসল।কাল থেকে তার কিছু খাওয়া নেই।তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিল বিনা দোষে।কিন্তু তাতে তার কোন দুঃখ নেই।তার দুঃখ শুধু এটাই, গ্রামের লোক তাকে ভুল বুঝল বলে।একটা চাপা দীর্ঘ নিঃশ্বাাস ভীতর থেকে!
হঠাৎই আকাশ ছেয়ে গেল কালো মেঘে।শনশন করে বইতে লাগলো বাতাস।আধুলি নদীর জল সেই হাওয়ার তোড়ে উথালপাতাল হতে লাগল। কানাইএর মনে হল এটা বুঝি তার মনের প্রতিচ্ছবি। আস্তে আস্তে ঝড়ের বেগ আরও বাড়তে লাগলো। সেই সংগে বিদ্যুৎ-এর ঝলক। মনে হল হঠাৎ এক ঝটকায় জগৎসংসার যেন কানাই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছে। আস্তে আস্তে দু'একফোটা করে বৃষ্টি শুরু হল। কানাই এদিকওদিক চেয়ে দেখলো মাথা ঢাকার আশ্রয়ের খোঁজে। কিন্তু একটা বড় বটগাছ ছাড়া চোখে কিছু পড়লনা।গ্রামেও আর ফিরতে পারবেনা কানাই। বাধ্য হয়ে ওই বটগাছের নীচেই আশ্রয় নিল সে।আর প্রায় সংগে সংগে কানাই এর চোখের মতোই আকাশ থেকে নামল অঝোর ধারায় বৃষ্টি। সেদিন সারাদিন বৃষ্টিতে ধুয়ে গেলো বিশ্বপ্রকৃতি। নদীর জলও বেড়ে গেলো অনেক। বৃষ্টিতে ভিজে প্রচণ্ড জ্বর এলো কানাইয়ের।সে বটগাছের কোলে যেন মিশে যেতে চাইছিল বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। তার পরদিনও একী অবস্থা;বৃষ্টির কোন বিরাম নেই,ঝমঝমিয়ে পড়েই চলেছে। আর সেই সংগে দু-তিন দিনের নাখাওয়া কানাইয়ের জ্বর উত্তরোত্তর বেড়েই চলল।আস্তে আস্তে প্রচণ্ড জ্বরে সে অজ্ঞান হয়ে গেলো। অজ্ঞান অবস্থাতে সে বোধহয় ঘুমের ঘোরে দেখল তার মা তাকে যেন ডাকছে।তবে এবার অবয়ব নয়,কানাই পরিষ্কার দেখল এক ময়লা লালপাড় সাদা শাড়ী পরা শ্যামলা গাঁয়ের বধূ তার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। এক প্রচণ্ড বিদ্যুৎ চমকে কানাই এর জ্ঞান ফিরল।জ্ঞান ফিরতে সে দেখল চতূর্দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঝিঁঝিঁ ডাকছে তারস্বরে।বৃষ্টির বেগটা একটু কমেছে, চতূর্দিকে ভেজা মাটির গন্ধ। কিন্তু ওটা ছলাৎছলাৎ করে কীসের শব্দ হচ্ছে??তাহলে কী....... কানাই এর অনুমানই সত্যি হল;জলের চাপে আধুলি নদীর বাঁধের এক জায়গায় ছোট্ট ছিদ্র থেকে হুড়হুড় করে জল বেরিয়ে আসছে বাইরে!এই ছিদ্র বড় হয়ে যদি বাঁধ ভেঙে জল বেরিয়ে আসে তাহলে মহেনপুর তো বটেই,আশেপাশের আরও কয়েকটা গ্রাম সম্পূর্ণ ডুবে যাবে!!!কানাই ভাবলো সে তার প্রানের বিনিময়েও গ্রামের সকলকে বাঁচাবে। এতদিন যাদের কাছে খেয়েপরে বড় হয়েছে সে তাদের প্রতিদান দেবে। দুর্বল দেহে অতিকষ্টে কানাই উঠে দাঁড়ালো। তারপরে বাঁধে সৃষ্টি হওয়া ছোট্ট ছিদ্রটিতে নিজের বৃষ্টিসিক্ত জামাটা খুলে ঢুকিয়ে দিলো।তারপরে বাঁধের ধারে পড়ে থাকা বড় ছোট পাথর কিছুটা গড়িয়ে, কিছুটা চাগিয়ে এনে ডাঁই করতে লাগল ছিদ্রের সামনে ।সারারাত ধরে পাথর জমা করে যখন ছিদ্রের মুখটা ও তারপাশে কিছুটা জায়গা যখন সম্পুর্ণ বন্ধ হয়ে গেল,তখন ভোর হয়ে গেছে। বাঁধ থেকে জল বেরোনো বন্ধ হয়ে গেছে বহু আগে।বৃষ্টিটাও গেছে থেমে। আর যদি কিছুক্ষণ বৃষ্টি হত, তাহলে সে আর শেষরক্ষা করতে পারতনা।কিন্তু শেষমেশ তার কষ্ট সার্থক হয়েছে।।
চতূর্দিকে ঘন কুয়াশা চাদর মেলেছে। ঠাণ্ডা হাওয়া তার রোগক্লিষ্ট শীর্ণ শরিরটাকে কুঁকড়ে দিচ্ছে। তবুও কানাই আনন্দে মুক্তির নিঃশ্বাস নিল।তার সারা দেহে থরথরিয়ে কাঁপছে।, কিন্তু সে আনন্দে উৎফুল্ল। সে আজ বহু মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। যা ওই হারু দাসের মতো লোকেরা কখনো করেনি বা পারবেওনা।
কাজ শেষে কানাই বাঁধের উপর উঠে দেখতে লাগল আর কোন জায়গায় ছিদ্র আছে কিনা।কিন্তু অদৃষ্টের লিখন খন্ডায় কে!!বৃষ্টিতে পিছল হয়ে থাকা বাঁধের উপর থেকে দূর্বল দেহের কানাই পা পিছলে পড়ে গেলো সদ্যযৌবনা আধুলি নদীর অতল জলে।আর সংগে সংগে তার ছোট্ট দেহটা হারিয়ে গেলো নদীর বহু গভীরে!!!
পরদিন সকালে মহেনপুর ও আশেপাশের কয়েকটা গ্রামের লোক আধুলি নদীর বাঁধের হালহকিকৎ জানতে নদীর ধারে এল।সংগে হারু দাস ও আছে। সকলের একটা জিনিশ চোখে পড়ল;বাঁধ ঠিকই আছে কিন্তু নদীর টইটম্বুর কালো জলে ভাসছে এক বারোতেরো বছরের ছেলের দেহ! তার মুখটা বোধহয় খিদে-তেষ্টায় আর নানা কষ্টে কালো হয়ে গেছে। গ্রামের লোকেরা জানেওনা ওই ছোট্ট দেহটাই তাদের সকলের প্রান বাঁচিয়েছে। কিছুপরে তাকে অনেকে চিনতে পারলেও "লাওয়ারিশ" ওই দেহটাকে কেউ নদী থেকে তুলতেও রাজি হলনা।ঘৃণায় কেউ মুখ মোচড়াল,কেউ বা থুথু ফেলে চলে গেল।হারু দাস আস্তে আস্তে বলে উঠল,"ছোঁড়ার উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে।"বলার প্রায় সংগে সংগেই আবারো আকাশে দেখা দিলো মেঘের ঘনঘটা। সংগে অঝোর ধারায় বৃষ্টি;আধুলি নদীর জলটা হঠাৎই ফুঁসে উঠল বাঘের মতো!!!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এই গল্পটি এক চোদ্দ-পনেরো বছরের অনাথ ছেলের করুণ জীবনের মর্মন্তুদ কাহিনী।।
"মানুষের নানা কথা শুনে শুনেই কানাই বড় হয়েছে।কিন্তু হারু দাসের ওই "বাপমাখেকো ছেলে" কথাটা তার এত মনে লেগেছিল যে,জ্যোৎস্না মাখা আকাশের দিকে চেয়ে তার চোখ থেকে ঝরঝর করে জল গড়াতে লাগলো। আজ তার মায়ের জন্য বড় অভাব বোধ হচ্ছিলো।মাকে কানাই কখনো দেখেনি। কিন্তু স্বপ্নে বহুবার মাকে দেখে মায়ের একটা হাল্কা অবয়ব তার মনে গেঁথে গেছিলো। মনে মনে সেই অবয়বকে ঘিরে সে তার যাবতীয় দুঃখ -অভিযোগ জানাচ্ছিল।
মন্দিরের অন্যদিকেই হারু দাসের বাড়ী। হঠাৎই
সেদিক থেকে একটা খসখস শব্দ ভেসে এল।আর এই শব্দটার ফলেই কানাই এর জীবনে নেমে এল ঘোর বিপর্যয়!!
কানাই শব্দ লক্ষ্য করে চেয়ে দেখলো......
১০ মে - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।